ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ-এর কথা বর্তমানে মোটামুটি সবাই জানে। সন্তান জন্মদানের এই পদ্ধতিটি প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অনেক নিঃসন্তান দম্পতির মুখে হাসি ফোটাচ্ছে। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাজ্যে যে প্রক্রিয়া প্রথমবার সফলভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটি ধীরে ধীরে এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, বর্তমানে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর আইভিএফ-এর মাধ্যমে প্রায় ৪ মিলিয়ন শিশু জন্ম নিচ্ছে।
২০১৮ সালে পাওয়া এক সমীক্ষা অনুসারে, পুরো পৃথিবীতে তখন পর্যন্ত টেস্টটিউব বেবি হিসেবে জন্ম নিয়েছিল প্রায় ৮ মিলিয়ন শিশু। সংখ্যাটা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। এর যেমন আছে প্রশংসা, তেমনি আছে অনেক সমালোচনাও। কিন্তু আজ এসব আলোচনা বা সমালোচনা নিয়ে নয়, কথা বলবো আইভিএফ বা ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনের পেছনে থাকা নারী মিরিয়াম মেনকিনের কথা।
গবেষণাগারে দিনের পর দিন গবেষণা করতে করতে হুট করে কিছু একটা ম্যাজিকের মতো আবিষ্কার হয়ে গেল। সামান্যের মধ্য থেকেই অসামান্য কিছু খুঁজে পেলেন কোন এক বিজ্ঞানী। এমনটাই তো সবসময় শুনেছেন। বৈজ্ঞানিক অনেক আবিষ্কার বাস্তব হয়েছেও এভাবে। তবে মিরিয়াম আর তার আবিষ্কারের গল্পটা একটু আলাদা। ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। হার্ভার্ডের ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ জন রকের টেকনিশিয়ান হিসেবে তখন কাজ করছিলেন এই নারী। সেসময় চিকিৎসকের কাছে আসা অনেক নারীই সন্তান ধারণ করতে অক্ষম ছিলেন।
এদের মধ্যে যে এক-পঞ্চমাংশ নারীর জরায়ু সন্তান জন্মদানের উপযোগী, শুধু ফেলপিয়ান টিউবের সমস্যার কারণে সন্তান ধারণ করতে পারছেন না তারা, তাদেরকে সাহায্য করতে চাচ্ছিলেন জন রক। তাই সহকারীকে কাজ দিয়েছিলেন শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর ভেতরে শরীরের বাইরেও কোনোরকম সংযোগ ঘটানো যায় কিনা, তা দেখার। অনেকদিন চলে গেলেও এই চেষ্টায় কোনো কাজই হচ্ছিলো না। ৪৩ বছর বয়স্ক মিরিয়াম সারারাত নিজের আটমাস বয়সী মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে সেদিন খুব ক্লান্ত ছিলেন। তাই গবেষণাগারে শুক্রাণুর ভেতরে যখন ডিম্বাণু ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি, তখন সময়ের হিসেব ছিল না তার।
সাধারণত, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুকে একত্র করার পর আধঘণ্টা অপেক্ষা করার নির্দেশ ছিলো। কিন্তু কতক্ষণ আর মাইক্রোস্কোপে চোখ রাখা যায়! ক্লান্ত মিরিয়াম কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তা তিনি নিজেও জানতেন না। ঘুম ভাঙতেই তার চোখ গেল ঘড়ির দিকে। ইশ! অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি মাইক্রস্কোপে আবার চোখ লাগান মিরিয়াম। আর তার পরই এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখতে পান তিনি। তার এবং জন রকের এতদিনের চেষ্টা অবশেষে সফল হয়েছে!
অনেক বছর পর নিজের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে মিরিয়াম মেনকিন বলেন-
“আমি এত বেশি বিধ্বস্ত আর ক্লান্ত ছিলাম যে, মাইক্রোস্কোপ দিয়ে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু দেখতে দেখতে আমি ঘণ্টাখানিক ভুলেই গিয়েছিলাম ঘড়ির দিকে তাকাতে… অন্যভাবে বলতে গেলে, আমাকে মানতেই হবে যে, ছয় বছর ব্যর্থ হওয়ার পর যে সফলতা ধরা দিয়েছিল, সেটা কোন মেধার কারণে নয়- কাজের সময় একটু ঘুমিয়ে পড়ার কারণে।”
দিনটি ছিল মঙ্গলবার। শুক্রবারে জারের দিকে আবার তাকালেন মিরিয়াম। সেখানে তখন কোষ তৈরি হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। টিউবের ভেতরে পৃথিবীর প্রথম মানব ভ্রূণ মানবদেহের বাইরে তৈরি হওয়ার কাজটি দেখেন মিরিয়াম। অবশ্য তখনো ভবিষ্যতে এই প্রক্রিয়া এত বেশি জনপ্রিয় হবে, তা হয়তো বুঝতে পারেননি এই নারী।
১৯৭৮ সালে বিশ্ব প্রথম ইন ভিট্রো শিশু লুই ব্রাউনকে দেখে। খুব দ্রুতই এই আইভিএফ প্রক্রিয়াটা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ২০১৭ সালে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ২,৮৪,৩৮৫ বার আইভিএফ-এর চেষ্টা করা হয়। এতে করে ব্রাউনের মতো আরো মোট ৭৮,০৫২ জন শিশু জন্ম নেয়।
তবে মিরিয়াম যত সহজভাবে ঘটনাটি বলেন, ব্যাপারটি এতটাও সহজ ছিলো না। বছরের পর বছর কঠোর অধ্যবসায় এবং গবেষণার পর এই সাফল্য অর্জন করেন তিনি। আর সবচাইতে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, জন রকের সাথে এই সাফল্যের অংশীদার মিরিয়াম হলেও, তার নামটা সবার চোখের আড়ালেই রয়ে গিয়েছে। ইতিহাস মেনকিনের এই অবদানকে স্বীকার করে নেয়নি। নানা নামে তাকে ডাকা হয়েছে সবখানে। টেকনিশিয়ান, সহকারী, জীববিজ্ঞানী এমন আরো অনেক কিছু। তবে জন রকের সহকারী নয়, এই গবেষণায় এর চাইতেও অনেক বেশি কিছু ছিলেন মিরিয়াম।
নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনবার্গ স্কুল অভ মেডিসিনের গাইনী এবং রিপ্রোডাক্টিভ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক তেরেসা উডরাফের মতে, জন রকের পাশে থেকে কাজ করেছেন মিরিয়াম মেনকিন। তাই এই গবেষণার সাফল্য তারও। তিনি শুধু মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে সাহায্য করেননি। বরং, তিনি না থাকলে হয়তো আইভিএফ বাস্তব হতে আরো সময় লাগত, কিংবা হয়তো কখনো এমনটা সম্ভবই হতো না।
ইতিহাসবেত্তা মার্গারেট ম্যাশ উডরাফের সাথে একমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, রক মূলত একজন চিকিৎসক ছিলেন। আর মিরিয়াম ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। মেনকিনের সম্পর্কে মার্শ ২০০৮ সালে রকের জীবনী লেখার সময় জানতে পারেন। সেবার ওয়ান্ডা রোনারের সাথে যৌথভাবে লেখা এই বইয়ে মেনকিনকে গবেষণার সহকারী হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। এজন্য অবশ্য মার্শ এখনো দুঃখ অনুভব করেন। পরবর্তী সময়ে কখনো সুযোগ পেলে এই নারীকে বিজ্ঞানী হিসেবেই উল্লেখ করতে চান তিনি।
কে এই মিরিয়াম মেনকিন?
১৯০০ সাল। মায়ের গর্ভে বড় হতে থাকে একটি প্রাণ। ১৯০১ সালের ৮ আগস্ট, লাটভিয়ার রিগাতে জন্ম নেন মিরিয়াম ফ্রাইডম্যান। খুব ছোট্টবেলাতেই মিরিয়ামকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে আসেন বাবা-মা। সেখানে বাবা চিকিৎসক হিসেবে বেশ নাম এবং অর্থ কামান। বাবা বলতেন, কীভাবে কিছুদিন পরেই ডায়াবেটিসকে পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যাবে। মুগ্ধ হয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এই গল্পগুলো শুনতেন ছোট্ট মিরিয়াম। ১৯২২ সালে কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে হিস্টোলজি অ্যান্ড কম্পেরাটিভ এনাটমিতে ডিগ্রী নেন তিনি। পরবর্তী বছরেই কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োলজি এবং ফিজিওলজির উপরেও পড়াশোনা করেন মিরিয়াম।
তবে, চিকিৎসক হতে চাইলেও তৎকালীন সেরা মেডিকেল স্কুলগুলো থেকে বিতাড়িত হন এই নারী। সেসময় খুব কম ভালো স্কুলেই নারীদের যাতায়াত ছিলো। এমনকি হার্ভার্ডেও নারীদের প্রথম পাঠ নেওয়া শুরু হয় ১৯৪৫ সালে। এর আগে বিতর্ক ছিল এই বিষয়ে যে, নারীদের মূল দায়িত্ব সন্তান জন্ম দেওয়া ও লালনপালন হওয়ায়, নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিলে সেটি প্রকৃতির আইনের বিরোধিতা করা হবে কি না।
পরবর্তী সময়ে হার্ভার্ডের মেডিকেল শিক্ষার্থী ভ্যালি মেনকিনকে বিয়ে করেন মিরিয়াম। হয়ে যান মিরিয়াম মেনকিন। স্বামীর সহকারী হিসেবে কাজ করতেন তিনি। একইসাথে ব্যাক্টেরিওলজি এবং এম্ব্রায়োলজি নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। সেখানেই তার পরিচয় হয় গ্রেগরি পিনকাসের সাথে। রকের সাথে পরবর্তীতে গ্রেগরি জন্মবিরতিকরণ পিল আবিষ্কার করেছিলেন। গ্রেগরি প্রথম প্রাণী শরীরের বাইরে একটি খরগোশের জন্ম দিয়েছিলেন। তাকে সাহায্য করার কাজ শুরু করেন মিরিয়াম। তবে ১৯৩৭ সালে গ্রেগরি ইংল্যান্ডে ফিরে গেলে জন রক মিরিয়ামকে নিজের সাথে কাজ করার আহ্বান জানান। মূলত, গ্রেগরির কাজের ব্যাপারে আগ্রহ থেকেই এ কাজটি করেন তিনি।
প্রতি বুধবার রকের জন্য অপেক্ষা করতেন মিরিয়াম। সেখানে কোনো নারীর বিচ্ছিন্ন জরায়ু পেলে সেখান থেকে ডিম্বাণু বের করে সেটি শুক্রাণুর সাথে মিলিত করার চেষ্টা করতেন তিনি। গর্বের সাথে নিজেকে ‘এগ চেজার’ বলে ডাকতেন এই নারী। মোট ১৩৮টি ব্যর্থ চেষ্টা করার পর অবশেষে ছ’ বছর পর সাফল্য তার হাতে ধরা দেয়।
চিৎকার করে সবাইকে ডাকেন মিরিয়াম। পৃথিবীর সবচাইতে ছোট্ট মানুষকে দেখতে ছুটে আসে হাসপাতালের বাকি সবাই। এরপর কোনো বিশ্রাম ছাড়াই দিনের পর দিন যত্ন নিতে থাকেন মিরিয়াম এই ভ্রূণটির। প্রথম ডিম্বাণুটি অবশ্য কাজ করেনি। তবে পরবর্তী সময়ে একটি দ্বিকোষী জাইগোট এবং দু’টি ত্রিকোষী জাইগোটের জন্ম দেন মিরিয়াম। তবে একই সময়ে মিরিয়ামের স্বামী চাকরি হারান। এছাড়া, চারপাশে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনকে নেতিবাচকভাবে নেওয়া হয়। গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। তবে আবার ফিরে আসেন এই বিজ্ঞানী।
১৯৪৮ সালে রক এবং মিরিয়াম মিলে আইভিএফের ওপর প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ইতোমধ্যেই মিরিয়ামের স্বামী ভ্যালি বিচ্ছেদ চেয়ে বসেন। একা সন্তানদের নিয়ে গবেষণাগারে পয়সা ছাড়া কাজ করাটা কষ্টকর হয়ে পড়ে মিরিয়ামের জন্য। একটা সময় বোস্টনে ফিরে আসেন তিনি। কাজ শুরু করেন আবার রকের সাথে। তবে ততদিনে যুগ পাল্টেছে। সন্তান নেওয়ার জন্য নয়, সন্তানধারণ আটকানোর জন্য কন্ট্রাসেপ্টিভ তৈরি করছিলেন তখন রক। ধীরে ধীরে একটা সময় তাই রকের পাশে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েন তিনি।
মিরিয়াম মেনকিন যদি মেডিকেল স্কুলে পড়তে পারতেন, বিয়ে না করতেন বা এমন আরো অনেক ‘যদি’ যদি বাস্তব হতো, তাহলে হয়তো আজকের এই গল্পটা একটু অন্যরকম হতো। তবে প্রতিকূলতাকে পার হয়েও যে অবদান মিরিয়াম রেখেছেন, তাতে সহজেই তাকে বিজ্ঞানীর তালিকায় ফেলে দেওয়া যায়।