মানবজাতির ইতিহাসে যে সকল অধ্যায়কে দুঃখ ও কলঙ্কের আধার হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়, ক্রীতদাস প্রথা নিঃসন্দেহে সেগুলোর মাঝে শীর্ষস্থানীয়। মানুষ কিভাবে তার স্বজাতির সাথে পশুর চেয়েও নির্মম ব্যবহার করতে পারে, কিভাবে একই রক্ত-মাংস-শারীরিক গঠনের অপর একজনকে তার প্রাপ্য মর্যাদা না দিয়ে পশুর মতো নিজের অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে পারে, তার নিদর্শন হয়ে আছে এই প্রথাটি।
আজকের দিনে হতভাগা সেই ক্রীতদাসদের উপর চালানো অমানবিক নির্যাতনের কথা জানলে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করতে চাইবে না। আর কেনই বা করবে বলুন? যদি আমি আপনাকে বলি এককালে ক্রীতদাসদের শরীরের কাটা স্থানে লাল মরিচ ডলে দেয়া হতো, শরীর কেটে আংটা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো, তাহলে আপনি কি সেগুলো বিশ্বাস করতে চাইবেন? অবশ্যই না। কিন্তু সত্যি সত্যিই এগুলো হয়েছে! আজকের লেখাতে দুঃখজনক সেই নির্যাতনের ইতিহাসই তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে।
কটন স্ক্রু
ক্রীতদাসদের উপর নির্যাতনের কাহিনী শুরু করা যাক মোজেস রোপারকে দিয়েই। অমানুষিক সেই নির্যাতন থেকে বেশ কয়েকবারই পালানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি, বেশ কয়েকবার ধরাও পড়ে যান। এর ফলে তার উপর নেমে আসে অকথ্য সব নির্যাতন। অবশেষে ১৮৩৫ সালে চূড়ান্তভাবে পালাতে সক্ষম হন রোপার।
একবারের কথা, পালাতে গিয়ে ধরা পড়েছেন রোপার। মালিক তখন বড্ড ক্ষেপা তার উপর। কালো লোকটিকে এবার ঠিকমতো শায়েস্তা না করলেই নয়! তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘কটন স্ক্রু’ নামের একটি যন্ত্র। এটি মূলত ব্যবহার করা হতো তুলা চাপ দিয়ে প্যাকেট করার জন্য। শাস্তির বর্ণনা শোনা যাক রোপারের মুখ থেকেই।
“ছবির ‘a’ এর জায়গায় হাত বেঁধে তিনি আমাকে ঝুলিয়ে দিতেন। ‘e’-তে থাকা স্ক্রুয়ের চারদিকে ঘুরতো একটি ঘোড়া এবং এটাকে উপর-নিচে ওঠা-নামা করাতো। তখন ‘c’ ব্লকটি ‘d’ বক্সের উপর চাপ দিতো যার ভেতরই থাকতো তুলা… আমাকে মাটির উপর ১০ ফুট উঁচু পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখা হতো, যখন মি. গুচ… আমাকে পাঁচ মিনিটের মতো বিশ্রাম করতে দিতেন। তারপর আমাকে আবারো ঘোরানো হতো। এরপর তিনি আমাকে নিচে নামাতেন এবং ‘d’ বক্সে আমাকে ঢোকাতেন এবং সেখানে দশ মিনিটের মতো আটকে রাখতেন…।”
মুখোশ
আফ্রিকার বন্দী ক্রীতদাসেরা মাঝে মাঝেই তাদের দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি লাভের প্রত্যাশায় পালানোর পথ বেছে নিতো। তবে এটি করতে গিয়ে প্রায় সময়ই ধরা পড়ে যেত তারা। এরপরই তাদের উপর শুরু হতো অমানুষিক অত্যাচার।
সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোই করতে বাধ্য করা হতো সেসব ক্রীতদাসকে। শিকলে বেঁধে রাখা হতো ভাগ্যবিড়ম্বিত সেই ক্রীতদাসদের। ভারী ভারী সব মালপত্র বহন কিংবা রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা লাগতো তাদের শিকলাবদ্ধ অবস্থাতেই। অবশেষে একসময় মারাত্মক হতাশা ঘিরে ধরতো তাদের। আবার পালানোর চিন্তা করা তো দূরের কথা, বেঁচে থাকাটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠতো তাদের কাছে। তখন তাদের অনেকেই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তির পথ খুঁজত। নিজেদের শেষ করে দিতে কখনো কখনো তারা এক ঢোকেই শেষ করে দিতো কড়া মদের পাত্র। ফলে তাদের মৃত্যু হতো বিষক্রিয়ায়। কখনো আবার তারা মুখে পুরে নিতো এক দলা মাটি কিংবা ময়লা। ফলে দম বন্ধ হয়েই মারা যেত দুর্ভাগা সেই পলায়নপর ক্রীতদাসেরা।
তারা যেন এমনটা করতে না পারে সেজন্য তাদের মালিকেরা তাদের মুখে ছবিতে দেখানো এমন টিনের মুখোশগুলো পরিয়ে রাখতো। মুখোশগুলোর মুখের সামনের দিকে থাকতো খুব সরুভাবে কাটা অংশ। এছাড়া নাকের নিচে থাকতো কিছু ছিদ্র যাতে তারা নিঃশ্বাস নিতে পারে।
কলার
এখন যে নির্যাতনটির কথা বলবো, তা জেনে প্রথমেই আপনার মাথায় আসবে কুকুরের নাম। কারণ পোষা কুকুরকে আমরা যেমন গলায় বেল্ট পরিয়ে রাখি, তেমনটা করা হতো পলায়নপর ক্রীতদাসদের সাথেও। তবে তাদের বেল্ট পরানো হতো না, লাগিয়ে দেয়া হতো ধাতব কলার।
মাসের পর মাস সেই কলারগুলো লাগিয়ে রাখা হতো তাদের গলায়। উদ্দেশ্য একটাই, “তুমি পালাতে গিয়ে যে ‘পাপ’ করেছো, এটাই হলো তার উপযুক্ত শাস্তি। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সতর্ক হয়ে যাও। নাহলে আরো খারাপ কিছুই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”- এ কথাগুলো তাদের মাথায় পাকাপাকিভাবে ঢুকিয়ে দেয়া। মোটা ও ভারী সেই কলারগুলোতে থাকতো ধাতব কাঁটার ন্যায় অংশ। ফলে সেগুলো গলায় জড়িয়ে মাঠে কাজ করতে তাদের বেশ অসুবিধা হতো। এছাড়া রাতের বেলা ঠিকমতো ঘুমও হতো না তাদের। কোনো ক্ষতি না করে কলারটি খুলতেও লেগে যেতো এক ঘণ্টার মতো সময়।
এবার আসা যাক কাঠের কলারের দিকে। ইংরেজ ধর্মপ্রচারক ও লেখক উইলিয়াম এলিস উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তার রচিত বই ‘Three Visits to Madagascar’-এ প্রথম এর কথা লিখেছিলেন।
“তাদের একটি বাড়িতে… বেশ কয়েকজন ক্রীতদাসী কাজ করছিলো। তাদের কয়েকজন ঝুড়িতে করে তুলা বা অন্য জিনিস এক রুম থেকে আরেক রুমে নিয়ে যাচ্ছিলো… আমি অল্পবয়সী এক মেয়েকে দেখলাম যার কাঁধে কিছু বোর্ড রাখা ছিলো। সেগুলোর প্রতিটিই ছিলো দু’ফুটের বেশি লম্বা এবং দশ ইঞ্চি থেকে এক ফুটের মতো চওড়া। নিচে কাঠের সাহায্যে বোর্ডগুলো লাগানো ছিলো। প্রতিটি বোর্ডের মাঝখান থেকেই কিছু অংশ কেটে নেয়া হয়েছিলো যাতে করে জোড়া লাগানোর সময় সেটা গলার যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকে। দুর্ভাগা মেয়েটি শাস্তি ও মর্যাদাহানিকর সেই জিনিসটি পরেই অন্যান্যদের সাথে কাজ করে যাচ্ছিলো।”
চাবুক
পলায়নপর ক্রীতদাসদের শাস্তি দেয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জিনিসটি ছিলো চাবুক। চাবুকের আঘাতে বাতাসে যে শপাং শপাং শব্দ হতো, তা যেন আতঙ্কের মাত্রা বাড়িয়ে দিতো বহুগুণে। এক্ষেত্রে আঘাতের মাত্রা এতটাই বেশি হতো যে মাঝে মাঝেই দুর্ভাগা সেই ক্রীতদাসটির মাংস খুলে খুলে আসতো! আঘাতের চোটে কম করে হলেও একটি চোখ চিরতরে হারিয়ে ফেলা ছিলো বেশ সাধারণ ঘটনা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে অনেক সময়ই তারা হাইপোভলেমিক শকে চলে যেত। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো চাবুক মারার জন্য বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও খোলা হয়েছিলো সেই দিনগুলোতে।
ব্লেড
এতক্ষণ ধরে এত ধরনের নির্যাতনের কাহিনী পড়ে কেউ কেউ ভাবতে পারেন, “আচ্ছা, তাদের কি হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার মতো নির্যাতনও করা হতো?” এক্ষেত্রে উত্তর অবশ্যই সম্মতিসূচক হবে। বিচারের অংশ হিসেবে পলায়নপর ক্রীতদাসদের শরীর কেটে বা আগুনে পুড়িয়ে কলঙ্কচিহ্ন এঁকে দেয়া হতো, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ কেটে ফেলা হতো, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তাদেরকে খোজাও করে দেয়া হতো।
যেমন এই ছবিটির কথাই ধরা যাক। এটি এঁকেছিলেন জন গ্যাব্রিয়েল স্টেডম্যান নামক এক তরুণ ডাচ। আঠারো শতকের শেষের দিকে ডাচ কলোনিগুলোতে ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ ঠেকাতে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। তার আত্মজীবনী ‘Five Years’ Expedition, Against the Revolted Negroes of Surinam’-তে তিনি তৎকালে ক্রীতদাসদের উপর নির্যাতনের একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। “চুরির বাড়তি সাজা হিসেবে তার বাম হাতটি কেটে ফেলা হতো এবং এটা হতো অন্যদের জন্য দৃষ্টান্তস্বরুপ একটি বিষয়। ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগে ব্যক্তিটিকে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা দেয়ার জন্যই নির্যাতনের এমন পন্থা বেছে নেয়া হতো।”
ঝুলিয়ে রাখা
এখন যে নির্যাতনটির কথা বলতে যাচ্ছি সেটি বেশ অমানবিক এবং সহ্য করাও কষ্টকর বটে। তাই দুর্বল হৃদয়ের হয়ে থাকলে আপনার প্রতি পরামর্শ থাকবে এই অংশটুকু এড়িয়ে যাবার জন্য।
ক্রীতদাসদের উপর নির্যাতনের এ কাহিনীটিও স্টেডম্যানের মাধ্যমেই জানা যায়। এ বেলায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসকে পাঁজরের জায়গাটিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো। তিনি লিখেছিলেন- “ভিক্টিমের পাঁজরে প্রথমে কাটা হয়েছিলো। এরপর গর্তটিতে একটি আংটা আটকে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে লোকটি তিনদিন পর্যন্ত বেঁচে ছিলো যতক্ষণ না তাকে পাহারা দেয়া লোকটি তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, যাকে সে (ক্রীতদাস) অপমান করেছিলো।”
যৌন নির্যাতন
সাদা চামড়ার মালিকদের বিচারের কোনো ভয় ছিলো না। তাই বিভিন্ন খামারের মালিক, তাদের ছেলে, ভাই ও অন্যান্য পরিচিত পুরুষ সদস্যরা নির্বিচারে ক্রীতদাসীদের ধর্ষণ করে যেত। কেবলমাত্র মনের খারাপ বাসনা চরিতার্থ করা থেকে শুরু করে শাস্তি দেয়া- সব ক্ষেত্রেই এটা ছিলো সাধারণ ঘটনা। ক্রীতদাসরাও একই নির্যাতনের শিকার হতো। কখনো কখনো এর শিকার হতো তাদের স্ত্রীরা।
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা!
‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ নামক প্রবাদ বাক্যটির সাথে পরিচিত আমরা সকলেই। এটা আমরা কেবল দুঃসময়ে আরো মানসিক আঘাত পাওয়ার মতো ব্যাপারেই ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু ক্রীতদাসদের বেলায় হতো এর একেবারে বাস্তব প্রয়োগ।
চাবুক বা অন্যকিছু দিয়ে নির্মমভাবে পেটানোর পর স্বাভাবিকভাবেই লোকটির শরীরের নানা জায়গা কেটে যেতো। কখনো কখনো মালিকপক্ষের লোকেরা সেই কাটা জায়গায় জোর করে তার্পিন ও লাল মরিচ ডলে দিতো। একবার এক পরিদর্শকের কথা জানা যায় যিনি ইট গুঁড়ো গুঁড়ো করে সেটি শূকরের চর্বির সাথে মিশিয়ে একজন ক্রীতদাসের পুরো শরীরে মাখিয়ে দিয়েছিলেন।
বেঁধে রাখা
হাত ও পায়ে বেড়ি দিয়ে আটকে রাখা হতো ক্রীতদাসদের। বিভিন্ন খামারের মালিকেরা তাদের অধীনস্ত ‘অবাধ্য’ ক্রীতদাসদের অপমান করতে ভারী লোহা দিয়ে বানানো সেসব বেড়ি দিয়ে তাদের আটকে রাখতো। ধীরে ধীরে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে লোকটি তার মালিকের আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হতো।
গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া
যদি কোনো ক্রীতদাস কোনো বিদ্রোহে অংশ নিতো কিংবা তার ব্যাপারে এমন সন্দেহ করা হতো, তাহলে কখনো কখনো তার শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মতো ঘৃণ্য কাজও করেছে মালিকপক্ষের লোকেরা।