প্রায় দুইশ বছর পর ফের সরগরম পানিপথ প্রাঙ্গন। লাখো সৈনিকের আর্তনাদের সাক্ষী এই পানিপথ ময়দান ফের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। ময়দানের এক প্রান্তে অপেক্ষা করছেন আফগান শাসক আহমেদ শাহ আবদালী এবং তার মিত্রপক্ষীয় সেনাদল। অপরপক্ষে মারাঠা শিবিরে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। প্রায় দুই মাস ধরে এই ময়দানে অবস্থান করছে এই দুই দল। হাতি, ঘোড়া, পদাতিক সেনা এবং গোলন্দাজ বাহিনী দ্বারা সজ্জিত দুই সেনাদল অপেক্ষা করছিলো তাদের দলপতির সবুজ সংকেতের। আজ তাদের সেই অপেক্ষার পালা শেষ হলো।
শক্তি এবং সংখ্যায় দু’দলই সমান। একদিকে ভারতবর্ষের বুকে আফগান শাসন পাকাপাকিভাবে কায়েম করতে অটল আবদালী বাহিনী। অপরদিকে যুদ্ধবাজ মারাঠারা। ভারতের বুকে শত শত যুদ্ধ জয়ের গৌরব অর্জনকারী মারাঠাদেরকে ‘অপ্রতিরোধ্য’ হিসেবে গণ্য করা হয়। মোঘল পরবর্তী যুগে মারাঠা শাসন টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর তারা। তাদের নেতৃত্বে আছেন সাদাশিভরাও ভাও। সময় যেন থমকে দাঁড়ালো পানিপথ প্রাঙ্গনে। আহমেদ শাহ আবদালী তার সেনাপ্রধানের দিকে একবার তাকালেন। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানানো মাত্র আফগানরাও যুদ্ধের নিশান উড়িয়ে দিলো। হুংকার দিতে দিতে ক্ষিপ্রগতিতে অগ্রসর হতে থাকলো মারাঠাদের দিকে। শুরু হয়ে গেলো পানিপথের যুদ্ধ; তৃতীয়বারের মতো।
পানিপথের প্রাঙ্গন যেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের আরেক নাম। এর আগে প্রথম এবং দ্বিতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসে বড় রকমের পরিবর্তন আসে। মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থানের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে পানিপথের দুটি যুদ্ধ। তেমনি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধও ইতিহাসের পাতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী।
‘পানিপথের যুদ্ধ’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রবন্ধে আমাদের শেষপর্ব পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ। প্রবন্ধের প্রথম দুই পর্বের লিংক:
১. পানিপথের প্রথম যুদ্ধ: মোঘল সূর্যোদয়ে অস্তমিত দিল্লী সালতানাত
২. পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ: মহামতি আকবরের উত্থান উপাখ্যান
যুদ্ধের পটভূমি
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভারবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় পানিপথ প্রান্তরে। এই যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে এই যুদ্ধের দুইপক্ষ মারাঠা এবং আহমেদ শাহ আবদালীর উত্থান সম্পর্কে।
মোঘলদের পতন
১৭০৭ সালে মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর ভারতবর্ষে ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। মোঘলদের প্রতিপত্তি এবং সাম্রাজ্যের প্রদীপ নিভু নিভু অবস্থায় জ্বলতে থাকে। ১৭৩৯ সালে পারস্যের শাসক নাদির শাহ ভারতবর্ষ আক্রমণ করে বসেন। নাদির শাহের সেনাদলের নিকট মোঘলরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। তিনি ভারতবর্ষের গৌরব ‘ময়ূর সিংহাসন’ লুট করে ইরানে নিয়ে যান। ময়ূর সিংহাসনের শীর্ষে অলঙ্কৃত বিশ্ববিখ্যাত কোহিনূর হিরা এর মাধ্যমে মোঘলদের হাতছাড়া হয়ে যায়।
নাদির শাহের অভিযানের মাধ্যমে ভারতের বুকে মোঘলদের প্রতিপত্তির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। স্থানীয় নেতারা মোঘলদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। দিকে দিকে বিভিন্ন বিদ্রোহী দল মোঘলদের অধীনে থাকা জয়গীর, মহকুমা, গ্রাম এবং রাজ্যগুলো দখল করতে থাকে। মোঘলদের শাসন যখন একদম শেষের দিকে, ঠিক তখন ভারতবর্ষের বুকে উত্থান হয় মারাঠা শক্তির। মারাঠা জাতি মোঘলদের অধীনে থাকা দাক্ষিণাত্য (Deccan) প্রদেশের সিংহভাগ দখল করে নেয়।
অপরদিকে মোঘলদের পতনের কারণে ক্ষমতা দখলের জের ধরে ভারতবর্ষের স্থানীয় মুসলিম সভাসদরা বিদেশি মুসলিম সভাসদদের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। উচ্চাভিলাষী মারাঠারা স্থানীয় মুসলিমদের সাথে হাত মেলায়। এর ফলে তারা সক্রিয়ভাবে দিল্লীর রাজনীতিতে প্রবেশ করে। মারাঠারা বিদেশী আগ্রাসনের হাত থেকে দিল্লীর মসনদ মুক্ত রাখার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। বিনিময়ে তারা পুরো ভারতবর্ষে ‘চৌথ’ এবং ‘সরমুখি’ নামক কর আদায়ের অধিকার লাভ করে।
আবদালীর ভারত অভিযান
অপরদিকে বিদেশী মুসলিমরা আফগান অধিপতি আহমেদ শাহ আবদালীর নিকট দিল্লীর মসনদ পুনরুদ্ধারের জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। আহমেদ শাহ আবদালী তাদের ডাকে সাড়া দেন। তিনি বিশাল সেনাবহর নিয়ে ভারতবর্ষ অভিযানে বের হন। সময়টা তখন ১৭৫২ সাল।
বিভক্ত ভারতবর্ষের স্থানীয় নেতারা আবদালী বাহিনীর চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ছিলেন। আবদালী খুব সহজে কাশ্মীর, মুলতান এবং পাঞ্জাব দখল করে নেন। মুলতানের সম্রাট আহমেদ শাহ আফগানদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। আবদালী মুইন-উল-মুলককে মুলতান এবং পাঞ্জাবের সুবেদার নিয়োজিত করেন। ১৭৫৩ সালে মুইন-উল-মুলক মৃত্যুবরণ করলে তার বিধবা স্ত্রী মুঘলানি বেগম ক্ষমতা দখল করে নেন। আহমেদ শাহ আবদালী এরপর দিল্লীর মসনদ দখলের উদ্দেশ্যে তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু রণকৌশলে পটু আবদালী বুঝতে পেরেছিলেন, তার একার পক্ষে এই অচেনা দেশ দখল করা সম্ভব নয়। তাই তিনি দিল্লী আক্রমণের পূর্বে অভ্যন্তরীণ রাজ্য থেকে মিত্র জোগাড় করতে থাকেন। অপরদিকে মারাঠারাও ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। ভারতবর্ষের বাতাসে যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
মারাঠা-আফগান খণ্ডযুদ্ধ
ভারতবর্ষে অভিযানের পরপরই আহমেদ শাহ আবদালী সরাসরি পানিপথ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি। পানিপথের পূর্বে মারাঠাদের সাথে তিনি বেশ কিছু খণ্ডযুদ্ধে লিপ্ত হন। মারাঠারা আবদালীর অভিযান রুখে দিতে বিভিন্ন রাজ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। অপরদিকে দিল্লীর রাজনীতিতেও অভিনব পরিবর্তন সাধিত হয়। ১৭৫৪ সালে মারাঠারা উজির গাজী উদ্দীনের সাহায্যে বাদশাহ দ্বিতীয় আলমগীরকে দিল্লীর মসনদে অধিষ্ঠিত করেন। মারাঠা দলের অধিপতি হিসেবে আবির্ভূত হন রঘুনাথ রাও। কিন্তু দিল্লীর সভাসদদের অনেকেই এই সিদ্ধান্তে নাখোশ হন। এদের মধ্যে নজিব-উদ-দৌলা প্রধান ছিলেন। তিনি আহমেদ শাহ আবদালীর সাথে হাত মেলানোর জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন।
ওদিকে ১৭৫৬ সালে মারাঠাদের সাহায্যে উজির গাজী উদ্দীন মুলতানের সিংহাসন থেকে মুঘলানি বেগমকে অপসরণ করেন। এই সংবাদ আবদালীর কানে পৌঁছালে তিনি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে যান। তিনি তৎক্ষণাৎ মুলতান এবং পাঞ্জাব আক্রমণ করেন এবং মারাঠাদের হটিয়ে দেন। এবার তিনি তার সন্তান তৈমুর খানকে পাঞ্জাবের দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৭৫৭ সালে আবদালী দিল্লী আক্রমণ করে বসেন এবং বিজয় লাভ করেন। আনুগত্যের উপহারস্বরূপ নজিব-উদ-দৌলাকে দিল্লীর ‘মীর বখশী’ হিসেবে নিয়োজিত করে তিনি কাবুলে ফিরে যান। কিন্তু মারাঠারা তখনও দমে যায় নি। এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় তারা। রঘুনাথ রাও বিশাল বাহিনী নিয়ে দিল্লী এবং পাঞ্জাব আক্রমণ করেন। তিনি নজিব-উদ-দৌলাকে দিল্লী থেকে হটিয়ে দেন এবং আহমেদ শাহ বাঙ্গাশ নামক এক সভাসদকে দিল্লীর মীর বখশী হিসেবে দায়িত্ব দেন। পাঞ্জাবে তৈমুর খান মারাঠাদের নিকট পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান। সেখানে নতুন শাসক হিসেবে আদিনা বেগের আগমন ঘটে। এভাবে দুই প্রভাবশালী সেনাপ্রধানের আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে ক্ষমতার দ্রুত পালা বদল ঘটতে থাকে।
মারাঠা নেতৃত্বের পরিবর্তন
১৭৫৯ সালে মারাঠা সরদার দত্তজি সিন্ধিয়া দিল্লীতে রঘুনাথ রাও-এর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি সাবাজি সিন্ধিয়াকে পাঞ্জাবের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং নজিব-উদ-দৌলাকে বন্দী করেন। দিল্লী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় আবদালীকে পুনরায় ভারত অভিযান পরিচালনা করতে হয়। সেবার আবদালীর সাথে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মারাঠারা পরাজিত হয়। যুদ্ধে দত্তজি আফগানদের হাতে নিহত হন।
এবার আবদালী বাহিনীর নিকট সিন্ধিয়া বাহিনী পরাজিত হলে মারাঠা নেতৃত্বে বড় রকমের পরিবর্তন হয়। মারাঠাদের নতুন অধিপতি হিসেবে দৃশ্যপটে আবির্ভাব ঘটে সাদাশিভরাও ভাও-এর। তিনি ভারত থেকে চিরতরে আবদালীকে বিতারণ করার লক্ষ্যে উঠেপড়ে লাগেন। ওদিকে আবদালী নজিব-উদ-দৌলার অনুরোধে মারাঠাদের নিশ্চিহ্ন করার পূর্ব পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নেন। এমতাবস্থায় দু’পক্ষই বিভিন্ন স্থানীয় নেতাদের সাথে মিত্রতা করতে থাকে। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে দলে দলে সৈনিকরা এসে যোগ দিতে থাকে যুদ্ধে।
দুই বাহিনীর বর্ণনা
মারাঠা এবং আফগান দু’দলই যুদ্ধকৌশলে সমান পারদর্শী ছিল। মারাঠারা পূর্বে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতাপের সাথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধজয় করে এসেছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারলো, আফগানদের হারাতে হলে তাদের আরো শক্তিশালী ফৌজ গঠন করতে হবে। তাই তারা স্থানীয় নেতাদের নিকট মিত্রতার প্রস্তাব প্রেরণ করে।
মারাঠাদের সাথে সিন্ধিয়া, বুন্দেল, হলকার, জাত, ইব্রাহিম খান গার্দির গোলন্দাজ বাহিনী এবং গাইখন্দের যোদ্ধারা হাত মেলায়। ফলে সাদাশিভরাও ভাও এক বিশাল সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠন করতে সক্ষম হন। ভাও ফরাসিদের নিকট থেকে গোলাবারুদও আমদানি করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করলে দিল্লীর মসনদে তার ভাগ্নে বিশ্বরাওকে আসীন করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি। যুদ্ধের কিছুদিন আগে জাতরা মারাঠাদের মিত্রতা ত্যাগ করলে সাদাশিভরাও ভাও খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েন। কিন্তু জাত, রাজপুতসহ প্রভৃতি জাতিদের সাহায্য ব্যতিরেকেই মারাঠারা বেশ শক্তিশালী ফৌজ গঠন করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে বসে নেই আফগানরাও। রোহিলার নজিব-উদ-দৌলা এবং অযোদ্ধার নবাব সুজা-উদ-দৌলা আফগানদের সাথে যুদ্ধে যোগদান করে। আবদালীর নেতৃত্বে সুদক্ষ গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে উঠে।
প্রায় এক লক্ষ সেনার বিশাল বাহিনী নিয়ে মারাঠারা যমুনা নদীর তীরে কুঞ্জপুরে প্রথম আফগানদের উপর আক্রমণ চালায়। বন্যা কবলিত যমুনার বিপরীত তীরে আবদালী তার বাহিনীর একাংশ নিয়ে আটকা পড়ে গেলে আফগানরা বিপদে পড়ে যায়। সেই যুদ্ধে মারাঠারা আফগানদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। এই পরাজয়ে আহমেদ শাহ আবদালী অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি অভিনব উপায়ে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে যমুনা পাড়ি দেন। মারাঠারা যুদ্ধ জয়ের আনন্দে এতটাই বিভোর ছিল যে, তারা আফগানদের যুদ্ধকৌশল ধরতে ব্যর্থ হয়। বুদ্ধিমান আবদালী এই সুযোগে মারাঠাদের ঘেরাও করে ফেলেন। তার নির্দেশে মারাঠাদের রসদ সঞ্চয় পথ বন্ধ করে দেয়া হয়। কোণঠাসা মারাঠারা নিরুপায় হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে দু’দল পানিপথ প্রান্তরে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হতে থাকে।
পানিপথের যুদ্ধে মুখোমুখি আফগান-মারাঠা
১৪ জানুয়ারি, ১৭৬১ সাল। সকাল থেকেই দুই বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়া শুরু করে। প্রথমে আহমেদ শাহ আবদালী তার সেনাদলকে যুদ্ধের ময়দানে অগ্রসর হতে আদেশ দেন। মারাঠারাও প্রস্তুত ছিল। আফগানদের হুংকারের প্রতিউত্তরে তারাও গগণবিদারী হুংকার দিয়ে ক্ষিপ্রগতিতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। শুরু হয়ে গেলো পানিপথের ঐতিহাসিক যুদ্ধ।
প্রথমেই মারাঠারা রোহিলা বাহিনীর উপর চড়াও হয়। হাজার হাজার মারাঠা সেনার মুহুর্মুহু আক্রমণে রোহিলা বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। তবে অপরদিকে আফগান বাহিনীও সমান তালে মারাঠাদের আক্রমণ করতে থাকে। আবদালীর পদাতিক বাহিনী মারাঠাদের মধ্যভাগ ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু ভাও-এর নেতৃত্বে তারা নতুন করে আক্রমণ শুরু করে। দু’দলই সমান তালে একে অপরকে আক্রমণ করতে থাকে। শত শত সৈনিক যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকে। পানিপথ প্রান্তর পুনরায় সৈনিকদের রক্তে লাল হয়ে যায়। যুদ্ধের কিছু সময় পর মারাঠা শিবিরে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃসংবাদের আগমন ঘটে যে, হলকারের সেনাপতি মালহার রাও তার বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ ময়দান হতে পলায়ন করেছেন।
সাদাশিভরাও ভাও এই সংবাদে হতভম্ব হয়ে যান। ওদিকে আবদালীর গোলন্দাজরা আক্রমণ করে মারাঠাদের পিছু হটাতে থাকে। মারাঠা গোলন্দাজ বাহিনী ইব্রাহিম খান গার্দির নেতৃত্বে আক্রমণ শুরু করে। তার দক্ষ আক্রমণের ফলে আফগানদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
কিন্তু মারাঠারা যুদ্ধ ময়দানে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। সাদাশিভরাও ভাও তার মিত্রবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিমসিম খেতে থাকেন। আবদালী এই সুযোগে চারদিক থেকে আক্রমণ পরিচালনা করেন। মারাঠারা পরাজয়ের ভয়ে পিছু হটা শুরু করে। সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে মারাঠারা চূড়ান্ত পরাজয় বরণ করে। সুসজ্জিত মারাঠা বাহিনীর লাশে পানিপথ প্রাঙ্গন হাহাকার করে উঠে। অপরদিকে আবদালী বাহিনীর বিজয়োল্লাস পানিপথের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে।
যুদ্ধের ফলাফল
এই যুদ্ধের মাধ্যমে এক সময়ের ‘অপ্রতিরোধ্য’ মারাঠাদের পতন ঘটে। যুদ্ধে সাদাশিভরাও ভাও, বিশ্বরাও, যশবন্ত রাও, তুকোজি সিন্ধিয়া প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ নেতার মৃত্যু ঘটে। ফলে নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পড়ে মারাঠা শিবির। যুদ্ধের পর আবদালী বাহিনী নির্বিচারে সাধারণ মারাঠা জনগণ হত্যা শুরু করে। ইতিহাসবিদদের মতে, সেদিন মহারাষ্ট্রে এমন কোনো পরিবার ছিল না, যার কেউ যুদ্ধে নিহত হয়নি। যুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার থেকে ৭০ হাজার মারাঠা নিহত হয়। আফগান বাহিনীরও প্রচুর প্রাণহানি ঘটে।
যুদ্ধের পর আহমেদ শাহ আবদালী দিল্লীর সিংহাসনে আসীন হন। ভারতবর্ষে আফগান শাসনের নতুন সূচনা ঘটে। কিন্তু তিনি বেশিদিন দিল্লী শাসন করতে পারেননি। আফগানিস্তানে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করতে তিনি দ্রুত দেশে ফেরত যান। আবদালীর স্থলে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম। কিন্তু রাজনৈতিক জটিলতা এবং ঐক্যের অভাবে ভারতবর্ষে আফগান শাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই সুযোগে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী শাসকগোষ্ঠীর সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় এবং ক্রমান্বয়ে ভারতবর্ষ দখল করে ফেলে।
এভাবেই পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের মাধ্যমে আরো একবার ভারতবর্ষের ইতিহাস নতুন মোড় নেয়। হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী শক্তিশালী ভারতবর্ষের মৃত্যুতে জন্ম নেয় এক পঙ্গু ভারতবর্ষ। যার স্বাধীনতার প্রদীপ নিভু নিভু অবস্থায় জ্বলতে থাকে আরও কয়েকটি বছর। পানিপথের সেই স্মৃতিকে পুঁজি করে রচিত হয় হাজার হাজার গল্প, কবিতা, উপন্যাস। মঞ্চায়িত হয়েছে ঐতিহাসিক নাটক। পানিপথের সেই যুদ্ধ হয়তো আজ আর নেই, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় চিরকাল বেঁচে থাকবে পানিপথ।
ফিচার ইমেজ: Yuga Parivartan