অটোমান সাম্রাজ্যের তুর্কি শাসকদের হাতে লক্ষ লক্ষ আর্মেনীয়র নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসে পরিচিত আর্মেনীয় গণহত্যা। ১৯১৫ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন, তুর্কি সরকারের নেতারা আর্মেনীয়দের বিতাড়িত ও নিশ্চিহ্ন করে ফেলার পরিকল্পনা করে। ১৯২০ এর দশকের সূচনালগ্নে সমাপ্তি ঘটে এই গণহত্যা ও গণ স্থানান্তরকরণের, ততদিনে ৬ থেকে ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় লাশে পরিণত হন। এর মাঝে অগণিত আর্মেনীয়কে জোর করে বের করে দেওয়া হয় দেশ থেকে। আজকের দিনে এসে অধিকাংশ ইতিহাসবিদ একে গণহত্যা বলেই অভিহিত করেন। এই হত্যাযজ্ঞটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাস থেকে একটি আস্ত জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য একটি পরিকল্পিত অভিযান। যা-ই হোক, তুর্কি সরকার এখনও পর্যন্ত এসব ঘটনার ব্যাপকতা, এমনকি এর সত্যতাও স্বীকার করে না।
আজকের লেখায় ‘দ্য হিস্টোরি চ্যানেল’ এর ওয়েবসাইটের ‘Armenian Genocide’ ভুক্তি অবলম্বনে ধরা হলো এই ভয়ঙ্কর গণহত্যার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
গণহত্যার শেকড় অটোমান সাম্রাজ্য
প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে ইউরেশিয়ার ককেশাস অঞ্চলে বাস করে আসছে আর্মেনীয়রা। এই সময়কালের একটি পর্যায়ে, আর্মেনিয়া রাজ্যের একটি স্বাধীন সত্ত্বা ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আর্মেনীয়রা ছিল পৃথিবীর প্রথম জাতি যারা চতুর্থ শতকের শুরুর দিকেই খ্রিস্টধর্মকে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের রাজধর্ম হিসাবে ঘোষণা করে।
কিন্তু এই সময়কালের অধিকাংশ পর্যায়েই, এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হয়েছে এক সাম্রাজ্য থেকে আরেক সাম্রাজ্যের কাছে। পঞ্চদশ শতকে এসে প্রবল প্রতাপশালী অটোমান সাম্রাজ্য দখল করে নেয় আর্মেনিয়াকে।
অটোমান শাসক এবং তাদের অধীনস্ত অধিকাংশ প্রজাই ছিল মুসলিম। আর্মেনীয়দের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে সীমিত পরিমাণে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার তারা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আর্মেনীয়রা তাদের চোখে ‘অবিশ্বাসী’ হওয়ার কারণে তাদের সাথে চলত অন্যায্য ও অসম আচরণও। সেসময় সেখানে খ্রিস্টানদেরকে কর দিতে হতো মুসলিমদের চেয়ে উচ্চহারে। আর তাদের রাজনৈতিক ও আইনী অধিকার ছিল একেবারে সামান্য।
এসব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও, আর্মেনীয় সম্প্রদায় অটোমান শাসনে বেশ উন্নতিসাধন করে। তারা তাদের তুর্কি প্রতিবেশীদের চেয়ে এগিয়ে ছিল শিক্ষা-দীক্ষায়, ছিল বেশ সম্পদশালীও। সেকারণে তুর্কিরা তাদেরকে দেখতো ক্ষোভের নজরে।
একটি সন্দেহের কারণে এই ক্ষোভ আরো ঘনীভূত হয়। তুর্কিরা ভাবতো, খ্রিস্টান আর্মেনীয়রা অটোমান খেলাফতের প্রতি যতটা অনুগত, তার চেয়ে হয়তো অনেক বেশি অনুগত ছিল খ্রিস্টান সরকারগুলোর প্রতি। তুরস্কের সাথে তখন একটা অস্থিতিশীল সীমান্ত ছিল রাশিয়ার, রাশিয়ার খ্রিস্টান সরকার তাই ছিল তাদের সন্দেহের মধ্যে অন্যতম।
অটোমান সাম্রাজ্যের যতই অবক্ষয় হচ্ছিল, এসব সন্দেহ ততই জোরদার হয়ে উঠছিল। উনিশ শতকের শেষদিকে, স্বৈরাচারী তুর্কি সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ভাবতেন, সরকারের প্রতি আনুগত্যের স্থান হলো সবকিছুর উপরে। সেসময় আবার আর্মেনীয়রা আন্দোলন করছিল নিজদের মৌলিক অধিকারে জন্য। একারণে ক্ষিপ্ত হয়ে সুলতান তখন ঘোষণা দেন যে, তিনি ‘আর্মেনীয় প্রশ্নটির’ একটি এসপার-ওসপার করেই ছাড়বেন।
১৮৯০ সালে সুলতান জনৈক সাংবাদিককে বলেন, “আমি খুব দ্রুত এই আর্মেনীয়দের একটা উচিত শিক্ষা দেবো। আমি তাদের কানে একটা বাকশো পরিয়ে দেব… যেটা তাদের বিপ্লবী চিন্তাভাবনার ইতি টেনে দেবে।”
প্রথম আর্মেনীয় হত্যাযজ্ঞ
আর্মেনীয়রা তাদের উপরে চলতে থাকা অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছিল। এরই প্রেক্ষিতে ১৮৯৪ থেকে ১৮৯৬ সালে, এই ‘কানে বাকশো পরিয়ে দেওয়াটা’ একটা হত্যাযজ্ঞের রূপ নিল।
তুর্কি সামরিক কর্মকর্তা, সৈন্য, ও সাধারণ লোকেরা আর্মেনীয় গ্রাম ও শহরগুলো উজাড় করে ফেলে, এবং সেখানকার মানুষদের পাইকারি হারে হত্যা করে। লাখ লাখ আর্মেনীয় খুন হন সেসময়।
তরুণ তুর্কিরা
১৯০৮ সালে তুরস্কে একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। নিজেদেরকে ‘তরুণ তুর্কি’ দাবি করা একদল সংস্কারক সুলতান আবদুল হামিদকে উৎখাত করে এবং আরও আধুনিক ধরনের একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে।
শুরুর দিকে আর্মেনীয়রা আশাবাদী ছিল যে, এই নতুন রাষ্ট্রে তারা অন্যদের সমান স্থানই পাবে। কিন্তু দ্রুতই তারা বুঝতে পারল, জাতীয়তাবাদী এই তরুণ তুর্কিরা সর্বোচ্চ যেটা চায়, সেটা হচ্ছে গোটা সাম্রাজ্যের ‘তুর্কিকরণ’। আর তাদের এই চিন্তাধারা অনুযায়ী, যারা তুর্কি নয়, এবং তাদের মধ্যে আবার যারা খ্রিস্টান, এদের সবাইকে তারা এই নতুন রাষ্ট্রের জন্য একটি বিশাল হুমকি বলে মনে করতে শুরু করল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা
১৯১৪ সালে, তুর্কিরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় ‘কেন্দ্রীয় শক্তি’র অন্তর্গত জার্মানি আর অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের পক্ষে। সেই সাথে ঠিক একই সময়ে, অটোমান ধর্মীয় নেতারা তাদের যুদ্ধকালীন মিত্র বাদে আর সকল খ্রিস্টানের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেন।।
অটোমান সামরিক নেতৃত্ব সেসময় ভাবতে শুরু করে, আর্মেনীয়রা হলো বেঈমান, আর সেকারণে বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি (ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স, সার্বিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ যারা মিত্রশক্তি হিসাবে পরিচিত ছিল) জিতলে নিজেরা স্বাধীনতা পাবে এই ভাবনা থেকে আর্মেনীয়রা হয়তো শত্রুশিবিরে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করায় আগ্রহী হয়ে উঠবে।
অটোমানদের ভাবনা অবশ্য মিথ্যা হয়নি। আর্মেনীয়রা স্বাধীনতাই চেয়েছিল, চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অন্যায়ের অবসান। যুদ্ধ যখন তীব্র হয়ে উঠল, আর্মেনীয়রা তখন ককেশাস অঞ্চলে তুর্কিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রুশ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা শুরু করল। যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে এই ঘটনাগুলো আর্মেনীয়দের ব্যাপারে তুর্কিদের সাধারণ সন্দেহকে আরও উসকে দিল। এরই ফলাফল স্বরূপ, তুর্কি সরকার তখন পূর্ব রণাঙ্গন (ইস্টার্ন ফ্রন্ট) জুড়ে থাকা যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে আর্মেনীয়দেরকে ‘চিরতরে সরিয়ে’ দেয়ার এক ভয়ঙ্কর নীতি গ্রহণ করল।
আর্মেনীয় গণহত্যার সূচনা
১৯১৫ সালের ২৪ এপ্রিল শুরু হয় আর্মেনীয় গণহত্যা। প্রথম আঘাত আসে বুদ্ধিজীবীদের উপর। সেদিনটিতেই তুর্কি সরকার কয়েকশো আর্মেনীয় বুদ্ধিজীবীকে গ্রেফতার ও হত্যা করে।
এরপর সাধারণ আর্মেনীয়দেরকে তাদের বাড়িঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করা হয়। কোনোরকম খাবার কিংবা পানি ছাড়া মেসোপটেমিয়ার মরুভূমিতে এক নির্মম মৃত্যুর মিছিলে পাঠানো হয় তাদেরকে। তাদেরকে নিজেদের এলাকা থেকে বের করে দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পাঠানো ও হত্যা করা হতে থাকে।
প্রায়ই মরুভূমির মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া আর্মেনীয়দেরকে বিবস্ত্র করে জ্বলন্ত সূর্যের নিচে পথ চলতে বাধ্য করা করা হতো, যতক্ষণ না তারা মরে পড়ে যেত। আর যারা থেমে যেতে চাইত, সাথে সাথে গুলি করে ফেলে দেওয়া হতো তাদের লাশ।
সেই সময়ে, তরুণ তুর্কিরা একটি বিশেষ সংগঠন তৈরি করে, যারা আবার ‘ঘাতক বাহিনী’ ও ‘কসাই ব্যাটেলিয়ন’ গঠন করে। তাদের কাজ নিয়ে একজন অফিসার বলেছিল, সেই ‘খ্রিস্টান উপাদানগুলোর বিলোপ সাধন’ করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
এসব ঘাতক বাহিনীর অধিকাংশই গঠিত হয়েছিল পেশাধার খুনী আর সাবেক দাগী আসামীদের নিয়ে। তারা আর্মেনীয়দের নদীতে ডুবিয়ে, পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে, ক্রুশবিদ্ধ করে, এমনকি জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারতো। এই নারকীয় গণহত্যার ফলে তুরস্কের গ্রামগুলোতে তৈরি হচ্ছিল অজস্র আর্মেনীয় লাশের স্তূপ।
দলিলপত্র থেকে দেখা যায়, এই ‘তুর্কিকরণ’ অভিযান চলাকালে, সরকারি বাহিনীগুলো আর্মেনীয় শিশুদেরকে অপহরণ করত, তাদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করত, এবং তুর্কি পরিবারের হাতে তাদেরকে তুলে দিত। কোথাও তারা নারীদেরকে ধর্ষণ করত, এবং তাদেরকে তুর্কি ‘হারেমের’ অধিবাসী হতে বাধ্য করত বা দাসী বানাতো। মুসলিম পরিবারগুলোকে আর্মেনীয়দের ফেলে যাওয়া বাড়িগুলোতে উঠে আসত আর তাদের সহায়-সম্পত্তি দখল করে নিত।
যদিও নানান প্রতিবেদনে তথ্যবৈচিত্র্য আছে, অধিকাংশ সূত্রই এই ব্যাপারে একমত যে, এই হত্যাযজ্ঞের সময় অটোমান সাম্রাজ্যে প্রায় ২০ লক্ষ আর্মেনীয় বাস করত। ১৯২২ সালে যখন এই গণহত্যার অবসান ঘটে, অটোমান সাম্রাজ্যে জীবিত রয়ে যাওয়া আর্মেনীয়ের সংখ্যা তখন মাত্র ৩ লক্ষ ৮৮ হাজারে নেমে আসে।
আজকের বিশ্বে আর্মেনীয় গণহত্যা
১৯১৮ সালে অটোমানরা আত্মসমর্পণ করার পরে, তরুণ তুর্কিদের নেতারা জার্মানিতে পালিয়ে যায়, যাদের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে গণহত্যার দায়ে তাদের বিচার করা হবে না। যা-ই হোক, আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীদের একটি দল এই গণহত্যার নেতাদেরকে খুঁজে বের করে গোপনে হত্যা করার একটা পরিকল্পনা করে, যেটি ‘অপারেশন নেমেসিস’ নামে পরিচিত।
সেই তখন থেকেই তুর্কি সরকার ‘গণহত্যা’র বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। তাদের যুক্তি হলো, আর্মেনীয়রা ছিল শত্রুপক্ষ, তাই তাদেরকে হত্যা করা ছিল একটি ‘জরুরি যুদ্ধকালীন’ কাজ।
আজকের সময়ে তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অপরাপর পশ্চিমা দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, আর তাই এসব দেশের সরকারগুলো তুরস্ককে সুদূর অতীতের এই গণনিধনযজ্ঞকে অভিযুক্ত করতে ইচ্ছুক নয়। কেবল ২০১০ সালের মার্চে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল প্যানেল এই গণহত্যার স্বীকৃতির পক্ষে ভোট দেয়।
এমনকি মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলোও দীর্ঘদিন পর্যন্ত তুরস্কের এই জঘন্য অন্যায়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিল। ২০০৪ সালের আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসে ‘আর্মেনীয় গণহত্যা’ শব্দবন্ধটি ব্যবহৃতই হয়নি!
যা-ই হোক, এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে তুরস্কের অবস্থান আজও পাল্টায়নি। আর্মেনীয় ও সারা দুনিয়ার সামাজিক ন্যায়বিচার কর্মীদের চাপ সত্ত্বেও তারা এই বর্বর গণহত্যার দায় স্বীকার করেনি। এমনকি সেই সময় আর্মেনীয়দের সাথে কী ঘটেছিল, তা নিয়ে আলোচনা করাও তুরস্কে এখনও অবৈধ!
ফিচার ইমেজ: Wikimedia Commons