১৮০১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। মধ্য এশিয়ার স্তেপ চিরে আফগানিস্তান এবং বর্তমান পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে ভারতে ঢোকার উদ্দেশ্য নিয়ে আতামান মাতভে প্লাতোভের নেতৃত্বে ২২ হাজারেরও বেশি কসাক যোদ্ধা যাত্রা শুরু করে।
কিন্তু হঠাৎ করেই তাদের থেমে যেতে হয় তৎকালীন রুশ সম্রাট পল আততায়ীর হাতে খুন হলে। তার ছেলে প্রথম আলেকজান্ডার সিংহাসনে বসার সাথে সাথেই কসাক দলকে ডেকে পাঠান। অনেকের কাছে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ হিসেবে পরিচিত পলের ভারত জয় স্বপ্নই থেকে যায়।
তবে অনেকেই জানেন না, এই অভিযানের পেছনে ছিলেন ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
ইংরেজ মোহের অবসান
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে সমস্ত ইউরোপীয় রাজাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল বিপ্লবে আক্রান্ত ফ্রান্সকে ধ্বংস করা, যাতে বিপ্লবের সংক্রামক ধারণা তাদের রাজ্যগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এদের মধ্যে ছিল রাশিয়ান সাম্রাজ্যও। সেকেন্ড কোয়ালিশনের যুদ্ধে একদিকে স্থলে আলেকজান্ডার সুভোরভ ইতালি আর সুইজারল্যান্ডে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে তার বিজয় অব্যাহত রেখেছিলেন, অন্যদিকে ফিওদর উশাকভের নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগরে ফরাসিদেরকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে সম্রাট প্রথম পলের মাথায় গেঁড়ে বসলো যে, ফরাসিদের সাথে সংঘর্ষ রাশিয়ার জন্য মোটেই লাভজনক কিছু নয়। জারের সৈন্যদের রক্তে যুদ্ধক্ষেত্র যখন রঞ্জিত হচ্ছে, তখন ব্রিটিশ এবং অস্ট্রিয়ানরা বড় কোনো অবদান না রেখেই রাশিয়ার কষ্টার্জিত বিজয়ের সুফল ভোগ করছিল।
পল এ ব্যাপারে নিশ্চিত হলেন, যখন ১৮০০ সালে ব্রিটেন মাল্টা দখল করে নিল। দ্বীপ থেকে ফরাসি সৈন্যদেরকে উচ্ছেদ করার পর ব্রিটিশরা একে নাইটস অফ মাল্টার কাছে ফিরিয়ে না দিয়ে নিজেদের উপনিবেশ এবং নৌ ঘাঁটি বানানোর কাজ শুরু করে। নাইটস অফ মাল্টার গ্র্যান্ডমাস্টার পল এতে দারুণ চটে যান, নিয়ে নেন ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে। সিদ্ধান্ত নেন পক্ষ বদলাবার।
নেপোলিয়নের সাথে বন্ধুত্ব
মাল্টা দখলের পরই পল ব্রিটিশদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে প্রাক্তন প্রতিপক্ষ ফ্রান্সের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেন, ফরাসিরাও একগাদা শত্রুর ভেতরে নতুন বন্ধুত্বের আহ্বানে সাড়া দিতে দেরি করেনি ।
ফরাসি প্রজাতন্ত্রের প্রথম কনসাল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ছয় হাজার রাশিয়ান বন্দী সৈন্যদের মুক্তি দেন। সাথে ব্যানার এবং অস্ত্র ফেরত দিয়ে পুরোদস্তুর এক মহড়ার করিয়ে রাশিয়ায় ফেরত পাঠান। নেপোলিয়নের এই আচরণে দারুণভাবে আপ্লুত হন পল। তার পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি ভবিষ্যত ফরাসি সম্রাট অষ্টাদশ লুইকে রাশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেন, যাকে ফরাসি বিপ্লবের পরে রাশিয়াতেই আশ্রয় দেওয়া হয়।
ফ্রান্স এবং রাশিয়া একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, যাদেরকে নিয়ে দু’পক্ষই একমত হয় যে, তারাই (ইংরেজরাই) ইউরোপের ঝামেলা এবং অশান্তির মূলে। “আপনাদেরকে সাথে নিয়ে আমরা পুরো পৃথিবীকে বদলে দেবো,” বলে প্যারিসের রুশ রাষ্ট্রদূতকে জানান নেপোলিয়ন।
তবে ব্রিটেনে সরাসরি আক্রমণের শক্তি তখনও দুই পক্ষের হয়নি, বিশেষ করে নৌপথে। ‘মিস্ট্রেস অব দ্য সি’জ’ বা সমুদ্রের মনিব হিসেবে পরিচিত ইংরেজ নৌবহরের সামনে রুশ-ফরাসি বাহিনি একত্রে দাঁড়ালেও তাদের সাথে পেরে উঠবে না। ফলে নেপোলিয়ন এগোলেন এক বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে। ব্রিটেনের রাজমুকুটের সবচেয়ে উজ্জ্বল হীরা, তাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভারত দখল করে নেওয়া। মিশর জয়ের পর থেকেই নেপোলিয়নের স্বপ্ন ছিল ভারতকেও একদিন করায়ত্ত করবেন।
আক্রমণের পরিকল্পনা
পরিকল্পনা অনুযায়ী, একদল লাইট আর্টিলারিসহ ৩৫ হাজার সৈন্যের একটি ফরাসি দল রুশ শহর আস্ট্রাখানের দিকে যাত্রা করবে, যেখানে তারা ৩৫ তম রাশিয়ান আর্মির (১৫ হাজার পদাতিক, ১০ হাজার অশ্বারোহী এবং ১০ হাজার কসাক) সাথে যোগ দেবে।
এরপর একত্রিত রুশ-ফরাসি বাহিনী আস্ট্রখান থেকে ক্যাস্পিয়ান সাগর পেরিয়ে পারস্যের আস্ট্রাবাদে (বর্তমান ইরানের গরগান) নিয়ে যাওয়া হবে। অভিযানের প্রথম পর্যায়ে, ফরাসি সীমান্ত থেকে পারস্য পর্যন্ত সময় লাগবে ৮০ দিন।
অভিযানের দ্বিতীয় পর্বের সময়কাল ৫০ দিন, যেখানে যৌথ বাহিনী আস্ট্রাবাদ থেকে আফগানিস্তানের হেরাত, ফারাহ এবং কান্দাহারের মধ্যে দিয়ে আধুনিক পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করবে, ভারতের আরও ভেতরে ঢোকার আগে।
৭০ হাজার সৈন্যের এই বিশাল রুশ-ফরাসি বাহিনীর পাশাপাশি রাশিয়ান ফার ইস্টার্ন ফ্লোটিলা (নৌবহর) এবং মূল দল যাওয়ার আগে ভারতের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য একটি আলাদা কসাক দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে কেবল এই কসাক দলটিই ভারতের উদ্দেশ্যে যায়। প্রথম পলের ব্যক্তিগত অনুরোধে পুরো অভিযানের নেতৃত্বে ফরাসি জেনারেল (১৮০৪ থেকে মার্শাল) আন্দ্রে মাসেনাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পূর্বদিকে যাত্রা
আতামান মাতভে প্লাতোভের কসাক সৈন্যদের যাত্রা ছিল যৌথ অভিযানের প্রথম ধাপ। এটি বহুদিন আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল, তবে অন্য উদ্দেশ্যে।
১৮০১ সালের ফেব্রুয়ারির শেষদিকে কসাক দল দন থেকে ওরেনবুর্গের দিকে যাত্রা শুরু করে, যেখান থেকে তাদের পরিকল্পনা ছিল কাজাখ স্টেপস, খিভা খানাতে এবং বুখারার (বর্তমান তুর্কমেনিস্তান এবং উজবেকিস্তান) যাওয়া এবং শেষে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে বর্তমান পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রবেশ করা।
তবে সমস্যা ছিল, এই পথ কসাক সৈন্যদের পরিচিত পথ থেকে বহুদূরে ছিল। যাওয়ার পথে কাজাখ স্টেপের যাযাবরদের সাথে বন্ধুত্ব করে যায় তারা। খিভা এবং বুখারার শাসকরা কসাকদেরকে সেভাবে আমন্ত্রণ জানাবে না ভেবেই রাশিয়া তাশখেন্ত স্টেটের সাথে মিত্রতা করে, যারা আফগানিস্তানে যাওয়ার পথে কসাকদেরকে গাইড এবং অন্যান্য জিনিস সরবরাহ করে সাহায্য করবে।
ভারতীয় দৃশ্যপট
রাশিয়ার ভারত অভিযানের সময় ভারতে ইংরেজদের অবস্থা অসাধারণ কিছু ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতের মুঠোয় তখনও পুরো ভারতবর্ষ চলে আসেনি। পূর্ব এবং দক্ষিণের কিছু অংশ ছাড়া ভারতের বাকি অংশ স্থানীয় শাসকদের হাতেই ছিল তখন।
দাবার গুটি ভালোভাবে চাললে, কসাক দল প্রথমে শিখদের নিয়ন্ত্রিত পাঞ্জাবে পৌঁছাবে। তারপর মোলাকাত হতে হবে মারাঠাদের সাথে, যারা বহু বছর ধরে ইংরেজদেরকে ঠেকিয়ে রেখেছে। আশা করা যায়, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না হলেও নতুন খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরবে না। রুশ-ফরাসি-ইংরেজদের এই খেলায় তারা নিরপেক্ষ অবস্থানই ধরে রাখবে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে থাকা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্রিটিশ সৈন্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। ২২ হাজার সৈন্যের কস্যাক দলের চেয়ে সামান্য বেশি ইংরেজ সৈন্য তখন অবস্থান করছিল ভারতে, সাথে ছিল স্থানীয় সৈন্যদের আধা-সামরিক বাহিনী।
কিন্তু কসাক এবং প্লাতোভ-মাসেনার সম্মিলিত ৭০ হাজার সৈন্যের বিশাল দল যদি একসাথে ভারতে আক্রমণ করে, তবে ইংরেজদের তাদের সামনে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভবই ছিল। তাছাড়া পল এবং নেপোলিয়নের ইচ্ছা ছিল ব্রিটিশ নিপীড়ন থেকে স্থানীয়দের মুক্তি দিয়ে তাদেরকে নিজেদের দলে ভেড়ানো।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর ফরাসিরা ভারতীয় উপমহাদেশের দক্ষিণ অংশের দখল নেবে, আর রুশরা নেবে উত্তর অংশের ভাগ। এই ছিল মূল পরিকল্পনা।
ইংরেজ ষড়যন্ত্র এবং অভিযানের সমাপ্তি
পরিকল্পনা হলেও ইংরেজদের সৌভাগ্যক্রমে সেই অভিযান আর ঘটেনি। ১৮০১ সালের মার্চের ২৩ তারিখ রুশ রাজপরিষদের ষড়যন্ত্রে প্রথম পল নিহত হন, যেখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে ব্রিটেন। নতুন সম্রাট প্রথম আলেকজান্ডার সিংহাসনে বসার সাথে সাথেই প্রথম যে আদেশগুলো দেন, তার একটি ছিল প্লাতোভের কসাক দলকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ।
নেপোলিয়ন তার রাশিয়ান মিত্রের মৃত্যুতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া জানান, “তারা নিভোসের তৃতীয় দিনে ব্যর্থ হলেও [ফরাসি রিপাবলিকান ক্যালেন্ডারের চতুর্থ মাসের তৃতীয় দিনে (১৮০০ সালের ২৪ ডিসেম্বর) নেপোলিয়নের ওপর হত্যাচেষ্টা চালায় ব্রিটিশরা], সেন্ট পিটার্সবার্গে সফল হয়েছে।”
কয়েক বছরের মধ্যেই রাশিয়া আবার ফরাসি বিরোধী জোটে যোগ দেয়। প্যারিস দখলের আগপর্যন্ত বেশ কয়েকবার তিক্ত পরাজয়ের সম্মুখীন হয় তারা। তবে শেষমেশ পতন হয় ফরাসিদের, শেষ হয় নেপোলিয়নের জয়যাত্রা।
এদিকে ব্রিটিশরা পরের দশকগুলোতে মারাঠা এবং শিখদেরকে গুঁড়িয়ে দিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতেই পুরো ভারতবর্ষ কব্জা করে ফেলে। রুশ-ফরাসিদের ভারতজয়ের স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়।