গলাবন্ধনী বা টাই আজকাল খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস। ফরমাল পোশাক আর ফ্যাশনের নামে গলাবন্ধনী ব্যবহার না করলে যেন হবেই না ব্যাপারটা এমন। শব্দটাও খুবই গুরুগম্ভীর। ছোটবেলায় একবার বাবা বলেছিলেন, একজন গ্র্যাজুয়েটের নিদর্শন হল এই গলাবন্ধনী। কারো গলায় যদি দেখতে পাও গলাবন্ধনী আটা রয়েছে, ধরে নিতে হবে সে একজন গ্র্যাজুয়েট, স্নাতক সম্পন্ন করেছে। তুমিও যেদিন স্নাতক সম্পন্ন করবে, সেদিন থেকে গলাবন্ধনী পড়া শুরু করতে পারবে।
সেই চিন্তা মাথায় নিয়েই বড় হয়েছি, স্নাতক এখনো শেষ হয়নি, মেডিক্যালের ছাত্র হিসেবে আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করা চাই আমার। (যদিও মাঝে মাঝে পড়ে ফেলি) গুরুগম্ভীর এক শব্দ বারবার উচ্চারণ করছি, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু ও উচ্চারণকটু। এবার থেকে “টাই” উল্লেখ করব বাকি লেখায়।
যা বলছিলাম, ফ্যাশনের নামে টাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারো কি কখনো মনে হয়েছে, কীভাবে আমরা এই টাই এর সাথে পরিচিত হলাম। একটুকরো একটা কাপড়, গলায় বেঁধে গলা আটকে দিলেই হয়ে গেল, অনেক উপকারীও বটে, সবথেকে বড় কথা হল, দেখতেও খারাপ লাগছে না, স্ট্যান্ডার্ড মনে হচ্ছে। দেখতে খুবই স্ট্যান্ডার্ড মনে হওয়াটাই ছিল টাই এর উৎপত্তিস্থল। এভাবেই আসলে কালের পরিক্রমায় টাই চলে আসে আমাদের সামনে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের মাটিতে ৩০ বছর ধরে যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ (১৬১৮-১৬৪৮) চলছিল, তখন হঠাৎ করেই শোভা পেতে দেখা যায় সৈনিকদের গলায় এক টুকরো কাপড়। টাইগুলোর উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকদের তাই ধারণা। তখনকার সময়ে একদেশ অন্যদেশ থেকে সৈনিক ভাড়া করে নিতো, তাদের হয়ে যুদ্ধ লড়ে দেয়ার জন্য। রাজা ত্রয়োদশ লুই ও তার পক্ষের সৈনিক সংখ্যা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, ক্রোয়েশিয়ান কিছু সৈনিক ভাড়া করে নিয়ে আসে। ক্রোয়েশিয়ান সেই যোদ্ধাদের সকলের গলায় এক টুকরো করে কাপড় শোভা পেতে দেখা যায়। তাদের সৈনিক সাজ পোশাকে জ্যাকেট পরতে হতো, সেই জ্যাকেটকে গলা পর্যন্ত আটকিয়ে রাখতেই তারা কাপড়ের টুকরো গলায় বেঁধে রাখতো, দেখতেও ভাল লাগতো।
রাজা ত্রয়োদশ লুই সৈনিকদের গলায় এমন টুকরো কাপড় দেখে মোহিত হয়ে যান। তার কাছে এতটাই ভাল লেগে যায় যে, রাজকীয় সভাগুলোয় সকল সভাসদদের জন্য গলায় টুকরো কাপড় বেঁধে আসার আইন জারি করেন। আর যেহেতু, ক্রোয়েশিয়ানদের থেকে এমনটা শুরু হয়েছে, তাদের সম্মানে এর নাম দেন “La Cravate”।
গলাবন্ধনীর আরো পুরনো এক গল্প পাওয়া যায় চৈনিক সভ্যতায়। ২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে চীনের সম্রাট ছিলেন শিহ্ হুয়াং তি। সম্রাট শিহ্ হুয়াং তি এর সময়কালীন যে সকল সৈনিকের টেরাকোটা শিল্প বর্তমানে পাওয়া গেছে, তা থেকে জানা যায় যে, প্রত্যেক সৈনিকের গলায় সিল্কের তৈরি এক টুকরো কাপড় পেঁচানো থাকতো।
খ্রিষ্টপূর্ব ১১৩ এ রোমান সাম্রাজ্যেও পাওয়া যায় এক নিদর্শন। রোমান সাম্রাজ্যে, চাকর আলাদা করে চিহ্নিত করে রাখার কাজে তাদের গলায় একটুকরো কাপড় পেঁচিয়ে বেঁধে রাখা হতো, মালিকেরা নিজের নিজের চাকরকে আলাদা করতে পারতেন তখন এই পেঁচানো কাপড় দেখে। কোন রোমান সৈন্যকে যদি টাইম ট্র্যাভেল করে বর্তমানে নিয়ে এসে, বলা হয় টাই পড়তে, তাহলে সে নিশ্চয় যারপরনাই অপমানিত বোধ করবে। কারণ তৎকালীন সময়ে সেটাই ছিল রীতি। তবে এখনও এ ধরণের টাই রয়েছে কিন্তু, একে বলা হয় Bolo Tie, মাঝে মাঝে জনি ডেপকে এমন টাই পড়তে দেখা যায়। টেক্সাসের আরিজোনায় এ টাই অফিসিয়াল পোশাকের সাথে পড়ার নিয়ম রয়েছে।
যতগল্পই থাকুক না কেন, টাই এর ফ্যাশন আমাদের সাথে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিল ক্রোয়েশিয়ান সৈনিকেরাই, তারাই এই টাই পরিধানকে ফ্যাশনে পরিণত করেছিল তাদের ইউনিফর্মের অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে।
গত দু’শ বছরে টাই পরিধানে পরিবর্তন এসেছে অনেকবার। ক্রোয়েশিয়ান সৈনিকেরা যে টাই পরিধান করতো, তার সামান্যই বর্তমানে রয়েছে, টাই পরিধানের আইডিয়া টা ছাড়া পুরো ফ্যাশনেই চলে এসেছে আমূল পরিবর্তন। সবথেকে বড় পরিবর্তনটি এসেছে ১৯২০ এর দশকে। টাই ই মনে হয় একমাত্র ফ্যাশনের বস্তু, যেটা গত দু’শ বছর ধরে টিকে রয়েছে। অন্য যতসব ফ্যাশন পোষাকজগতে এসেছে, সবই প্রতি দশকে পরিবর্তিত হয়ে পুরনো হয়ে গেছে। বর্তমানে আমরা যে টাই ব্যবহার করি, সেটি মূলত গত শতাব্দীতেই উৎপত্তি ঘটে।
গত শতাব্দীতে এই টাই পুরুষদের সাজপোষাকের প্রধান বস্তুতে পরিণত হয়। ১৯২০ সালের দিকে এই টাইয়ের বিবর্তনে চলে আসে আমূল পরিবর্তন, তাও আবার ভুলক্রমে। ইতিহাসে অনেকগুলো মজার ভুল রয়েছে, যেগুলো আমাদের জন্য বিপদের পরিবর্তে নিয়ে এসেছে বিপ্লব। নিউইয়র্কে একজন টাই মেকার ছিলেন, নাম হল জেসি ল্যাংসডর্ফ। তিনি একদিন একটা টাই তৈরির কাজ করছিলেন। ভুল করে টাই এর কাপড়টি মাঝখান দিয়ে তিনি কেঁটে ফেলেন। তিনি দেখেন যে, প্রতিবার এইভাবে যদি কেঁটে রেখে দেন, তাহলে টাই পড়ে আবার সেটা খুলে ফেলা যায়। আগেকালের টাইগুলো ছিল ফিক্সড, একবার বানিয়ে ফেললে শুধু ঐ একই স্টাইলে বারবার পড়তে হতো, আবার খুলে রেখে দিতে হতো। কিন্তু বর্তমানে আমরা যে টাই ব্যবহার করি সেটাই তৈরি হয় জেসি ল্যাংসডর্ফ এর হাত ধরে। পরা শেষে, গিঁট খুলে ফেলা যায়, পছন্দানুযায়ী গিঁট পরিবর্তন করা যায়। গিঁট যখন নিজের ইচ্ছামতো দেয়া যাচ্ছে, তখুনি মানুষের কাছে চলে এলো অবাধ স্বাধীনতা। ফলে আস্তে আস্তে নতুন নতুন অনেক গিঁট তৈরি হতে শুরু করলো।
গত শতাব্দীর পুরো সময় জুড়েই টাই এর বিবর্তন হয়েছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টুকু ছাড়া। যুদ্ধের দশকে মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিল, তাই টাই এর উল্লেখযোগ্য কোনরকম পরিবর্তন আসেনি। বর্তমানে অনেক ধরণের টাই পাওয়া যায়। দৈর্ঘ্যভেদে, কাপড়ের নমনীয়তা, আকার-আকৃতি ইত্যাদি ভেদে। পুরুষদের নিজস্ব স্টাইলকে প্রকাশ করার জন্যই এত ব্যতিক্রমী টাই পাওয়া যায় আজকাল। তবে স্ট্যান্ডার্ড টাই এর প্রস্থ হবে ৩.২৫-৩.৫ ইঞ্চি। তবে গত কয়েকবছরে আমাদের চোখের সামনেই টাইয়ের ফ্যাশনে একটা পরিবর্তন এসেছে, হয়তো সবার কাছে আগের বড় প্রস্থের টাইগুলো বর্তমানে দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। আজকাল সবাই অল্প প্রস্থের (২.৭৫-৩ ইঞ্চি) টাই ই পরিধান করে থাকে।
টাই পরিধানের পেছনে হাজার বছরের পুরনো আরো একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। গলায় এক টুকরো কাপড় বেঁধে দেয়াকেই যদি, টাই বলে মানা হয়, তাহলে সেই গল্পটিও সমর্থযোগ্য। ঠান্ডা-সর্দিতে বাঁচতে, গলায় এক টুকরো কাপড় পেঁচিয়ে রাখাটা হাজারো বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। কিন্তু ফ্যাশন হিসেবে আসে সেই ৩০বছরের ফরাসী যুদ্ধ থেকেই।
Ascot Tie বর্তমানের আধুনিক টাই থেকে খানিকটা ব্যতিক্রম। দেখতে খুবই সুন্দর লাগে, পড়তেও বেশ আরামদায়ক, আমার ব্যক্তিগত পছন্দ। এই টাইগুলো উনিশ শতকেই প্রচলন হয়, ইংল্যান্ডে। তৎকালীন সময়ে বিখ্যাত ঘোড়দৌড় হতো, নাম ছিল “The Royal Asoct”; সেখান থেকেই এই টাইয়ের নামের উৎপত্তি। Tailcoat Jacket এর সাথে বেশি মানায় এই Ascot Tie গুলো। আজকাল অতবেশি একটা দেখা না গেলেও, বিয়ের রিসেপশনগুলোতে হরহামেশাই দেখা যায়।
টাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক সাজপোশাক আমাদের জন্য। কোন ফর্মাল পোশাকে, পুরুষ হিসেবে আমরা হয়তো রঙিন কিছু পরিধান করিনা, সেটা শোভা দেয় না আমাদের। সবসময় কালো কিংবা প্রুশিয়ান ব্লু ব্যবহার করে থাকি, সাদা শার্টের সাথে কাল স্যুট, আমাদের সার্বজননীন সাজ। কাল জুতো, কাল প্যান্ট। এতকিছু সঙ্গে রঙ বয়ে নিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল এই আমাদের টাই। আমাদের একমাত্র সুযোগ। তবে কেউ কেউ মনে করেন, টাই আমাদের শার্টের বোতামকে ঢেকে রাখছে। তবে টাই প্রধানত আমাদের গলায় শার্টকে এঁটে রাখে, গলাকে উষ্ণ রাখে।
প্রতি বছরের ১৮ই অক্টোবর ক্রোয়েশিয়ায়, টোকিও, সিডনী, ডাবলিনের মত বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য শহরে আন্তর্জাতিক টাই উৎসব পালিত হয়।