দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে ইউরোপের প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদি প্রাণ হারিয়েছিলো। এটি ছিলো তৎকালে ইউরোপে বসবাসরত ইহুদিদের মোট সংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। এই ষাট লক্ষের মাঝে পনের লক্ষই ছিলো শিশু। প্রায় চার বছর ধরে চলা নির্মম এ হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে হলোকাস্ট নামে পরিচিত।
আজকের এ লেখা অবশ্য হলোকাস্টের সময় ইহুদিদের উপর চালানো নির্যাতন নিয়ে না। বরং সেই সময় নিজেদের জীবন বাঁচাতে তারা কী কী কৌশল অবলম্বন করেছিলো, তেমনই কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে এখানে।
বীটের রস
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে থাকা বন্দীদের অবস্থা ছিলো বেশ শোচনীয়। খাবারদাবার কখনোই ঠিকমতো জুটতো না তাদের ভাগ্যে। ছেঁড়া কাপড়চোপড় পরেই রাত-দিন খাটতে হতো তাদের। এর ফলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত এ মানুষগুলো হয়ে পড়েছিলো বেশ দুর্বল, তাদের চামড়াও হয়ে গিয়েছিলো ধূসর বর্ণের। দূর থেকে দেখলে মনে হতো কোনো জীবন্ত কঙ্কাল বুঝি হেঁটে বেড়াচ্ছে।
অসউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর কথাতেই আসা যাক। ১৯৪০ সালের মে মাস থেকে ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত এ ক্যাম্পগুলোতে প্রাণ হারিয়েছিলো প্রায় ১১ লক্ষ বন্দী।
এ ক্যাম্পগুলোতে প্রায়ই বন্দীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হতো। যদি পরীক্ষায় কাউকে দুর্বল পাওয়া যেত, তাহলেই তার অনিবার্য পরিণতি হতো মৃত্যু। এজন্য এক অদ্ভুত উপায় বেছে নিয়েছিলো সেখানকার বন্দীরা। স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর আগে নিজেদের গালে তারা কিছুটা বীটের রস (বীট – মিষ্টি স্বাদের মূলবিশিষ্ট এক ধরনের চারাগাছ), এমনকি মাঝে মাঝে নিজেদের রক্তও মেখে নিতো। তখন তাদের গালে কিছুটা রক্তিম আভা ফুটে উঠতো যা দেখে স্বাস্থ্য পরীক্ষকেরা তাদের সুস্থ বলে মনে করতো। ফলে বেঁচে যেত তাদের মূল্যবান প্রাণগুলো।
ব্যায়াম
নিজেদের স্বাস্থ্যবান দেখানোর জন্য বীটের রসের পাশাপাশি আরেকটা কাজও করতো বন্দী ইহুদিরা। যেকোনো স্বাস্থ্য পরীক্ষার আগে নিজেদের ব্যারাকে কিছুক্ষণ ব্যায়াম সেরে নিতো তারা। এর মাঝে ছিলো হালকা দৌড়াদৌড়ি করা ও পুশ-আপের মতো ব্যায়াম। এছাড়া মাঝে মাঝে তারা নিজেদের মাঝে মেকি ঝগড়া করেও নিজেদের চনমনে রাখতে চাইতো।
চুলের রঙ
হলোকাস্টের শুরুর দিকে নাৎসি বাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিলো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের বন্দী করা। ধরা পড়ার ভয়ে অনেকেই এজন্য তাদের জন্ম সনদ পুড়িয়ে ফেলেছিলো। চল্লিশোর্ধ্ব নারী-পুরুষেরা অবশ্য এটি করেও নিস্তার পায় নি। কারণ তাদের অনেকের চুলই আংশিক কিংবা অনেকটা পেকে গিয়েছিলো। ফলে সহজেই হিটলারের বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যাবার ভয় ছিলো তাদের। এজন্য তারা বেছে নিয়েছিলো চুলের কলপকে।
তারা তখন এত বেশি পরিমাণে কলপ কিনছিলো যে, বড় বড় ইহুদি শহরগুলোতে অল্প কিছুদিনের মাঝেই কলপের সংকট দেখা দেয়।
ভুয়া পরিচয় পত্র ও জন্ম সনদ
জন্ম সনদ, পাসপোর্ট ও অন্যান্য পরিচয় পত্র দেখে ইহুদিদের খুঁজে বের করতো নাৎসি বাহিনী। এজন্য নিজেদের এ দরকারি কাগজপত্রগুলোর ব্যাপারেও একটা ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিলো নির্যাতিত ইহুদিদের জন্য।
যুদ্ধ শুরুর আগে যারা পরিচয় পত্র বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো, যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আত্মগোপনে গিয়েও তারা একই কাজ চালিয়ে গিয়েছিলো। তাদের তৈরি ভুয়া পরিচয় পত্র ও জন্ম সনদের বদৌলতে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল অনেকেই। ভুয়া সেসব কাগজপত্র দিয়ে নাৎসি সেনাদের বিভ্রান্ত করে অনেকেই সুইজারল্যান্ড ও ডেনমার্কে পালিয়ে গিয়েছিলো।
এ প্রসঙ্গে অ্যাডোলফো কামিন্সকির কথা অবশ্যই বলতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার তৈরি ভুয়া কাগজপত্রের বদৌলতে জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলো প্রায় ১০,০০০ এর মতো মানুষ।
কিন্ডারট্রান্সপোর্ট
বাবা-মা সবসময়ই তাদের নিজেদের জীবনের চেয়ে সন্তানের জীবনকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও ব্যতিক্রম ঘটে নি এর। কিন্ডারট্রান্সপোর্ট নামে এক গোপন পালাবার পথ এ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতো তখন। যুদ্ধ শুরুর আগে সেই পথ দিয়ে আঠারো বছরের কম বয়সী ইহুদি ছেলে-মেয়েদের জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া থেকে অন্যান্য বন্ধুবৎসল রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
শুধু যুক্তরাজ্যেই ঠাই মিলেছিল প্রায় ১০,০০০ শিশুর। যাত্রাপথে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে তাদের দেয়া হতো ভুয়া পরিচয় পত্র। নির্ধারিত দেশে পৌঁছার পর তাদেরকে বিভিন্ন পরিবারের অধীনে দিয়ে দেয়া হতো। ১৯৪০ সালে নাৎসি বাহিনীর কাছে পোল্যান্ড পরাজিত হলে এবং সেই সাথে পরিবহন আইনে কঠোর করে ফেলায় বন্ধ হয়ে যায় কিন্ডারট্রান্সপোর্ট।
লুকিয়ে থাকা
তৎকালে নির্যাতিত ইহুদিদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছিলো অনেক অ-ইহুদি পরিবারও। তারাই ইহুদিদের জন্য লুকনোর জায়গার ব্যবস্থা করে দিতো। অব্যবহৃত বেজমেন্ট, চিলেকোঠা, দেয়াল কিংবা মেঝের নিচে গোপন জায়গা, নকল বইয়ের তাক, নকল জানালার মতো এমন অনেক জায়গায় লুকিয়ে তখন নিজেদের জীবন বাঁচাতো দুর্ভাগা ইহুদিরা।
উদাহরণস্বরুপ অ্যান ফ্রাঙ্ক এবং তার পরিবারের কথাই বলা যায়। তার বাবার অফিসের উপরে এক ছোট্ট এপার্টমেন্টের মতো জায়গায় তারা লুকিয়ে ছিলো অনেক দিন। এক পরিচিত লোকই খাবারদাবার ও দরকারি অন্যান্য জিনিসগুলো দিয়ে যেত তাদের।
নাৎসি সৈন্যদের অধীনে চাকরি
জীবন বাঁচাতে অনেক ইহুদিই তখন বিভিন্ন নাৎসি সেনাদের অধীনে চাকরি করতো। তবে সেই চাকরির কিছু নমুনা শুনলে, বিশেষত পুরুষদের, আশ্চর্য না হয়ে থাকার উপায় নেই।
ইহুদি পুরুষেরা নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো স্বধর্মের অন্যান্য মানুষগুলোর সাথে। তারা যে এলাকাতে থাকতো, সেখানে লুকিয়ে থাকা অন্যান্য ইহুদিদের খুঁজে বের করতো এবং তারপর তাদের তুলে দিতো সে যেই সৈন্যের অধীনে চাকরি করছে তার হাতে। বিভিন্ন গোপন আড্ডা খুঁজে বের করে সেখান থেকে ইহুদিদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলোও নাৎসি সেনাদের কাছে দিয়ে দিতো তারা। নিজেদের জীবন বাঁচাতে তাদের এমন বিশ্বাসঘাতকতা অবলম্বন ইতিহাসের পাঠককে বিস্মিত না করে পারবে না।
ইহুদি নারীরা বেঁচে থাকতে বিকিয়ে দিয়েছিলো নিজেদের সম্ভ্রম। নাৎসি বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে বিভিন্ন পতিতালয় খুলে সেখানেই দেহ ব্যবসায় নেমে যেত তারা। অন্যান্য নারী বন্দীদের তুলনায় দেহ ব্যবসায় নামা এ নারীরা কিছুটা ভালো জীবনযাপন করতে পারতো। তাদের অকালে প্রাণ হারানোর শঙ্কাও ছিলো কম।
ঘুষ
অর্থ দিয়ে সুখ কেনা না গেলেও নিজেদের স্বাধীনতা ঠিকই কিনে নিতে পেরেছিলো তৎকালীন উচ্চবিত্ত ইহুদি পরিবারগুলো। ক্ষমতার লোভ ও অর্থলিপ্সা পাগল করে তুলেছিলো নাৎসি সেনাদের। আর এ সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিলো ধনী ইহুদিরা। তারা তাদের সহায়-সম্বল সবকিছু অর্থলোভী সেসব সেনাদের হাতে সঁপে দিতো শুধুমাত্র আরো ক’টা দিন বেঁচে থাকবার অভিপ্রায়ে।
পালিয়ে যাবার পর হাতে অর্থ বলতে তেমন কিছুই থাকতো না, তবু মুক্তি তো মিলেছে। সেটাই যে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি!
বিদ্রোহ
১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মের কথা। সোবিবর ডেথ ক্যাম্পের বন্দীদের কয়েকজন সৌভাগ্যবশত ক্যাম্পটি নিয়ে সামনের দিনগুলোতে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনার কথা জেনে যায়। তারা জানতে পারে যে, রাশিয়ান সেনারা এখানে আসার আগেই সকল বন্দীকে হত্যা করা হবে এবং ক্যাম্পের অস্তিত্বও বিলীন করে দেয়া হবে।
এমন কথা শুনে বন্দীরা বুঝতে পারে যে, তাদের সামনে এখন পালানো ছাড়া বাঁচবার আর কোনো পথ খোলা নেই। তাই ক্যাম্পে থাকা প্রায় ৬০০ বন্দী সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্রোহ করার। এরপর একদিন সুযোগ বুঝে শুরু হয় তাদের বিদ্রোহ। একে একে ক্যাম্পের সকল গার্ডকেই হত্যা করে তারা। এরপর কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ভূমি মাইন পাতা উন্মুক্ত প্রান্তর দিয়ে তারা ছুটে যেতে শুরু করে বনাঞ্চলের দিকে। মাত্র ২০০ জনই বাঁচতে পেরেছিলো সেদিন।
জেল পালানো
হলোকাস্টের সময় অল্প যে ক’জন ইহুদী অসউইৎজ ডেথ ক্যাম্পের ভয়াবহতা থেকে নিজেদের জীবন বাঁচাতে পেরেছিলো, আলফ্রেড ওয়েটজ্লার তাদের মাঝে একজন। তিনি এবং তার সাথে পালানো রুডলফ ভ্রবা অবশ্য বিখ্যাত হয়ে আছে এ ক্যাম্পের সর্বপ্রথম বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার জন্য। ৩২ পৃষ্ঠার এ ভ্রবা-ওয়েটজ্লার রিপোর্টে ছিলো অসউইৎজ ক্যাম্পের গ্রাউন্ড প্ল্যান, গ্যাস চেম্বারের কন্সট্রাকশন প্ল্যান, মানবদেহ পোড়ানোর চুল্লির বর্ণনা এবং গ্যাস চেম্বারে ব্যবহৃত জিক্লন বি গ্যাসের একটি ক্যানিস্টারের মোড়ক। এ রিপোর্টের তথ্যের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে মিত্রবাহিনী নাৎসি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়, রক্ষা পায় ১,২০,০০০ হাঙ্গেরিয়ান ইহুদী।
১৯৪৪ সালের ৭ এপ্রিল শুক্রবার দুপুর দুটোর দিকে ওয়েটজ্লার এবং ভ্রবা পালিয়ে এক কাঠের স্তুপের আড়ালে আশ্রয় নেন। এ এলাকাটি বির্কেনয়ের কাঁটাতার দেয়া এলাকার বাইরে হলেও তা আরেকটি বড় এলাকার অংশ ছিলো যা সার্বক্ষণিক প্রহরার মাঝে রাখা হতো। ফলে পুরোপুরি মুক্তি তাদের তখনো মিলে নি। ক্যাম্পের অন্যান্য বন্দীরা তাদের লুকিয়ে থাকার জায়গাটির চারদিকে কাঠের বোর্ড জমা করে রেখেছিলেন যাতে তারা ধরা না পড়েন। কুকুরেরা যাতে গন্ধ শুঁকেও তাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে না পেতে পারে, সেজন্য সেই জায়গাটিতে তারা তামাক পাতা গ্যাসোলিনে ভিজিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতেই সেখানে ৪টি রাত কাটিয়ে দেন পলাতক দুই বন্দী।
১০ এপ্রিল ডাচ স্যুট, ওভারকোট ও বুট গায়ে জড়িয়ে দুজন ১৩৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পোল্যান্ডের সীমান্তের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করেন। তাদের কাছে দিক নির্দেশক বলতে কেবল ছিলো বাচ্চাদের মানচিত্রের বইয়ের একটি পৃষ্ঠা।