৩০০ স্পার্টানের সেই বিখ্যাত যুদ্ধের গল্পটা প্রায় সবারই জানা। বিখ্যাত পরিচালক জ্যাক স্নাইডার এ নিয়ে একটি চলচ্চিত্রও বানিয়েছিলেন 300 নামে। তবে গল্পের পেছনেও গল্প থাকে। সময়ের হাত ধরে জন্ম নেয় কিংবদন্তী। মুখে মুখে ঘুরে ফেরে বীরত্বগাথা। ডালপালা গজায়, একসময় ছোট্ট গল্পবৃক্ষ পরিণত হয় মহীরুহে।
৩০০ স্পার্টানের সেই গল্পেও তেমনই হয়েছে। মূল গল্পের গায়ে রং লেগেছে, সত্যের জায়গা দখল করে নিয়েছে কিংবদন্তী। কিংবদন্তীর গল্পটা মোটামুটি এমন-
পারস্যের সেনাদল যখন গ্রিস দখল করে নেওয়ার জন্য আক্রমণ করেছিল, স্পার্টানরা থার্মোপাইলি নামক এক এলাকায় তাদের মুখোমুখি হয়। খুবই সরু একটি রাস্তা ছিল সেখানে। বিশাল পারস্য আর্মি সেই সরু রাস্তায় আটকা পড়ে গেল। প্রাচীরের মতো ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে স্পার্টান যোদ্ধাদল। পারস্য সেনাদলের প্রবল আক্রমণ তিনদিন ধরে প্রতিরোধ করে স্পার্টানরা। পুরো ২৯৯ জন স্পার্টান মারা গেল। বাকি একজন বেঁচে ফিরেছিল স্পার্টায়। তার কাছ থেকেই সবাই জানতে পারে গল্পটা।
সবই ঠিক আছে এই গল্পের। সমস্যা একটাই: গল্পটা ভুল। সেই যুদ্ধে পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩০০ স্পার্টান কেবল যুদ্ধ করেনি। মিত্রবাহিনী ছিল তাদের।
পুরো গল্পটা বোঝার জন্য আরেকটু পেছনে, ফিরে যাওয়া যাক। ফিরে যেতে যেতে আমরা অবাক হয়ে আবিষ্কার করবো, শেক্সপিয়ার ঠিকই বলেছিলেন: ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। গল্পের মোড়কে পুরে তাকে আলাদাভাবে মহিমান্বিত করার প্রয়োজন পড়ে না।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৮০ সাল। জারজিসের নেতৃত্বে পারস্য বাহিনী গ্রিস দখলের জন্য যাত্রা করেছে। উত্তর গ্রিসের সমুদ্রতট ধরে গালফ অব ম্যালিয়া হয়ে পূর্ব অ্যাজিয়ান সমুদ্র ধরে থার্মোপাইলি পর্বতের পাদদেশে এসে স্থির হয়েছে। গ্রিকরা তাদের মুখোমুখি হলো পাহাড়ের এক সরু রাস্তার মুখে। এটাই ছিল থেস্যালি থেকে মূল গ্রিসে যাওয়ার একমাত্র সড়ক পথ, অন্তত পার্সিয়ানরা তা-ই জানতো। গ্রিক বাহিনীকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্পার্টান রাজা লেওনিডাস। একদিকে জারজিসের অধীনে পারসিয়ান সৈন্য ছিল ৭০ হাজার থেকে ৩ লক্ষের মতো। বিপরীতে লেওনিডাসের সৈন্য ছিল মাত্র ৭ হাজার।
ওদিকে সমুদ্রেও যুদ্ধ হচ্ছিল। গ্রিক নৌ-সেনারা সবটুকু দিয়ে লড়ছিল বিশাল পার্সিয়ান নৌবাহিনীর সাথে। লেওনিডাসের মাত্র ৭ হাজার সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে আসার পেছনে এটাও একটা কারণ। নৌপথে গ্রিস সরাসরি উন্মুক্ত, নৌবাহিনী হেরে গেলেই শেষ। কিন্তু সরু এই রাস্তা অল্প সৈন্য দিয়ে মোটামুটি কিছুটা সময় হলেও আটকে রাখা সম্ভব। মূল উদ্দেশ্যগুলোর একটা ছিল পার্সিয়ানরা যেন পেছন থেকে গিয়ে গ্রিক নৌবাহিনীকে আক্রমণ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা। কিছুদিন বাধা দিয়ে রাখতে পারলে খাবার আর পানির অভাবে জারজিস হয়তো পার্সিয়ান সৈন্যদের নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হবে।
স্পার্টান ঐতিহাসিক ক্যানেলের মতে, যুদ্ধ যে এত দ্রুত শেষ হয়ে যাবে, তা কেউ বুঝতে পারেনি। সবাই ভেবেছিল, কার্নিয়া ফেস্টিভাল শেষ হয়ে গেলে আরো স্পার্টান যোদ্ধা গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেবে। এ থেকে আসলে বোঝা যায়, কী প্রচণ্ড বিশ্বাস ছিল স্পার্টানদের নিজেদের উপর। সেটাকে খুব একটা ভুলও বলা যায় না অবশ্য। পুরো দু’দিন তারা পার্সিয়ানদেরকে কচুকাটা করেছে একের পর এক, আটকে দিয়েছে সরু রাস্তার মাঝেই।
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। স্পার্টানদের জন্য কার্নিয়া উৎসব এবং অলিম্পিক শুধু উৎসবই ছিল না। ধর্মীয় এই উৎসবগুলো পালন না করলে দেবতারা রুষ্ট হতে পারেন বলে মনে করতো তারা। ফলে, উৎসবে অংশগ্রহণ করা আসলে সবার জন্য ছিল বাধ্যতামূলক। এত অল্প স্পার্টানকে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার পেছনে এটাও আরেকটা কারণ। এছাড়াও ঐতিহাসিকদের মতে, লেওনিডাস যুদ্ধে যাওয়ার সময় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজকীয় দেহরক্ষী বাহিনীকেও নিয়ে যাননি। তার বদলে সাধারণ ৩০০ স্পার্টান সৈন্যকে (আসলে দাস) নিয়ে মিত্রবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিলেন। সেটাও সম্ভবত এই উৎসবের কারণেই।
দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, মীরজাফররা ইতিহাসের কোনায় কোনায় লুকিয়ে আছে। এখানেও তা-ই হলো। এফিয়ালতেস নামের এক বিশ্বাসঘাতক দ্বিতীয় দিন রাতে পার্সিয়ানদেরকে পাহাড়ের অন্যপাশ দিয়ে ঘুরিয়ে গ্রিক পদাতিক বাহিনীর পেছনে পৌঁছে দিল।
বিশ্বাসঘাতক এফিয়ালতেস যে পথ ধরে পার্সিয়ানদের নিয়ে গিয়েছিল, তার নাম অ্যানোপায়া। পথটার অবস্থান কোথায়, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। বিশ্বাসঘাতকতা না হলে গ্রিকরা যুদ্ধে জিতে যেত কি না, তর্ক আছে তা নিয়েও। সেসব তর্ক ঐতিহাসিকদের জন্যেই তোলা থাকুক। যে বিষয়ে কোনো তর্ক নেই, তা হলো স্পার্টানদের বীরত্ব। এফিয়ালতেস যখন পুরো গ্রিসকে বিক্রি করে দিয়েছে সামান্য কিছু স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে, তার বিপরীতে স্পার্টানরা যে বীরত্ব দেখিয়েছে, ইতিহাসে তা চিরজীবনের জন্য অমর হয়ে থাকবে।
এক গুপ্তচরের মাধ্যমে গ্রিকরা জানতে পারল, তারা ফাঁদে পড়ে গেছে। তখনো জারজিসের সৈন্যরা পেছনে এসে উপস্থিত হতে পারেনি। এ সময় লেওনিডাস বেশিরভাগ গ্রিক সৈন্যকে ফিরে যেতে বললেন। পরাজিত হতে পারেন ভেবে বাকিদেরকে চলে যেতে বলেছেন- এটা হতে পারে। তবে, ঐতিহাসিকদের মতে, সেন্ট্রাল গ্রিসকে রক্ষার জন্যও সৈন্য দরকার ছিল। সেজন্যই সম্ভবত বেশিরভাগ সৈন্যকে তিনি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বাকি রইল ২৯৮ স্পার্টান (বাকি দুজনকে ততক্ষণে যুদ্ধের খবর নিয়ে স্পার্টায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে) এবং ১,২০০ থেবানস আর থেসপিয়ানস যোদ্ধা।
ঐতিহাসিকদের ধারণা, তাদেরকে একরকম জোর করেই থাকতে বাধ্য করেছিলেন লেওনিডাস। মোট ১,৫০০ যোদ্ধা ছিল এই মিত্রবাহিনীতে। একপাশে মূল পার্সিয়ান সৈন্য, আরেকপাশে ১০,০০০ পার্সিয়ান, যারা বিশ্বাসঘাতকের সাহায্য নিয়ে পৌঁছেছে। যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অল্প কয়েকজন থেবানস বেঁচেছিল কেবল। কারণ তারা শেষ পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করেছিল। উপস্থিত স্পার্টানদের একজনও বাঁচতে পারেনি।
এদিকে নৌ-পথেও গ্রিকরা হেরে গিয়েছিল। পার্সিয়ানরা অ্যাথেন্সসহ গ্রিসের বিশাল একটা অংশ দখল করে নিয়েছিল। গ্রিক ঐতিহাসিক পিটার গ্রিনের মতে, পার্সিয়ানদের নৌবাহিনীও প্রচুর ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। সেজন্যই বিশ্বাসঘাতকরা পার্সিয়ানদেরকে স্পার্টা আক্রমণ করতে বললেও তারা আর রাজি হয়নি। তাই, সৌভাগ্যক্রমে স্পার্টা সেবার বেঁচে যায়।
কিন্তু কথা হলো, এই অল্প কয়েকজনকে নিয়ে লেওনিডাস তাহলে রয়ে গিয়েছিলেন কেন? এ প্রশ্নের কোনো নির্দিষ্ট উত্তর জানা যায় না। হয়তো রাজা হিসেবে দেশ রক্ষার প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে। হয়তো বীরত্বের জন্য এত সহজে পরাজয় মেনে নিতে পারছিলেন না। তবে, সবচেয়ে যৌক্তিক যেটা মনে হয়, তিনি হয়তো এরপরেও আশা করেছিলেন, এই কয়জনকে নিয়ে অন্তত এটুকু সময় পার্সিয়ানদেরকে আটকে রাখা যাবে যাতে বাকি স্পার্টান যোদ্ধারা এসে যোগ দিতে পারে। নাহয়, দুজন স্পার্টানকে শুধু খবর পৌঁছে দিতে পাঠাবেন, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এটা ঠিক যৌক্তিক মনে হয় না।
তারপরও কথা থেকে যায়। হয়তো যে ইতিহাস এখানে বলা হয়েছে, তাতেও মিশে আছে কিংবদন্তী। হয়তো ৩০০ স্পার্টানসহ মোট ১৫০০ জন আসলে পালাতে চেষ্টা করেও আটকে গিয়েছিল বলেই আর ফিরে যায়নি। হয়তো স্পার্টানরা গ্রিকদের উত্তরের সেই অংশটা রক্ষা করার ব্যাপারে অতটা আগ্রহীও ছিল না। উৎসবের জন্য না, বরং অনাগ্রহের কারণেই হয়তো তারা বেশি সৈন্য পাঠায়নি। এ অনুমানের সাথে একজন রাজাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো ঠিক মেলে না। তবে, রাজা নিজেই যে রাজপরিবারের কারো ষড়যন্ত্রের শিকার হননি, তা-ই বা কে বলবে? হয়তো রাজপরিবারের অন্য কেউ সিংহাসন দখল করতে চেয়েছিল। নাহয়, দেহরক্ষীদেরকে ছাড়া কেবল দাস-সৈন্যদেরকে নিয়ে একজন রাজা কেন এভাবে যুদ্ধে চলে গেলেন, এ প্রশ্নেরও যথাযথ কোনো উত্তর নেই।
ঘটনা যেটাই হোক, আটকা পড়ার কারণেই হোক বা স্বেচ্ছায়, ৩০০ স্পার্টান সেদিন যে দারুণ বীরত্ব দেখিয়েছেন, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে তাদের সাথের বাকি ১,২০০ গ্রিকও নিঃসন্দেহে বীরত্বের সাথেই যুদ্ধ করেছেন। আমরা যেন স্পার্টানদেরকে অতিমানব বানিয়ে না ফেলি। আবার তাদের সাথে বাকি গ্রিকদের বীরত্বকেও আমরা যেন অস্বীকার না করি।
গ্রিকদের বীরত্বকে অস্বীকার না করলেও কিন্তু সেই ৩০০ স্পার্টান বীরকে কোনোভাবে অসম্মান করা হয় না!