গ্রেট ডিপ্রেশন: যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মহামন্দা, ঘুরে দাঁড়ানো এবং নির্মমতা

পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দা সংগঠিত হয়েছিল ১৯২৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এক দশকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে নেমেছিল ভয়াবহ ধ্বস, যার প্রভাব পড়েছিল আমেরিকানদের ব্যক্তিগত জীবনে। সময়ের তোড়ে আমেরিকা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ও ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়েছিল এর প্রভাব।

এই মন্দায় যুক্তরাষ্ট্রের সকল স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নানারকম সমস্যা তৈরি হয়। কোটি কোটি আমেরিকান বেকার হয়ে পড়েন। ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যায় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা মেক্সিকান শরণার্থীদের একাংশ নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরতে বাধ্য হন।

শুধু এই সমস্যাগুলোর মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল না এর প্রভাব! তৎকালীন মার্কিন রাজনৈতিক আবহাওয়াও পাল্টে দেয় এটি। ব্যর্থতার দায়ভার কাঁধে নিয়ে রিপাবলিকানরা বিদায় নেন এবং ডেমোক্রেটরা গদিতে বসে এই অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে কাজে নেমে পড়েন।

স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্বিষহ স্মৃতি বহন করা সেই সময়কে ইতিহাসে গ্রেট ডিপ্রেশন কিংবা অর্থনৈতিক মহামন্দা বলা হয়। আর আজকের এই লেখায় গ্রেট ডিপ্রেশনের কারণ, ক্ষয়ক্ষতি এবং সেই সময়কার মেক্সিকান বংশোদ্ভূত মার্কিনিদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় আচরণের চিত্র তুলে ধরা হলো।

গ্রেট ডিপ্রেশন বা অর্থনৈতিক মহামন্দা

১৯২০ সালের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তখন দেশটির অর্থনীতি দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে। উল্লেখযোগ্য বড় শহরগুলোতে গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং বড় কলকারখানা।

একই সময় মার্কিন প্রশাসন কৃষি ও রেলখাতেও উন্নয়নের কাজ শুরু করেছিল। যার ফলে লক্ষ লক্ষ নাগরিকের স্থায়ী কর্মসংস্থান তৈরি হয় এবং তারা উল্লেখযোগ্য হারে আয় করতে থাকেন। কয়েকবছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত অবস্থা আরো পাল্টে যায়। নতুন নতুন কলকারখানার সঙ্গে তৈরি হয় উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, কর্পোরেট অফিস এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

image source:the balance

কর্মসংস্থানের অভাব না থাকায় প্রায় সকল নাগরিকের হাতেই প্রচুর অর্থ ছিল। আর এই কারণেই তারা শেয়ার বাজারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কেউ কেউ তো নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে স্থায়ী বিনিয়োগকারীও হয়ে ওঠেন। আর এর সংখ্যা দিন দিন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে থাকে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, সেই সময় একজন বাবুর্চি হতে শুরু করে একজন কারখানার মালিক- প্রায় সবাই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতেন! নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে হাজার মানুষের ভিড় ছিল নিত্যদিনের চিত্র।

১৯২৯ সালের আগস্টে এসে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজার চরম শিখরে আরোহন করে। কিন্তু ততদিনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়াও উপলব্ধি করতে থাকে সবাই। ঐ বছরের গ্রীষ্মে দেশটির জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে এবং মার্কিন নাগরিকরা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের দিকে মনোনিবেশ করায় কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

তখন একদল নাগরিক, ব্যবসায়ের নামে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেগুলো শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। এতে করে স্থানীয় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তৎকালীন সরকার। সব মিলিয়ে এক ধরনের অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোতে। কিন্তু এত শত সমস্যার মাঝে একদিনের জন্যেও শেয়ারের দাম কমেনি!

ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে দিশেহারা মানুষের ঢল; Image source: moneyweek

অতঃপর ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষদিকে ঘটে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কিছু সংখ্যক ভীতু বিনিয়োগকারী সেই সময় তাদের সব শেয়ার বিক্রি করতে থাকেন। আর তাদের মদদ দিচ্ছিলেন কিছু সংখ্যক অসাধু বিনিয়োগকারী।

শুধুমাত্র ২৪ অক্টোবর একদিনে বিক্রি হয়েছিলো প্রায় ১২.৯ মিলিয়ন শেয়ার! আর এটিকে একটি সুযোগ ভেবে লক্ষ লক্ষ লোক ব্যাংক থেকে ঋণ করে শেয়ার ক্রয় করেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের ইতিহাসে সেদিনকে ‘কালো বৃহস্পতিবার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। মূলত সেদিনই অর্থনৈতিক মহামন্দার দিকে প্রথম পা ফেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

image source: moneyweek

এর চার দিন পর ২৯ অক্টোবর নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খায়। সেদিন প্রায় ১৬ মিলিয়ন শেয়ার বিক্রি হয়েছিল। মূলত বিপর্যয় বুঝতে পেরে, একটি মহল চারদিন আগে ক্রয় করা শেয়ারগুলো বিক্রি করতে থাকে।

কিন্তু মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের শেয়ারগ্রহীতারা সেটি বুঝতে না পেরে, কম দামে পাওয়ার লোভে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেসব শেয়ার কেনেন। আর এরই মাঝে শুরু হয় দরপতন। হাহাকার নেমে আসে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। ইতিহাসে ঐ দিনটিকে ‘কালো মঙ্গলবার’ হিসেবে উল্লেখ করেন অর্থনীতিবিদরা।

গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাব

১৯২৯ সালের অক্টোবরের ঐ দুই দিনে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার। নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েন নতুন বিনিয়োগকারীরা। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট-বড় সকল ক্ষেত্রে।

কয়েকদিনের মধ্যে শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেক হ্রাস পায়। ব্যবসায়ে নিশ্চিত ক্ষতি বুঝতে পেরে বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মী ছাঁটাই শুরু করে। কোথাও কোথাও গুলিবর্ষণ করে কর্মীদের মেরে ফেলার মতো ঘটনাও ঘটে। দোকানগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও, ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছিলেন না বিক্রেতারা।

মাত্র ১ বছরের মাথায় প্রায় ১ কোটি মার্কিন নাগরিক বেকার হয়ে পড়েন, যা ১৯৩১ সালে গিয়ে দেড় কোটিতে ঠেকে। রাষ্ট্রপতি হার্বার্ট হোভারের প্রশাসনও এই অবস্থায় দিশেহারা হয়ে যায়। তারা তাদের বেশকিছু বড় প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানেও লক্ষ লক্ষ লোক বেকার হয়ে পড়েন।

গোটা যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তা রাস্তায় মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করে। সেই সময় মানুষ অভাবের তাড়নায় নিজেদের ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেও ক্রেতা খুঁজতেন। শুধু তাই নয়; অবস্থা এতটাই বেগতিক ছিল, যে কৃষকেরা নিজেদের ফসল সংগ্রহের সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেন! তারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কাজ খুঁজে গোটা দিন পার করতেন।

গ্রেট ডিপ্রেশন-এর সময়ে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় এক পথশিল্পী; Image source: historic uk

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মতো দেউলিয়া হয়ে যায় ব্যাংকগুলোও। লোকজন তাদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত আনতে কিংবা নতুন করে ঋণ নিতে গেলে তারা তাদের দরজা বন্ধ করে দিতো। ১৯৩৩ সালে প্রায় সবগুলো শহরের ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়। আর বেকার নাগরিকদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ মিলিয়নে।

যেখানে ১৯২৯ সালেও ৯০ শতাংশ মার্কিন নাগরিক শেয়ার বাজারের নিয়মিত বিনিয়োগকারী ছিলেন, সেখানে ১৯৩৩ সালে এসে ১৫ মিলিয়ন নাগরিকের বেকারত্ব এবং ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হওয়ার মতো ঘটনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। আর এই দুর্দিনে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে।

গ্রেট ডিপ্রেশনে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিবর্তন

অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণে মার্কিন রাজনীতিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ১৯২৯ সালে যখন শেয়ারবাজারে দরপতন হয় এবং ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হতে শুরু করে তখন নেতৃত্বে ছিলেন রাষ্ট্রপতি হার্বার্ট হুভার।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার পূর্বে হুভার এক সময় মার্কিন বাণিজ্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। যার কারণে প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিশ্বাস ছিল, তিনি দেশকে এই মন্দা পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে পারবেন। কিন্তু বাস্তবে, রিপাবলিকান হুভার মানুষের চিন্তাচেতনাকে মোটেও মূল্যায়ন করেননি! এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি হেঁটেছিলেন উল্টোপথে।

প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভার; Image Source: The National

হুভার-প্রশাসন নিঃস্ব হওয়া নাগরিকদের ত্রাণ সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। মূলত রিপাবলিকানরা বিশ্বাস করতেন, সরকার রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সেই সাথে চাকরিচ্যুত কিংবা নিঃস্ব হওয়া লোকদের ত্রাণ সরবরাহে তারা দায়বদ্ধ নন।

সরাসরি নাগরিকদের সঙ্গে সমঝোতায় না গিয়ে হুভার-প্রশাসন রাষ্ট্রের বড় বড় প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেয়, যাতে সেখান থেকে অর্থ বাঁচিয়ে তা ব্যাংকগুলোকে ঋণ হিসেবে দিতে পারে। যদিও তাদের এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। এছাড়াও তারা এই মন্দার সুযোগ কাজে লাগিয়ে মেক্সিকান শরণার্থীদের বিতাড়িত করার কার্যক্রম শুরু করেছিল।

প্রেসিডেন্ট হুভার বিরোধী স্লোগানে-ফেস্টুনে ছেয়ে গিয়েছিল চারপাশ; Image source: britanica

অতঃপর নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে, ১৯৩৩ সালের মার্চের ৪ তারিখ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ডেমোক্রেট নেতা ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৩২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

মূলত রিপাবলিকানদের ব্যর্থতার দিনে ডেমোক্রেটরা পরিবর্তনের আশ্বাস দেন, যা মার্কিনিদের আকৃষ্ট করেছিলো। আর দায়িত্ব নেওয়ার ১০০ কার্যদিবসের মধ্যে রুজভেল্ট প্রশাসন শুরু করে আশার আলো দেখাতে। নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুরু হয়।

দুর্গতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকলে মানুষ সন্তান বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিতে পারে?; Image source: rare history

রুজভেল্ট প্রথমেই চারদিনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ দেশের সমস্ত ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করেন। ঐ চারদিনের মধ্যে তিনি কংগ্রেসে নতুন আইন পাশ করিয়ে শিল্প, কৃষি ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে গতিশীল করার উদ্যোগ নেন।

পুরোদমে শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যক্রম। রুজভেল্ট ব্যাংকের নিয়মনীতি পরিবর্তন করেন এবং শুধুমাত্র আমদানির জন্য ঋণ প্রদানের শর্ত ছুঁড়ে দেন। আর এই শর্তে স্থানীয় ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে থাকে।

গ্রেট ডিপ্রেশনের টুকরো টুকরো স্মৃতি; Image source: sites.google

রুজভেল্ট প্রশাসন বেশ কিছু বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। মূলত প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নাগরিকদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। সে প্রকল্পের মধ্যে টেনেসি ভ্যালি অঞ্চলের বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ, বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থা এবং জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ছিল উল্লেখযোগ্য।

উক্ত প্রকল্পে ১৯৩৫ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত, প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন মার্কিন নাগরিক স্থায়ীভাবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। শুধুমাত্র একটি প্রকল্পের মাধ্যমেই রুজভেল্ট প্রশাসন অর্ধেক নাগরিকের অবস্থান পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। এছাড়াও ডেমোক্রেটরা নেতৃত্ব কাঁধে নেওয়ার পরের ৩ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি গড়ে ৯ শতাংশ বেড়েছিল।

নিউ ইয়র্কের রাস্তায় প্রতিবাদী পোস্টারসমেত এক বিক্ষুব্ধ নাগরিক; Image source: moneyweek

যখন গ্রেট ডিপ্রেশন শুরু হয়, তখনও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য কোনো সামাজিক নিরাপত্তা আইন ছিল না। ছিল না বেকার ভাতা, কিংবা বয়স্ক ভাতা। রুজভেল্ট প্রশাসন ১৯৩৫ সালে কংগ্রেসে সোশাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাশ করে। নতুন এই আইন পাশ করার কারণে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা এবং পেনশনের অন্তর্ভুক্ত হন। যদিও এই কার্যক্রমের নিয়মনীতি ছিলো খুব কঠিন।

রুজভেল্ট প্রশাসনের সংস্কারপন্থী মনোভাবের কারণে ১৯৩৮ সাল থেকে আবারও অর্থনৈতিক-উন্নতির দেখা পান মার্কিনিরা। রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয়ে পার্থক্য কমতে থাকে, সেই সাথে মানুষও হয়ে ওঠেন স্বাবলম্বী। ব্যাংকগুলোও আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ায় এবং শেয়ারবাজার আগের অবস্থানে ফিরে যায়।

যদিও সেই সময় একেবারেই অর্থনৈতিক মহামন্দা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি দেশটি। কারণ পুরোপুরি ক্ষতি কাটিয়ে পূর্বের অবস্থানে ফিরে আসতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজনও ছিল।

ভাতা প্রদানের লাইন; Image source: the week

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন নীরবে এগিয়ে চলছিল, ঠিক তখন ইউরোপে শুরু হয় রাজনৈতিক আন্দোলন, যা পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রূপ নেয়। জার্মান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্রিটেন এবং ফ্রান্সকে সমর্থন দেওয়ায় জার্মানদের চক্ষুশূলে পরিণত হন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট।

আর এতে করে নানারকম হুমকির সম্মুখীন হন তিনি। যুদ্ধের অশনি সংকেত টের পেয়ে, সামরিক শক্তির উন্নয়ন ঘটান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট। এতে করে লক্ষ লক্ষ লোকের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। সেই সাথে গ্রেট ডিপ্রেশন বা অর্থনৈতিক মহামন্দা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

গ্রেট ডিপ্রেশনের সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কর্তৃক মেক্সিকানদের প্রত্যাবাসন

অর্থনৈতিক মহামন্দার সময়ে মার্কিন প্রশাসন ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণিত একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। বরাবরই মেক্সিকানরা ছিলেন মার্কিন নাগরিক এবং প্রশাসনের চোখের বালি। অন্যদিকে, দুই দেশের মধ্যকার সুদীর্ঘ সীমান্ত খোলা থাকায় মেক্সিকো থেকে লাখ লাখ মানুষ প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন।

এমন শরণার্থীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। প্রতিনিয়ত বেড়ে চলা মেক্সিকানদের অনুপ্রবেশ সীমিত করতে নানানরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সরকার। যদিও ততদিনে দেশটির প্রায় প্রতি অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস শুরু করেন লক্ষ লক্ষ মেক্সিকান।

চিন্তিত মায়ের এই ছবিটিই পরবর্তীকালে গ্রেট ডিপ্রেশনের সমার্থক হয়ে গিয়েছিল; Image source: tonsoffacts

গ্রেট ডিপ্রেশন শুরুর সময়ে মার্কিন নাগরিকদের বেকার সমস্যার সমাধানে, মেক্সিকো থেকে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো লোকদের বিতাড়িত করার উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট হোভার। এছাড়াও তখন তার সরকার মেক্সিকানদের সঙ্গে আসা কুষ্ঠ, কলেরা ইত্যাদি রোগের স্থায়ী সমাধানেরও পথ খুঁজছিলেন।

বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে, সেই সময় প্রায় ১.৮ মিলিয়ন লোককে মেক্সিকোতে প্রত্যাবাসন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাদের মধ্যে সবাই মেক্সিকান ছিলেন না। বস্তুত ঐ ১.৮ মিলিয়নের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন বিভিন্ন সময়ে মেক্সিকোতে পাড়ি জমানো পরিবারের সন্তান। তাদের মধ্যে প্রায় সবার জন্মও যুক্তরাষ্ট্রে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা মেক্সিকান বংশোদ্ভূত মানুষদের বিতাড়িত করেছিল হোভার প্রশাসন।

পুরো কাজটি তারা ধাপে ধাপে সম্পন্ন করেছিল। ৩০’ এর দশকের শুরুর দিকে লস অ্যাঞ্জেলস কল্যাণ বিভাগের হাসপাতালে ভর্তি কুষ্ঠ ও কলেরা রোগীদের মেক্সিকোতে প্রেরণ করে স্থানীয় সরকার। অতঃপর বিভিন্ন সময় একসঙ্গে হাজার হাজার মেক্সিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন শিশু-কিশোরকে বিতাড়িত করে তারা। আর এই কাজটি সম্পন্ন করতে তারা ১৯২৯ সালে কংগ্রেসে পাশকৃত লিভিংস্টোনের ১৩২৫ ধারার অভিবাসন নীতিকে কাজে লাগান।

সব হারিয়ে শহর ছাড়ছে এক পরিবার; Image source: the atlantic

এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস সীমান্ত দিয়েই পরিচালিত হয়নি। এটি মিশিগান, ইলিনয়, কলোরাডো, ওহাইয়ো এবং নিউ ইয়র্ক থেকেও পরিচালিত হয়েছিল। আর এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণসমেত সাক্ষ্য দেন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা একজন মেক্সিকান নাগরিক।

হোসে লোপেজ নামক ঐ ব্যক্তি ২০০৩ সালে তার পরিবারকে ক্যালিফোর্নিয়া দিয়ে পশ্চিম মেক্সিকোতে বিতাড়িত করার লোমহর্ষক সাক্ষ্য দেন। লোপেজের মতো গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় বিতাড়িত লোকদের মধ্যে ৬০ শতাংশের জন্ম হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জন-আইন বিভাগের অধ্যাপক কেভিন আর জনসন বলেন, “তৎকালীন এই প্রত্যাবাসনে কোনোপ্রকার আইন মানা হয়নি এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনাও অনুসরণ করেনি সরকার। তাই যে কেউ বলতে পারেন যে ,এই বৃহৎ জনসংখ্যাকে বিতাড়িত করা ছিল সংবিধান, আইন পরিপন্থী, যার দায় যুক্তরাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে না।”

রিপাবলিকানদের পর ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া ডেমোক্রেট নেতা ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট এই প্রত্যাবাসন নীতিকে সমর্থন দেননি, আবার নিষেধও করেননি! যদিও এর পেছনে কারণ ছিল।

রুজভেল্ট চেয়েছিলেন দেশকে চলমান অর্থনৈতিক মন্দা থেকে মুক্ত করতে। আর সেটি করতে গিয়ে তিনি অভিবাসন নীতি নিয়ে ভাবেননি। শুধু হোভার, রুজভেল্ট নন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘আসল’ নাগরিকরাও এই মেক্সিকানদের পছন্দ করতেন না!

শহর ছাড়বার আরেকটি করুণ দৃশ্য; Image source: ny times

পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মৃত্যুবরণ করার পূর্বে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ নেন, যার ফলে বিতাড়িত হওয়া লোকদের একটি অংশ আবারও যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত আসতে পেরেছিলেন। যদিও মেক্সিকোতে বিতাড়িত হওয়ার পর সেখানে মেক্সিকানদের নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেন। মার্কিন পুরুষরা যুদ্ধে যোগ দেয়ার কারণে দেশটির কৃষি এবং শিল্পকারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। আর সেগুলোকে গতিশীল করতে ব্রাকেরো প্রোগ্রাম নামক একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার।

মেক্সিকান বংশোদ্ভূত মার্কিনিদের মেক্সিকোতে পুশব্যাক করা হচ্ছে; Image source: history

এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃৃষিকাজে এবং শিল্পকারখানায় শ্রমিক হিসেবে লাখ লাখ মেক্সিকানকে স্বল্প মজুরিতে নিয়োগ দেয় মার্কিন প্রশাসন। আর তারা এই প্রক্রিয়ায় অগ্রাধিকার দেয় গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় বিতাড়িতদের।

শেষপর্যন্ত ঘুরেফিরে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করা নাগরিকদেরই শ্রমিক হিসেবে ফিরিয়ে আনে তারা। যদিও ১৯৪৫ সালে রুজভেল্ট মৃত্যুবরণ করায় তার অনেক পরিকল্পনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তার মৃত্যুর পর একাধিক নেতা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলেও মেক্সিকানদের জন্য তৈরি অভিবাসন নীতি এবং ৩০’ এর দশকের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষমা চাননি কেউই।

জমিতে কাজ করছেন মেক্সিকান বংশোদ্ভূত মার্কিন চাষীরা; Image source: 21 bern

পরবর্তীকালে এই ঘটনায় মামলা হলে তার দীর্ঘ বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করে যুক্তরাষ্ট্র। রায় অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেও সে সময় বিতাড়িত হওয়া প্রায় ১.২ মিলিয়ন লোককে নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য হয় দেশটি।

যদিও ততদিনে তাদের বেশিরভাগই মৃত্যুবরণ করেছিলেন, কিংবা ব্রাকেরো প্রোগ্রামে কাজ করতে এসে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছিলেন। ২০১৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বিচার-বিভাগ একটি আইন পাশ করে, যার মধ্যদিয়ে ৩০’ এর দশকের সেই নির্মম ঘটনাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

 

Related Articles

Exit mobile version