সোনার শহরের কথা উঠলেই চেখের সামনেই প্রথমেই ভেসে উঠে সেই স্বপ্নের শহর ‘এল ডোরাডো’, যেখানে ছড়িয়ে রয়েছে সোনার যত গুপ্ত ভাণ্ডার। কিংবদন্তি এই শহরকে ঘিরে রয়েছে কতোই না উপাখ্যান আর নানা কল্পকাহিনী। শহরটির খোঁজে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কতশত অভিযাত্রী ছুটে বেড়িয়েছে। পাড়ি দিয়েছে কত দুঃসাহসী অভিযান। কিন্তু সেই স্বপ্নের শহর ‘এল ডোরাডো’র দেখা কি পেয়েছিল তারা? নাকি সবই ছিল মরীচিকা? চলুন আজ সেই পরশ পাথরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়া যাক!
স্প্যানিশ ভাষায় এল ডোরাডো মানে ‘যেটি সোনা’। এটি এসেছে এল অমব্রে দোরাদো (El Hombre Dorado) বা ‘সোনার মানুষ’ থেকে। অনেক দিন আগে দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়ায় এক আদিবাসী গোষ্ঠী ছিল মুইসকা।
মুইসকা ঐতিহ্য অনুসারে, নতুন রাজা নির্বাচন করার পর মাথা থেকে পা পর্যন্ত সোনার গুঁড়ো মাখিয়ে তাকে গুয়াতাভিতার পবিত্র স্নান করানো হয়। এদের বলা হতো এল ডোরাডো। পরে এটি কীভাবে যেন হয়ে যায় এক হারিয়ে যাওয়া শহরের নাম, যেটি নাকি সম্পূর্ণটাই সোনা দিয়ে তৈরি। গুয়ানার লেক পারিমের কাছে কল্পনার শহরটির ঠিকানা। বহু যুগ ধরে এর খোঁজে হাজার হাজার মানুষের অভিযান চলেছে বলে কথিত আছে।
এল ডোরাডো হলো সেই মিথ নগরী, যা সোনা দিয়ে তৈরি বলে মনে করতো স্প্যানিশদের মতো অনেকেই। কিন্তু এই নগরীর সন্ধান আজ অবধি কেউ দিতে পারেনি। আনুমানিক ৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বিভিন্ন নথিতে এল ডোরাডোর কথা বিভিন্নভাবে ছড়াতে শুরু করে। ষোড়শ শতকে সবচেয়ে বিস্তার লাভ করে এ মিথ। ষোড়শ শতকে এ নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ হলো হুয়ান রড্রিগজ ফ্রেইলের লেখা ‘দ্য কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডিসকভারি অব দ্য নিউ কিংডম অব গ্রানাডা’।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের কাছে বাকি পৃথিবীর অনেকটাই অজানা ছিল। গুজবের সঙ্গে কল্পনা মিশে তাদের ধারণা দৃঢ় হয়, কোথাও নিশ্চয়ই সোনায় মোড়া এই শহরটি ঠিক আছে। বহু গল্প, উপন্যাস আর সিনেমায় এই এল ডোরাডোর নাম উঠে এসেছে। যার মধ্যে একটি কবিতা স্বয়ং এডগার অ্যালান পোর লেখা। মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো বলেছিলেন, “এল ডোরাডো যেতে চাও, তবে চাঁদের পাহাড় পেরিয়ে, ছায়ার উপত্যকা ছাড়িয়ে, হেঁটে যাও, শুধু হেঁটে যাও…”
ফ্রান্সিসকো পিসারো ১৫৩০ সালে ইনকা সাম্রাজ্য লুট করার পর বাইরের পৃথিবীর সবাই ভাবতো, লাতিন আমেরিকার যে জায়গাগুলো এখনও বাইরের মানুষের কাছে অনাবিষ্কৃত, সেখানে কোথাও বিশাল ধন সম্পদের সাম্রাজ্য রয়েছে। এরাই এই সোনার রাজ্যের গুজব তৈরি করে।
একই সময়ে অভিযাত্রী কুয়েসাদা গুয়াটাভিটা হ্রদের পানি সেচে চার হাজার সোনার টুকরো পেয়েছিলেন। ধারণা করা হয়, প্রতি বছর উৎসবের সময় আদিবাসীরা হ্রদে প্রথানুযায়ী সোনা নিক্ষেপ করত। এটি তারই যেন ইঙ্গিত দিয়ে যায়। কিন্তু অনেকেই তা বিশ্বাস করেন না। এই সোনার লোভে বহু অঞ্চল থেকে লোকেরা এসেছে। প্রচুর পরিশ্রম করে হ্রদের তলদেশে জোয়ারের সময়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে। অনেকেই এভাবে কিছু সোনার টুকরো সংগ্রহ করতে পারলেও সোনার শহর ‘এল ডোরাডো’র খোঁজ পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি।
স্প্যানিশরা যখন লাতিন আমেরিকা জয় করেন, স্থানীয় মুইসকা গোষ্ঠীকে খুঁজে বেরও করেন। লেক গুয়াতাভিতায় খোঁজ চালিয়ে কিছু সোনা পান। কিন্তু তাতে তাদের আঁশ মেটেনি। একের পর এক ব্যর্থ অভিযানে মানুষ আসতে থাকে সেখানে। সবসময় সেটা সুখকর ছিল না। সেখানকার আদিম আদীবাসীদের তারা মারধর, অত্যাচার চালাতে থাকে সোনার খোঁজে। কিন্তু লাভ হয় না। তাদের হাত থেকে রেহাই পেতে তারাও নানারকম গল্পগাঁথা তৈরি করে। ক্রমশ তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলে এল ডোরাডোর কিংবদন্তি।
১৭৯৯-১৮০৪ সালে অভিযান চালিয়ে আলেকজান্ডার ফন হামবোল্ট লাতিন আমেরিকায় এক দুঃসাহসিক অভিযান করেন। তীব্র খরস্রোতা ওরিনিকো নদী পাড়ি দেন তিনি। দুর্গম অঞ্চলে তাঁবু খাটিয়ে থাকেন। ১৮০১ সালে ৪৫ দিন দুর্গম পথ অতিক্রম করে পৌঁছতে সক্ষম হন রিও ম্যাগদালেনাতে। এই স্থানের খোঁজে বহু অভিযাত্রী দীর্ঘকাল ধরে হন্যে হয়ে ঘুরছিল। কিন্তু সেই স্বর্ণ অস্তিত্ব খুঁজে পেতে তিনিও ব্যর্থ হন। পরে তিনি শহরটির অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করেন।
তবে এল ডোরাডো থেকে যায় পৃথিবীর একটি রূপকের নাম হয়ে, যার মানে যেখানে খুব তাড়াতাড়ি ধনসম্পত্তি লাভ করা যায়। কেউ কোন ব্যর্থ অভিযানে বেরুলেও সেটিকে ‘এল ডোরাডো খোঁজ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তবে এল ডোরাডো অভিযান ব্যর্থ হয়নি একেবারে। ১৫৪১ সালে সোনার শহরের খোঁজে অভিযাত্রী ফ্রান্সিসকো দে ওরেয়ানা আর গনসারো পিসারো অভিযানে বেরিয়েছিলেন। আমাজন নদীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে পুরো দৈর্ঘ্যটাই জানা হয়ে যায় ওরেয়ানার।
গহীন বনের ভিতর দিয়ে বয়ে চলা আমাজন নদী যে কত বড়, তা কেউ কখনও আন্দাজও করতে পারেনি। বর্তমানে এটি বিশ্বের দীর্ঘতম নদী হিসেবে পরিচিত। যাই হোক, যদিও খোঁজ মেলেনি স্বর্ণ শহরের, তবু এই আবিষ্কারের জন্যই ইতিহাসের পাতায় উঠে যায় ওরেয়ানার নাম। এই অভিযানের মূল্য সোনার চেয়েও কম কিছু নয়।
২০০১ সালে রোমের এক পাঠাগারে হঠাৎ এক ধুলোমাখা নথি আবিষ্কৃত হয়। তাতে এল ডোরাডো শহরের কথা লেখা রয়েছে। আন্দ্রিয়া লোপেজ নামের এক ধর্মযাজক ১৭ শতকের সেই নথি লিপিবদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। লিপি থেকে জানা যায়, সেই শহরের অমিত ধনসম্পত্তির কথা। কিন্তু শহরটি কোথায় তা সেই লিপিতে খোলাসা করেননি যাজক। শুধু বলেছেন পেরু থেকে ১০ দিনের হাঁটাপথ। কিন্তু পেরুর কোন শহর থেকে বা কোন দিক থেকে যাত্রা শুরু করতে হবে তার কোনো সঠিক তথ্য লিপিতে জানা যায়নি।
এল ডোরাডোর সন্ধান পেতে গত ১০০ বছরে নানা দেশের সংগঠিত অভিযানই হয়েছে অন্তত ১৪টি। এই অভিযানে ইনকা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেলেও দেখা মেলেনি সেই স্বর্ণ শহরের। আবার অনেক সময়েই ঘন জঙ্গল থেকে বের হতে না পেরে হারিয়ে গেছেন অনেক অভিযাত্রী। ১৯৭১ সালে গহীন জঙ্গলে এমনিভাবে হারিয়ে গেছেন ফরাসি এবং মার্কিন একদল অভিযাত্রী। ১৯৯৭-তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নরওয়ের অভিযাত্রীরা |
ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ রেইনফরেস্ট আর পার্বত্য অঞ্চলের কোনো এলাকায় এ স্বর্ণ নগরীর খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। আবার অনেক অভিযাত্রী মনে করেন, পেরু‚ বলিভিয়া এবং ব্রাজিলের মিলনস্থলে গভীর জঙ্গলের ভিতরে ছিল সেই গোপন শহর, যেখানে ধনসম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছিল ইনকারা। ফলে অভিযাত্রীরা সেই লক্ষ্যে আমাজন অরণ্যের মাঝে অভিযান চালান। কিন্তু তারপরও সে শহরের দেখা মেলেনি। তবে মাচুপিচু আবিষ্কারের পর থেকে অভিযাত্রীরা নতুন করে উৎসাহ পেয়েছেন।
অভিযাত্রী বিংহ্যামের নেতৃত্বে ১৯১১ সালে উরুবাম্বা নদী অববাহিকায় খাড়াই পাহাড়ের উপর আবিষ্কৃত হয় ইনকাদের তৈরি হারিয়ে যাওয়া এই শহর। কী কারণে এই পবিত্র স্থান নির্মাণ করেছিল ইনকারা‚ তা আজও রহস্যাবৃত। মাচুপিচু আবিষ্কার যখন হয়েছে, তাহলে একদির স্বপ্নের সোনার শহর এল ডোরাডো আবিষ্কার হবে সে আশায় বুক বেঁধেছেন অনেক অভিযাত্রী।