আমেরিকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলের ম্যাসাচুসেটস প্রদেশের একটি গ্রাম সালেম, আজকের ডেনভার শহরের সামান্য দূরের এক ছোট্ট লোকালয়। ১৬৯২ সালে এখানেই ঘটে গিয়েছিল ইতিহাসের এক লজ্জাজনক ও বীভৎস ঘটনা। বিচারের নামে হয়েছিল কলঙ্কজনক প্রহসন। কিছু নিরপরাধ ও অসহায় নারীকে ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে সালেম গ্রামে এক নিষ্ঠুর বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল। সেসময় ম্যাসাচুসেটস প্রদেশেটি ছিল ব্রিটিশদের একটি উপনিবেশ। ইংল্যান্ড থেকে আসা অভিবাসীদের একটি দল এই সালেম গ্রামে বসতি স্থাপন করে। কী ঘটেছিল এবং কীভাবে শুরু হয়েছিল সে অন্যায় বিচার, আসুন তা জানতে চেষ্টা করি।
১৬৯২ সাল। এবারের মতো বসন্ত খুব কমই এসেছে সালেম গ্রামে। নতুন পত্র-পল্লবে, আর পাখিদের কলতানে মুখরিত চারিদিক। কিন্তু গ্রামের সব মানুষের মধ্যে সেই বসন্তের আবেদন অনুপস্থিত। এর কারণ কী? ঔপনিবেশিকতার বিস্তারের গোড়ার দিকের সেই দিনগুলিতে লোকজনের মধ্যে নানা অন্ধ বিশ্বাস প্রবলভাবে কাজ করতো। তারা বিশ্বাস করতো ভূত-প্রেত, ওঝা-ঝাড়ফুঁক ও মন্ত্র-তন্ত্রে।
১৬৯২ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সে গ্রামে ১২ বছর বয়সী অ্যাবিগেইল উইলিয়ামস ও তারই চাচাতো বোন ৯ বছর বয়সী বেটি প্যারিস নামের দুই মেয়ে হঠাৎই পাগলামি শুরু করে। মৃগীতে আক্রান্ত রোগীরা যেমন ছটফট করে ও মূর্ছা যায়, অবিকল সেরকম লক্ষণ ফুটে উঠলো তাদের আচরণে। তারা পাগলের মতো গোঙাতে থাকে, আছাড় খেতে লাগে মাটিতে, হাত-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকে সারা উঠোন জুড়ে। কোনো কারণ ছাড়াই অ্যাবিগেইল ও বেটি নিজের মনে কথা বলে এবং দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে আকাশে ওড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে। কখনো চিৎকার, কখনোবা কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, কখনো ঘর গরম রাখার চুল্লির ভেতর ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে, আবার কখনোবা চিমনী দিয়ে উপরের দিকে ওঠার চেষ্টা করে।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর একই লক্ষণ নিয়ে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে গ্রামের আরও ছয়টি ফুটফুটে মেয়ে। মনে হবে যেন কোনো অলৌকিক শক্তি ভর করেছে তাদের ওপর। গ্রামের লোকেরা কী করবে বুঝতে না পেরে দিশেহারা হয়ে গেল আতঙ্কে। ওষুধ এবং প্রার্থনা– কোনটিতেই কোনো কাজ হচ্ছিল না। দিশেহারা হয়ে বেটি প্যারিসের বাবা রিভ প্যারিস গ্রাম্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হলেন।
ডাক্তার সবকিছু দেখেশুনে রায় দেয় যে, তাদের এই অসুখের পেছনে কোনো শয়তানের হাত রয়েছে! গ্রামটিতে প্রটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রটেস্ট্যান্টরা ছিল পিউরিটানপন্থী। এই মতবাদে বিশ্বাসীরা ছিল মূলত প্রাচীনপন্থী ও হতাশাবাদী। তারা বিশ্বাস করতো, মানব জাতির জন্ম পাপ থেকেই। আর সে কারণে, সবার মধ্যে আছে ঈশ্বর এবং শয়তানের বাস। এই মানব শরীরের আশেপাশেই এক অদৃশ্য জগতে তাদের বাস। ফলে গ্রামের ডাক্তার যখন রায় দেয় যে তাদের এই আটটি মেয়ের অসুখের পেছনে শয়তানের হাত রয়েছে, তখন সালেমের গোঁড়া প্রটেস্ট্যান্ট বাসিন্দারা খুব সহজেই ডাক্তারের ঐ বক্তব্যে সায় দেয়।
শেষ পর্যন্ত ২৬ ফেব্রুয়ারি ডেকে আনা হলো গ্রামের ওঝাকে। ওঝার প্রশ্নের উত্তরে মেয়েরা জানালো যে, গ্রামের কয়েকজন বৃদ্ধা নাকি ডাইনি, তারাই নানা তুকতাক করে তাদের (মেয়েদের) এই অবস্থা করেছে। মেয়েদের দলটির মধ্যে অ্যাবিগেইল ও বেটি তো সরাসরি তিন জন বৃদ্ধার নাম করে তাদের ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করলো। গ্রামবাসীরাও মেয়েদের এই দাবি সহজেই মেনে নিল, কারণ তারাও মনে করছিলো গ্রামের ওপর কারো অশুভ শক্তির ছায়া পড়েছে। ফলে সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো গ্রামবাসীদের মধ্যে।
কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়, তারা ছিল সমাজে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণীর মানুষ। এদের একজন ছিল রিভ প্যারিসের ক্রীতদাস, টিটুবা। অন্যজন ছিল সারাহ্ গুড, যিনি ছিলেন গৃহহীন ভিখারিনী এবং একজন মা। অন্যজন সারাহ অসবোর্ন, যার সাথে গ্রামের কয়েকজনের সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং যার বিবাহিত জীবন নিয়ে গ্রাম জুড়ে ছিল নানা স্ক্যান্ডাল।
২৯ ফেব্রুয়ারি অ্যবিগেইল ও বেটি প্যারিসের সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে সেই তিনজন বৃদ্ধাকে ধরে আনা হলো। সালেম গ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট জোনাথন করউইন ও জন হ্যাথর্নের তত্ত্বাবধানে এই তিন মহিলার বিচারের আয়োজনের তোড়জোড় শুরু হলো। মার্চের শুরুতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো।
প্রথমে তিনজন নারীই তাদের বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। ফলে ব্যাপারটি সেদিনেই মিটে যেতে পারতো। কিন্তু অ্যাবিগেইলের চাচা যখন এই তিন নারীর ওপর জোর জেরা চালাতে শুরু করেন, তখন ক্রমাগত জেরার মুখে টিটুবার বক্তব্য এক সময় পরিবর্তিত হয়।
সেই বৃদ্ধা স্বীকার করেন যে, একটি পুরুষ শয়তান নানা আকৃতি নিয়ে তার সামনে হাজির হয় এবং এই শয়তানই কিশোরীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। তিনি জানালেন, গ্রামের অনেকেই এই চক্রের সাথে জড়িত, তাদের তিনি ‘শয়তানের অনুচর’ বলে চিহ্নিত করলেন।
টিটুবার এই স্বীকারোক্তির পরিণতি হলো ভয়ঙ্কর। এই ঘটনা সারা সালেম জুড়ে শুরু হয় গ্রামবাসীদের ব্যাপক উন্মাদনা। তিনজন মহিলাকেই জেলে প্রেরণ করা হলো। সালেম গ্রামের চার্চের একজন সদস্য মার্থা কোরিকে যখন ডাইনি অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সারা গ্রামের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। দীর্ঘদিন ধরে পাশাপাশি বাস করেও হঠাৎই আশেপাশের মানুষ পরস্পরকে সন্দেহ করতে শুরু করলো। খুঁজে খুঁজে ধরে আনা শুরু হলো সেইসব কথিত শয়তানের অনুচরদের। তাদের যখন নিয়ে আসা হলো মেয়েগুলোর কাছে, তাদের অস্থিরতা যেনো আরও বেড়ে গেলো; যেন ভীষণ ত্রাসে ও আতঙ্কে তাদের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগলো, মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে লাগলো।
এই দৃশ্য দেখে গ্রামবাসীদের মাঝে আতঙ্ক আরও প্রবল আকার ধারণ করে। মানুষদের মধ্যে ডাইনি বিশ্বাসের ভাবনা তীব্রভাবে সারা গ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। একের পর এক নারীকে ডাইনি বা শয়তানের অনুচর ইত্যাদি অভিযোগে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো হলো। সব মিলিয়ে ধরা হলো ২০০ জনের মতো নারীকে। এমনকি চার বছরের এক শিশুর বিরুদ্ধেও ডাইনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগ আনা হয়। অভিযুক্তদের দিয়ে ভরে যায় জেলখানা। শেষে ব্যাপারটা এমন জায়গায় পৌঁছালো যে, শয়তানের ভয়ে সন্ধ্যের পর রাস্তায় বের হওয়া কার্যত বন্ধ হয়ে গেলো। এমনকি বিড়াল-কুকুর দেখেও মানুষ ভাবতে লাগল ‘ছদ্মবেশী শয়তান’।
কিন্তু ব্যাপারটা থেমে রইলো না এখানেই। ‘ডাইনি খোঁজা’ এতোদূর গড়ালো যে, শেষ পর্যন্ত ১৬৯২ সালের ২৭ মে ম্যাসাচুসেটসের প্রশাসক বাধ্য হলেন বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিতে। তদন্তের কাজ চালানোর জন্য একটি বিশেষ উচ্চ পর্যায়ের আদালত বসানো হলো।
প্রথম অভিযোগ আনা হলো ব্রিজেট বিশপ নামের একজন বয়স্ক মহিলার বিরুদ্ধে, যিনি ছিলেন খুবই গল্পবাজ। নানা গাল-গল্পে তিনি গ্রামের ছোটদের মাতিয়ে রাখতেন। তার বিরুদ্ধে ডাইনিবিদ্যা চর্চার অভিযোগের জবাবে তিনি আদালতে জানিয়েছিলেন, তিনি নবজাতক শিশুর মতোই নিষ্পাপ। কিন্তু তার এই বক্তব্য আমলেই নেয়নি কেউ। তাকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। ১০ জুন প্রথম নারী হিসেবে ব্রিজেটের ফাঁসি কার্যকর হয়।
এভাবে আরও ১৯ জন বন্দীর দীর্ঘদিন বিচার চলার পর আদালত তাদেরকে ডাইনিবিদ্যা অপপ্রয়োগের দায়ে অভিযুক্ত করলো। সমগ্র নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলে সব মিলিয়ে ৩৪ জনকে ডাইনী অভিযোগে চালান করা হলো জেলখানার অন্ধকারে। বন্দীদের অধিকাংশই ছিলেন মহিলা, অবশ্য সেই দলে সামান্য কয়েকজন পুরুষ সদস্যও ছিলেন। জুলাই মাসে পাচঁজনের, আগস্ট মাসে পাঁচজনের এবং সেপ্টেম্বর মাসে আটজনের ফাঁসি কার্যকর হয়।
এ সময়েই ৭ জন বন্দীর জেলখানাতেই নির্মম মৃত্যু ঘটে। কোনোরূপ চাক্ষুস প্রমাণ ছাড়া শুধুমাত্র অভিযোগ এবং কয়েকজনের স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে এতাগুলো নৃশংস হত্যাকাণ্ড বিচারের নামে প্রহসনই নয়, মানুষের সভ্যতার উপর ছিল চরম কুঠারাঘাত। শুধু তা-ই নয়, ডাইনী চর্চায় সহায়তার অভিযোগে দুটি কুকুরকেও হত্যা করা হয়। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যপার হলো টিটুবা, যার সাক্ষ্যের ওপর এই বিচারকার্য শুরু হলো, তাকে কখনোই অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো না। বিচার শুরুর আগেই তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়।
এই মর্মান্তিক ঘটনার পরেই টনক নড়লো প্রশাসনিক কর্তাদের। ১৬৯৩ সালের শুরুর দিকে গভর্নর উইলিয়াম ফিলিপ অভিযুক্তদের কাছে ক্ষমা চান। তিনি ডাইনি অভিযোগে সব ধরনের গ্রেফতার বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ভিত্তিহীন আতঙ্কের ফল কীরকম মারাত্মক হতে পারে তা উপলব্ধি করতে পারল সাধারণ মানুষ। সালেমের বাসিন্দাদের এই ভয় এবং সন্দেহ দূর হতে লেগে গিয়েছিল বেশ কয়েকটি বছর। পরবর্তীতে গ্রামের অনেক অধিবাসীই স্থায়ী নিবাস ছেড়ে অন্যত্র বসতি স্থাপন করে।
এই ঘটনার পরে আর কখনো ডাইনি সন্দেহে হত্যার নির্দেশ সরকারীভাবে জারি করা হয়নি। কিন্তু সালেমের সেই চরম বেদনাময় ঘটনা চিরদিনের মতো ঠাঁই করে নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। অনেকেই বলেন, রক্ষণশীল মানুষের ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণেই এই নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। বিশজনেরও অধিক নিরাপরাধ মানুষকে আত্মপক্ষের কোনো সুযোগ না দিয়ে শুধুমাত্র ডাইনী অপবাদে নির্মম মৃত্যুর শিকার হতে হয়। মানুষের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণার মূল্য হিসেবে তাদের জীবন দিতে হলো।
আজও সালেম গ্রামের অধিবাসীরা ভুলতে পারেননি সেইদিনের সেই ঘটনা। ইতিহাসের সেই অধ্যায়কে স্মৃতিতে ধরে রাখার জন্য সালেমে এখনও রয়েছে সেই ডাইনিদের বাড়িটি এবং একে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি জাদুঘর। জাদুঘরের সামনে স্থানীয় মানুষজন ডাইনি-খোঁজার কাহিনী লেখা পোস্টার বিক্রি করেন উৎসুক দর্শনার্থীদের। অনেক পর্যটক সালেম গ্রামে আসেন সেই জাদুঘর আর গ্রামের নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সেই নির্মম অধ্যায়কে ঘিরে নানা অজানা ইতিহাসকে জানার জন্য।