আয়ারল্যান্ডের নিকটে আটলান্টিক মহাসাগরের নির্জন উপকূলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট এক উপদ্বীপ। নাম তার হুক। ১১৭০ সালের কথা, একদিন রেডমন্ড লে গ্রস নামক এক নরম্যান নাইট পথ হারিয়ে সাগর জলে ভাসতে ভাসতে এ দ্বীপে এসে নোঙর করেন। দ্বীপের মনোরম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন তিনি। ইচ্ছাপোষণ করেন এখানেই থেকে যাওয়ার। অতঃপর, সেখানে তৈরি করেন ছোট্ট একটি কুটির। সমুদ্রের সতেজ বাতাস, নির্মল জনপদ ও শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির কোলে এখানে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে তার বংশপরম্পরা।
চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়, বৃহৎ বাসস্থানের আবশ্যকতায় রেডমন্ডের বংশধরেরা তার হাতে গড়া ছোট্ট কুটিরের সংস্কার করেন। সেখানে তৈরি করেন সুবিশাল এক অট্টালিকা। রেডমন্ডের নামানুসারে সদ্যসমাপ্ত নতুন বাসস্থানের নামকরণ করেন রেডমন্ড হল। ১৬৪১-৫৩ সালে চলমান আইরিশ জোটবদ্ধ যুদ্ধে রেডমন্ডের এক উত্তরসূরি ইংরেজ প্রশাসন ও অলিভার ক্রমওয়েলের বিরুদ্ধে গিয়ে সহযোগিতা করেন বিদ্রোহী আইরিশ ক্যাথোলিক সৈন্যদের। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ ক্রমওয়েল প্রথম চার্লসকে প্রদান করেন মৃত্যুদণ্ড!
এসময় বিদ্রোহী সৈন্যদের সহযোগিতার শাস্তিস্বরূপ রেডমন্ড পরিবারকেও বাস্তুচ্যুত করা হয়। স্থানান্তরিত করা হয় অন্য ভূমিতে। সুবিশাল রেডমন্ড হলের মালিকানা প্রদান করা হয় এক ইংরেজ পরিবারকে। সতেরো শতকের শেষাংশের সেসময়ে বাড়িটির মালিকানা পায় টটেনহ্যাম নামক এক বিত্তশালী ইংরেজ পরিবার। এসময় নতুন গৃহকর্তা টটেনহ্যাম রেডমন্ড হলের নাম পরিবর্তন করেন। প্রিয়তমা স্ত্রী অ্যান লোফটাসের নামে নামকরণ করেন লোফটাস হল। কিছুদিন পর শহুরে বাসভবন ছেড়ে তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে পাড়ি জমান সেখানে।
সমুদ্রের পাড়ে এমন মনোরম বাড়ি আগে দেখেনি টটেনহ্যাম পরিবারের কেউ। ফলে প্রত্যেকেই বেজায় খুশি। আর তাই খুশিমনে সবাই হাত লাগালেন জিনিসপত্র গোছানোর কাজে। প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে সাজিয়ে তুললেন ঘরের পরিবেশ। বাইরে সবুজ ঘাসে মোড়ানো উঠোনের একপাশে তৈরি করলেন শুভ্র-সতেজ ফুলের বাগান। বাড়ির বিভিন্ন প্রান্তে রোপণ করলেন মৌসুমি ফলের অসংখ্য চারাগাছ। জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষায় কাঠের বেষ্টনী দিয়ে গড়ে তুললেন একটি সুরক্ষা দেয়ালও। বিকেলের স্নিগ্ধ রোদে জমিয়ে আড্ডা দিতে সমুদ্রের পাড়ে কতগুলো বেঞ্চিও পেতে দিলেন টটেনহ্যাম।
সময় গড়িয়ে চললো। সমুদ্রের কূল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ২২টি কামরা ও ৯৭টি জানালা বিশিষ্ট বিশালাকার এ বাড়িও একসময় বেশ দূর থেকে দৃষ্টি কাড়তে লাগলো নাবিকদের। বহুবছর ধরে এ দ্বীপের পাশ ঘেঁষে ছুটে চলা নাবিকরা আচমকা এখানে বসতি দেখে চমৎকৃত হন। ভাবেন- মানুষের কতই না অদ্ভুতুড়ে ইচ্ছে!
মৌসুমি বায়ুপ্রবাহে একসময় উত্তাল হয়ে ওঠে সাগরের চিরচেনা রূপ। ধারণ করে ভয়ংকর দৃশ্যপট। সৃষ্টি হয় সমুদ্রঝড়। এসময় প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোপে দিশেহারা নাবিকেরা আশ্রয় নিতে শুরু করেন এখানে। ঘরের গৃহকর্তা টটেনহ্যামও সরল মনে সবাইকে প্রদান করেন আশ্রয়। সমুদ্র অতিথিদের আতিথেয়তায় আয়োজন করেন সুস্বাদু ভোজনের। অতঃপর, আড্ডা-গল্প ও মহাসাগরে দাপিয়ে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনেই সবাই কাটিয়ে দেন রাত।
একদিনের ঘটনা, প্রতিকূল আবহাওয়ার তেমনই এক রাতে এক অদ্ভুতদর্শন জাহাজ এসে আছড়ে পড়ে হুক উপদ্বীপের বেলাভূমিতে। জাহাজ থেকে নেমে আসে কেবল একজন মানুষ। বৃষ্টির ঝাঁপটা আর প্রচণ্ড ঢেউয়ের তোপে জবুথবু এ মানুষ কীভাবে সেখানে বেঁচেছিল কে জানে! তবে, জাহাজ থেকে নামার পরই নির্জন এ দ্বীপের অদূরে একসময় আবছা আলোর দেখা পায় সে। খুশিতে মনটা নেচে ওঠে তার। একটুখানি খাবার ও উষ্ণতার আশায় গুটি গুটি পায়ে সে এগিয়ে চললো সেদিকে। বৃষ্টিস্নাত ঘাস ও কাঁদামাটি মাড়িয়ে একসময় সে এসে পৌঁছায় লোফটাস হলের সদর দরজায়। সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে সে দরজায় কড়া নাড়লো- ঠক ঠক ঠক!
ভেতর থেকে গৃহকর্তা টটেনহ্যাম দরজা খুললেন। দেখলেন- ঝড় ও তুফানের ঝাঁপটায় কাকভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক সুদর্শন যুবক। দেরি না করে তৎক্ষণাৎ তাকে নিয়ে এলেন বাড়ির ভেতরে। টটেনহ্যাম দম্পতির ছিল দুই কন্যা- অ্যান ও এলিজাবেথ। তাদের মধ্যে অ্যান বয়সে বড়। তাই বাড়িতে আসা অতিথির প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখতে টটেনহ্যাম বড় মেয়েকেই নির্দেশ দিলেন। সে-ও আন্তরিকতা সাথে দেখাশোনা করছিল সবকিছু। কেটে যেতে লাগলো সময়, সমুদ্রও যেন কিছুতেই স্বাভাবিক হতে চাইছিল না! তাই অগত্যা বাধ্য হয়ে একসময় আগন্তুক যুবক বাড়ির কার্নিশে বসে আপনমনে তাস খেলতে লাগলেন।
তাকে সঙ্গ দিতে একে দুইয়ে পরিবারের বাকিরাও এসে যোগ দিলেন। নির্মল পরিবেশে ফুরফুরে মেজাজে বেশ ভালোই জমে ওঠেছে খেলা। হাসি-আনন্দেই কাটছে সবার সময়। তবে আগন্তুকের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে অ্যানের। আর তাই প্রতিদিন নির্ধারিত এক সময়ে অ্যান সেই সুদর্শন যুবকের ঘরে যেতে লাগলো। একসময় বাবা-মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা কাটাতে লাগলো অন্তরঙ্গ সময়। বিষয়টি সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও একদিন ধরা পড়লো এলিজাবেথের চোখে। যদিও এলিজাবেথ নিজের কাছেই গোপন রাখলো বিষয়টি। কিন্তু, সত্যিকার বিপত্তি বাধলো দিন-দুয়েক পর।
দুপুরের খাবারের পর বিকেলের রোদে সেই আগন্তুক যুবক আবারও তাস নিয়ে বসেছিলো, তখন তার সঙ্গে এসে যোগ দিলো অ্যান। খেলার পাশাপাশি দুজন পেতে বসলো বিভিন্ন গল্পের পসরা। একসময় আনমনা অ্যানের হাত ফসকে একটি তাস পড়ে যায় টেবিলের নিচে। যখনই সে নিচ থেকে তাসটি তুলতে গেলো, তখনই বীভৎস এক ভয়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো তার শরীর। নিচে যা দেখলো, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে!
আগন্তুক যুবকের পা দুটো অশরীরীর পায়ের মতো ভয়ংকর বিদঘুটে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ কেটে উল্টোভাবে জোরে দিয়েছে। পায়ের আঙুলে বিদ্যমান কালো-কুৎসিত নখগুলোও বেশ স্পষ্টভাবেই দেখতে পেয়েছে অ্যান। সঙ্গে সঙ্গে বীভৎস এক আর্তনাদের পর জ্ঞান হারালো সে। আচমকা এমন আর্তনাদ শোনে বাড়ির লোকজন দ্রুত ছুটে আসলো তার পানে। দেখলো- মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে অ্যান। পাশে থাকা আগন্তুক যুবকটি নেই, কাছে-পিঠে কোথাও দেখাও যাচ্ছে না তাকে। তবে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আগুনের গোলায় ছাদ ভেদ করে পালিয়ে গেছে সে। সেখানে তৈরি হয়েছে বিশালাকার এক ফুটো!
ভয়ংকর এ ঘটনার পর একসময় অ্যানের জ্ঞান ফিরে। ঘটনার বিস্তারিত খুলে বলে সে। বলেই আবারও সংজ্ঞা হারায় অ্যান। তবে, সেবার যখন তার জ্ঞান ফিরে, তখন অ্যান রীতিমতো পৈশাচিক আচরণ করতে লাগলো, বলতে লাগলো সব অদ্ভুতুড়ে কথাবার্তা। তখন টটেনহ্যাম দম্পতি নিরুপায় হয়ে অ্যানকে বন্দী করে রাখলেন তার প্রিয় টেপেস্ট্রি রুমে। কিছুদিন পর তারা এটাও বুঝতে পারলেন, অ্যান সন্তানসম্ভবা।
তৎক্ষণাৎ গির্জার ফাদারকে ডেকে নিয়ে আসলেন তারা। খুলে বললেন বিস্তারিত। সবকিছু বুঝতে পেরে ফাদার সতর্ক করলেন সবাইকে। জানালেন- গর্ভে থাকা শিশুটি হবে একটি ভূত-প্রেত কিংবা শয়তান! তাই জন্মের পর পরই তাকে মেরে ফেলতে হবে। মাটিচাপা দিতে হবে টেপেস্ট্রি রুমে। যথারীতি অ্যানের বাবা-মা শিশুটিকে মেরে সেই টেপেস্ট্রি রুমেই মাটিচাপা দেন। এ কাজের জন্য একজন ধর্মযাজককেও নিয়ে এসেছিলেন তারা।
বীভৎস এ ঘটনার বাঁকে টটেনহ্যাম পরিবারের সুন্দর সময়গুলো যেন থমকে দাঁড়ায়। টেপেস্ট্রি রুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে অ্যানও উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে বাইরের পানে। এভাবে কয়েক বছর পর একদিন মারা যায় অ্যান। পেছনে রেখে যায় অসংখ্য সুখময় স্মৃতি। তবে, অ্যানের মৃত্যুর পর শুরু হয় আসল ভুতুড়ে কাণ্ড! সুবিশাল এ বাড়িতে ঘটতে লাগলো অদ্ভুতুড়ে সব ঘটনা। রাতের বেলায় বারান্দায় মনে হতো কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাতের ইশারায় কাছে ডাকছে। ঘুম-গোসল ও খাবার সময়ও কেউ বসে রয়েছে পেছনে! এরকম আরও বহুবিধ ঘটনার পর একসময় টটেনহ্যাম পরিবার বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চলে আসেন দূরে, জনবহুল এক লোকালয়ে।
তবে, বজ্রঝড়ের কবলে পড়া নাবিকরা সেসময়ও জনশূন্য পরিত্যক্ত এ বাড়িতে আশ্রয় নিতে থাকেন। সেসময় তারাও সেখানে টের পান অশরীরীদের সরব উপস্থিতি, মুখোমুখি হন ভয়ংকর সব অতিপ্রাকৃতিক ঘটনার। অতঃপর কেটে গেছে আরও বহুবছর। একসময় রোমহর্ষক এ ঘটনা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে। মিশে গেছে সত্য-মিথ্যের অনন্য মিশেলে, অতিরঞ্জনের ছটায় তৈরি হয়েছে বিচিত্র সব গল্পও। এরই সূত্র ধরে একসময় দূর-দূরান্ত থেকে উৎসুক ভ্রমণ পিপাসুরা আসতে লাগলো এখানে। তাঁবু খাটিয়ে রাত্রি যাপনও করতে লাগলো তারা। এসময় কেউ কেউ নাকি স্থিরচিত্রে ধারণ করতে পেরেছে কতক অশরীরীর বিভৎস ছায়া!
কিছুদিন পর দর্শনার্থীদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে বাড়িটি বাজেয়াপ্ত করে কর্তৃপক্ষ। নিষিদ্ধ করে জনসাধারণের অবাধ আসা-যাওয়া। একসময় সরকারিভাবে ছাদে তৈরি হওয়া গর্তটিও মেরামতের সিদ্ধান্ত হয়। তবে, যখনই মেরামতকাজ শুরু হয়, তখনই শিকার হতে হয়েছে ভয়ংকর কোনো দুর্ঘটনার। আর তাই বিরক্ত হয়ে একসময় বাড়িটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
ভূত-প্রেত কিংবা অশরীরী, সেকালের এসব অতিপ্রাকৃতিক সত্তার গা ছমছমে রহস্য এখনো মানবমনে ভীতির সঞ্চার করে, শিহরণ জাগায় হৃদয়-আত্মায়। অনুভূতির আল্পনায় আঁকিবুঁকি কাঁটে ভৌতিক সব ঘটনা, যা কল্পনার ডানায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনন্য এক জগতে।
আর তাই এসব রহস্যময়তাকে শৈল্পিক রূপ দানে ২০২০ সালে এক হোটেল কর্তৃপক্ষ বাড়িটি কেনার জন্য উঠে-পড়ে লাগে। সময়-সুযোগ বুঝে আবেদনও জানায় সরকারের কাছে। সর্বশেষ, ২০২১ সালে বেশ চড়া মূল্যে বাড়িটি কিনেও নেয় তারা। জানা যায়, রহস্য-রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষদের জন্য এক ভিন্নধর্মী ভূতুড়ে হোটেল হতে যাচ্ছে সেখানে!