ভিয়েনা কংগ্রেস
জয়ের ভাগ বুঝে নিতে ১৮১৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই ভিয়েনাতে ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা উপস্থিত হতে থাকে। মূল খেলোয়াড় চারজন, জার আলেক্সান্ডার, অস্ট্রিয়ার মেটেরনিখ, প্রুশিয়ার ফ্রেডেরিক উইলিয়াম ও হার্ডেনবার্গ আর ইংল্যান্ডের পক্ষে ক্যাস্টারলেই। ক্যাস্টারলেইকে পরে প্রতিস্থাপন করেন ওয়েলেসলি, আর তিনি যুদ্ধে চলে গেলে সেখানে আসেন লর্ড ক্ল্যানকার্টি। নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে এই কংগ্রেস চলেছিল পরের বছরের জুন অবধি, যার মধ্যে একশ দিনের যুদ্ধ (The Hundred Days War) হয়ে যায়।
ফ্রান্সের প্রতিনিধি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁলিরা (Talleyrand), তবে প্রথমে তার ভোটাধিকার ছিল না এবং মূল চার মাথার আলাপচারিতায় অংশগ্রহণের সুযোগও ছিল সীমিত। একই অবস্থা ছিল স্পেন এবং আমন্ত্রিত সুইডেনসহ ইউরোপের অন্যান্য ছোট রাষ্ট্রগুলির। তবে তাঁলিরা ঝানু কূটনীতিক। স্পেন আর ছোট রাজ্যগুলোর সমর্থন নিয়ে দুই মাসের মাথায় তিনি ফ্রান্সের ভোটাধিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করেন। তার দক্ষতাতেই একশ দিনের যুদ্ধের সমাপ্তির দুই সপ্তাহ আগেই কংগ্রেসের ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়ে যায়, ফলে যুদ্ধে পরাজিত হলেও ফ্রান্সকে বিশেষ কোন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি।
চূড়ান্ত চুক্তিপত্রে ফ্রান্সকে ১৭৯২ নয়, ১৭৮৯ এর পূর্বের সীমান্তে ফিরে যেতে হয়। তার মানে ছিল ফরাসি বিপ্লবের পর অন্তর্ভুক্ত সমস্ত অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে। ডাচ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হলো বর্তমান বেলজিয়াম। ১৮১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি স্যাক্সোনির আনুষ্ঠানিক বিভক্তিতে প্রুশিয়া পেল রাজ্যের দুই-পঞ্চমাংশ। এদিকে প্রুশিয়ান কিছু অঞ্চল আবার হ্যানোভার নিয়ে যায়। ব্রিটিশরা চাপ দিয়ে প্রুশিয়াকে গছিয়ে দিল রাইন আর ওয়েস্টফ্যালেয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, যা পূর্বে হ্যানোভার থেকে পশ্চিমে ফ্রান্স আর নেদারল্যান্ড অবধি চলে গেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল এই অঞ্চল থেকে যেহেতু অস্ট্রিয়া বিদায় নিচ্ছে, সেহেতু ফ্রান্সকে পাহারা দিতে প্রুশিয়ার মতো কাউকে প্রয়োজন। সুইডিশ পোমেরানিয়াও প্রুশিয়ার হাতে চলে যায়। প্রুশিয়ার অনিচ্ছাসত্ত্বেও অস্ট্রিয়ার প্রভাব বলয়ের ভেতর থেকে জার্মান রাষ্ট্রগুলো একটি কনফেডারেশন গঠন করা হলো। অস্ট্রিয়া পেল ভেনিস, আর পোল্যান্ডের অংশবিশেষ আবার রাশিয়ার পেটে চলে গেল। ইংল্যান্ড পেল মাল্টা, উত্তমাশা অন্তরীপ, শ্রীলঙ্কার উপনিবেশ।
ফ্রেডেরিক উইলিয়াম কিন্তু খুব খুশি হলেন না। কারণ ভাগাভাগির অসমতার ফলে তার রাজ্য বেখাপ্পামতো হয়ে গেল। পূর্ব আর পশ্চিম প্রুশিয়া আলাদা করা ছিল হেসে, হ্যানোভার আর ব্রান্সউইক দিয়ে। ৭০০ মাইল বেশি সীমান্ত তাকে এখন পাহারা দিতে হবে সীমিত জনবল নিয়ে। সীমান্তের একপ্রান্ত গিয়ে ঠেকেছে মোজেল নদীর তীরবর্তী ফরাসী থিঁওভিল দুর্গ বরাবর, আরেক দিক চলে গেছে নিমেন নদীর দিকে। বলা যায় প্রুশিয়া এখন তিনটি, একটি জার্মানিতে, একটি রাইনের তীরে, আরেকটি পোল্যান্ডে। তিন অঞ্চলের মধ্যে অন্যান্য রাষ্ট্র মাথা তুলে আছে। এই বিভক্তি দূর করার প্রধান উপায় একটাই, একীভূত জার্মানি।
সম্রাটের প্রত্যাবর্তন
এল্বাতে বসে নেপলিয়নের নজর এড়াচ্ছিল না কিছুই। ভিয়েনাতে ভাগবাটোয়ারা নিয়ে কোয়ালিশনের মধ্যে মন কষাকষি শুরু হয়েছে। প্রাথমিক উচ্ছাস কেটে যেতে জনগণও রাজতন্ত্রের ব্যাপারে আবার বিরক্ত হয়ে উঠছে। অষ্টাদশ লুই ফরাসী বিপ্লবের সমস্ত চিহ্ন ঝেড়েপুছে ফেলতে চাইছেন। ভাই-ভাবির মৃত্যুবার্ষিকী রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ভোটাধিকারের ব্যাপারেও সম্পদশালী লোকেরা ছাড়া আর সকলকেই বঞ্চিত করা হয়েছে। লুইয়ের সাথে বহু রাজ সমর্থক দেশে ফিরে এসেছে। তাদের এবং ক্যাথলিক চার্চের অনেক সম্পত্তি বিপ্লবের সময় বাজেয়াপ্ত করে সাধারণ জনতার মাঝে বিলিবন্টন করা হয়েছিল। এখন তারা আবার সেগুলো ফেরত চাচ্ছে। সব মিলিয়ে গণ-অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করেছে। রাজ সমর্থকেরা নেপোলিয়নের ব্যাপারেও উদ্বিগ্ন। ফ্রান্স থেকে এল্বার দূরত্ব বেশি নয়। তারা ভয় পাচ্ছে নেপোলিয়ন যেকোনো সময় ফিরে এসে রাজার কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারেন। তাকে আটলান্টিকের গহিন কোনো দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।
এদিকে পরিস্থিতি অনুকূল দেখে নেপোলিয়ন ২৫ ফেব্রুয়ারি ১১০০ বিশ্বস্ত লোক নিয়ে ছয়টি জাহাজ ভাসালেন ফ্রান্সের দিকে। দ্বীপের চারিদিকে থাকা ব্রিটিশ এবং স্প্যানিশ নৌবহর ঐদিন অনুপস্থিত ছিল। চার দিন পর সম্রাট এসে নামলেন কাঁনে’র কাছে। তিনি উত্তরে যাত্রা করলেন, উদ্দেশ্য গ্রেনোবল। নেপোলিয়নের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে সেই অঞ্চলের পরিচিত আছে। লুই তাকে গ্রেফতার করতে সেনা পাঠালেন। পঞ্চম রেজিমেন্ট প্রথম তার মুখোমুখি হয়। তারা নেপোলিয়নের দলে যোগ দিল। আরো কয়েকটি সেনাদল একই কাজ করলে প্যারিস থেকে মার্শাল নেই ৬,০০০ সেনা নিয়ে রওনা হলেন। নেপোলিয়নকে খাঁচায় ভরে প্যারিসে আনার কথা বলে গেলেও বাস্তবে তিনি তার প্রাক্তন কমান্ডারের হাতেই নিজের ভাগ্য সঁপে দিলেন। লিঁওতে মার্শাল ম্যাকডোনাল্ডের সেনারাও সম্রাটের জয়ধ্বনি করে তার পতাকাতলে সমবেত হলো। নেপোলিয়ন লুইকে বলে পাঠালেন আর সেনা পাঠানোর প্রয়োজন নেই, তার যা দরকার তিনি পেয়ে গেছেন। ২০ মার্চ নেপোলিয়ন প্যারিসে পৌঁছতে পৌঁছতে লুই পালিয়ে যান।
সপ্তম কোয়ালিশন
মার্চের ১৩ তারিখ ভিয়েনাতে বসেই অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, প্রুশিয়া আর রাশিয়া সপ্তম কোয়ালিশন গঠন করে। ২৫ তারিখ এর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন করা হয়। জুলাই মাসের ১ তারিখে আবার ফ্রান্সে আগ্রাসনের পরিকল্পনা ধার্য হলো। রাশিয়া আর অস্ট্রিয়া সৈন্য সমাবেশ শুরু করে। এদিকে আগে থেকেই বেলজিয়ামে ব্লুশা আর ওয়েলেসলি (ডিউক অফ ওয়েলিংটন) অবস্থান করছিলেন। ওয়েলেসলি ব্রাসেলসে মূল ঘাঁটি বানিয়েছিলেন, আর ব্লুশা নামুর শহরের কাছে শিবির করেন। ফলে কোয়ালিশনের পুরো বাহিনী ভাগ ভাগ হয়ে ছড়িয়ে ছিল বিরাট অঞ্চল জুড়ে।
নেপোলিয়ন মোটামুটি আড়াই থেকে তিন লাখ সেনা জড়ো করলেন। প্যারিস রক্ষার দায়ভার বর্তাল মার্শাল ডেঁভোর কাঁধে, নেপোলিয়নের সাথে রওনা দিলেন সল্ট, নেই, গ্রুশি আর এরলন। সম্রাটের ইচ্ছা শত্রু প্রস্তুত হবার আগেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া। বেলজিয়ামে লড়াই করার ফয়সালা করলেন তিনি, উদ্দেশ্য প্রুশিয়ান আর ব্রিটিশ বাহিনীকে একত্রিত হবার সুযোগ না দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে তাদের ধ্বংস করে ফেলা। সূচনা হল শতদিনের যুদ্ধ বা হান্ড্রেড ডেইজ ওয়ার্সের।
যুদ্ধের সূচনা
জুনের প্রথম সপ্তাহে শোয়ার্জেনবার্গ অস্ট্রিয়ানদের নেতৃত্ব দিয়ে জার্মানির ভেতর দিতে রাইনের পথ ধরলেন।তার দিকে না গিয়ে নেপোলিয়ন চলে যান বেলজিয়ামে। নেপোলিয়নের বেলজিয়াম অভিযান ওয়াটারলু ক্যাম্পেইন বা ফ্লেমিশ যুদ্ধ নামে পরিচিত।
ওয়াটারলু ক্যাম্পেইন এর পুরো অঞ্চল খুব বেশি বড় নয়। এর দক্ষিণে মঁবেজ আর নামুর শহরের যোগসূত্র সাম্ব্রে নদী।দুই শহরে মাঝামাঝিতে শাহ্লেওয়া (Charleroi) নগরী। এখানে ব্রাসেলসের রাস্তা নদী পার হয়ে চলে গেছে। রাস্তা ধরে নগরের দশ মাইল উত্তরে গেলে একটি চৌরাস্তা, ক্যাট্র ব্র্যা। এর এক মাইল দক্ষিণে লিনি শহর। শাহ্লেওয়া’র বিশ মাইল উত্তরে ছোট্ট গ্রাম ওয়াটারলু। তার দশ মাইল পূর্বে ওয়াভ এলাকা।
১৫ জুন ফরাসীরা শাহ্লেওয়া’র সামনেই সাম্ব্রে পার হয়ে এলো। পথিমধ্যে প্রশিয়ান চৌকিগুলি তারা উড়িয়ে দেয়। ব্লুশা আর ওয়েলেসলি তাদের আশা করেননি। ফলে দুজনেই বেকায়দায় পড়ে যান। ফরাসিরা অবস্থান নেয় প্রুশিয়ান আর ব্রিটিশদের মাঝে। মার্শাল নেই ক্যাট্র ব্র্যা’র দিকে চাপতে থাকেন, সেখানে ছিল ওয়েলেসলির একদল সেনা। লিনির দক্ষিণে একদল ফরাসী সেনা ছাউনি ফেলল। নেপোলিয়ন অবস্থান নেন শাহ্লেওয়া’তে, মার্শাল এরলনও তার সেনা নিয়ে অন্যদিকে শিবির করেন।ব্লুশা এদিকে লিনির দিকে এগিয়ে এলেন।ওয়েলেসলি চললেন ক্যাট্র ব্র্যার দিকে।
১৬ তারিখ দুদিকে লড়াই শুরু হলো। একদিকে নেপোলিয়ন বনাম ব্লুশা, অন্যদিকে নেই আর ওয়েলেসলি। সত্তুরোর্ধ্ব ব্লুশার সাথে ৮০,০০০ সৈন্য, নেপোলিয়নের ৭০,০০০। ফলে সম্রাট এরলনকে সংবাদ দেন তার সাথে যোগ দিতে, নেই আবার তাকে ডেকে পাঠালেন ক্যাট্র ব্র্যার দিকে। এই চক্করে পড়ে এরলন একবার যান লিনির দিকে, আবার রওনা দেন ক্যাট্র ব্র্যার দিকে। ফলে কোনো লড়াইয়েই তিনি অংশগ্রহণ করতে পারলেন না।
এদিকে এরলন না আসাতে সম্রাট ইম্পেরিয়াল গার্ডদের লেলিয়ে দিলেন প্রুশিয়ানদের দিকে। এবার ব্লুশা পিছাতে বাধ্য হন। ১৬,০০০ প্রুশিয়ান মারা যায় এই লড়াইয়ে। ব্লুশার ঘোড়া গুলি খেলে তিনি চাপা পড়েন ঘোড়ার মৃতদেহের নিচে। এ সময় তার আশপাশ দিয়ে ফরাসি অশ্বারোহীরা পলায়নরত প্রুশিয়ানদের তাড়া করে। বুদ্ধি করে ব্লুশার সহকারী কম্যান্ডারকে গ্রেটকোট দিয়ে ঢেকে দেন, ফলে তার পদমর্যাদার প্রতীক ফরাসিরা দেখতে পায়নি। পেলে নিশ্চিতভাবেই তার ব্লুশার ব্যাপারে মনোযোগী হত। হয়তো তাকে হত্যা করত, বা বন্দি করে নিত।
যুদ্ধক্ষেত্রে আটকে থাকা ব্লুশা বেশ কয়েকঘন্টা তার বাহিনীর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। এ সময় তার স্টাফ অফিসার গিনিয়াসেনইয়ো দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশদের খুব একটা বিশ্বাস করতেন না। এই সমস্যা কোয়ালিশন বাহিনীর বহু পুরনো। কোয়ালিশনের কমান্ডারদের নিজেদের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস নেপোলিয়নের কাছে তাদের বারংবার পরাজয়ের অন্যতম একটি কারণ ছিল। তবে ব্লুশার নির্দেশ ছিল পশ্চাদপসরণ করলে ওয়াভে গিয়ে সবাইকে মিলিত হতে হবে, সেখানে থেকে উদ্দেশ্য হবে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে ওয়াটারলুতে একত্রিত হওয়া। গিনিয়াসেনইয়ো ওয়াভে চলে যান, সেখানে একপর্যায়ে ব্লুশাও যোগ দেন। তিনি দ্রুত কিছু সেনা অগ্রবর্তী দল হিসেবে ওয়াটারলু’র দিকে প্রেরণ করেন।
পরদিন নেপোলিয়ন গ্রুশাকে পাঠালেন তাদের ধাওয়া করতে, যাতে তারা ঘুরে আবার ওয়েলেসলির সাথে মিলিত না হতে পারে। ক্যাট্র ব্র্যা’তেও ওয়েলেসলি অবস্থান ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি চলে গেলেন ওয়াটারলু। এদিকে গ্রুশার ধাওয়া এড়াতে ব্লুশা মূল প্রুশিয়ান সেনাদল নিয়ে ঘুরপথ ধরলেন, ফলে অনেক সময় লাগল তার ওয়াটারলু পৌঁছতে।
ওয়াটারলু
ব্রাসেলসের বাইরে সঁয়নি বনাঞ্চল। এর একপ্রান্তে ওয়াটারলু গ্রাম। ব্রিটিশ কম্যান্ড সেন্টার এখানে নিয়ে এসেছেন ওয়েলেসলি। ব্রিটিশ বাহিনী বলা হলেও এটি আসলে সম্মিলিত একটি বাহিনী যেখানে ৬৮,০০০ সেনা ইংরেজ, বাকিরা হ্যানোভার, ব্রান্সউইক, নেস এবং নেদারল্যান্ডসের। ওয়াটারলুর দুই মাইল দূরে সেন্ট জ্যাঁ পর্বতের ঢালে ব্রিটিশ লাইন। তাদের সামনে দিয়ে চলে গেছে ব্রাসেলসে দিকে যাবার রাস্তা। রাস্তার পূর্বে সমতলভূমি, কিন্তু ঝোপঝাড়ে ঢাকা থাকায় অশ্বারোহী সেনারা কোনো কাজে আসবে না। পশ্চিমে প্রায় সাড়ে তিনশ মিটার জায়গা ঝপ করে পাঁচ দশ ফুট নিচু হয়ে গেছে। শাহ্লেওয়া থেকে ব্রাসেলসের রাস্তা ধরে নেপোলিয়ন এখানে এসে উপস্থিত হলেন।
ব্রিটিশদের অবস্থান প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত হলেও সমস্যাও কম নয়। তাদের পালিয়ে যাবার রাস্তা একটাই, পেছনদিকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সঙ্কীর্ণ বিপদজনক রাস্তা। তবে ওয়েলেসলি আশা করছেন পালানোর প্রয়োজন হবে না, ব্লুশা এসে পড়লে দুজনে মিলে নেপোলিয়নকে উচিত শিক্ষা দিতে পারবেন।
১৭ জুন রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তাঘাট ভিজে গিয়েছিলে। ফলে ফরাসিরা তাদের ব্যবহারের জন্য কামান টেনে নিতে অসুবিধায় পড়ে। তাদের কামানের সংখ্যা ছিল ব্রিটিশদের থেকে বেশি, ফলে শুরুতেই নেপোলিয়ন হোঁচট খেলেন। তিনি কৌশলগত একটি ভুলও করে বসেন। তিনি যদি সকালে আক্রমণ শুরু করতেন তাহলে প্রায় শতভাগ সম্ভাবনা ছিল যে দুপুরের মধ্যেই ওয়েলেসলির ব্যুহ খানখান হয়ে যেত। তা না করে তিনি দুপুর অবধি অপেক্ষা করেন, ইচ্ছা ছিল মাটি শুকিয়ে গেলে কামান টেনে নিয়ে ব্রিটিশদের বরাবর তাক করবেন। এই দেরির কারণে প্রুশিয়ানরা এসে পড়বার সুযোগ পায়।
এদিকে গ্রুশা প্রুশিয়ানদের একটি অংশ ওয়াভের কাছে নাগালে পেয়েছেন। এখানে তিনি তাদের হটিয়ে দেন, কিন্তু তাকে ফাঁকি দিয়ে ব্লুশা মূল বাহিনী নিয়ে ততক্ষণে ওয়াটারলুর দিকে পাড়ি জমিয়েছেন। সেখানে ওয়েলেসলির অবস্থা মোটামুটি কেরোসিন। ফরাসী গোলাগুলিতে বহু সৈন্য নিহত হয়েছে, অনেক জায়গাতেই প্রতিরোধ প্রচণ্ডভাবে দুর্বল। নিচু রাস্তার দিক থেকে বিপুল বিক্রমে ফরাসি চার্জ ব্রিটিশদের মধ্যভাগকে ঠেলে দিয়েছে পেছনে। ব্রিটিশ ব্যুহের কাছে সুরক্ষিত সেইন্তে (La Haye Sainte) নামে একটি দুর্গের মতো ফার্মহাউজ ফরাসিরা ব্রিটিশদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। সেখান থেকে তার দুর্বল ব্রিটিশ মধ্যভাগে মরণ আঘাত হানার জন্য তৈরি হচ্ছিল। পার্শ্ববর্তী প্ল্যানেনুয়া গ্রামেও ফরাসি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নেপোলিয়ন জয়ের সুবাতাস পাচ্ছেন। নিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কায় বার বার ঘড়ি দেখতে দেখতে ওয়েলেসলি প্রুশিয়ানদের অভিসম্পাত করছেন। পরাজয় আসন্ন বুঝে তিনি প্রার্থনা করলেন, “ঈশ্বর, হয় রাত নামিয়ে দাও অথবা ব্লুশাকে পাঠাও”।
বিকাল চারটার দিকে অবশেষে প্রুশিয়ান সেনারা আসতে শুরু করে। মূল বাহিনি নিয়ে ব্লুশা পৌঁছালেন আরো পরে। তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাইটানকে পাঠালেন প্ল্যানেনুয়া গ্রাম দখল করতে। বুলোর একদল সেনা একবার সেটা দখল করেও ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু জাইটান দেখতে পেলেন ওয়েলেসলির বাম বাহুর অবস্থা সঙ্গিন। ফলে তিনি কম্যান্ডারের আদেশ পালন মুলতবি রেখে ওয়েলেসলির সাথে যোগ দেন। ফলে ফরাসিরা মার খেয়ে পিছিয়ে যায়। জেনার যুদ্ধের পর প্রুশিয়ান বাহিনীর এটি ছিল অন্যতম একটি পরিবর্তন, যেখানে পরিস্থিতি অনুযায়ী যুদ্ধের মাঠে নেতৃত্ব দানকারী অফিসারেরা বিশেষ পরিস্থিতিতে জেনারেলের অনুমতি ব্যতিরেকেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। জাইটানের এই কাজ যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
জাইটানের আবির্ভাবের ফলে বাম বাহু থেকে অতিরিক্ত সেনা ওয়েলেসলি মধ্যভাগে সরিয়ে আনতে পারলেন।ফলে সেদিকে ফরাসি হামলা ব্যর্থ হয়ে যায়। সম্মিলিত ব্রিটিশ আর প্রশিয়ান সেনাদের আক্রমণে এরপর দলে দলে ফরাসিরা পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে শেষ চেষ্টা হিসেবে নেপোলিয়নের ইম্পেরিয়াল গার্ড মাঠে নামে। এদের ব্যুহ তখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে কেউ ভাঙতে পারেনি। সামনে থেকে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মার্শাল নেই। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তাদের অবিচল প্রতিরোধ কোয়ালিশন বাহিনীকে মুগ্ধ না করে পারেনি। তবে এতে ভবিতব্য পরিবর্তন হল না। দুই পাশ থেকে কামানের গোলার মধ্যে ওয়েলেসলির সৈন্যদের সাথে ফরাসি ইম্পেরিয়াল গার্ডের তুমুল সংঘর্ষে ফরাসি সেনাদের অধিকাংশই মারা যায়। ইম্পেরিয়াল গার্ডদের সেরা সেনাদল, বিখ্যাত ওল্ড গার্ডকে নেপোলিয়ন রেখে দিয়েছিলেন ফরাসীদের পালানোর পথ সুরক্ষিত রাখতে, তাদের তিনি সরাসরি যুদ্ধে পাঠাননি।
ওয়াটারলুর ইতিহাসবিখ্যাত এই যুদ্ধে নেপোলিয়নের ক্ষমতার চূড়ান্ত অবসান হয়। এই যুদ্ধের কৃতিত্ব জনমনে ওয়েলেসলি ওরফে ডিউক অফ ওয়েলিংটন পেলেও অনেক ঐতিহাসিকই মত পোষণ করেন যে যদি ৫০,০০০ প্রুশিয়ানদের নিয়ে ব্লুশা সময়মত হাজির না হতেন তাহলে ইতিহাস নতুন করে লিখতে হত।
প্যারিস চুক্তি
২১ জুন প্যারিসে ফিরে এলেন ক্লান্ত নেপোলিয়ন। তার পক্ষে রাজনৈতিক সমর্থন পুরোপুরি অনুপস্থিত দেখে তিনি তার ছেলেকে উত্তরাধিকারী করে ২২ তারিখ পদত্যাগ করেন। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা তা মেনে নিলেন না। জোসেফ ফুঁশে অস্থায়িভাবে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। ২৫ তারিখ নেপোলিয়ন চলে আসেন প্যারিসের অনতিদুরে মালমেজোঁ’তে। প্রুশিয়ানরা প্যারিসের দিকে এগিয়ে এলে ২৯ তারিখ তিনি ফরাসি বন্দরনগরী রশফাঁ চলে যান, ইচ্ছা এখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রগামি জাহাজে করে পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু ব্রিটিশ নৌবহর ফ্রান্সের চারিদিক ঘিরে রাখায় তার সেই ইচ্ছা বাস্তবায়িত হলো না।
এদিকে নিরুপায় ফরাসিরা আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিলে ৭ জুলাই ব্লুশা আর ওয়েলেসলি প্যারিসে ঢুকলেন। ৮ তারিখ অষ্টাদশ লুই পুনরায় ক্ষমতা নেন। নেপোলিয়ন জানতেন প্রুশিয়ার সাথে যে আচরণ তিনি অতীতে করেছেন, তাতে তাদের হাতে বন্দি হলে কী যন্ত্রণা তার জন্য অপেক্ষা করছে। ফলে ১৫ জুলাই তিনি নিজেকে তুলে দেন ভাগ্যের হাতে, আত্মসমর্পণ করেন চিরশত্রু ব্রিটিশদের রণতরী বেলেরফোনে’র ক্যাপ্টেন মেইটল্যান্ডের কাছে। তাকে নির্বাসন দেয়া হয় সেন্ট হেলেনা দ্বীপে, সেখানেই ১৮২১ সালের ৫ মে তার মৃত্যু হয়। প্রথমে সেন্ট হেলেনাতেই তার কবর হলো। পরে ১৮৪০ সালে নেপোলিয়নের দেহাবশেষ প্যারিসে ফিরিয়ে আনা হলো।
১৮১৫ সালের ২০ নভেম্বর প্যারিসের দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। ভিয়েনা কনভেনশনের ফলাফল মেনে ফ্রান্সকে তার বিপ্লব পূর্ব সীমান্তে ফিরে যেতে হয়। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৭০০ মিলিয়ন ফরাসি মুদ্রাও তাদের উপর ধার্য হয়। সেই সাথে কোয়ালিশনের দেড় লাখ সৈন্য ফ্রান্সে পাঁচ বছরের জন্য রেখে দেয়া হলো, যাদের নেতা হলেন ওয়েলেসলি। এদের খরচ বহনের দায়িত্বও ফরাসিদের নিতে হয়। তবে তিন বছর পরেই দখলদার সেনাদের উঠিয়ে নেয়া হয়।