দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের গুপ্তচরবৃত্তির ৩ টি রোমাঞ্চকর ঘটনা

গল্পের বইয়ে তো কত রকম গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনায় আমরা পড়ে থাকি। এসব রোমহর্ষক অভিযানের গল্প আমাদের নিয়ে যায় কল্পনার এক অন্য রকম রাজ্যে। কিন্তু আজ কোন কাল্পনিক গল্প নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কয়েকটি সত্যিকারের স্পাই বা, গুপ্তচরবৃত্তির গল্প নিয়েই আজকের এই আয়োজন। তো চলুন শুরু করা যাক।

একটি মৃতদেহ যা হিটলারকেও বোকা বানিয়েছিল

তখন ১৯৪৩ সাল। মিত্রশক্তি তখন সিসিলি আক্রমণের ছক করছিল। তারা জানত যে, তারা সিসিলি আক্রমণ করলে হিটলারের নাজি বাহিনী খুব দ্রুতই সেখানে তাদের শক্তি বর্ধিত করার ক্ষমতা রাখে। তাই এখানে আক্রমণের জন্য ব্রিটিশরা কিছু ফন্দী বের করতে থাকে। আর এ জন্যই সাজানো হলো এক মিথ্যা নাটক। এ নাটকের ধারণাটি দিয়েছিলেন বিখ্যাত স্পাই চরিত্র জেমস বন্ডের স্রষ্টা  ইয়ান ফ্লেমিং।

জেমসের বন্ডের স্রষ্টা ইয়াং ফ্লেমিং, ব্রিটিশ নাভাল ইন্টেলিজেন্সের একটি কক্ষে (Source: npr.org/)

জেমসের বন্ডের স্রষ্টা ইয়াং ফ্লেমিং, ব্রিটিশ নাভাল ইন্টেলিজেন্সের একটি কক্ষে; Image Courtesy: npr.org

নাটকের প্লট অনুসারে মিত্রবাহিনী গ্লিনডোর মিশেল নামের এক ভবঘুরে মানুষের মৃতদেহ খুঁজে বের করেন। মিত্র বাহিনী লাশটির নাম দেয় ক্যাপ্টেন উইলিয়াম বিল মার্টিন। এই কাল্পনিক চরিত্রটির জন্ম সাল বানানো হয় ১৯০৭ সালকে। তার জন্ম হয়েছিল ওয়েলসের কার্ডিফে। মার্টিন নামটি পছন্দ করা হয়েছিল কারণ ব্রিটিশ রয়্যাল মেরিন বাহিনীতে ক্যাপ্টেন বা, মেজর পদে মার্টিন নামের অনেক সেনা ছিল তখন। তার পরিচয় পত্রে যে মানুষটির ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল তিনি ছিলেন এম আই ফাইভ অফিসার রনি রিড। তার চেহারা অনেকটাই মৃতদেহটির মত ছিল।

রয়্যাল মেরিনের কাল্পনিক চরিত্র মেজর উইলিয়াম মার্টিনের পরিচয়পত্র (Source: en.wikipedia.org)

রয়্যাল মেরিনের কাল্পনিক চরিত্র মেজর উইলিয়াম মার্টিনের পরিচয়পত্র; Image Courtesy: en.wikipedia.org

মৃতদেহটিকে মিত্র বাহিনীর পোশাক পড়িয়ে দেয়া হয় এবং তার কোমরের বেল্টের সাথে এক ধরণের বিশেষ শিকলের সাহায্যে একটি ব্রিফকেস বেঁধে দেয়া হয়। এই ব্রিফকেসে ছিল গ্রীসে মিত্রবাহিনীর এক মিথ্যা কিন্তু বিশাল আক্রমণের নকশা। তারা একটি নষ্ট প্যারাসুট মৃতদেহটির গায়ে লাগিয়ে দিয়ে মৃতদেহটিকে সমুদ্রের স্রোতের সাথে ভাসিয়ে দিল যাতে হিটলারের নাজি বাহিনী তা খুঁজে পায়।

মৃতদেহটির কাছ থেকে জার্মানরা যা যা খুঁজে পেয়েছিল (Source: npr.org)

মৃতদেহটির কাছ থেকে জার্মানরা যা যা খুঁজে পেয়েছিল; Image Courtesy: npr.org

ব্রিটিশ বা, মিত্র বাহিনী যেরকম আশা করেছিল ঠিক সেরকমই ঘটল। নাজিরা মৃতদেহসহ ব্রিফকেসটি খুঁজে পেল। আসলে মৃতদেহটি স্পেন খুঁজে পেয়েছিল, কিন্তু তাদের ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর সাথে জার্মান ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর যোগাযোগ ছিল। তারা ভাবল কোন বিমান দুর্ঘটনায় মিত্র বাহিনীর এই সৈনিকটি মারা গিয়েছে। তারা আক্রমণের নকশাটিকে আসল ভেবে বসল। হিটলার নিজেও এ বিষয়ে জানতেন এবং তিনি নিজেও ঘটনাটিকে সত্য বলেই মনে করলেন। ফলাফলস্বরুপ জার্মানরা তাদের সেনাবাহিনীর এক বড় অংশকে (প্রায় ৯০ হাজার সৈন্যকে) সেই মিথ্যা আক্রমণের জায়গায় পাঠিয়ে দিল। ফলে মিত্র বাহিনী খুব সহজেই সিসিলি আক্রমণ করে বসল কারণ সেখানে সৈন্য সংখ্যা কমে গিয়েছিল এবং বাইরে থেকে সৈন্য আনার মত অবস্থাও ছিল না নাজিদের। যার ফলে মিত্রবাহিনীর হাজার হাজার সৈনিকের জীবন বেঁচে যায়। ব্রিটিশদের এ আক্রমণের আরো ২ সপ্তাহ পর পর্যন্ত জার্মানরা বিশ্বাস করে বসে ছিল যে, মূল আক্রমণটি গ্রীসেই হবে। কিন্তু সেই আক্রমণটি আর কখনই হয়নি।

এ ঘটনাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এ ঘটনার ফলে জার্মানরা পরবর্তিতে অনেক আসল ঘটনা কাকিতালিয়ভাবে আগেই জেনে যাওয়ার পরও ব্রিটিশদের ফাঁদা পাত ভেবে এড়িয়ে গিয়েছিল এবং ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল।

দ্যা ম্যান হু নেভার ওয়াস বইয়ের প্রচ্ছদ (Source: openlibrary.org)

দ্যা ম্যান হু নেভার ওয়াস বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Courtesy: openlibrary.org

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা বই “দ্যা ম্যান হু নেভার ওয়াস” প্রকাশের পরপরই বেস্ট সেলার বই হয়ে যায়। দুই বছর পর এই একই নামে একটি সিনেমাও মুক্তি পায়।

পোল্যান্ডের এক স্পাইয়ের সাহসিকতার গল্প

ক্রিস্টিনে গ্রানভিলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু সাহসী অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু তার সবচেয়ে সাহসী অভিযান ছিল এক উদ্ধার অভিযান।

ঘটনাটি ফ্রান্সের। তখন ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাস চলছিল। ক্রিস্টিনে ফ্রান্সের এক গেস্টাপো নিয়ন্ত্রিত জেলখানায় ঢুকে পড়েন। গেস্টাপো হচ্ছে তৎকালিন জার্মানদের পুলিশ বাহিনীর নাম। ক্রিস্টিনে সেই জেলে বন্দী থাকা ৩ জন স্পাই যাদের মৃত্যুদন্ডের ঘোষণা হয়েছিল তাদের মুক্ত করে আনেন।

1400354395210-cached

বামে ক্রিস্টিনে গ্রানভিলে এবং ডানে তার জীবনের উপড় ভিত্তি করে লেখা বই দ্যা স্পাই হু লাভডের প্রচ্ছদ; Image Courtesy: thedailybeast.com

এ ঘটনার আগে থেকেই সারা ফ্রান্সে ক্রিস্টিনের মুখ সহ ধরিয়ে দিন লেখা পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে লাগানো ছিল। কিন্তু ক্রিস্টিনে এমনভাবে সেখানে গিয়েছিলেন যে কেউই তাকে চিনতে পারেনি। সে কারারক্ষীদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে, সে একজন ব্রিটিশ স্পাই এবং একজন ব্রিটিশ জেনারেলের ভাগ্নী। সে ক্যাপ্টেন আলবার্ট শেঙ্কের সাথে দেখা করতে সক্ষম হয়। সে আলবার্ট শেঙ্ককে এই বলে হুমকি দেন যে, মিত্র বাহিনী খুব শীঘ্রই তাদের আক্রমণ করতে যাচ্ছে। যদি ধরা পড়া ৩ জন স্পাইয়ের কোন রকম ক্ষতি করা হয় তবে তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ করে দেয়া হবে।  ক্রিস্টিনে তাকে আরো বলেন, তারা যদি ধরা পড়া ৩ জন স্পাইকেই ছেড়ে দেয় তাহলে তাদেরকে পরবর্তিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেয়া হবে এবং মিত্র বাহিনী তাদের কোন ক্ষতি করবে না।

ক্রিস্টিনে তাদের ২০ লাখ ফ্রাঙ্ক পরিমাণ অর্থ দেয়ার লোভ দেখিয়েছিল। ক্রিস্টিনে প্রায় ৩ ঘন্টা ধরে তাদের সাথে কথা কাটাকাটি করে। সে তাদের সাথে আপোষ করার চেষ্টা করে। সে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে তাদের বিভ্রান্ত করে দেয়। ক্রিস্টিনে তাদের বলেছিল মিত্রবাহিনী যেকোন সময় সেখানে চলে আসবে এবং তার সাথে তাদের তারবিহীন যোগাযোগ রয়েছে। সে স্পাইদের একজনকে নিজের স্বামী হিসেবে (যা সত্য ছিল না) এবং অন্যান্যদের তার স্বামীর বন্ধু হিসেবে উল্লেখ করেছিল।

ক্রিস্টিনের ব্যক্তিত্ত্ব, অর্থের লোভ এবং মিত্র বাহিনীর আক্রমণের ভয়ে জার্মান পুলিশরা তার প্রস্তাবে রাজি হয় এবং ৩ জন স্পাইকেই ছেড়ে দেয়। ক্রিস্টিনেকে তার সাহসের জন্য আজও ইতিহাসের পাতায় স্মরণ করা হয়।

এক বিখ্যাত জাজ গায়িকা যিনি তার মিউজিক শিট এবং অন্তর্বাসের ভেতরে করে তথ্য পাচার করতেন

জোসেফাইন বেকার। আমেরিকাই তার জন্ম। বেশ জনপ্রিয় গায়িকা ছিলেন তিনি। নাচতেনও বেশ ভাল। তিনি ১৯৩৭ সালে ফ্রান্সের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। যখন ২য় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকেই ফ্রান্স জার্মানদের দখলে চলে আসে তখন বেকার তাদের বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি আসলে তাদেরই দলের লোক। জোসেফাইন বেকার পরবর্তিতে বেশ কিছু বছর মিত্র শক্তির হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করেন। তিনি উচ্চবিত্তদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে উচ্চ পদের সেনাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতেন।

গায়িকা জোসেফাইন বেকার
Image Courtesy: pinterest

গায়িকা জোসেফাইন বেকার

তিনি তথ্য পাচারের সময় তার মিউজিক শিটে স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় না এমন ধরণের অদৃশ্য কালি দিয়ে তার তথ্যগুলো লিখতেন। যখন কোন গোপন ছবি পাচার করার প্রয়োজন পড়ত তিনি তা তার অন্তর্বাসের ভেতরে পিন দিয়ে আটকিয়ে নিতেন।

এরকম আরো অসংখ্য রোমাঞ্চকর কাহিনীর ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। যার অনেকগুলো কাহিনী হয়ত এখনও সাধারণ মানুষেরা জানে না। পরবর্তীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এমন আরো কিছু রোমাঞ্চকর ঘটনা নিয়ে আপনাদের সামনে আসার ইচ্ছা থাকলো। সেই পর্যন্ত সবাই ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ।

Related Articles

Exit mobile version