ইতিহাস; এ এক নেশার জিনিস। মায়া এবং মোহের বস্তু। যারা ইতিহাসে একবার ডুবতে পারেন, তাদের আর অন্য কিছুর দরকার হয় না। কোয়ারেন্টিনের দিনগুলোতে এই বিষয় হতে পারে আপনার একান্ত সঙ্গী। এই ইতিহাস নিয়ে যে আলোচনা, তাকে বলে ইতিহাসতত্ত্ব। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য ইতিহাস এবং ইতিহাসতত্ত্ব সিরিজে আমরা বিস্তারিত আকারে আলোচনা করব। এই সিরিজে আমরা জানতে পারব-
- ইতিহাস কী?
- ইতিহাসতত্ত্বই বা কী?
- বিখ্যাত ঐতিহাসিকগন এদেরকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন?
- ইতিহাসতত্ত্বের প্রকারভেদ কী কী?
- বিভিন্ন যুগের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক কে কে ছিলেন?
আরও অনেক কিছু!
তবে চলুন প্রিয় পাঠক, আর দেরি না করে শুরু করা যাক।
সংজ্ঞায়ন
ইতিহাস অভিব্যক্তিটি ইংরেজি History শব্দের অনুবাদ। এর উৎপত্তি গ্রিক Historia বা Historie থেকে। এর অর্থ কোনো ঘটনা বা বিষয়ের সত্য উদঘাটনের অনুসন্ধান তথা জিজ্ঞাসা বা তদন্ত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪-৪২০) সর্বপ্রথম তার গবেষণাকর্মের শিরোনামে শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার বইয়ের নাম Histories। এটি সাধারণভাবে গ্রিক-পারসিক যুদ্ধের ইতিহাস নামে খ্যাত। এ গ্রন্থে তিনি লিডিয়ার রাজা ক্রোসাসের রাজত্বকাল (খ্রিস্টপূর্ব ৫৬০-৫৪৬) হতে খ্রিস্টপূর্ব ৪৭৮ এ গ্রিকদের নিকট আগ্রাসী পারসিকদের পরাজয় পর্যন্ত গ্রিক ও এশিয়াবাসীর মধ্যকার বিরাজমান সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন। শাব্দিক অথবা বৈয়াকরণিক অর্থে ইতিহাস শব্দটির জাত্যর্থ Connotation নিরূপণ করা যদিও কঠিন নয়, তবে শব্দটির প্রচলিত ব্যাপক অর্থের দিকে নজর দিলে এর স্পষ্ট ও সরল সংজ্ঞা দেওয়া বেশ জটিল।
J. Huizinga (১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) এর মতে, ইতিহাস হলো একটি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, যাতে কোনো সভ্যতা নিজেই তার উত্থানের অতীত ব্যাখ্যা প্রদান করে। R. Flint (১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দ) এবং C. H. Oman (১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দ) এর দৃষ্টিতে, মানুষের কার্যাবলী লিপিবদ্ধকরণে মানুষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকেই (man’s effort to record the doings of man) ইতিহাসের সর্বোত্তম সংজ্ঞা হিসেবে গ্রহণ করা যায়।
ইতিহাসের প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও গুরুত্ব সম্বন্ধে R. G. Collingwood (১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ) এর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণী থেকে ইতিহাস কী তার একটি ধারণা লাভ করা যায়। তার মতে, ইতিহাস ধর্মতত্ত্ব বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো চিন্তনের একটি বিশেষ ধরন বা শাখা (a special form of thought)। তাই এটি এক ধরনের গবেষণা বা অনুসন্ধান (a kind of research or enquiry)। তিনি মনে করেন, ইতিহাস হলো মানব জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে তথা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষের অতীত কার্যাবলী সম্বন্ধীয় প্রশ্নোত্তর বা গবেষণা।
এখানে মূলত গুরুত্ব সহকারে মানুষের অতীত কার্যাবলীর সাহিত্যিক বিবরণীকে ইতিহাস হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আধুনিক যুগে ইতিহাসের সাধারণ ধারণা, যুক্তিসঙ্গতভাবেই, সমস্ত জীবজগৎ ও জড়জগতকে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রফেসর এম আর তরফদার (১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ) ইতিহাসের একটি পরিচিত সংজ্ঞা সময়সীমার মধ্যে ইতিহাস একটি আন্দোলন মেনে নিয়ে বলেন,
ইতিহাস অতীতের কঙ্কাল নয়, শবাধারে পাঁচ হাজার বছর ধরে বন্ধ করে রাখা মমির মতো কোনো নিশ্চল পদার্থ নয়।
এ হচ্ছে আন্দোলন যার মধ্যে গতি আছে- যা অতীত থেকে শুরু করে বর্তমানের সময় সীমার ভিতর দিয়ে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে।
উল্লিখিত সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার আলোকে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতগণ এখন খুব সরলভাবে ইতিহাসের সংজ্ঞা প্রণয়ন করেছেন। তাদের মতে, ইতিহাস হলো মানুষ, সময় ও স্থানের একটি সমন্বিত বিষয়। অর্থাৎ, ইতিহাস = মানুষ + সময় + স্থান।
আবার কখনও ইতিহাসকে তারা এই বলে অভিহিত করেছেন যে, এটি একটি জীবন্ত অতীতের অধ্যয়ন। বস্তুত মানুষ, জীব ও জড় , রাজনীতি, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতির সুসংবদ্ধ, প্রবহমান, পরিবর্তনশীল, আবার সঙ্গে সঙ্গে স্থিতিশীল বিবরণী হলো ইতিহাস। কেউ কেউ ইতিহাসের সাথে ধর্ম ও নীতিশাস্ত্রের প্রচ্ছন্ন সম্পর্কেরও ইঙ্গিত দেন
ইতিহাসতত্ত্বের ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো হিস্টোরিওগ্রাফি (Historiography)। অত্যন্ত সংক্ষেপে বললে, ইতিহাস লিখন শিল্প বা কলা (art of writing history)-কে ইতিহাসতত্ত্ব বলে। এর দ্বারা ইতিহাস বিষয়ক লিখিত সাহিত্যের গঠন প্রণালি, বিষয়বস্তু ও অবয়ব সংক্রান্ত একটি সর্বাত্মক ধারণাকে বোঝায়। এর আলোকে বলা যায়, ইতিহাস রচনার কৌশল, পদ্ধতি, তত্ত্ব এবং গবেষণার ও উপস্থাপনার নীতিমালার আলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনার দৃষ্টিতে মৌলিক ও গৌণ উৎসাদি থেকে ইতিহাস উপাত্তের সংগ্রহ, মূল্যায়ন, বিন্যাস প্রভৃতি ইতিহাস লিখনশাস্ত্রের তথা ইতিহাসতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
উল্লেখ্য, ইতিহাসের উৎস হিসেবে কোনো বিখ্যাত গ্রন্থ গুরুত্বপূর্ণ হলেও ইতিহাসতত্ত্বের নিরিখে তা গুরুত্বহীন হতে পারে। এসব বিবেচনায় বলা যায় যে, কোনো নির্দিষ্ট যুগে, কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী কর্তৃক রচিত ইতিহাসের বিষয়বস্তু, পরিবেশনা ও বিন্যাসনীতি, ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, রচনা পদ্ধতি বা কৌশল প্রভৃতির একটি সামষ্টিক অভিব্যক্তি হলো ঐ সময়ের, ঐ অঞ্চলের, ঐ জনগোষ্ঠীর ইতিহাসতত্ত্ব (Historiography)। D. M. Sturly (১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ) ইতিহাসতত্ত্বের তিনটি মূল বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন,
- লিখনশিল্পের বিকাশ ও লিখিত দলিলাদি জড় করা।
- ইতিহাস ধারণার বিকাশ ঘটানো, অর্থাৎ সময় নিরিখে কোনো ঘটনা বা বিষয়ের পরিবর্তন বা বিকাশ অনুধাবন করা।
- ইতিহাস উৎসাদি ও অনিরীক্ষিত প্রামাণিকতার প্রতি সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটানো বা ঐতিহাসিক পদ্ধতির বিবর্তন।
বস্তুত, ইতিহাসতত্ত্বের এ ব্যাখ্যা ও সংজ্ঞার ধারাবাহিকতায় উৎপত্তি লাভ করেছে, গ্রিক ইতিহাসতত্ত্ব (Greek Historiography), রোমান ইতিহাসতত্ত্ব (Roman Historiography), মুসলিম ইতিহাসতত্ত্ব (Muslim Historiography), পারসিক ইতিহাসতত্ত্ব (Persian Historiography), তুর্কি ইতিহাসতত্ত্ব (Turkish Historiography) প্রভৃতি।
ইতিহাস যেহেতু সময়ের আবর্তে বিষয়াবলীর অনুসন্ধান করে, তাই যুগভেদে ইতিহাসতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যে কিছু ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক যুগ পর্যন্ত ইতিহাসতত্ত্বের দীর্ঘ পরিক্রমায় অন্তত পাঁচটি স্বতন্ত্র পর্ব পরিলক্ষিত হয়। সেগুলো হলো-
- আদিরূপ বা প্রাক-গ্রিক ইতিহাসতত্ত্ব।
- গ্রিক ইতিহাসতত্ত্ব।
- মধ্যযুগীয় ইতিহাসতত্ত্ব।
- রেনেসাঁ পর্ব।
- আধুনিক ইতিহাসতত্ত্ব।
চলুন পাঠক, এদের শ্রেণীবিভাগ থেকে কিছু আলোচনা করা যাক।
আদিরূপ বা প্রাক-গ্রিক ইতিহাসতত্ত্ব
এ পর্বের ইতিহাসের সাধারণ নাম প্রাগ-ইতিহাস (quasi history)। এ ইতিহাসতত্ত্বের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো দিব্যতান্ত্রিকতা (theocratic) ও অতিকথন (myth)। এর বিষয়বস্তু অতিপ্রাকৃত বাদে ভরপুর ছিল। প্রাচীন মিশর, ব্যবিলন, পারস্য, চিন, ফিলিস্তিন প্রভৃতি অঞ্চলে এ ধরনের ইতিহাস খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। দিব্যতান্ত্রিকতায় বর্ণিত বক্তব্য কোনো অনুসন্ধান বা প্রশ্নের উত্তর নয়, বা কোনো গবেষণারও ফল নয়; বরং লেখক যা জানতেন তার উপস্থাপনা।
দ্বিতীয়ত, যেসকল ঘটনা বা কার্যাবলী বর্ণিত, তা মানুষের নয় বরং ঈশ্বরের। এখানে মানুষ কার্যাবলীর আংশিক মাধ্যম কিন্তু বাহন (agent) নয়। অতিকথনে (myth) আদৌ মানবীয় কাজ থাকে না। এখানে গল্পের চরিত্র শুধু ঈশ্বর। বর্ণিত ঘটনাবলি পূর্বে নির্দিষ্ট তারিখে সংঘটিত কোনো বিষয় নয়। এগুলো পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়, তবে তারিখবিহীন। এটা এতই প্রাচীন ও পূর্বেকার যে, কেউ তা জানে না! গ্রিকদের জাগরণের পূর্ব পর্যন্ত এ ধরনের ইতিহাস সমগ্র নিকট প্রাচ্যে বিদ্যমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, খ্রিস্টপূর্ব নবম শতকে (৮৪০ খ্রিস্টপূর্ব) জর্ডানের মোয়াব রাজা মেসাহ উৎকীর্ণ মোবাইট পাথরখণ্ড (Mobite stone/ Mesha Stele), হিব্রু সাহিত্য, বাইবেলীয় পুরাতন নিয়ম (Old Testament), মেসোপটেমীয় ও মিশরীয় সাহিত্যে এ ধরনের ইতিহাস উপাদান পাওয়া যায়।
পরবর্তী পর্বসমূহে আমরা অন্যান্য প্রকারভেদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানব।