বৈশ্বিক নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্ক (ওসমানী সাম্রাজ্য) যোগদান করে জার্মানির আহবানে। অক্ষশক্তির পক্ষে এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর থেকেই ভাঙনের সুর শুরু হয় সাম্রাজ্যটিতে। ফলে, তুর্কি সরকারকে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন লড়াই করতে হয়েছে সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষায়, যুদ্ধ ফ্রন্ট খুলতে হয়েছে সিনাই-প্যালেস্টাইন, মেসোপটেমিয়া ও পূর্ব আনাতালিয়ায়। সময়ের সাথে প্রতিটি ফ্রন্টেই ব্যর্থ হয় তুরস্ক সরকার, পর্যুদস্ত হয়ে ১৯১৮ সালের ৩১ অক্টোবর যুদ্ধ বিরতির চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ব্রিটিশদের সাথে।
সে বছরের নভেম্বরের শুরুতেই ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর নৌযান কনস্টান্টিনোপল বন্দরে নোঙর করে। ডিসেম্বর থেকে রাজধানীতে প্রবর্তিত হয় মিত্রশক্তির সামরিক শাসন। শাসনযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে যায় মিত্রশক্তির অধীনে। নিয়ন্ত্রণে যায় তুরস্কের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমও।
এ সময় তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশদের সামরিক কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। ইতালির সামরিক বাহিনী দখল করে নেয় আনাতালিয়া অঞ্চল, ফরাসি বাহিনী সামরিক অভিযান চালায় সিলিসিয়া ও আদানার অঞ্চলে। একসময় অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা গ্রিকরা মিত্রশক্তির সহায়তায় অবতরণ করে স্মার্না অঞ্চলে, অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের সহযোগিতায় তুর্কিদের হারিয়ে দখল করে নেয় স্মার্না। এই বিজয়ের পর গ্রিক সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করে আনাতালিয়া দখলের দিকে। অগ্রসরমান গ্রিকদের রুখতে প্রয়োজনীয় রসদ না থাকায় আনাতালিয়া থেকে সৈন্যদের নিয়ে পেছনে হটতে থাকেন সেনাপতি আলী ফুয়াদ। পশ্চাদপসরণের সুযোগ নিয়ে গ্রিকদের আরেকটি বাহিনী দখল করে নেয় তুরস্কের ব্রুসা অঞ্চল, অগ্রসর হতে থাকে আফিয়ুনকারাহিসারের দিকে। একপর্যায়ে মিত্রশক্তির হস্তক্ষেপে আর অগ্রসর হয়নি গ্রিক বাহিনী।
এ সময় তুরস্কের সুলতান ছিলেন ষষ্ঠ মুহাম্মদ। মিত্রশক্তির সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষরের পরেই নতুন মন্ত্রীসভা গঠন করেন সুলতান, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন দামাদ ফরিদ পাশাকে। সময়ের সাথে তুরস্কের বিভিন্ন অংশে শক্তিশালী হচ্ছিল জাতীয়তাবাদীরা, তাদের সাথে আলোচনার সুবিধার্থে বেশ কয়েকবারই মন্ত্রীসভার পরিবর্তন আনেন তিনি। জাতীয়তাবাদীগণ তুরস্কের সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হলেও আস্থাশীল ছিলেন সুলতানের প্রতি।
১৯১৯ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জাতীয়তাবাদীদের নেতা মোস্তফা কামালের এক চিঠির প্রেক্ষিতে বদল আসে প্রধানমন্ত্রী পদে, পহেলা অক্টোবর থেকে দামাদ ফরিদ পাশার স্থলে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন আলী রিজা পাশা। বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয়তাবাদীদের সাথে আলী রিজা পাশার ঐক্যমত বিচলিত করে মিত্রশক্তিকে। এ পদে আবারো পরিবর্তন আসে ১৯২০ সালের মার্চ মাসেই, আলী রিজা পাশার স্থলাভিষিক্ত হন সালিহ পাশা। নতুন প্রধানমন্ত্রী সালিহ পাশাও তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের বিরোধিতা করতে রাজি ছিলেন না, ফলে প্রধানমন্ত্রী পদে আরেক দফা পরিবর্তন আসে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসেন দামাদ ফরিদ পাশা।
সেভ্রে চুক্তি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির অংশ ছিল সার্বিয়া, রোমানিয়া, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সময়ের সাথে মিত্রশক্তির পক্ষে জড়িয়েছে জাপান, মন্টিনিগ্রো, বেলজিয়াম, পর্তুগাল ও চীনের মতো দেশগুলো। অক্ষ শক্তিতে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত হয় জার্মান আর অটোমান সাম্রাজ্য। সাড়ে চার বছরের এই যুদ্ধে পরাজিত হয় অক্ষশক্তির অংশ সাম্রাজ্যগুলো। বিজয়ী মিত্রশক্তির পক্ষ থেকে তাদের উপর নেমে আসে ক্ষতিপূরণমূলক বিভিন্ন চুক্তি, ধরনে যেগুলো ছিল অনেকটা শাস্তির মতো।
পরাজয়ের পর জার্মানির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় ভার্সাই চুক্তি, তুরস্কের উপর চাপানো হয় সেভ্রে চুক্তি। প্যারিস শান্তি সম্মেলন থেকে এই চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা চলে আরো পনেরো মাস। ১৯২০ সালের জুনের শুরুতে তুরস্কের সাথে মিত্রশক্তির চুক্তির একটি খসড়া প্রকাশ করে মিত্রশক্তি। তুরস্কের শাসনতান্ত্রিক প্রকৃতি থেকে শুরু করে একেবারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ধারা সংযুক্ত হয় এতে, মোট ধারার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩৩ টিতে। এরমধ্যে ৩৬ ধারা থেকে আলোচনা করা হয়েছে তুরস্কের রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে, এই অংশে ছিল প্রায় ১০৮টি ধারা। বন্দর, জলপথ আর রেলওয়ে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ৩২৮ ধারা থেকে ৩৭৩ ধারা পর্যন্ত। জুনের শুরুতে চুক্তির খসড়া প্রকাশিত হলেও, চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় আরো দুই মাস পরে, ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট।
ভূখণ্ডের রাজনৈতিক পরিবর্তন
জার্মানির উপর চাপানো ভার্সাই চুক্তি ছিল বেশ কঠোর। যাকে হিটলার অবহিত করেছিলেন Diktat of Versailles হিসেবে। সেভ্রে চুক্তি সেদিক থেকে ছিল আরো কঠোর। তুরস্কের সার্বভৌমত্বের প্রতি যা ছিল অপমানজনক। চুক্তির কঠোরতার মাত্রা হিসেবে সেভ্রে চুক্তিকে Diktat of Sevres হিসেবে অবহিত করা যায়। এই চুক্তি তুরস্কের ভূখণ্ডের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেয় নানা দিক থেকে।
প্রথমত, তুরস্কের অন্যতম প্রধান শহর ইস্তাম্বুলের পূর্ববর্তী নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল, শিল্প আর অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র এই শহর ১৪৫৩ সাল থেকে ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রথম ধারাতেই, ৩৬ নং ধারাতে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলের উপর তুরস্কের রাজনৈতিক অধিকার স্বীকার করে মিত্রশক্তি, স্বীকার করে রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব। তবে, এই রাজনৈতিক স্বাধীনতার সাথে শর্ত জুড়ে দেয়, সেভ্রে চুক্তির অন্যান্য শর্ত পূরণে তুরস্ক ব্যর্থ হলে মিত্রশক্তি পেয়ে যাবে কনস্টান্টিনোপলের কর্তৃত্ব গ্রহণের সুযোগ। স্বভাবই, তুরস্কের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এই ধারাতেই সংকুচিত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয়ত, কুর্দি জাতি মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বৃহত্তম নৃগোষ্ঠী। এরা ছড়িয়ে আছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে, এদের বসবাস ছিল তুরস্কেও। দীর্ঘ সময় থেকেই তারা চেষ্টা করছে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে, নিজেদের একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে। কুর্দি অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠারত জন্য মিত্রশক্তির নেতৃস্থানীয় দেশগুলোকে নিয়ে একটি কমিশন গঠিত হওয়ার কথা ছিল, যেখানে সদস্য হওয়ার কথা ছিল ফরাসি, ব্রিটিশ ও ইতালি সরকারের। ৬২ নং ধারায় কুর্দিদের জন্য স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অধিকার পাবার পাশাপাশি, ৬৪ নং ধারা অনুযায়ী কুর্দিদের আরো সুযোগ ছিল সেভ্রে চুক্তি কার্যকর হওয়ার এক বছরের মধ্যে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য লিগ অফ নেশনের কাছে দাবি জানানোর। লিগ অফ নেশনসে স্বাধীনতার দাবি পাশ হলে সেই অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য থাকতো তুরস্ক।
তৃতীয়ত, আগে দীর্ঘ সময় গ্রিস অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ ছিল, তারা স্বাধীনতা অর্জন করে অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে। স্বাধীনতা অর্জনের পরেও গ্রিস আর অটোমানদের মধ্যে জাতিগত বিদ্বেষ ছিল, ছিল রাজনৈতিক সীমানা নিয়েও বিতর্ক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের পরাজয়ের পর গ্রিকরা তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক আক্রমণ চালায়, এ রকমই একই শহর ছিল স্মার্না। সেভ্রে চুক্তির ৭৭ নং ধারা অনুযায়ী, এই শহর ও তার চারপাশের এলাকা তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, এসব অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রিসের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব। প্রস্তাব করা হয়, চারপাশের সীমানা নির্ধারণের জন্য ফরাসি, ব্রিটিশ ও ইতালীয় সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিশন গঠনের।
এই ধারা অনুযায়ী, সেভ্রে চুক্তি সম্পাদনের পাঁচ বছর পর এ অঞ্চলের লোকজন গ্রিসের সাথে সংযুক্তির জন্য লিগ অফ নেশনসের কাছে দাবি জানাতে পারবে এবং সেই আবেদন গৃহীত হলে, তা মেনে নিতে তুরস্ককে বাধ্য থাকতে হবে।
চতুর্থত, সেভ্রে চুক্তির ৮৮ থেকে ৯০ ধারা পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছে আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। কয়েক শতাব্দী ধরেই অটোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে বাস করছিল আর্মেনীয়রা। অটোমান সাম্রাজ্যে বসবাসকারী আর্মেনীয়দের সংখ্যা ১৭ থেক ২৩ লাখের মধ্যে ছিল বলে ধারণা করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদের উত্থানের সাথে সাথে অটোমান শাসকরা আর্মেনীয়দের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালে অটোমান শাসকেরা আর্মেনীয়দের উপস্থাপন করে শত্রুপক্ষ হিসেবে। ফলে, সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে হত্যা করা হয় আর্মেনীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের।
সেভ্রে চুক্তির ৮৮ ধারা অনুযায়ী, অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র তুরস্ক, আর্মেনিয়ার স্বাধীনতাকে মেনে নেবে, আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি দেবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে। দুই রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করার কথা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের। সেই মধ্যস্থতায় যদি তুরস্কের কোনো অঞ্চল আর্মেনিয়াকে দিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসতো, তবে তুরস্ককে তা মেনে নিতে হতো।
পঞ্চমত, সেভ্রে চুক্তির ৯৫ তম ধারা অনুযায়ী তুরস্ক সিরিয়া ও মেসোপটেমিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেনে নেয়। প্যালেস্টাইনের শাসনভার অর্পণ করা হয় ব্রিটিশ সরকারের কাছে। ব্রিটিশ সরকারকে বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুযোগও দেওয়া হয় এই চুক্তিতে।
তুরস্ক হেজাজের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেওয়ার কথা ছিল এই চুক্তি অনুযায়ী। ত্যাগ করতে হয় মিসরের উপর সমস্ত দাবি। সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণের যে ক্ষমতা ছিল সুলতানের হাতে, তা গিয়ে বর্তায় ব্রিটিশ সরকারের কাছে। সাইপ্রাসের উপর থেকে সমস্ত দাবি ত্যাগ করার কথা ছিল এই চুক্তিতে।
পাশাপাশি এই চুক্তি অনুযায়ী, তুরস্কের মোট সৈন্যসংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের মধ্যে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। মিত্রশক্তিকে দেওয়া হয় তুর্কি সেনাবাহিনীকে ‘উপদেশ’ দেওয়ার সুযোগ। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও ইতালির প্রতিনিধি সমন্বয়ে প্রস্তাব করা হয়েছিল ‘অর্থনৈতিক কমিশনের’, বিদেশি নাগরিকদের জন্য ছিল অনৈতিক কিছু সুবিধা। ফলে, চুক্তির বদলে একে ব্যাখ্যা করা যায় একপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া কিছু শর্ত হিসেবে।
জলপথের রাজনৈতিক পরিবর্তন
বসফরাস প্রণালী এশিয়া ও ইউরোপের সীমানা নির্ধারণ করে, একে আখ্যায়িত করা হয় ইস্তাম্বুল প্রণালী হিসেবেও। সেভ্রে চুক্তির ৩৭ নং ধারা অনুযায়ী, বসফরাস প্রণালী সকল জাতির বাণিজ্যিক ও যুদ্ধজাহাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আকাশসীমাও উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় বাণিজ্যিক ও সামরিক উড়োজাহাজের চলাচলের জন্য। এই জলপথে অবাধ জলযান চলাচল নিশ্চিত করার জন্য একটি কমিশন গঠিত হওয়ার কথা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, গ্রিস ও রুমানিয়া সরকারের প্রতিনিধি নিয়ে। ৪০ নং ধারায় লিগ অফ নেশনসের সদস্যপদ প্রাপ্তি সাপেক্ষে কমিশনের সদস্যপদ লাভের সুযোগ দেওয়া হয় তুরস্ককে।
একইভাবে, ইমব্রস ও তেনেদস দ্বীপের কর্তৃত্ব স্থানান্তরিত হওয়ার কথা ছিল গ্রিসের কাছে, ইজিয়ান সাগরেরও কয়েকটি দ্বীপের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল গ্রিসের। সেভ্রে চুক্তিতে, ইজিয়ান সাগরের দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ যাওয়ার কথা ছিল ইতালির কাছে। সবমিলিয়ে, জলপথে তুরস্কের সার্বভৌমত্বকে পুরোপুরি সংকুচিত করা হয়।
কেন বাস্তবায়িত হয়নি সেভ্রে চুক্তি?
তুর্কি জাতির ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো হতাশাজনক মুহূর্ত আর আসেনি। প্রত্যেকটা যুদ্ধের ফ্রন্টে তাদের পরাজয় হয়েছিল। আঠারো লক্ষ বর্গকিলোমিটারের অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের জন্য যে অটোমান যোদ্ধাদের খ্যাতি ছিল, সেই যোদ্ধারাও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় জাতীয় প্রত্যাশা অনুযায়ী যুদ্ধে ফলাফল আনতে পারেনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে তাই তুর্কিরা ডুবে যায় চরম হতাশায়, তাদের সামনে তৈরি হয় রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এমন ভগ্ন-মনোবলের তুর্কি জাতি যেকোনো ধরনের সম্মানজনক চুক্তি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু, মিত্রশক্তি এই ভগ্ন-মনোবলের তুর্কি জাতির উপর চাপিয়ে দেয় অপমানজনক সেভ্রে চুক্তি, যাকে তুলনা করা হয় ভার্সাই চুক্তির সাথে, ক্ষেত্রবিশেষে আখ্যায়িত করা হয় ভার্সাই চুক্তির চেয়েও কঠোর চুক্তি হিসেবে। আঠারো লাখ বর্গকিলোমিটারের সাম্রাজ্যের আয়তন টুকরো টুকরো করে নামিয়ে আনা হয় সাড়ে চার লাখ বর্গকিলোমিটারে।
সবমিলিয়ে তুর্কি জাতি সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি অপমানজনক এই চুক্তি মেনে নিতে পারেনি। ফলে, তুর্কি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটতে শুরু করে, সেনাপতি মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে এই জাতীয়তাবাদীরা আত্মপ্রকাশ করে একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট হিসেবে, সক্রিয় হয় তুরস্কের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায়। তাদের মাধ্যমেই বিজয় ঘটে তুর্কি জাতীয়তাবাদের, সেভ্রে চুক্তি বাতিল হয়ে হয় তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক লুজান চুক্তি। লুজান চুক্তি নিয়ে আলোচনা করা হবে পরবর্তীতে।