কাইরাওয়ান শহরে শাসকদের বেঁধে দেওয়া অতিরিক্ত করের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। প্রলেতারিয়েতদের ডাকে শুরু হয় সহিংসতা। শান্তশিষ্ট শহরটিতে ছড়িয়ে পড়ে লুটপাট ও রাহাজানির লেলিহান অগ্নিশিখা। একটু আর্থিক অবস্থা যাদের ভালো ছিল, তাদের হাতে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় জীবন এবং সম্পদ হারানোর ঝুঁকি নিয়ে শহরে থেকে যাওয়া, নয়তো সবকিছু গুছিয়ে প্রাণ নিয়ে পলায়ন। আল-ফিহরি পরিবার পালিয়ে কোনো অচেনা শহরে গিয়ে নতুন করে বাঁচার পথটিই বেছে নিয়েছিল।
কাইরাওয়ান শহরের ছবির মতো সুন্দর বাড়ি-ঘর, সৌন্দর্য আছড়ে পড়া চমৎকার ঝর্ণাধারা কিংবা জ্ঞান আহরণের জন্য প্রতিষ্ঠিত ভবনগুলো ছেড়ে যেতে আল-ফিহরি পরিবারের দুই বুদ্ধিমতী মেয়ে ফাতিমা ও মরিয়মের মোটেও ভালো লাগেনি। তাদের স্বপ্ন ছিল, এ শহরের মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য একদিন কিছু করবেন, শহরের সাধারণ মানুষের জীবনমান আরেকটু উন্নত হবে। কিন্তু বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে পালাবার সময় সেসব স্বপ্ন যেন চোখের সামনে হাওয়ায় উবে গেল।
আফ্রিকার প্রতিকূল পরিবেশে ১,৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কাইরাওয়ান শহরের আরও অনেকের সাথে আল-ফিহরি পরিবার মরোক্কোর ফেজ শহরে এসে থামল। আলো ঝলমলে এ শহর মাতৃভূমির চেয়ে অনেক বেশি শান্ত, এখানকার শাসকেরা সাধারণ মানুষের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা চাপিয়ে দেয় না। আল-ফিহরি পরিবার এখানে এসে নতুন করে জীবনযাপন শুরু করল। ভাগ্যের সহায়তা ও পরিশ্রম– দুয়ের সমন্বয়ে অল্প সময়ে দুই বোন মরিয়ম ও ফাতিমার বাবা ও ভাইয়েরা বেশ সম্পদ কামিয়ে ফেললেন। ফেজ শহরের দারুণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় ফাতিমারা আবার নতুন করে তাদের স্বপ্ন বুনতে শুরু করলেন।
ব্যবসায়িক সফলতার কারণে আল-ফিহরি পরিবার যখন সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই শুরু হয় তাদের দুর্ভোগ। ফাতিমা-মরিয়মের বাবা, ভাই ও কিছুদিনের মধ্যে ফাতিমার স্বামী মারা গেলে তাদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। কিন্তু পরিবারের পুরুষদের মৃত্যুতে তারা প্রচণ্ড শোকাহত হলেও একেবারে ভেঙে পড়েননি। উত্তরাধিকারের বদৌলতে পাওয়া সম্পদের মাধ্যমে এক বোন মরিয়ম প্রতিষ্ঠা করেন আল-আন্দালুস মসজিদ, যেটি সে সময় স্পেন থেকে পালিয়ে আসা মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করত। ৮৫৯ সালে আরেক বোন, বিদুষী নারী ফাতিমা একটি মাদ্রাসা ঘরানার প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন, যেটিতে পড়ালেখা শেষ করলে ডিগ্রি দেয়া হতো। পরবর্তী সময়ে এটির নাম হয় ইউনিভার্সিটি আল-কারাউইন এবং পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘটনাটি ছিল এমনই।
এবার আমাদের এশিয়া মহাদেশের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। ফিলিপাইনে স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক শাসন শুরু হলে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারের জন্য মিশনারিদের ভিড় বাড়তে থাকে এশিয়ায়। ১৫৮৭ সালে প্রথম ডোমিনিকান মিশনারিদের জাহাজ ফিলিপাইনের উপকূলের এসে নোঙর করে। এই দলটির একজন ছিলেন ফাদার মিগুয়েল দে বেনাভিদেস।
পর্তুগিজ এই ধর্মপ্রচারক ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী একজন ব্যক্তি। তিনি ১৬০১ সালে বিশপ থেকে আর্চবিশপে উন্নীত হন এবং তিনি সে সময়ে ছিলেন পুরো ফিলিপাইনের তৃতীয় আর্চবিশপ। তবে তার দূরদর্শিতার কথা আলাদা করে বলতে হয়। ফিলিপাইনে খ্রিস্টধর্ম ও উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যতের কথা তিনি তার সময়ে ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। এ কারণেই একটি বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করেন তিনি।
ফাদার বেনাভিদেসের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য, তিনি তার জীবদ্দশায় কোনো উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান দেখে যেতে পারেননি। ফিলিপাইনে সে সময়ের ফাদারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে সবচেয়ে আগ্রহী ব্যক্তি ছিলেন ফাদার বেনাভিদেস। তবে ১৬০৫ সালে তিনি মারা যান। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্দেশ্যে তিনি তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ও অর্জিত সম্পদ উইল করে দিয়েছিলেন মৃত্যুর আগেই। তার অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় ১,৫০০ পেসো। আর লাইব্রেরিতে ছিল মোটামুটি একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর মতো বই। এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন তহবিল ছিল এটাই।
ফাদার বেনাভিদেসের মৃত্যুর পর ফাদার বার্নার্দো দা সান্তা ক্যাতালিনা নামের আরেকজন পাদ্রী প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর জন্য এগিয়ে আসেন। তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ডোমিনিকান চার্চের পাশেই তিনি একটি ভবন তৈরি করেছিলেন। এরপর ১৬১১ সালে স্পেনের রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের দূত ম্যানিলায় কলেজ প্রতিষ্ঠার অনুমতিপত্র নিয়ে হাজির হয়। স্পেনিশ রাজার কাছ থেকে সরাসরি অনুমতিপত্র পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠার কাজ নতুন মাত্রা লাভ করে। অবশেষে ১৬১১ সালে ২৮শে এপ্রিল, ‘কলেজিও দে নুয়েস্ত্রা সেনোরা দেল সান্তিসিমো রোজারিও’ নামে ফিলিপাইনের ম্যানিলায় ডোমিনিকান চার্চের পাশে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে বিখ্যাত ডোমিনিকান ধর্মতত্ত্ববিদ সেইন্ট থমাস এ্যাকুইনাসের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘ইউনিভার্সিটি অভ সান্তো টমাস’।
- ১৬১৯ সালের কলেজটিকে ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের উপর ডিগ্রি প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়।
- ১৬৪৫ সালে পোপ দশম ইনোসেন্ট এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা প্রদান করেন।
- ১৬৮০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল নিয়োগের ক্ষেত্রে স্প্যানিশ রাজতন্ত্রকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
- ১৬৮১ সালে পোপ একাদশ ইনোসেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়টিকে অন্যান্য বিষয়ের উপরেও ডিগ্রি দেয়ার অনুমতি প্রদান করেন।
- ১৭৩৪ সালে পোপ ত্রয়োদশ ক্লিমেন্ট সব অনুষদকে ডিগ্রি দেয়ার অধিকার প্রদান করেন এবং ভবিষ্যতে কোনো অনুষদ খোলা হলে সেগুলোও যেন ডিগ্রি প্রদান করতে পারে, এমনটা নিশ্চিত করেন।
এভাবে ধাপে ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিধি বাড়তে থাকে। একসময় এটি ফিলিপাইনের একমাত্র ও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হওয়ার গৌরব অর্জন করে, যেটি পোপের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হতো।
ফিলিপাইনে একসময় সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বেশ জোরালো বিতর্ক শুরু হয়েছিল। ‘ইউনিভার্সিটি অভ সান কার্লোস’ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান নিজেদের ফিলিপাইন তথা এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিল। তারা দাবি করেছিল, ইউনিভার্সিটি অভ সান্তো টমাস প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আরও ১৬ বছর আগে, অর্থাৎ ১৫৯৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তবে তাদের দাবির সত্যতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিতর্ক নিরসনের জন্য ‘ন্যাশনাল হিস্ট্রিক্যাল কমিশন অভ ফিলিপাইন্স’ একটি অনলাইন নিবন্ধ প্রকাশ করে, যেখানে ইউনিভার্সিটি অভ সান্তো টমাসকে ফিলিপাইন তথা এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
হোসে রিজাল, এমিলিও জাসিন্তো, মার্কো এইচ. ডেল পিলার ও এ্যাপোলিনারিও মাবিনি– এই চারজন ব্যক্তিকে ফিলিপাইনের ভাগ্যনির্ধারণ করা নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যারা সবাই একসময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ফিলিপাইনের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতির পদ থেকে শুরু করে সংসদ সদস্য– এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া ছাত্ররা কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেননি। বিভিন্ন সময় বিখ্যাত পোপেরা এ বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ করে গিয়েছেন। এখানকার খেলোয়াড়েরা ফিলিপাইনের জাতীয় ক্রীড়াক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রাখেন। ফিলিপাইনের কলেজিয়েট লিগে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্কেটবল দল ‘গ্রোলিং টাইগার্স’ সবচেয়ে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
৪১০ বছরের ইতিহাসে ইউনিভার্সিটি অভ সান্তো টমাসের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম মাত্র দু’বার বন্ধ ছিল। ১৮৯৮-৯৯ সালে ফিলিপাইনে বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ে তথা আমেরিকা-ফিলিপাইন যুদ্ধের সময় পুরো বিশ্ববিদ্যালয় এক বছর বন্ধ ছিল। এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২-৪৫, প্রায় তিন বছর জাপানি সেনাবাহিনীর দখলে ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে বিদেশি নাগরিক ও বেসামরিক মানুষদের জন্য ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ হিসেবে ব্যবহার করেছিল। ১৯৪৫ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি, আমেরিকার সেনাবাহিনী এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে জাপানের হাত থেকে মুক্ত করে, আটকে থাকা ব্যক্তিদের মুক্তি দেয়।
মজার বিষয় হলো, এশিয়া সবচেয়ে পুরােনো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরানো বিশ্ববিদ্যালয়– যেটাই হোক না কেন, কোনোটিই স্থানীয় মানুষের হাতে তৈরি হয়নি, বাইরে থেকে আসা মানুষদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় একজন নারীর হাত ধরে গড়ে উঠলেও সে সময়ে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় গমনের পথ ছিল একেবারে রুদ্ধ। এমনকি পুরো মধ্যযুগেও নারীদের বিশ্ববিদ্যালয় গমনের কোনো গল্প শোনা যায় না। আরেকটি মজার বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্র তার অন্তর্গত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশাল অংকের বিনিয়োগ করলেও একেবারে প্রাচীনকালে তা ব্যক্তি উদ্যোগেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে উঠেছিল, রাষ্ট্রের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না।