প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে দাও, দরকার হলে গুপ্তহত্যা করেও।
এটি প্রাচীন ভারতের মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজ-পরামর্শক কৌটিল্যের নীতি বাক্য। রাষ্ট্র পরিচালকেরা এই বাক্যটিকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছেন। ধারণা করা হয় কৌটিল্যের পরামর্শে মহাবীর আলেক্সান্ডারের দুই জেনারেলকে হত্যা করেছিল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুপ্তঘাতকরা।
একটি রাষ্ট্র কীভাবে আরেকটি রাষ্ট্রের উপর ক্ষমতার প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে- এটিই ছিল কৌটিল্যের কূটনীতির মূলনীতি। তার কূটনীতির অপরিহার্য একটি অংশ ছিল গুপ্তহত্যা। যুগের পর যুগ রাজনীতি বা কূটনীতিতে এই কৌশল ব্যবহার হয়ে আসছে।
গত শতকে অনেক গুপ্তহত্যা ঘটিয়েছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলন থেকে শুরু করে মিত্ররাষ্ট্রের যেসব নীতিনির্ধারক ইসরায়েলের স্বার্থের পরিপন্থি তাদেরও বাদ দেয়নি মোসাদ। তারা গুপ্তহত্যাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, মৃতদেহ বাদে আর কোনো প্রমাণই পাওয়া যেত না।
‘বিশ্বের সবচেয়ে কার্যকরী হত্যাযন্ত্র’ খ্যাত মোসাদের শিকার থেকে রেহাই পাননি বিজ্ঞানীরাও। শত্রুদেরকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে এগিয়ে নিতে পারবে এমন অনেককেই লক্ষ্য বানায় মোসাদ। তারপর সুযোগ বুঝে ঘায়েল করে দেওয়া হয়। তাদের গুপ্তহত্যার শিকার কয়েকজন বিজ্ঞানী ও গবেষককে নিয়ে আজকের আয়োজন।
অপারেশন ডেমোক্লিস
এই অপারেশনের মাধ্যমে ব্যাপক হারে প্রতিপক্ষের বিজ্ঞানী নিধন অভিযান শুরু হয়। পর পর কয়েকটি যুদ্ধে ইসরায়েলের কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের হুসেইন বুঝতে পারেন, প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নাৎসি জার্মানির ভি-টু রকেট প্রজেক্টে কাজ করা অনেক প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীকে নিয়ে মিশর নিজেদের রকেট প্রজেক্ট শুরু করে।
১৯৬২ সালে নতুন রকেটের সফল পরীক্ষার পর গোটা বিশ্ব নড়ে বসে। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের পরিবারকে ক্রমাগত হুমকি দিতে শুরু করে মোসাদ। ২৭ নভেম্বর রকেট বিজ্ঞানী ওলফগ্যাং পাইলজের অফিসে একটি পার্সেল বোমা পাঠানো হয়েছিল, যার বিষ্ফোরণে আহত হয় তার সহকারী। মিশরে মিলিটারি হার্ডওয়্যার সরবরাহ করা হেইঞ্জ ক্রুগ অপহৃত হন। তাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি। মিশরের এক রকেট কারখানায় পার্সেল বোমায় নিহত হয় ৫ কর্মী। বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীর উপর গুলি চালানো হয়। আতঙ্কিত হয়ে ১৯৬৩ সালের শেষ নাগাদ বিজ্ঞানীদের একটি বড় অংশ ইউরোপে ফেরত যান। স্থবির হয়ে যায় এই প্রজেক্ট।
ইয়াহিয়া এল মাশাদ
মিশর, ব্রিটেন এবং রাশিয়ায় পড়াশোনা করে এসে এই গবেষক মিশরের আণবিক সংস্থায় যোগ দেন। ৩য় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর মিশরের বেসামরিক আণবিক কর্মসূচী একদম বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের পর এল মাশাদ ইরাকে চলে যান এবং দেশটির আণবিক সংস্থায় যোগ দেন। রিঅ্যাক্টরের জন্য প্রচুর খুচরা যন্ত্রপাতি ইউরোপ থেকে আমদানি করতে হতো। এর জন্য এল মাশাদকে ফ্রান্সে নিজেদের কেনাকাটার সমন্বয়কারী হিসেবে নিযুক্ত করে ইরাক। মোসাদ যখন এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় তখন তাকে হত্যা করে।
প্যারিসের লা মেরিডিয়ান হোটেলে গলা কাটা অবস্থায় তার মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার হত্যাকাণ্ডে যুক্ত থাকা এক নারীও আত্মহত্যা করেন, যদিও প্যারিস পুলিশের ধারণা, ঐ নারী আত্মহত্যা করেননি, বরং এটিও মোসাদের কাজ।
ড. মাজিদ শাহরিয়ারি ও ড. আব্বাস–দাভানি
নিউট্রন বিশেষজ্ঞ মাজিদ শাহরিয়ারি ইরানের এক প্রতিভাবান পরমাণু গবেষক। নির্দিষ্ট পদবী না জানা গেলেও ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার একজন প্রকৌশলী হিসেবে উল্লেখ করা হতো তাকে।
২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর নিজে গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থল শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ট্রাফিক জ্যামে গাড়ির গতি কমে যেতেই হঠাৎ মোটরবাইক থেকে গুপ্তঘাতক চুম্বক লাগানো সি-৪ বোমা গাড়ির দরজায় আটকে দেয়। কয়েক সেকেন্ড পরেই বিস্ফোরণ ঘটে এবং তিনি মারা যান। পাশের আসনে বসা ড. মাজিদের স্ত্রীও মারাত্মক জখম হন এই হামলায়।
এর কিছু দূরেই দ্বিতীয় একটি হামলা হয়। এতে তেহরানের রাস্তায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক ড. আব্বাসির গাড়ি লক্ষ্য করেও একইভাবে হামলা হয়। আহত হলেও শেষপর্যন্ত প্রাণে বেঁচে যান তিনি। একই দিনে তৃতীয় আরেকটি বিস্ফোরণের কথাও শোনা যায়, যদিও ইরানের গণমাধ্যমে পুলিশ প্রধান তা অস্বীকার করেন।
পদার্থবিজ্ঞানে প্রচুর জ্ঞান রাখা ড. আব্বাসি ইরানের আণবিক সংস্থার তৎকালীন প্রধান ছিলেন। অস্ত্রের উন্নতির জন্য লেজার প্রযুক্তি নিয়েও গবেষণা করতেন তিনি। লেজার প্রযুক্তি গোলা বা রকেটের লক্ষ্য ভেদ করার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও ইরানের হাতে গোনা কয়েকজন আইসোটোপ পৃথকীকরণ বিশেষজ্ঞের মধ্যে তিনি একজন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে অসহযোগিতার অভিযোগে ২০০৭ সালে জাতিসংঘ তার ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং বিদেশে থাকা সমস্ত সম্পদ জব্দ করার হুকুম দেয়। প্রাথমিক তদন্ত করলেও তেহরান পুলিশ ঘটনার হোতাদের ধরতে ব্যর্থ হয়।
মাসুদ আলী মোহাম্মদী
প্রতিভাবান এই গবেষক ইরানের বিখ্যাত শারিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। গোপনে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সাথে বেশ ভালোভাবেই যুক্ত ছিলেন। ইরানের অভিজাত রেভ্যলুশনারি গার্ডের সাথে তার সম্পৃক্ততা আছে বলে শোনা যায়। ২০০৯ সালে হজ্জ করতে গিয়ে তিনি প্রথম বুঝতে পারেন, কেউ তাকে অনুসরণ করছে।
তিনি ভেবেছিলেন, স্বদেশের মাটি তার জন্য নিরাপদ। কিন্তু ২০১০ সালের এক সকালে বাড়ির থেকে বের হয়ে গাড়িতে উঠার সময় একটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। পাশের এক মোটরবাইকের সাথে একটি বোমা বাঁধা ছিল। সেটি এতই শক্তিশালী ছিল যে আশেপাশের বাড়ির কাঁচ পর্যন্ত শক-ওয়েভে ভেঙে যায়।
২০০৯ সালে উইকিলিকসের ফাঁস করা এক মার্কিন তারবার্তা বিশ্লেষণ করে ইরান সন্দেহভাজন একজনকে আটক করে। আটক মজিদ জামালি মোসাদের সাথে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করে এবং ২০১১ সালে তার ফাঁসি হয়।
দারিউশ রেজায়ি
৩৫ বছর বয়সী পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক দারিউশ রেজায়ি ইরানের বুশেহর পরমাণু প্রকল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশলী ছিলেন। বিকাল ৪টা ৩০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লাস নিয়ে ফেরার সময় মোসাদের দুই এজেন্ট তাকে অনুসরণ করে। দক্ষিণ তেহরানের অভিজাত এলাকা বনি হাশেম স্ট্রিটে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই গুলি করা হয় তাকে। পশ্চিমাদের বিশ্বাস, বুশেহর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আড়ালে ইরান পারমাণবিক বোমা তৈরি করছিল। এটিতেও কোনো ক্লু পায়নি পুলিশ।
মোস্তফা আহমাদ রোশান
৩২ বছর বয়সী কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আহমাদ রোশান ইরানের নাতাঞ্জ পারমাণু কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। ২০১২ সালের ১১ জানুয়ারি প্রতিদিনকার মতো উত্তর তেহরানের রাস্তা দিয়ে গাড়িতে করে যাওয়ার সময় হঠাৎ তার গাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে। প্রত্যক্ষদশীরা জানায়, মোটরসাইকেল থেকে দুজন লোক কিছু একটা গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ পরে বের করে, গাড়িতে চুম্বক সংযুক্ত বোমা বসানো হয়েছিল। কয়েক মুহূর্ত পরেই বিস্ফোরণ ঘটে। শক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করতে না পারলেও এটা প্রায় নিশ্চিত, ইরানের বিপ্লব বিরোধী গোষ্ঠী মুজাহিদিন-ই খালকের সহায়তায় এই বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে মোসাদ।
ধারণা করা হয়, সে সময় ইরানের পুলিশ এবং গোয়েন্দা দপ্তরের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া বিভিন্ন বার্তায়ও আড়ি পেতেছিল মোসাদ এজেন্টরা।
জেরাল্ড বুল
অনেকের কাছে তিনি এক খ্যাপাটে বিজ্ঞানী। দূরপাল্লার কামান নিয়ে গবেষণা করতেন। সাদ্দামের সাথে পরিচয়ের পর পশ্চিমা আর্টিলারির আদলে তিনি ইরাককে কয়েকটি মডেলের কামান তৈরি করে দেন। শেষমেশ হাত দেন ব্যবিলন নামের দুই ধরনের সুপার গান তৈরির কাজে। সম্ভবত সাদ্দাম হোসেন তাকে এই কাজে অর্থায়ন করছিলেন এবং ইসরায়েলের ধারণা ছিল বুল সফল হলে ইসরায়েলের ভূখণ্ড ব্যবিলনের আওতায় চলে আসবে।
১৯৯০ সালের ২০ মার্চ। দরজায় ঘণ্টা বাজলে বুল দরজা খুলতে যান। খুলতেই একঝাঁক গুলি তাকে বিদ্ধ করে। ইসরায়েল গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়, সাদ্দামের সাথে মতের অমিল হওয়ায় তাকে ইরাকীরা হত্যা করেছে, যদিও পরে মোসাদের সংশ্লিষ্টতা চাপা থাকে না। ব্যবিলনের খুচরা যন্ত্রাংশ ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশের কাস্টমসে জব্দ করা হয়।
মোহাম্মদ জাওয়ারি
হামাসের আল কাসসাম ব্রিগেডের হয়ে কাজ করা সামরিক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ জাওয়ারি ১০ বছর ধরে ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। ৪৯ বছর বয়সী এই প্রকৌশলী আবাবিল নামের একটি ড্রোন তৈরি করছিলেন। ২০১৪ সালে আবাবিল প্রথম স্বল্পমাত্রায় ব্যবহার করা হলেও ধারণা করা হয়, এতে কোনো অস্ত্র ছিল না। জাওয়ারি আবাবিলকে অস্ত্র বহনের উপযোগী করে তুলছিলেন। আল জাজিরার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তিনি হামাসের ড্রোন প্রজেক্টের দলনেতা ছিলেন।
২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বরে তিউনিশিয়ার সফক্স শহরে গাড়ি চালানোর সময় হঠাৎ করেই একটি ট্রাক এসে তার পথ আটকে দাঁড়ায়। সাইলেন্সার লাগানো বন্দুক থেকে ২০টি গুলিতে তাকে ঝাঁঝরা করে দেয়। ঘটনাস্থলের পাশেই একটি ক্যাফের সিসিটিভিতে সবকিছু ধরা পড়ছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, অজ্ঞাত কোনো হ্যাকার সিসিটিভিটি অচল করে রেখেছে এবং সব ফুটেজ ডিলিট করে দিয়েছে। ধারণা করা হয়, সাংবাদিক ছদ্মবেশে একজন মোসাদ এজেন্ট তার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ইসরায়েল তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়।
জাওয়ারির সহকারী অল্পের জন্য সেখান থেকে বেঁচে ফিরে আসে। তবে অনেকেরই ধারণা, একজন প্রত্যক্ষদর্শী রাখতেই মোসাদ তার সহকারীকে প্রাণে মারেনি, যাতে এই হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা সবাই জানতে পারে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যাবার সাহস না পায়।
ফাদি আল–বাৎশ
শিক্ষায় অন্যতম সফল এই ফিলিস্তিনি নাগরিক ২০১১ সালে উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে মালয়েশিয়া আসেন। কুয়ালালামপুর ইউনিভার্সিটি অব মালায় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি শিক্ষকতা এবং গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ২০১৩ সালে তিনি ড্রোন প্রযুক্তির উপর একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি নিজের প্রতিভার ছাপও রাখেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পুরষ্কার। খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা হয়, ফাদি হামাসের জন্য রকেট আধুনিকায়নের কাজ করছিলেন।
প্রতিদিনের মতো ২১ এপ্রিল সকালে নামাজ পড়তে বেড়িয়েছিলেন ফাদি। মসজিদের সামনে আসতেই ২০ মিনিট ধরে মোটরবাইকে অপেক্ষা করা দুই গুপ্তঘাতক ১০টি গুলি চালায় তাকে লক্ষ্য করে। এর মধ্যে ৪টি গুলি তার মাথায় বিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার। মালয়েশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী আহমাদ ঘটনার জন্য কারো নাম উল্লেখ না করে ‘একটি বিদেশী সংস্থা’র কথা বলেন। তবে এটি সবার কাছেই পরিষ্কার, এই হত্যার পেছনে মোসাদ ছাড়া আর কেউ নেই।