মিরাকল
মধ্য সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ – মার্চের শেষের দিক, ১৯৪৬
দিনগুলো পার হতে লাগলো। সেই সাথে আসতে থাকলো আরো দুঃসংবাদ।
মামা মারা গেলেন। তার গলার ভেতরটা এতটাই পুড়ে গিয়েছিল যে, তিনি আর কিছুই খেতে কিংবা পান করতে পারছিলেন না। যে মামা সাচিকোর জীবনটা বাঁচিয়েছিলেন, তিনিই চিরতরে চলে গেলেন।
নাগাসাকি থেকে আরো খারাপ খবর আসতে লাগলো। মা’র তেইশজন আত্মীয় মারা গিয়েছেন!
শিমাবারার বাড়িতে বাবা, মা, সাচিকো আর মিসা খুব কষ্টেই দিনাতিপাত করতে লাগলো। পাইন গাছে ঘেরা এ বাড়ির পাশের হ্রদটিই এককালে সাচিকো ডাকতো এই বলে যে, “আমার বুকে এসে সাঁতার কাটো।” কিন্তু সাচিকো নিজেও এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো যে, সে আর হ্রদটির ডাক শুনতে পাচ্ছিলো না। বরঞ্চ সে তার মৃত ভাইদের ডাকই শুনতে পেতো। তার প্রলাপ জুড়ে ছিলো আকি, ইচিরো আর তোশি, যারা তার সাথে দেখা করতে আসতো, তার সাথে হাসতো, একসাথে খেলা করতো।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সাচিকো বিছানায় পড়ে রইলো। কোনোকিছুই খেতে পারছিলো না, ক্লান্তিতে মনোযোগ দিতে পারছিলো না কোনোদিকেই। তারও অনেক জ্বর উঠলো। চুলগুলো একে একে পড়ে যাচ্ছিলো। দাঁতের মাঢ়ি থেকে রক্তপাত হচ্ছিলো। ছোট ছোট রক্তবর্ণের দানা দেখা দিলো তার শরীরেও। অল্প কিছুদিনের মাঝেই সেগুলো পুরো শরীরে ছড়িয়ে গেলো। বিন্দু থেকে মটরের ন্যায় আকার ধারণ করলো। শরীরে সংক্রমণের ফলে ঘা দেখা দিলো। সেগুলোতে আবার মাছি ডিমও পাড়লো। লার্ভাগুলোর কারণে চুলকানির পাশাপাশি অত্যধিক ব্যথাও হতে লাগলো।
মৃত ভাইয়েরা সাচিকোকে আবারও ডাক পাঠালো, “আমাদের সাথে চলে আসো।”
মা-বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লো। সেই সাথে মিসাও। ধার করা পুরনো এক কম্বল গায়ে জড়িয়ে সাচিকো আর মিসা একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে রইলো। কোনো অনুভূতিই তাদের মাঝে কাজ করছিলো না।
শরতের বৃষ্টি শুরু হলো। আকাশে বিজলী চমকে উঠলো। বজ্রের গর্জন শোনা যেতে লাগলো। দুঃস্বপ্নে সাচিকো বোমারু বিমানগুলোকে উড়ে যেতে দেখতো। মাঝরাতে তার চিৎকারে মিসার ঘুমও ভেঙে যেত। ছোট্ট দুই মেয়েকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেন মা। তার চোখ বেয়ে নেমে আসতো অবিরাম অশ্রুর ঝর্নাধারা।
সাচিকো দিনকে দিন দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলো। খাবার পাওয়া খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। মাত্র এক বাণ্ডিল শুকনো উডন ন্যুডলসের (গমের আটা দিয়ে তৈরি একপ্রকার ন্যুডলস) জন্য বাবা পাশেরই এক কৃষকের কাছে বেশ কাকুতিমিনতি করেছিলেন। মা বনে-জঙ্গলে মাশরুম খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। পানি গরম করে স্যুপভর্তি একটি পাত্র তিনি সাচিকোর মুখের সামনে ধরতেন। সেখানে থাকতো ন্যুডলস আর মাশরুম।
“খাও সাচিকো, খাও। প্রতিটা চুমুকই খুব মূল্যবান।”
সাচিকো খেতে লাগলো। বারবার খেতে লাগলো। মায়ের হাতের তৈরি এই অমৃত সাচিকোর শরীরে শক্তির যোগান দিয়ে যেতে লাগলো।
… … … …
অক্টোবর গড়িয়ে নভেম্বর চলে এলো। বাড়িতে ঠাণ্ডা আরও বাড়লো।
ডিসেম্বরে তুষারমাখা একটি চাঁদ আকাশ আলোকিত করে উঠলো।
মার্চ নাগাদ বসন্তের সুবাতাস বইতে শুরু করলো। মা, বাবা, সাচিকো আর মিসা- প্রত্যেকেই প্রাণে বেঁচে গেলো। শিমাবারার পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় আট মাস কাটানোর পর তারা আবারও নাগাসাকিতে ফেরার স্বপ্ন দেখতে লাগলো।
… … … …
রেডিয়েশন সিকনেস
পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হয়ে হিরোশিমা ও নাগাসাকির জনগণকে পরবর্তী দিনগুলোতে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে।
ফ্যাট ম্যানের আঘাতে নাগাসাকি শহরের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিষ্ফোরণের কেন্দ্রস্থল থেকে ১.৫ মাইল (২.৪ কিলোমিটার) ব্যাসার্ধের মাঝে থাকা সব বাড়িঘরই ধ্বংস হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো আশেপাশের ৩ মাইলেরও (৪.৮ কিলোমিটার) অধিক এলাকা জুড়ে থাকা মানুষজন।
সে সময় নাগাসাকিতে ছিলো ২,৬,০০০-২,৭০,০০০ মানুষের বসবাস। বোমা হামলার ফলে প্রায় ৭৪,০০০ মানুষ মারা যায়, যার অর্ধেকই মারা যায় আগস্টের ৯ তারিখে। যেসব শিশু এ বোমা হামলার পরেও বেঁচে গিয়েছিল, তাদের মাত্র ১৩৪ জন বিষ্ফোরণের কেন্দ্রস্থলের ১ কিলোমিটারের ভেতরের বাসিন্দা। সাচিকো আর মিসাও ছিলো সেই দলের সদস্য।
বেঁচে যাওয়াদের মাঝে আনুমানিক ৭৪,০০০ নাগরিকই ছিলো অসুস্থ। খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসা সেবা ছিলো অপ্রতুল। বিষ্ফোরণের ফলে নাগাসাকি মেডিকেল কলেজের চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে থাকা ৭০ জন চিকিৎসকের মাঝে প্রাণে বাঁচতে পেরেছিলেন মাত্র ৩০ জন। তারাই আহতদের সেবাশুশ্রূষা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পরিবারের সদস্যরা, যাদের আগে কোনো মেডিকেল ট্রেনিংও ছিলো না, তারাই একে অপরের সেবাযত্ন করে যাচ্ছিলো।
একজন রোগী আসলে কতটা আহত হয়েছেন এবং তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু- এটা নির্ভর করতো বিষ্ফোরণের সময় এর কেন্দ্রস্থল থেকে তিনি কতটা দূরে ছিলেন তার উপর। বিষ্ফোরণের ফলে আহতরা মূলত তিন ধরনের সমস্যায় পড়ছিল: দেহে ক্ষত সৃষ্টি হওয়া, দেহ পুড়ে যাওয়া এবং বিকীরণজনিত অসুস্থতা। এছাড়াও ভবন ধসে পড়ে এবং ধ্বংসাবশেষ ছুটে আসার ফলে অনেকেরই দেহের বিভিন্ন অংশের হাড় ভেঙে গিয়েছিল, তৈরি হয়েছিল গভীর ক্ষত। সাচিকোর ছোট ভাই তোশিও এভাবেই মাথায় আঘাত পেয়ে মারা যায়। বিষ্ফোরণের ফলে সৃষ্ট তাপে অনেকেই থার্ড ডিগ্রি বার্নের সম্মুখীন হন। সাচিকোর বড় ভাই আকির শরীরও ঠিক এভাবেই পুড়ে গিয়েছিল।
সাচিকোর আরেক ভাই ইচিরো, এবং পরবর্তীতে সাচিকো, বাবা, মা, মিসা এবং মামাও বিকীরণজনিত অসুস্থতার শিকার হয়েছিলেন। তবে খুব কম মানুষজনই তখন সেটা বুঝতে পেরেছিল। বিকীরণের শিকার হওয়া মানুষগুলোর দেহে শুরুতে তেমন একটা উপসর্গ দেখা যায়নি। উপসর্গগুলো ধাপে ধাপে প্রকাশ পেতে থাকে। পিপাসা, দুর্বলতা, বিতৃষ্ণাবোধ, জ্বর, ডায়রিয়া এবং বমি- এগুলোই ছিলো বিকীরণজনিত অসুস্থতার প্রথম লক্ষণ।
তিন থেকে ছয় সপ্তাহ পর থেকে আরো উপসর্গ প্রকাশ পেতে থাকে- চুল পড়া, মাঢ়ি থেকে রক্তক্ষরণ, হতোদ্যম হয়ে পড়া এবং দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ তাপমাত্রার জ্বর (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো)।
রক্তবর্ণের গুটিতে সারা শরীর ছেয়ে যেত, যা দেখে বোঝা যেত যে, ইন্টারনাল ব্লিডিং হচ্ছে। মুখ এবং গলায় দগদগে ঘা হতো। ফলে আহতদের জন্য কোনো খাবার গেলে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়তো। যারা সংক্রমণের শিকার হতো, তাদের অবস্থা হতো আরো খারাপ। নিয়মিতই প্রলাপ বকতো তারা। আর এভাবেই একসময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। যারা বেঁচে যেত, তাদেরও দীর্ঘদিনের যন্ত্রণাদায়ক নিরাময় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
পারমাণবিক বোমা তৈরির পেছনে যে বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন, তারা মানবদেহের বিকীরণের প্রভাব সম্পর্কে এতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না। এর আগে মানবদেহের উপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে তারা কোনো পরীক্ষানিরীক্ষাও চালাননি। আবার পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের আগে মার্কিন সামরিক বাহিনীও সম্ভাব্য আহতদের জন্য কোনোরকম ওষুধ তৈরির পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
হাতের কাছে পাওয়া সীমিত উপকরণ দিয়ে সর্বোচ্চ সেবাই দিয়ে যাচ্ছিলেন চিকিৎসকগণ। বিকীরণজনিত এই অসুস্থতা পরবর্তী আরো বেশ কয়েক মাস ধরে চিকিৎসক সমাজকে হতভম্ব করে রেখেছিল।
এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ
১) পর্ব – ১ || ২) পর্ব – ২ || ৩) পর্ব – ৩ || ৪) পর্ব – ৪ || ৫) পর্ব – ৫ || ৬) পর্ব – ৬ || ৭) পর্ব ৭