মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা সত্যিই কষ্টকর। তখন ছবি, ভিডিও আর ব্যবহার্য নানা জিনিসপত্রের মধ্য দিয়েই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকেন সেই ব্যক্তি। আধুনিক যুগে এগুলোর সাথে যুক্ত হয়েছে সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে সেই ব্যক্তির করা বিভিন্ন পোস্ট, কমেন্ট ইত্যাদি। তবে সবাই এভাবে মৃত প্রিয়জনকে শুধু মানসিকভাবে স্মরণ করেই সন্তুষ্ট থাকেন না, তারা তাকে পেতে চান শারীরিকভাবেই!
এজন্য নানা পদ্ধতি অবলম্বন করে মৃতব্যক্তির দেহকে সংরক্ষণ করার বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করেন তারা। মৃতব্যক্তির দেহ সংরক্ষণের বিচিত্র সেসব পদ্ধতি নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
মমি
মৃতদেহ সংরক্ষণ কথাটি শুনলে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম সিনেমার কল্যাণে আমাদের মাথায় সবার আগে যে শব্দটি আসে তা হলো ‘মমি’। এজন্য শরীরের ভেতর থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে বিভিন্ন পচনশীল পদার্থ বের করে সেখানে অন্যান্য পদার্থ দিয়ে পূর্ণ করে দেয়া হতো। এরপর সেই দেহটি সাদা কাপড়ে মুড়ে দিয়ে একে রাখা হতো বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত এক বাক্সে।
পুরো মমিকরণ পদ্ধতি নিয়ে একটি সচিত্র বর্ণনাভিত্তিক লেখা রোয়ার বাংলায় লিখেছিলাম প্রায় মাস তিনেক আগে। আগ্রহীরা এই লেখাটি পড়ে নিতে পারেন- প্রাচীন মিশরীয়রা মৃতদেহ থেকে যেভাবে মমি বানাতো (সচিত্র বর্ণনা)
আতশবাজি
রাতের আকাশে আতশবাজির বর্ণিল ছটা পছন্দ করেন না এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে কেউ কেউ এ বিষয়টিকে এতটাই পছন্দ করেন যে এখানেই নিজের শেষ দেখতে চান। এক্ষেত্রে মৃতদেহের অবশিষ্টাংশকে প্রথমে আতশবাজির দাহ্য পদার্থগুলোর সাথে ভালোভাবে মেশানো হয়। পরবর্তীতে যখন সেটি আকাশে বিষ্ফোরিত হয়, তখন সেই অবশেষ ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে, ভেসে চলে বাতাসে!
পেপারওয়েট
আমাদের আশেপাশেই এমন অনেকের দেখা মেলে, যারা কিনা কাজের মাঝেই খুঁজে পান জীবনের প্রকৃত আনন্দ। আর কাজপাগল সেই মানুষগুলোর জন্যই অদ্ভুত এ সৎকার পদ্ধতি।
এজন্য দরকার হয় মৃতব্যক্তির দেহের ছাই। একেকটি পেপারওয়েট বানাতে মোটামুটি আধা চা-চামচ পরিমাণ ছাই লাগে। সেই ছাইকে এরপর রঙিন কাঁচের উত্তপ্ত মিশ্রণের সাথে মিশিয়ে হরেক রকম ডিজাইনের পেপারওয়েট তৈরি করা হয়। বাইরে থেকে পেপারওয়েটের ভেতরের সেই ছাই দেখার ব্যবস্থাও রাখা হয়।
টেডি বিয়ার
আমাদের অনেকেরই অত্যন্ত পছন্দের এক নির্জীব সঙ্গী হলো টেডি বিয়ার। ‘হাউ কিউট’, ‘সো সুইট’ হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে প্রায় সময়ই পরিচিতজনদের তাদের টেডি বিয়ারের সাথে ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ছবি আপলোড করতে দেখা যায়।
এসব দেখেই অদ্ভুত এক মৃতদেহ সংরক্ষণ পদ্ধতির আইডিয়া নিয়ে এসেছে কিছু কোম্পানি। এ লক্ষ্যে তারা প্রথমে মৃতব্যক্তির দেহের ছাই সংগ্রহ করে নেয়। এরপর সেই ছাইকে কোনো একটি পাত্রে রেখে সেই পাত্রটি ঢুকিয়ে দেয়া হয় একটি টেডি বিয়ারের ভেতরে! কেন? যাতে করে সেই টেডি বিয়ারকে জড়িয়ে ধরলে একজন ব্যক্তি তার সেই হারানো প্রিয়জনের ছোঁয়াই খুঁজে পান!
ডায়মন্ড
টেডি বিয়ারকে তো আর সারাক্ষণ কোলে করে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায় না। তাই কেউ কেউ চিন্তা করলেন এমন কোনো এক পদ্ধতির কথা, যাতে করে চিরবিদায় নেয়া প্রিয়জনকে সবসময় কাছে রাখা যায়। আর সেখান থেকেই এসেছে ডায়মন্ডের ধারণা।
এজন্য মৃতব্যক্তির ভস্মকে প্রথমে প্রায় ৫,০০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় উত্তপ্ত করা হয়। এরপর নন-কার্বন পদার্থগুলোকে অক্সিডাইজেশনের করে কার্বনকে গ্রাফাইটে রুপান্তরিত করা হয়। এরপর প্রভাবকের উপস্থিতিতে উচ্চ তাপ ও উচ্চ চাপে একে ক্রিস্টালে পরিণত করা হয়। সবশেষে সেই ক্রিস্টালকে খদ্দেরের পছন্দের আকারে কাটা হয়। এভাবে পুরো প্রক্রিয়াটি সারতে কয়েক মাস লেগে যায়।
গ্রাহকের রঙ ও আকারের চাহিদা ভেদে এমন একেকটি ডায়মন্ডের দাম ২,০০০ থেকে ২৫,০০০ ইউএস ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সেই ডায়মন্ডকে কেউ কেউ আবার তাদের ব্যবহৃত অলঙ্কারে লাগিয়েও ঘোরেন!
রেজোমেশন (Resomation)
শবদাহেরই আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে এই রেজোমেশনকে। এজন্য মৃতদেহকে পানি ও লাই (Lye – ধোয়ামোছায় ব্যবহৃত তরল ক্ষারবিশেষ) এর মিশ্রণের সাথে উচ্চ চাপে প্রায় ৩২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপে উত্তপ্ত করা হয় রেজোমেটর (Resomator) নামক মেশিনে। এর ফলে মৃতদেহের সাদা বর্ণের ধুলোর মতো অবশেষ পাওয়া যায়। অপেক্ষাকৃত কম কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ ও শক্তি সাশ্রয়ী পদ্ধতি বলে অনেকেই একে পরিবেশবান্ধব বলে মনে করে থাকেন।
মহাশূন্যে মহাযাত্রা
রাতের আকাশে তারার সৌন্দর্যে বিমোহিত হওয়া মানুষেরা প্রায় সময়ই ভেবে থাকেন, “ইশ! আমিও যদি ঐ অন্তহীন মহাশূন্যে হারাতে পারতাম!” আশ্চর্য হলেও সত্য যে, তাদের জন্য আসলেই মহাশূন্যে বিলীন হওয়ার পদ্ধতি রয়েছে।
এজন্য অবশ্য সরাসরি মৃতদেহকে মহাশূন্যে পাঠানো হয় না, বরং পাঠানো হয় তার দেহভস্মকে। ১৯৯৭ সালে মানব ইতিহাসে প্রথম এমন ঘটনাটি ঘটেছিলো। সেইবার ২৪ জন মানুষের ছাইয়ের শেষ গন্তব্য হয়েছিলো মহাশূন্যে।
কেউ যদি আবার সাময়িকভাবে নিজের অবশেষকে মহাশূন্যে ঘুরিয়ে আবার পৃথিবীতে ফেরত আনাতে চান, তবে সেই ব্যবস্থাও রয়েছে। পদ্ধতিটি বেশ ব্যয়বহুল বলে (প্রতি পাউন্ড ছাইয়ের জন্য ১০,০০০ ইউএস ডলার) শুধুমাত্র ছাইয়ের কিছু অংশ পাঠানোর উপায় রয়েছে।
প্রমেশন (Promession)
এ পদ্ধতিটির উদ্ভাবন করেছিলেন সুইডেনের জীববিজ্ঞানী সুসান উইঘ-মাসাক। প্রমেশনে প্রথমে মৃতদেহকে শীতল করে নেয়া হয়। এরপর সেই দেহটিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সেই চূর্ণ থেকে পানি অপসারণ করা হয়। পরিশেষে প্রাপ্ত শুকনো মৃতদেহ চূর্ণকে ভূমির উপরিভাগে ছড়িয়ে দেয়া হয় যা বছরখানেকের মাঝে জৈব সারে পরিণত হয়।
সঙ্গীত
সুরের প্রতি আমাদের রয়েছে এক অন্যরকম ভালোবাসা। পছন্দের কোনো গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটে যায়, তা অনেকেরই খেয়াল থাকে না। সেই সাথে ইয়ারফোনটা কানে গুঁজেও চলে অনেকের সঙ্গীত শ্রবণচর্চা।
সঙ্গীতপিপাসু মানুষদের শবদাহের মাধ্যমে প্রাপ্ত দেহাবশেষ এক বিশেষ উপায়ে সঙ্গীতের মাঝেই মিশিয়ে দেয়ার পদ্ধতি নিয়ে এসেছে ব্রিটিশ এক প্রতিষ্ঠান, নাম AndVinyly। বিশেষভাবে প্রস্তুতকৃত ভিনাইল রেকর্ডে মৃত ব্যক্তির দেহভস্ম মেশানোর এ প্রক্রিয়ার খরচের অঙ্কের শুরুটা ৩,০০০ পাউন্ড থেকে।
অবশ্য এটি তৈরিতে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। ছাইয়ের পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে রেকর্ডটি লাফিয়ে ওঠে মাঝে মাঝেই। একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার আগেই তার পছন্দের গান ও অ্যালবামের উপরের ডিজাইন জমা দিতে হয় কোম্পানিটির কাছে। মৃত্যুর পর ছাই দিয়ে তৈরি ভিনাইল রেকর্ডের ৩০ কপি চলে যায় তার প্রিয়জনদের ঠিকানায়।
প্রবাল
যুদ্ধ-বিগ্রহ কিংবা প্রাকৃতিক কারণে যারা সমুদ্রের বুকে মৃত্যুবরণ করেন, তাদের মৃতদেহ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়ার ইতিহাস বহু পুরনো। তবে স্থলভূমিতে মারা গিয়েও প্রবালের মাঝে নিজেকে মিশিয়ে সমুদ্রের তলদেশে চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চাওয়ার বিচিত্র এ শখের জন্ম গত শতকের শেষের দিকে।
এক্ষেত্রে প্রথমে মৃতব্যক্তির ছাইকে কনক্রিটের সাথে মিশিয়ে প্রবালের বল বানানো হয়। এরপর সেই বলকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ দিকে সমুদ্রোপকূলের নির্দিষ্ট জায়গায় মৃত ব্যক্তি বা তার প্রিয়জনদের পছন্দের জায়গায় ডুবিয়ে দেয়া হয়। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এভাবে নিজেদের দেহভস্ম সমুদ্রের তলদেশে রাখা মানুষের সংখ্যা প্রায় ১,৮০০।
ট্যাটু
শরীরের বিভিন্ন অংশে ট্যাটু আঁকানোর শখ আছে অনেকের। বিভিন্ন রকম নকশা, প্রতীক, প্রিয়জনের নাম ইত্যাদি থাকে সেসব ট্যাটুতে। তবে কিছু কিছু মানুষ এই ট্যাটুর সাথেও মৃত প্রিয়জনদের এক বিশেষ উপায়ে সংযুক্ত করে নিয়েছেন। এজন্য আগের মতোই তারা বেছে নেন চলে যাওয়া মানুষটির দেহভস্ম।
ছাইকে প্রথমে ভালো করে ছেঁকে সেখান থেকে বড় অংশগুলো ফেলে দেয়া হয়। এরপর সেই ছাইয়ের মিহি দানাগুলোকে আরো উত্তপ্ত করা হয় জীবাণুমুক্তকরণের উদ্দেশ্যে। এরপর সেখান থেকে সামান্য কিছু ছাই নিয়ে মেশানো হয় ট্যাটু আঁকতে ব্যবহৃত কালির সাথে। এভাবেই পরপারে পাড়ি জমানো প্রিয়জনকে শরীরে কোনো নকশার মাধ্যমে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন উদ্ভট রুচির একজন ট্যাটুধারী।
ছাইয়ের শিল্পকর্ম
মৃতব্যক্তির দেহভস্মের সাথে বিভিন্ন রঙ মিশিয়ে তাকে হাতে আঁকা বিভিন্ন ছবির মধ্য দিয়ে সংরক্ষণের কথা শুনে থাকবেন অনেকেই। একই সাথে কাঁচের নানা শিল্পকর্ম ও বিভিন্ন অলঙ্কারেও একই কৌশল কাজে লাগানো হয়ে থাকে।
মৃতব্যক্তিদের দেহ সংরক্ষণের ইতিহাস পড়তে পড়তে যদি বিভিন্ন রকম দেহ সৎকারের পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে হয়, তবে ঘুরে আসতে পারেন নিচের লেখাটি থেকে-