ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে মানবজাতিকে প্রাণঘাতী সব ভাইরাসের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ভয়াবহ সব মহামারিতে মারা গিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে আতংকে দিন কাটাচ্ছে পুরো বিশ্ববাসী। ইতালি, ইরান, স্পেনসহ বিভিন্ন দেশ পুরোটাই লক-ডাউনে। বাকি দেশগুলোয় অসংখ্য মানুষকে থাকতে হচ্ছে কোয়ারেন্টিনে। এই ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দের ব্যবহার শুরু হওয়ার পেছনেও রয়েছে একটি ইতিহাস। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে শহর থেকে প্রায় ৬০০ বছর আগে ‘কোয়ারেন্টিন’ শব্দের উৎপত্তি সেই শহর এত বছর পর আবারো একই পরিস্থিতির মুখোমুখি!
১৩৪৭ সালের অক্টোবর মাস। কৃষ্ণসাগর থেকে ১২ টি জাহাজ সিসিলির মেসিনা বন্দরে নোঙ্গর করল। বন্দরের লোকজন জাহাজিদের অভ্যর্থনা দিতে এসে সাংঘাতিক ভাবে চমকে গেলেন। সবগুলো জাহাজের বেশিরভাগ লোকজন মরে পড়ে আছে! যারা মারা যায়নি তাদের অবস্থাও গুরুতর। পুরো শরীর থেকে রক্ত ও পুঁজ গড়িয়ে পড়ছে। জানতে পেরে সিসিলি কর্তৃপক্ষ তাড়াতাড়ি জাহাজের এই বহরকে বন্দর ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। ইউরোপে ঢুকে গেল বুবোনিক প্লেগ! ‘ব্ল্যাক ডেথ’ নামে পরিচিত এই মহামারিকে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে ধরা হয়। ১৩৪৭-১৩৫০ পর্যন্ত চলা এই ধ্বংসযজ্ঞে পুরো ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিল।
সিসিলির এই ঘটনায় শিক্ষা নিল ভেনিস শহর। যদিও কিভাবে রোগ ছড়ায় সেই জ্ঞানের অভাব ছিল তাদের। তবে তারা ধারণা করতে পেরেছিল, সংস্পর্শে আসার সাথে নিশ্চয়ই এর কোনো সম্পর্ক আছে। তৎকালীন ভেনিস নিয়ন্ত্রিত নগরী রাগুসা (বর্তমানে ক্রোয়েশিয়ায়) ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। কোনোভাবে প্লেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ১৩৭৭ সালে শহরের গ্রেট কাউন্সিল একটি আইন জারি করেন। আইনটিকে বলা হয়েছিল, ত্রেনটিনো (trentino) বা ৩০ দিনের আইসোলেশন পিরিয়ড। এই আইনটিতে ৪ টি আদেশ দেয়া হয় –
- প্লেগ আক্রান্ত এলাকা থেকে আসা কোনো জাহাজ রাগুসা বন্দরে ভিড়তে পারবে না। এর আগে থাকতে হবে ১ মাসের আইসোলেশনে।
- রাগুসা শহর থেকে কেউ জাহাজের ভেতরে যেতে পারবেনা। এরপরেও কেউ গেলে তাকেও শাস্তি স্বরূপ ১ মাস জাহাজে থাকতে হবে।
- কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কেউ জাহাজে খাবার নিয়ে যেতে পারবেনা। গেলে আগের মতোই শাস্তি।
- উপরোক্ত আইন কেউ না মানলে তাকেও ১ মাসের আইসোলেশনে থাকতে হবে এবং জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে।
বন্দরে ভিড়তে না দেয়ার এই আইনটি টিকে যায়। পরবর্তী ৮০ বছরের মধ্যে ইতালির অন্যান্য কয়েকটি শহর যেমন- ভেনিস, পিসা, জেনোয়া প্রভৃতিতেও trentino প্রয়োগ করা হতে থাকে। জীবাণুবাহিত রোগ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকলেও প্লেগের ভয়াবহতা শহরগুলোকে কঠিন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে।
তবে এই সময়ের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়। ৩০ দিন থেকে বাড়িয়ে আইসোলেশন পিরিয়ডের মেয়াদ করা হয় ৪০ দিন। এর সাথে আইনটির নাম trentino থেকে পরিবর্তন হয়ে হয় quarantino। এ শব্দটি আসে ইটালিয়ান quaranta থেকে, যার অর্থ চল্লিশ। এই quarantino থেকেই বর্তমানে ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দ কোয়ারেন্টিন (quarantine) এর উদ্ভব।
আইসোলেশন পিরিয়ড ৩০ দিন থেকে ৪০ দিনে নিয়ে আসার সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো কোনো কোনো শহর ৩০ দিনকে যথেষ্ট মনে করেনি বলেই আরো ১০ দিন বাড়িয়ে দেয়। তবে ধারণা করা হয়, খ্রিস্ট ধর্ম মতে ৪০ দিনের অনেক গুরুত্ব থাকায় quarantino’র উদ্ভব। বাইবেলের কয়েকটি ঘটনার সাথে ৪০ দিন এর সম্পর্ক আছে-
- নূহ নবীর সময়কার ‘মহাপ্লাবন’এর সময় ৪০ দিনরাত ধরে পৃথিবীতে বৃষ্টি হয়।
- মুসা নবী সিনাই পর্বতে ‘টেন কমান্ডমেন্ট’ পাওয়ার আগে ৪০ দিন রোজা রেখে কাটান।
- ইহুদীরা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমিতে পৌঁছানোর আগে ৪০ বছর ঘুরে কাটায়।
তবে ৪০ দিনের ধর্মীয় কারণ ছাড়া আরেকটি ব্যাখ্যা গবেষকরা দিয়েছেন। প্রাচীন গ্রিসের চিকিৎসকরা কোনো ছোঁয়াচে রোগ ছড়িয়ে গেলে এর লক্ষণ দেখা দিতে কয়েকদিন লাগে বলে মনে করতেন। ‘ক্রিটিকাল ডেইজ’ হিসেবে পরিচিত এইদিনগুলোর মেয়াদ ছিল ৪০ দিন।
কোয়ারেন্টিন যুগে যুগে
১৪ শতকের পরের বিভিন্ন মহামারিতে রোগের বিস্তৃতি রোধে কোয়ারেন্টিনের ব্যবহার করা হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি পায় এবং কোয়ারেন্টিনের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে।
ইয়েলো ফিভার ( ১৭৯৩ সাল)
১৭৯৩ সালের গ্রীষ্মে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ক্যারিবীয় অঞ্চল থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ইয়েলো ফিভার। দুই বছরব্যাপী চলা এই মহামারিতে প্রায় ৫,০০০ মানুষ মারা যায়। মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ালেও তখনকার আমেরিকার রাজধানী এই শহরের কর্তৃপক্ষের সে ব্যাপারে কোনো ধারণা ছিলনা। আতঙ্কিত শহরের বাসিন্দাদের শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বলা হয়। রোগ সংক্রমণ বন্ধ করতে শহরের বাইরের হাসপাতালে রোগীদের রাখা হয়। বলা বাহুল্য, মশার মাধ্যমে ছড়ায় বলে এই সিদ্ধান্ত মহামারি ঠেকাতে কোনো কাজে আসেনি।
বুবোনিক প্লেগ ( ১৯০০ সাল )
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বুবোনিক প্লেগের আবির্ভাব ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রানসিসকো শহরে ১৯০০ সালে তেমনই এক প্রাদুর্ভাব হয়। মার্চ মাসে চীনা বংশোদ্ভূত এক লোকের মৃত্যু ঘটে। ময়নাতদন্তে জানা যায়, প্লেগই এই মৃত্যুর কারণ। শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক আর সাথে সাথে রেসিজম। শহরবাসীর ‘এন্টি-চাইনিজ’ সেন্টিমেন্টের কারণে পুরো চায়নাটাউন কোয়ারেন্টিন করা হয়। শহরের চারদিকে দেয়া হয় কাঁটাতারের বেড়া। যদিও শহর কর্তৃপক্ষ কয়েকদিন পরেই সেটা তুলে নেয়।
স্প্যানিশ ফ্লু ( ১৯১৮ সাল )
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিপর্যস্ত বিশ্ববাসীর ‘কাটা গায়ে নুনের ছিটা’র মত আবির্ভাব হয় এক ভয়ংকর মহামারির। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামে পরিচিত ( যদিও স্পেনের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই) এই মহামারিতে মারা যায় প্রায় ৫ কোটি মানুষ। ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় এর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কোয়ারেন্টিনের পাশাপাশি স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নিষিদ্ধ করা হয় জনসমাগম। অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই রোগ ঠেকাতে এইসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও আটকানো যায়নি ব্যাপক প্রাণহানি।
‘কোয়ারেন্টিনে’র আগের কোয়ারেন্টিন
রোগ যাতে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য বিচ্ছিন্ন থাকার ইতিহাসও বেশ পুরনো। এমনকি বাইবেলেও কুষ্ঠ রোগীদের আইসোলেশনে রাখার উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এক হাদিসে প্লেগ আক্রান্ত এলাকা থেকে কেউ বাইরের এলাকায় না আসতে এবং বাইরে থেকে প্লেগ আক্রান্ত এলাকায় না যেতে বলেছেন (বুখারী-৫৭২৮)। উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ (শাসনকাল ৭০৫- ৭১৫ সাল) দামেস্ক শহর থেকে বাইরে কুষ্ঠ রোগীদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করেন।
চৌদ্দ শতকের শুরুর দিকে ভেনিসে কুষ্ঠ রোগীদের জন্য lazaretto নামের হাসপাতাল নির্মাণ করা হয় শহরের বাইরে। ১৩৭৪ সালে ইতালির রেজিও শহরের কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেন, প্লেগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে শহরের বাইরে মাঠের মধ্যে রেখে আসতে হবে। এতে সে সুস্থ হলে সুস্থ হোক বা মারা গেলে মারা যাক!
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে কোয়ারেন্টিন করে রাখাটাই ছোঁয়াচে রোগ ঠেকানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতি। নিয়তির নির্মম পরিহাস, যে ভেনিস শহর থেকে কোয়ারেন্টিন শব্দটির উৎপত্তি, সেই শহরের সব মানুষজন আরো একটি ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আজ কোয়ারেন্টিনে!