অপরাধী শনাক্তকরণে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের সফল ব্যবহারের সূচনা (পর্ব | ১)

১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ইংল্যান্ডে তখন গ্রীষ্মকাল চলছে, কেতাবি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ইংলিশ সামার’। ‘ইংলিশ সামার’-এর সময়ে দেশটিতে মোটামুটি যাদের সামর্থ্য আছে, তারা সমুদ্রসৈকতে গমন করেন, গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে বাঁচতে সমুদ্রপাড়ে অলস সময় কাটান, বিভিন্নরকম খাবারের স্বাদ নেন। যাদের সামর্থ্য আরও বেশি, তারা টেনিসের সবচেয়ে পুরোনো টুর্নামেন্ট উইম্বলডন দেখতে রাজধানী লন্ডনে পাড়ি জমান। ইংল্যান্ডে বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বেশি প্রমোদভ্রমণের আয়োজন করা হয় এই সময়েই। যা-ই হোক, মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসের সেই বৃহস্পতিবারে লন্ডন থেকে ১১৪ মাইল দূরের এলাকা লেস্টারশায়ারের এক গ্রামে এমন এক ঘটনা ঘটে যে, স্থানীয় মানুষেরা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেল, ঘটনার পর থেকে অজানা আশঙ্কায় পার হতে শুরু করলো তাদের প্রতিটি দিন।

ুআিববজনক
ইংলিশ সামার বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে ইংল্যান্ডে; image source: cactuslanguage.com

যেদিন ঘটনা ঘটে, তার দুদিন আগে লেস্টারশায়ারের নার্বোরো গ্রামের পঞ্চদশী কিশোরী ডন অ্যাশওয়ার্থ বেড়াতে গিয়েছিল বন্ধুর বাসায়। বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সে তার বন্ধুর বাসা থেকে নিজের বাসায় ফেরার জন্য রওনা দেয়। বন্ধুর বাসা থেকে তার বাসার দূরত্ব খুব বেশি ছিল না, পাশের এন্ডার্বি নামক গ্রামেই অ্যাশওয়ার্থের বাসা। মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটার ব্যাপার। হয়তো ক্লান্তির জন্যই কিনা, সেদিন অ্যাশওয়ার্থ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল গতানুগতিক রাস্তা দিয়ে না গিয়ে সে সংক্ষিপ্ত রাস্তায় বাসায় ফিরবে। স্থানীয়ভাবে এই সংক্ষিপ্ত রাস্তার নাম ছিল ‘টেন পাউন্ড লেন’। কিন্তু কে জানতো, এই টেন পাউন্ড লেন দিয়ে ঘরে ফেরার সিদ্ধান্তই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে?

টেন পাউন্ড লেন দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে অ্যাশওয়ার্থ নিখোঁজ হলো। পুলিশের কাছে খবর যাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে নার্বোরো গ্রামে তন্নতন্ন করে খোঁজ চালানো হলো, কিন্তু মেয়েটির প্রস্থানের রহস্য কিছুতেই ভেদ করতে পারলো না স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবশ্য অ্যাশওয়ার্থের অন্তর্ধানের রহস্য ভেদ করতে খুব বেশি বেগ পোহাতে হলো না লেস্টারশায়ার পুলিশের। অন্তর্ধানের দু’দিন পর টেন পাউন্ড লেন থেকে কাছেই অবস্থিত একটি মাঠের কোণে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো। পুলিশ যখন মৃতদেহ উদ্ধার করে, তখন সেটি কিছু গাছের ডালপালা দিয়ে ঢাকা ছিল। সম্ভবত অপরাধী চেয়েছিল প্রথম দেখাতেই যেন কেউ বুঝতে না পারে সেখানে একটি মৃতদেহ রয়েছে। পুলিশ মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে দিয়ে পোস্ট-মর্টেম রিপোর্টের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে সময় পার করতে থাকে। মৃতদেহের ময়নাতদন্তের পর যে প্রতিবেদন এসেছিল তাতে লেখা ছিল,

যিনি মারা গিয়েছেন তাকে প্রথমে ধর্ষণ করা হয়েছে, এরপর গলায় ফাঁস লাগিয়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। মারা যাওয়ার আগে মেয়েটি যথেষ্ট বাধা দিয়েছিল, কিন্তু অপরাধীর শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে পারেনি।

গশুতজআককগ
লিন্ডা মান হত্যাকান্ডের পর পুলিশের তদন্ত; image source: inews.co.uk

ডন অ্যাশওয়ার্থ ধর্ষণ ও খুনের শিকার হন ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে। এরও আড়াই বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৮৪ সালে ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটে লেস্টারশায়ারে। সেই কেসেও মৃত ব্যক্তি ছিল পনের বছরের এক কিশোরী, তার নাম ছিল লিন্ডা মান। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, টেন পাউন্ড লেনের কাছাকাছি যে মাঠে অ্যাশওয়ার্থের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিল, তার মাত্র কয়েকশো গজ দূরত্বেই সেই আড়াই বছর আগের ঘটনার ভিকটিম লিন্ডা মানের মৃতদেহ পাওয়া যায়। শুধু তা-ই নয়, উভয় ক্ষেত্রেই পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বেশ মিল ছিল। এসব মিলের কারণে পুলিশ এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয় যে- দুটো ক্ষেত্রে অপরাধী একজনই, এবং যেখানে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে (ক্রাইম সিন), তার আশেপাশেই বসবাস করেন।

সাধারণত একটি এলাকায় কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর স্থানীয় জনগণের যে প্রতিক্রিয়া হয়, এক্ষেত্রেও তা-ই হলো। নার্বোরো ও তার আশেপাশের এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ালো থমথমে, আরও একটি সম্ভাব্য অস্বাভাবিক মৃত্যুর আতঙ্কে জনগণ ভয়ে কুঁকড়ে যেতে শুরু করলো। পুলিশ যখন গণমাধ্যমে জানায় যে, দুটো কেসের অভিন্ন খুনী অপরাধ সংঘটনের জায়গার আশেপাশেই বসবাস করেন, তখন স্থানীয় জনগণের আতঙ্কের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে ‘খুনী আমাদের মাঝেই রয়েছেন’ বা ‘আমরা যদি তাকে ধরতে ব্যর্থ হই, তাহলে পরবর্তী শিকার হতে যাচ্ছে তোমার কন্যা’– এ ধরনের শিরোনামে অসংখ্য সম্পাদকীয় প্রকাশিত হতে শুরু করে। ডন অ্যাশওয়ার্থ যে গ্রামে বাস করতো, সেই এন্ডার্বি গ্রামের যাজক অপরাধীকে স্বতস্ফূর্তভাবে আইনের সামনে নিজেকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানান, অন্যথায় পরকালে স্রষ্টার সামনে তাকে কী ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে– সেই বিষয়ে পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করেন।

জআওআকআপ
ডন অ্যাশওয়ার্থের হত্যাকান্ডের পর থমথমে হয়ে যায় নার্বোরো ও এন্ডার্বি গ্রামের পরিস্থিতি; image source: leicestermercury.co.uk

ডন অ্যাশওয়ার্থের মৃত্যুর পর লিস্টারশায়ার পুলিশ বাহিনীর উপর অপরাধী শনাক্তকরণ ও গ্রেফতার করার জন্য বিশাল চাপ আসতে থাকে। ১৯৮৪ সালে লিন্ডা মানের মৃত্যুর পর অপরাধী তো দূরে থাক, একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তিকেও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি, তবে অপরাধীকে গ্রেফতারের অভিযান অব্যাহত ছিল। এর আড়াই বছর পরে, ১৯৮৬ সালের জুন মাসে সংঘটিত ডন অ্যাশওয়ার্থ হত্যাকান্ডের পর পুলিশ বেশ নড়েচড়ে বসে। এবার কোনো কুল-কিনারা করতে না পারলে যে স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর যোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে, সেটিও অনুমিতই ছিল। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- প্রথমে পনের বছর বয়সী কিশোরী লিন্ডা মানের হত্যাকান্ডকে সবাই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই ধরে নিয়েছিল। কিন্তু যখন অ্যাশওয়ার্থের ক্ষেত্রে আবারও ঠিক আগেরবারের মতো প্রায় একই ধরনের ধর্ষণ ও পরবর্তীতে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলো, তখন তখন দ্বিতীয় ঘটনাকে আর বিচ্ছিন্ন বলে উড়িয়ে দেয়ার অবকাশ ছিল না। পুলিশ এবার অকপটে স্বীকার করে যে, একজন সিরিয়াল কিলারের মাধ্যমেই এসব হচ্ছে। সুযোগ পেলে যে সেই সিরিয়াল কিলার সামনে এরকম ঘটনা আর ঘটাবে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে তখন থেকেই।

স্বাভাবিকভাবে পুলিশের উপর বিভিন্ন মহল থেকে চাপ দেয়া হচ্ছিল দ্রুততম সময়ের মধ্যে অপরাধী শনাক্ত ও গ্রেফতারের জন্য। ঘটনার কিছুদিন পরপরই রিচার্ড বাকল্যান্ড নামের একজন সতের বছর বয়সী তরুণকে লেস্টারশায়ার পুলিশ গ্রেফতার করে। বাকল্যান্ড অপরাধ সংঘটনের স্থানের পাশেই বসবাস করতো। বলে রাখা ভালো, সে মানসিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যহীন ছিল। তাকে গ্রেফতারের পেছনে পুলিশের দাবি ছিল- বাকল্যান্ড এই অপরাধ সংঘটনের ব্যাপারে বেশ কিছু তথ্য জানে, যেগুলো জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে আদায় করা গেলে তদন্তে সুবিধা হবে। তবে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তরুণ বাকল্যান্ড মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির মতোই আচরণ করছিল। জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রশ্নের উত্তরে সে বেশ কয়েকবার স্বীকার করেছিল যে সেই হত্যকান্ডগুলো ঘটিয়েছে, আবার পরক্ষণেই সেসব স্বীকারোক্তিকে ভুল আখ্যায়িত করেছিল। পর্যাপ্ত জিজ্ঞাসাবাদের পর ১৯৮৬ সালের ১০ আগস্ট তার বিরুদ্ধে লেস্টারশায়ার পুলিশ আদালতে চার্জশিট দাখিল করে, যেখানে তাকে দুটো খুনের জন্যই অভিযুক্ত দেখানো হয়। পরদিনই তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে শুনানির সময় সে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেগুলোর প্রতিটি অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে পুলিশ এই বিষয়ে নিশ্চিত ছিল যে বাকল্যান্ড আদালতে মিথ্যা বলছে, এবং একপর্যায়ে সে দোষী প্রমাণিত হবে।

গসজতক
পুলিশের হাতে গ্রেফতারকৃত সন্দেহভাজন রিচার্ড বাকল্যান্ড; image source: bbc.co.uk

লেস্টারশায়ারে যেখানে গ্রামে (নার্বোরো গ্রাম) ডন অ্যাশওয়ার্থ হত্যাকান্ড ঘটেছিল, তার পাঁচ মাইল দূরেই ইউনিভার্সিটি অব লেস্টারশায়ারে একজন জিনতত্ত্ববিদ কীভাবে একটি বংশের সদস্যদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে রোগ ছড়ায়, সেটির রহস্য ভেদ করার জন্য গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। গবেষণার ক্ষেত্রে জিনতত্ত্ববিদ অ্যালেক জেফ্রিজ কোষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে সেগুলো ফটোগ্রাফিক ফিল্মে স্থাপন করতেন। এরপর সেগুলো ফটোগ্রাফিক ট্যাংকে রাসায়নিক তরলে ডোবানোর পর যে ছবি ভেসে উঠতো, সেগুলোতে বেশ কিছু রেখা পাওয়া যেত, যেগুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যেত। জিনতত্ত্ববিদ অ্যালেক জেফ্রিজ তার গবেষণার পর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, যাদের কোষ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করার পর এভাবে ফটোগ্রাফিক প্লেটের মাধ্যমে চিহ্নিতকারক রেখাগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে, তাদের পরবর্তীতে ডিএনএ টেস্টিংয়ের মাধ্যমে আলাদা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। তিনি তার এই গবেষণার উপর একটি একাডেমিক পেপার লেখেন, যেটি বেশ সাড়া ফেলে।

Related Articles

Exit mobile version