তৃতীয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ তথা ছয় দিনের যুদ্ধ চলাকালে, ১৯৬৭ সালের ৮ জুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএস লিবার্টি জাহাজের উপর অতর্কিতে জেট প্লেন এবং টর্পেডো দিয়ে আক্রমণ করে ইসরায়েল। ঐ আক্রমণে নিহত হয় মার্কিন নৌবাহিনীর ৩২ জন সদস্য এবং আহত হয় আরো ১৭১ জন। ঐ আক্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছিল আমাদের পূর্ববর্তী একটি লেখায়, যা আপনি পড়ে নিতে পারেন এখান থেকে।
ইউএসএস লিবার্টি ইনসিডেন্ট ছিল যুদ্ধজাহাজের বাইরে যেকোনো মার্কিন জাহাজের উপর আক্রমণের সবচেয়ে বড় ঘটনা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটিই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ নৌ-হামলা, যার কোনো সংসদীয় তদন্ত সংঘটিত হয়নি। কেন? কারণ প্রকাশ্যে দুর্ঘটনা দাবি করলেও তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন শুরুতেই জানতে পেরেছিলেন, ইসরায়েল এই হামলাটি চালিয়েছিল ইচ্ছাকৃতভাবেই। কিন্তু দুই রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্যই এই ভয়াবহ আক্রমণের মূল ঘটনা তারা চেপে যান ইচ্ছাকৃতভাবে এবং তদন্তকে প্রবাহিত করেন ভিন্ন খাতে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে মুহূর্তে ইসরায়েলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি রাষ্ট্রের ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে, ঠিক সে মুহূর্তে কেন ইসরায়েল তার ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকার একটি জাহাজে আক্রমণ করতে গেল? এর নিশ্চিত কোনো উত্তর এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল যেখানে দীর্ঘদিন পর্যন্ত স্বীকারই করেনি যে হামলাটি ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে করেছিল, সেখানে স্বভাবতই তাদের কাছ থেকে এর কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। তবে বিভিন্ন সময় এর সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন সাংবাদিক, গবেষক এবং লেখকরা বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন। সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হলেও তাদের ব্যাখ্যাগুলো পর্যালোচনা করলে এই হামলার কারণ সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
গোলান অভিযানের তথ্য গোপন করার জন্য
অধিকাংশ বিশ্লেষকের ধারণা, গোয়েন্দা কার্যক্রমে নিযুক্ত ইউএসএস লিবার্টি জাহাজটি হয়তো এমন কোনো তথ্য জেনে ফেলেছিল অথবা জানার সম্ভাবনা ছিল, যা ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে জানতে দিতে চায়নি। গোপন সে তথ্যটি কী হতে পারে, সেটি নিয়েও আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। তবে আক্রমণ থেকে বেঁচে আসা ক্রুরা ছাড়াও অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন ইসরায়েলের পরবর্তী যুদ্ধপরিকল্পনা জানতে না পারে, সেটাই ছিল এই আক্রমণের মূল লক্ষ্য। হামলার কয়েকদিন আগে থেকেই তেল আবিবে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের যোগাযোগ ব্যবস্থা জ্যাম করে দেওয়ার মধ্য দিয়েও এ সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তি পাওয়া যায়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র তো ইসরায়েলেরই মিত্র, তাহলে তারা ইসরায়েলের পরিকল্পনা জেনে ফেললে ক্ষতি কী? ব্যাপারটি হচ্ছে, বাইরের কোনো রাষ্ট্র যত ঘনিষ্ঠ মিত্রই হোক, তার বাইরেও প্রতিটি রাষ্ট্রেরই নিজস্ব কিছু স্বার্থ থাকে, যা তার ঘনিষ্ঠ মিত্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়। ছয়দিনের যুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের স্বার্থ ছিল ভিন্ন।
১৯৬৭ সালের ঐ যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি অংশগ্রহণ করেনি। এমনকি ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর উপর আক্রমণ করুক, এটাও যুক্তরাষ্ট্র চায়নি। কারণ সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে চরমভাবে পরাজিত হচ্ছিল। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে আরব রাষ্ট্রগুলোকে, বিশেষ করে মিসরকে সরাসরি সাহায্য করছিল তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরকম পরিস্থিতিতে আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা এড়াতে চাইছিল যুক্তরাষ্ট্র।
ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বাস দিয়েছিল, তাদের আক্রমণটি হবে খুবই সীমিত। কিন্তু বাস্তবে তাদের পরিকল্পনা ছিল আরো বিশাল। আর সে পরিকল্পনা যেন যুক্তরাষ্ট্র জেনে ফেলতে না পারে, সেজন্যই তারা যুদ্ধের সময় তেল আবিবে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসের যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো করে দিয়েছিল। আলজাজিরার ‘দ্য ডে ইসরায়েল অ্যাটাক্ড আমেরিকা‘ শিরোনামের ডকুমেন্টারিতে নির্মাতা রিচার্ড বেলফিল্ডও লিবার্টি জাহাজের বেঁচে আসা কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ উপসংহারই টেনেছেন যে, জাতিসংঘের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে সম্পূর্ণ অতর্কিতে সিরিয়ার গোলান উপত্যকায় পরের দিন আক্রমণ করার যে গোপন পরিকল্পনা ইসরায়েলের ছিল, সেটা যেন যুক্তরাষ্ট্র জেনে ফেলতে না পারে, সেজন্যই তারা সেদিন গোয়েন্দা কার্যক্রমে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। একই রকম দাবি করা হয় বিবিসির ‘ইউএসএস লিবার্টি: ডেড ইন দ্য ওয়াটার‘ ডকুমেন্টারিতেও।
ইসরায়েল জানত, ইউএসএস লিবার্টির মূল উদ্দেশ্য মিসর এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর গোয়েন্দাগিরি করা হলেও জাহাজটিতে হিব্রু ভাষা বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাও ছিল, যার কাজ ছিল ইসরায়েলি বেতার বার্তা ধারণ করা এবং তার মর্ম উদ্ধার করা। ইসরায়েলের ভয় ছিল, যুক্তরাষ্ট্র যদি তাদের পরিকল্পনা আগেই জেনে যায়, তাহলে নিজেদের স্বার্থেই তারা তা বাস্তবায়ন করতে বাধা দিবে। অন্যদিকে রাশিয়ান লেখক জোসেফ ডাইচম্যান তার ‘হিস্টরি অফ দ্য মোসাদ’ বইয়ে দাবি করেন, ইসরায়েলের নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই লিবার্টির উপর হামলা করা ইসরায়েলের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কারণ তাদের কাছে তথ্য ছিল, লিবার্টি জাহাজের সকল তথ্য সোভিয়েত গোয়েন্দাদের কাছে পাচার হয়ে যাচ্ছিল। তারা যদি জাহাজটিতে আক্রমণ না করত, তাহলে সোভিয়েতে ইউনিউনের কাছ থেকে মিসর এবং সিরিয়া তাদের পরিকল্পনা আগেই জেনে ফেলত।
আরিশ গণহত্যার তথ্য আড়াল করার জন্য
লিবার্টি জাহাজের উপর ইসরায়েলের ইচ্ছাকৃত হামলার সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে দ্বিতীয় একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, সে সময় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মিসরের আল-আরিশে প্রায় ১,০০০ মিসরীয় বন্দীকে হত্যা করেছিল। ইসরায়েলের ভয় ছিল, ইউএসএস লিবার্টি হয়তো এ তথ্য জেনে ফেলতে পারে এবং ভবিষ্যতে এ তথ্য তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এবিসি নিউজের প্রয়োজক জেমস ব্যামফোর্ড তার ‘বডি অফ সিক্রেটস‘ নামক বইয়েও এ অভিযোগ করেন। তবে ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে আল-আরিশ হত্যাকান্ডের দায় অস্বীকার করে। তারা দাবি করে, ১,০০০ মিসরীয় যুদ্ধবন্দী না, বরং সে সময় ২৫০ ফিলিস্তিনী সশস্ত্র যোদ্ধা তাদের সাথে গোলাগুলিতে নিহত হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য
লিবার্টিতে আক্রমণের কারণ হিসেবে বিবিসির ‘ডেড ইন দ্য ওয়াটার‘ ডকুমেন্টারিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটি সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরা হয়। সেখানে দাবি করা হয়, ইসরায়েলের আসল উদ্দেশ্য হয়তো ছিল এই হামলার দায় মিসরের উপর চাপানো, যেন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। বাস্তবে সত্যি সত্যিই লিবার্টিতে আক্রমণের সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের নির্দেশে ভূমধ্যসাগরে নিয়োজিত মার্কিন ষষ্ঠ নৌবহর থেকে আটটি যুদ্ধবিমান মিসরে আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যখন ইসরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে যে, তারাই ভুলক্রমে হামলাটি চালিয়েছিল, তখনই কেবল বিমানগুলো ফিরে আসে।
‘রিমেম্বার দ্য লিবার্টি‘ নামে একটি বই, যার লেখকদের মধ্যে লিবার্টি হামলা থেকে বেঁচে আসা কয়েকজন কর্মকর্তাও আছেন, দাবি করে যে, এই হামলার পেছনে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনও জড়িত ছিলেন। ইসরায়েলের সাথে মিলে তিনি এ হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন এই উদ্দেশ্যে, যেন হামলার জন্য মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরকে দোষারোপ করে সেই অযুহাতে যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে। কিন্তু তাদের মতে, জাহাজটি সম্পূর্ণ না ডুবে যাওয়ার কারণে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। সাংবাদিক পিটার হুমানের লেখা ‘অপারেশন সায়ানাইড‘ বইয়েও একই রকম দাবি করা হয়।
অন্যান্য তত্ত্ব
অধিকাংশ সাংবাদিক এবং লেখক মূলত উপরের তিনটি ব্যাখ্যার যেকোনো একটিকে গ্রহণ করেন, তবে এর বাইরেও কিছু দাবি আছে। যেমন, সাংবাদিক রাসেল ওয়ারেন হাউই তার ‘উইপন্স‘ নামক বইয়ে হামলা থেকে বেঁচে আসা কয়েকজন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে দাবি করেন, লিবার্টি জাহাজের ২০০ ফুট নিচে দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে একটি সাবমেরিন অবস্থান করছিল। উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েল যদি কায়রো, বাগদাদ অথবা দামেস্ক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানোর জন্য সাবমেরিন থেকে আক্রমণ করে ইসরায়েলের মিসাইল সাইটগুলো ধ্বংস করে দেওয়া। ইসরায়েল সেটা জানতে পেরেছিল বলেই লিবার্টির উপর আক্রমণ করেছিল।
আরেকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এসেছে ইসরায়েলি লেখক জন লোফটাসের ‘দ্য সিক্রেট ওয়ার অ্যাগেইনস্ট দ্য জিউজ‘ বইয়ে। সেখানে তিনি দাবি করেন, ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে লিবার্টির উপর আক্রমণ করেছিল, কারণ তারা জানতে পেরেছিল লিবার্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ইসরায়েলের গোপন তথ্যগুলো মিসরের কাছে পাচার করে দেওয়া, যেন তারা ইহুদীবাদী রাষ্ট্রটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ইতিহাস দেখলে এটিকে নিছকই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বলেই মনে হয়। কিন্তু বিপুল সংখ্যক ইসরায়েলি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে, আমেরিকানরা সহ পৃথিবীর সবাই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
ইউএসএস লিবার্টি প্রকৃত পক্ষেই কেন ধ্বংস করা হয়েছিল, সে রহস্য হয়তো কখনোই পুরোপুরি ভেদ হবে না। অথবা বিশ-ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছর পর পুরানো গোপন নথিপত্র অবমুক্ত করা হলে হয়তো বেরিয়েও আসতে পারে অজানা কোনো তথ্য। কিন্তু ততদিনে হয়তো তার কোনো গুরুত্ব থাকবে না। তবে এ ঘটনার মধ্যে যে বিষয়টি আবারও পরিষ্কার হয়, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শুধু মধ্যপ্রাচ্য বা অনুন্নত বিশ্বের জন্য না, বরং অনেক সময় তাদের নিজেদের নাগরিক এবং সামরিক বাহিনীর জন্যও ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়।