৪৯৯ খ্রিস্টপূর্বের সময়কার কথা। পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের অংশ আইওনিয়ায় (বর্তমান পশ্চিম তুরস্কের একটি উপকূলীয় এলাকা) তখন এক বিশাল বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ সময় কয়েকটি গ্রিক নগররাষ্ট্র এই বিদ্রোহে আইওনিয়ান বিদ্রোহীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলোর সহায়তায় বিদ্রোহ আরো বেগবান হয়। ছয় বছর পর পার্সিয়ান বাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। ইতিহাসে এটি আইওনিয়ান রিভল্ট (৪৯৯-৪৯৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) নামে পরিচিত। কিন্তু এই বিদ্রোহে গ্রিকদের সহযোগিতার কথা শুনে তৎকালীন পারস্য সম্রাট দারিয়ুস অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। তিনি এর প্রতিশোধ হিসেবে গ্রিকদের ডানা ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার বাহিনীকে গ্রিকদের বিরুদ্ধে এক বিশাল সামরিক অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন।
৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পার্সিয়ান বাহিনী ও অ্যাথেনিয়ান তথা গ্রিক বাহিনী ম্যারাথনের যুদ্ধে মুখোমুখি হয়। এই যুদ্ধে অ্যাথেনিয়ান সেনাপতি মিল্টিয়াডিসের নেতৃত্বে মাত্র দশ হাজার সৈন্য নিয়ে গ্রিক বাহিনী ছাব্বিশ হাজার সৈন্যের পার্সিয়ান বাহিনীকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। পার্সিয়ানরা গ্রিকদের কাছে এই লজ্জাজনক পরাজয় মেনে নিতে পারছিল না। এবার পার্সিয়ানরা আরো বড় আকারে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে থাকে।
৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ, আকামেনিদ পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের অধিপতি সম্রাট দারিয়ুস দ্য গ্রেট তার ছত্রিশ বছরের রাজত্বের (৫২২-৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) অবসান ঘটিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। নতুন সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন দারিয়ুসের সন্তান জার্জিস দ্য গ্রেট। প্রবল প্রতাপশালী সম্রাট জার্জিস তার পূর্বসূরির পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। পরাক্রমশালী পার্সিয়ান সাম্রাজ্য যেখানে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে সেটা হলো গ্রিস। স্বাভাবিকভাবেই গ্রিস বিজয় তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে এবং ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা জার্জিসের মাথায় গেড়ে বসে। ফলে, তিনি যেকোনো মূল্যে গ্রিস বিজয় করতে চেয়েছিলেন। ব্যাটল অব ম্যারাথনের দশ বছর পার হতে চলেছে। সম্রাট জার্জিস তখন গ্রিস বিজয়ের জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করেন।
গ্রিক অভিযানের উদ্দেশ্যে জার্জিস তার সমগ্র সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করেন। গ্রিসে একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালানোর জন্য কয়েক বছর ধরে তিনি প্রয়োজনীয় সৈন্য ও রসদ সংগ্রহ করতে থাকেন। পার্সিয়ান, মিডিয়ান, আর্য, এলামাইট, গান্ধার, ভারতীয়, সিথিয়ান, ব্যাবিলনীয়, অ্যাসিরিয়ান, আরব, মিশরীয়, আর্মেনিয়ান, লিডিয়ান, আয়োনিয়ানসহ সমগ্র সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতি ও অঞ্চলের সৈন্য ছিল এই বাহিনীতে।
এই অভিযানে পার্সিয়ান বাহিনীর প্রকৃত সৈন্যসংখ্যা কত ছিল তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। থার্মোপাইলির যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো পার্সিয়ান সূত্র টিকে নেই, ফলে যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে শুধুমাত্র গ্রিক সূত্রগুলোই ভরসা। স্বাভাবিকভাবেই গ্রিক সূত্রগুলো গ্রিকদের পক্ষে যাওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে, হয়েছেও এমন। গ্রিক বিবরণে গ্রিকদের বীরত্বকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। ইতিহাসের জনক হেরোডোটাসের মতে এই যুদ্ধে পার্সিয়ান বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ছিল ২.৬ মিলিয়ন। কবি সিমোনাইডস তো আরো এগিয়ে, তার মতে এই সংখ্যা চার মিলিয়ন। তবে আধুনিক হিসাব ও প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী সেই বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ৭০,০০০ থেকে ৩,০০০০০ এর মধ্যে ছিল।
৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জার্জিস তার বিশাল বাহিনী নিয়ে গ্রিস বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। জার্জিসের পরিকল্পনা ছিল এশিয়া মাইনর (বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়া) থেকে যাত্রা শুরু করে স্থলপথে থ্রেস ও মেসিডোনিয়া হয়ে গ্রিসের দিকে অগ্রসর হবেন, এবং একটি বিশাল নৌবহর তাকে সাহায্যের জন্য উপকূল বরাবর একইসঙ্গে অগ্রসর হবে। সেই বছরের জুন মাসের শুরুতে সম্রাট জার্জিস ও তার রাজকীয় বাহিনী নৌকার তৈরি সেতুর উপর দিয়ে দার্দানেলিস প্রণালী অতিক্রম করে।
পার্সিয়ানদের এই বিশাল অভিযানের খবর গ্রিসে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। এই খবর জেনে গ্রিক নগররাষ্ট্রগুলো একটি জরুরী বৈঠকে মিলিত হয়। নিজেদের মধ্যে শত্রুতা বন্ধ করে একটি বৃহত্তর জোট গঠন করে পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। যুদ্ধ ঘনিয়ে আসায় গ্রিকদের এই জোট রণকৌশল সম্পর্কে আলোচনার জন্য আবারো বৈঠকে বসে। আলোচনায় প্রথমে পারস্য বাহিনীর অগ্রগতি রোধ করার জন্য টেম্পে উপত্যকায় একটি প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পার্সিয়ানরা হেলেস্পন্ট অতিক্রম করেছে এবং তাদের বিশাল সেনাবাহিনী সম্পর্কে খবর পেয়ে গ্রিকরা একটি নতুন পরিকল্পনা করে। গ্রিকদের সেই কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেয় যে গ্রিক বাহিনী অ্যাথেন্স থেকে ১৩৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে থার্মোপাইলির গিরিপথে পার্সিয়ানদের পথ রোধ করবে। থার্মোপাইলি খুবই সংকীর্ণ একটি গিরিপথ, যার একপাশে পাহাড় এবং অপরপাশে সমুদ্র।
গ্রিকদের এই পরিকল্পনার মূলে ছিল পারস্যের বিশাল সৈন্য। পার্সিয়ান বাহিনীর প্রচুর সৈন্য এত ছোট গিরিপথ দিয়ে শত্রু বাহিনীকে পরাজিত করে অতিক্রম করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ ছিল। ৪৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগস্ট মাসে গ্রিকদের কাছে খবর আসে যে পার্সিয়ানরা থার্মোপাইলির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। খবর পেয়ে গ্রিকদের যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কারণ তখন স্পার্টানদের পবিত্র ধর্মীয় উৎসব কার্নিয়া চলছিল। কার্নিয়া চলাকালীন স্পার্টার নাগরিকদের শহরের বাইরে যুদ্ধযাত্রা ও রক্তপাত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। এই উৎসব চলাকালে রক্তপাত ও যুদ্ধ করলে দেবতারা অসন্তুষ্ট হয় বলে স্পার্টানরা বিশ্বাস করতো। ফলে তারা পড়লো এক মহাবিপদে। স্পার্টা ত্যাগ করলেও সমস্যা, আবার পার্সিয়ানদের না আটকালেও সমস্যা। এ যেন ফাটা বাঁশের চিপায় পড়ে স্পার্টানরা।
এমতাবস্থায় স্পার্টায় এক জরুরী বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে স্পার্টান নাগরিকরা তো যুদ্ধে যেতে পারবে না কিন্তু স্পার্টার রাজা লিওনিডাস তার ৩০০ রাজকীয় প্রহরী নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন। কেন স্বয়ং রাজাকেই এই যুদ্ধে আসতে হলো তা স্পষ্ট নয়। অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রের সৈন্যদের সঙ্গে স্পার্টার রাজা লিওনিডাস তার ৩০০ সৈন্য নিয়ে থার্মোপাইলির দিকে অগ্রসর হন। ১০০০ ফোসিয়ান, ৭০০ থিস্পিয়ান এবং ৪০০ থেবান সহ সব মিলিয়ে গ্রিক বাহিনীতে মাত্র ৭০০০ সৈন্য ছিল। এই স্থল বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্পার্টার রাজা লিওনিডাস। গ্রিকদের আরেকটি বাহিনী নৌপথে পার্সিয়ান নৌবহরের বিরুদ্ধে এগোচ্ছিল। সেই গ্রিক নৌবহরের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন অ্যাথেনিয়ান রাজনীতিবিদ এবং জেনারেল থেমিস্টোক্লিস।
থার্মোপাইলির গিরিপথে পৌঁছে লিওনিডাস তার সৈন্যদের নিয়ে একটি অবস্থান নেন। রণক্ষেত্রটি গ্রিকদের জন্য খুবই সুবিধাজনক ও আদর্শ স্থান ছিল। থার্মোপাইলির এই সংকীর্ণ গিরিপথটি সাঁজোয়া গ্রীক হোপলাইটদের দ্বারা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানের জন্য অত্যন্ত উপযোগী ছিল। এর ফলে তুলনামূলক হালকা সাজে সজ্জিত পার্সিয়ানদের কাবু করা সহজ হবে। গ্রিকরা যেখানে অবস্থান নেয় সেখানে বিপরীত দিক থেকে আসার জন্য এই গিরিপথটি ছাড়াও পাহাড়ের অপরপাশ দিয়ে একটি সরু পথ ছিল। লিওনিডাস সেখানে ১০০০ গ্রিক সৈন্যকে পাহারাদার হিসেবে রাখেন। কয়েকদিন পর পার্সিয়ানদের বিশাল সৈন্যবাহিনী থার্মোপাইলিতে এসে উপস্থিত হয়ে সেখানে শিবির স্থাপন করে। পারস্য সম্রাট জার্জিস গ্রিকদের কাছে একজন দূতের মাধ্যমে অস্ত্র ত্যাগ করে আনুগত্যের আহ্বান জানায়, কিন্তু গ্রিকরা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
জার্জিস এরপর চারদিন পর্যন্ত কোনো আক্রমণ করেননি। তিনি ভেবেছিলেন যে গ্রিকরা তার বিশাল বাহিনী দেখে ভয় পেয়ে পিছু হটবে। কিন্তু গ্রিকদের অটল অবস্থান দেখে শেষ পর্যন্ত পঞ্চম দিন সকালে সম্রাট জার্জিস আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। পার্সিয়ান বাহিনীর একটি ইউনিট গ্রিকদের উপর আক্রমণ করতে এগিয়ে আসে। এর প্রতিরোধ হিসেবে গ্রিকরা একত্রিত হয়ে একটি ঢালের প্রাচীর তৈরি করে। পার্সিয়ানদের অস্ত্রশস্ত্র গ্রিকদের এই ঢাল প্রাচীর ভাঙতে ব্যর্থ হয়। তাদের ধনুক এবং তীরগুলোও গ্রীকদের শক্ত ঢালের বিরুদ্ধে অকেজো প্রমাণিত হয়। পার্সিয়ানদের মূলত প্রয়োজনীয় ভারী অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল। তাদের তলোয়ার এবং ঢালগুলো ছিল গ্রীকদের তুলনায় ছোট। পার্সিয়ানদের প্রচুর সাহস ও সহনশীলতা ছিল ঠিক, কিন্তু গ্রিক ভূখণ্ডের জন্য তারা প্রশিক্ষিত ছিল না। এছাড়া গ্রিক বাহিনী ছিল ভারি সাজে সজ্জিত এবং সেখানে লম্বা বর্শা হাতে হোপলাইটরাও ছিল।
গ্রিক বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পার্সিয়ানরা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পার্সিয়ানদের সেনাবাহিনী অনেক বড় হলেও এই আঁটসাঁট সরু জায়গায় সংখ্যাধিক্য তাদের কোনো বাড়তি সুবিধা দিতে পারেনি। কারণ এতো বিশাল সেনাবাহিনী থাকার পরও জায়গা অনেক কম থাকায় বেশি পরিমাণে সৈন্য একসঙ্গে অগ্রসর হতে পারছিল না। ফলে সাধারণত বিস্তৃত রণক্ষেত্রে যে ধরনের যুদ্ধ হয় সেরকম যুদ্ধে জড়ানো যাচ্ছিল না। তবে এই আঁটসাঁট স্থানটি গ্রীকদের জন্য খুবই উপযুক্ত ছিল কারণ তারা একত্রিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে অভ্যস্ত ছিল। এটি কম সৈন্যের গ্রিকদের জন্য অত্যন্ত উপকারী হলেও পার্সিয়ানদের জন্য অস্বস্তিকর ছিল। পার্সিয়ানরা গ্রিকদের অবস্থান ভেঙে দেওয়ার জন্য বারবার আক্রমণ চালিয়ে প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে প্রচুর পরিমাণে হতাহতের সঙ্গে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
পরের দিন একইভাবে পার্সিয়ানরা গ্রিকদের উপর আক্রমণ করে। জার্জিস মনে করেছিলেন গ্রিকরা অধিক পরিশ্রমের ফলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই তিনি তার বাহিনীকে আরো তীব্র আক্রমণের নির্দেশ দেন। প্রথম দিনের মতোই এবারও পার্সিয়ানরা ব্যাপক হতাহতের সঙ্গে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। জার্জিস কাছাকাছি পাদদেশে একটি সোনার সিংহাসন থেকে যুদ্ধ দেখছিলেন। তার সৈন্যদের বারবার ব্যর্থতা দেখে তিনি রাগে চিৎকার করতে করতে সিংহাসন থেকে লাফ দিয়ে উঠেন।
দ্বিতীয় দিন শেষে ইফিয়াল্টেস নামক একজন স্থানীয় মেষপালক জার্জিসের ক্যাম্পে গিয়ে হাজির হয়। সে আকর্ষণীয় পুরস্কারের বিনিময়ে পারস্য সম্রাটকে পাহাড়ের অপরপাশের সরু রাস্তা সম্পর্কে জানায়। এই তথ্য জেনে সম্রাট জার্জিস তো বেজায় খুশী। তিনি এর সদ্ব্যবহার করতে একটি বৃহৎ বাহিনীকে সেখান দিয়ে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। তৃতীয় দিন ভোরবেলা পথের পাহারাদার গ্রিকরা অগ্রসরমান পারস্যদের দেখে হতবাক হয়ে পড়ে। পার্সিয়ানদের এই পথে অগ্রসর হওয়ার খবর শুনে লিওনিডাস অন্যান্য সেনাপতিদের একটি জরুরী বৈঠকে ডাকেন। এমতাবস্থায় অধিকাংশ সেনাপতি পশ্চাদপসরণের পক্ষে মত দেন। তাদের বুঝতে বাকি নেই যে, পার্সিয়ানরা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে এই মুহূর্তে তাদের আটকানোর ক্ষমতা গ্রিকদের নেই, ক্ষয়ক্ষতি কমাতে চাইলে পালানোই এখন সেরা উপায়।
কিন্তু লিওনিডাস পিছিয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন না। তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মরলে যুদ্ধক্ষেত্রেই লড়াই করতে করতে মরবেন কিন্তু পিছু হটবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তিনি গৌরব করে বলেন, স্পার্টানরা কখনো পিছু হটে না, হয় বিজয় অথবা মৃত্যু। কিছু মত অনুযায়ী ডেলফির ওরাকল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, হয় স্পার্টা পার্সিয়ানদের হাতে ধ্বংস হবে অথবা এর রাজা নিহত হবে। এটা জেনে লিওনিডাস ভাবেন যে, তার আত্মত্যাগ হয়তো স্পার্টাকে রক্ষা করবে। তাই তিনি তার ৩০০ জন স্পার্টান নিয়ে রণক্ষেত্রেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। লিওনিডাসের এই অটল অবস্থান দেখে তার সঙ্গে ৪০০ থেবান এবং ৭০০ থিস্পিয়ানও থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কয়েকশো সৈন্য ছাড়া সমগ্র গ্রিক বাহিনী তখন পশ্চাদপসরণ করে।
সকাল বাড়ার সাথে সাথে জার্জিস আরেকটি শক্তিশালী আক্রমণ শুরু করেন। গ্রীকরা পার্সিয়ানদের সর্বোচ্চ ক্ষতি সাধনের জন্য গিরিপথের একটি বিস্তৃত জায়গায় এগিয়ে গিয়ে আক্রমণের মুখোমুখি হয়। শেষ পর্যন্ত পার্সিয়ানদের আক্রমণের মুখে স্পার্টার রাজা লিওনিডাস নিহত হয়। আরো কিছুক্ষণ লড়াই করা পর থেবানরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু তখনও অন্যান্য গ্রীকরা মরণপণ যুদ্ধ করছে। কিন্তু পার্সিয়ান বিশাল বাহিনীর কাছে কয়েকশো গ্রিক সৈন্য শেষ পর্যন্ত নিঃশেষ হয়ে পড়ে। এরই সঙ্গে থার্মোপাইলির যুদ্ধে পার্সিয়ানরা চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। সমগ্র গ্রিক বাহিনীর পতনের সঙ্গে সঙ্গে পার্সিয়ানদের দক্ষিণে যাওয়ার রাস্তা খুলে যায়। জার্জিস এক বাঁকা হাসি হেসে দক্ষিণ দিকে হাত উঁচিয়ে তার বাহিনীকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন।
থার্মোপাইলের যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। হেরোডোটাসের মতে পার্সিয়ানদের প্রায় ২০,০০০ সৈন্য এই যুদ্ধে নিহত হয় এবং প্রায় ৪০০০ গ্রীক সৈন্য প্রাণ হারায়। স্থলযুদ্ধে হারার পর গ্রিক নৌবহরও দক্ষিণে সরে আসে। কিছুদিন পর পার্সিয়ানরা আরো অগ্রসর হয়ে অ্যাথেন্স দখল করে নেয়। এরপর সালামিসের যুদ্ধে এবং প্লাটিয়ার যুদ্ধে গ্রিকরা পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে। এর ফলে পারস্যের বেশিরভাগ সৈন্য এশিয়ায় ফিরে যেতে বাধ্য হয় এবং এই যাত্রায় পার্সিয়ান আক্রমণের সমাপ্তি ঘটে। থার্মোপাইলির যুদ্ধ ছিল জার্জিসের গ্রিক অভিযানের সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধ।
থার্মোপাইলির যুদ্ধ গ্রিকদের ইতিহাসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধগুলোর মধ্যে একটি। যদিও এই যুদ্ধে সম্মিলিত গ্রিক বাহিনী পরাজিত হয়েছিল তথাপি এটি তাদের বীরত্বের এক অনন্য নিদর্শন। এই যুদ্ধের পর স্পার্টার মর্যাদা আরো বেশি শক্তিশালী হয়েছে। এটি পার্সিয়ানদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রিকদের আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করে।