হাজার বছর আগে বেরিং প্রণালী দিয়ে মানুষ আমেরিকাতে প্রবেশ করে। তারপর অনেককাল পার হয়ে গিয়েছে, বেরিং প্রণালীর সেই পথ সাগরের গ্রাসে চলে গিয়েছে। ফলে আমেরিকার এই বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী, লাল চামড়ার বদৌলতে ইংরেজিতে যাদেরকে রেড ইন্ডিয়ান বলা হয়, তারা অনেকগুলো বছর নিরুপদ্রবে কাটায়। বর্তমানের গ্রেট প্লেইনস নামে পরিচিত ভূখন্ড আর পাশের পাহাড় ও মরু অঞ্চলে এই রেড ইন্ডিয়ানরা বাস করতো। পূর্বাঞ্চলের ইন্ডিয়ানদের তুলনায় আরো শ’দুয়েক বছর তারা শ্বেতাঙ্গদের বিশেষ উৎপাত ছাড়াই কাটিয়েছিল।
কলম্বাসের আমেরিকা পুনঃআবিষ্কারের সাথে সাথে বহু ইউরোপীয় গিয়ে হাজির হয় এই নতুন ভূখন্ডে। ওলন্দাজ, ফরাসি আর ইংরেজদের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বহু জাতি। গ্রেট প্লেইনস এবং মরু অঞ্চলের রেড ইন্ডিয়ানরা অবশ্য যুদ্ধে আরো দক্ষ ছিল। দক্ষিণের স্প্যানিয়ার্ডদের কাছ থেকে ঘোড়া এবং অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে সাহসী এই লোকগুলো বহুকাল লড়ে গিয়েছে। শেষমেশ আধুনিক কামান-বন্দুকের হাতে হার মানতে বাধ্য হলেও গর্বিত এই জাতিগুলো জন্ম দিয়েছে সাহসী গল্পগাঁথার। জেনে নেওয়া যাক এমনই কিছু লড়াকু রেড ইন্ডিয়ান জাতের কথা, যারা শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিরোধের জন্ম দিয়েছিল।
সিউ
সিউরা মূলত বনচারী মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের ডাকোটা, মিনেসোটা, লোয়া এবং কানাডার ম্যানিটোবা অঞ্চলে তারা ঐতিহাসিকভাবে বসবাস করে আসছে। সিউরা পশুর ফার বিক্রি করতো ফরাসিদের কাছে। পরে ফরাসিরা উত্তর আমেরিকা থেকে পাততাড়ি গোটালে মার্কিনীদের সাথে সিউদের ক্রমাগত যুদ্ধ বাধতে থাকে।
ডাকোটা, লাকোটা এবং নাকোটা; সিউদেরকে এই তিনভাগে ভাগ করা হতো। ১৮৬২ সালে ডাকোটাদের সাথে শ্বেতাঙ্গদের মন কষাকষি শুরু হয়। হামলার অভিযোগে তিন শতাধিক সিউকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিচারের নামে যে প্রহসন হয়েছিল তা ছিল যেমন হাস্যকর, তেমনই গোজামিলে ভরপুর। পরম মানবতাবাদী হিসেবে পরিচিত আব্রাহাম লিংকনের প্রশাসন খুব দক্ষতার সাথে সিউদেরকে ধ্বংস করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।
ব্ল্যাক হিলস সিউদের কাছে খুবই পবিত্র জায়গা। ব্ল্যাক হিলস আর সংলগ্ন পাউডার রিভার অঞ্চলে লাকোটা সিউরা রেড ক্লাউডের নেতৃত্বে বহু বছর যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে লিটল বিগহর্নের যুদ্ধে সিউরা বিশেষ বীরত্ব দেখায় ও জয়লাভ করে। মার্কিন সরকার রেললাইন বসিয়ে রীতিমত শিকারী ভাড়া করে এসব অঞ্চলে বাইসন হত্যা করতো, যাতে খাদ্যাভাবে সিউরা হার মানে।
সিউদের পক্ষে অনন্তকাল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মার্কিন সরকার এক মোটা অংকের বিনিময়ে ব্ল্যাক হিলসে দখলদারিত্ব আরোপ করে। যদিও সিউরা কখনোই এই চুক্তি মেনে নেয়নি। মার্কিন ব্যাংকে জমতে জমতে ডলারের অংকটা বর্তমানে এক বিলিয়ন ছাড়িয়ে গিয়েছে।
সিউ ইন্ডিয়ানরা এখনো নিজস্ব আবাসভূমির জন্য দাবি জানিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র আর কানাডা মিলিয়ে এক লক্ষ সত্তর হাজারের মতো সিউ বাস করে। ‘ড্যান্সেস উইথ উলভস’ নামের বিখ্যাত সিনেমাটি সিউদেরকে কেন্দ্র করে বানানো হয়েছে।
অ্যাপাচি
নিউ মেক্সিকো, টেক্সাস, আরিজোনা, মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চলে অ্যাপাচিদের বসবাস। স্প্যানিশদের সাথে দশকের পর দশক সফলভাবে যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বদৌলতে তারা ঘোড়া আর অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুর্ধর্ষ গোত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই অ্যাপাচিরা। মেসকালেরো, জিকারিল্লা, চিরিকাহুয়াসহ নানা গোত্রে তারা বিভক্ত।
১৮৪৬ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মেক্সিকোর যুদ্ধ বেঁধে গেলে অ্যাপাচিরা মার্কিন সরকারকে নানাভাবে সাহায্য করেছিল। কিন্তু পরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই তাদের আবার যুদ্ধ বেঁধে যায়। ১৮৮৬ সালে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হওয়ার আগপর্যন্ত জেরোনিমো, মাঙ্গাস কলোরাডো বা ভিক্টোরিওর মতো নেতাদের হয়ে অ্যাপাচিরা লড়াই করে গিয়েছে। ঘোড়ায় চড়ে, তীর-ধনুক আর বন্দুক নিয়ে আক্রমণরত অ্যাপাচি যোদ্ধারা মার্কিন বসতি স্থাপনকারীদের কাছে ছিল সাক্ষাত যমদূত। অ্যাপাচিদেরকে মূলধারার মিডিয়াতে সবসময় তুলে ধরা হয় যুদ্ধবাজ, নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর যোদ্ধাজাতি হিসেবে। অথচ বাস্তবে কিন্তু তারা স্রেফ নিজেদের বিচরণভূমি, অ্যাপাচেরিয়া রক্ষার জন্যই লড়েছিল।
আরো অনেক রেড ইন্ডিয়ানের মতো অ্যাপাচিরাও বাইসন শিকার করে জীবন চালাতো। বর্তমানে লক্ষাধিক অ্যাপাচি যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে।
নাভাহো
নাভাহোদেরকে অনেকে অ্যাপাচি বা পুয়েবলো গোত্রের ইন্ডিয়ান মনে করে ভুল করে। আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শুষ্ক মরু অঞ্চলে নাভাহোদের বাস। সমতলের ইন্ডিয়ানদের মতো টিপি নয়, নাভাহোরা বাস করে কাদামাটি দিয়ে বানানো কুড়েতে। মেক্সিকোর শ্বেতাঙ্গদের সাথে দীর্ঘদিন যুদ্ধবিগ্রহ এবং ব্যবসার বদৌলতে নাভাহোদের হাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভেড়া এবং ঘোড়ার মজুত জমা হয়।
নাভাহোরা অন্যান্য ইন্ডিয়ানদের তুলনায় কিছুটা কম দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির শিকার। মেক্সিকো-আমেরিকা যুদ্ধের সময়ে নাভাহোরা মার্কিন সরকারকে সহযোগিতা করেছিল। এর বিনিময়ে বছর বিশেকের মধ্যে দেখা গেল পালে পালে নাভাহো নারী-পুরুষ-শিশুকে তাড়িয়ে তিনশত মাইল দূরের রিজার্ভেশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে পানি, খাবার বা চাষযোগ্য জমি ছিল না বললেই চলে। এই অভূতপূর্ব বদান্যতায় বহু নাভাহোর মৃত্যু হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বহু নাভাহো সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। যুদ্ধে তাদের দক্ষতার কারণেই মার্কিন সমাজে কিছুটা সম্মান পাওয়ার সুযোগ হয় এই ইন্ডিয়ান গোত্রের। বর্তমানে লাখ তিনেকের মতো নাভাহো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে। তাদের নিয়ে বহু সিনেমা ও বই লেখা হয়েছে।
কোমানচি
১৬৮০ সালে মেক্সিকোর পুয়েবলো ইন্ডিয়ানরা স্পেনীয়দেরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে। এর কিছুকাল পরে সশোনি গোত্রের ইন্ডিয়ানদের মধ্য থেকে কম-বেশি বারোটা দল আলাদা হয়ে যায়। পুয়েবলোদের কাছ থেকে ঘোড়া যোগাড় করে খুব দ্রুত এই ইন্ডিয়ানরা যুদ্ধে দক্ষ হয়ে ওঠে। কোমানচি নামে পরিচিত এই ইন্ডিয়ানরা অশ্বারোহী যোদ্ধা হিসেবে ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। টেক্সাস, কলোরাডো, ওকলাহোমা, কানসাস আর নিউ মেক্সিকো মিলিয়ে বিরাট এক অঞ্চল বশীভূত হয় তাদের হাতে। কোমানচি একটি উতে শব্দ, এর অর্থ, ‘যে সবসময় লড়াই করতে চায়/শত্রু’।
কোমানচিরা ছিল যাযাবর, বাইসন শিকার করে জীবন চালাতো তারা। প্রতি পূর্ণিমায় কোমানচিরা ঘোড়ায় চড়ে রাত-বিরেতে প্রতিবেশী গোত্র এবং শ্বেতাঙ্গ বসতি স্থাপনকারীদের ওপরে হানা দিত। কোমানচেরিয়ার আশেপাশের সকল প্রতিবেশীরা এই যুদ্ধংদেহী গোত্রটিকে ভীষণ ভয় করতো। তাদের দলে কেবল যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আলাদা একজন নেতা থাকতো। তবে খুব বেশিকাল কোমানচিদের প্রতাপ বজায় থাকেনি। আধুনিক মার্কিন অস্ত্র এবং অতি শিকারের ফলে বাইসন কমে যাওয়ায় কোমানচিরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এছাড়া হাম বা বসন্তের মতো রোগে কোমানচিদের সংখ্যা ১৮৭০ সালের মধ্যে কয়েক হাজারে নেমে আসে। তবে এত দুর্গতির মধ্যেও রেড রিভারের যুদ্ধ সহ বেশ কিছু যুদ্ধে কোমানচিরা অংশগ্রহণ করেছে।
বর্তমানে হাজার পনেরোর মতো কোমানচি যুক্তরাষ্ট্রে বাস করে। নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে মাত্র এক শতাংশ। অথচ একটা সময় তাদের পরাক্রমে সবাই তটস্থ থাকতো।
উতে
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো আর উতাহ অঞ্চলে উতেদের বাস। আদিতে তারা পাহাড়ে বসবসা করতো। ক্রমে ঘোড়া কিনে তারা সমতল অঞ্চলে নেমে আসে এবং শিকারীর জীবন বেছে নেয়। উতেদের সাথে প্রতিবেশী ইন্ডিয়ান গোত্রগুলির সম্পর্কটা ছিল কিছু জটিল। উতেরা কখনো মার্কিন সরকারের পক্ষে লড়াই করতো, তো কখনো অন্য গোত্রের ইন্ডিয়ানদের ওপরেই হামলা চালিয়ে বসতো। দক্ষ যোদ্ধা এই মানুষগুলো শিকারের পাশাপাশি সীমিত পরিমাণে ভুট্টা চাষ করতো। প্রতি বছর খুব জাকজমকের সাথে ‘ভাল্লুক নাচ’ আর ‘সূর্য নাচ’ আয়োজন করা হত।
উনিশ শতকের শুরুর দিকে উতেদের অঞ্চলে মর্মনরা এসে হাজির হয়। তাদের সাথে উতেদের নিত্য মারামারি লেগেই থাকতো। পরে কলোরাডো অঞ্চলে সোনা আবিষ্কার হলে পালে পালে বুভুক্ষু শ্বেতাঙ্গ এসে হাজির হয়। উতেদের জন্য বরাদ্দকৃত জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমানো হতে থাকে। এর পাশাপাশি যুদ্ধ, বাচ্চাদের অপহরণ করে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়া এবং অসুখ-বিসুখের দাপটে খুব দ্রুত উতেদের সংখ্যা কমে যায়। ১৮৭০ এর মধ্যেই গর্বিত এই জাতিটি একরকমের হৃতবল হয়ে পড়ে। বর্তমানে মাত্র হাজার দশেক উতে টিকে আছে।