যীশু খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ কয়েকটি শহর

আধুনিক সভ্যতার উন্নত শহরগুলো সম্পর্কে আমরা মোটামুটি জানি। সমৃদ্ধ এসব শহরের রয়েছে নিজস্ব গতিধারা, সংস্কৃতি আর যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগেও বহু সমৃদ্ধ শহর গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর বুকে। তাদের কোনোটি আজ নিশ্চিহ্ন, আবার কোনো কোনো শহর হয়তো নিজেকে আরও সমৃদ্ধ করে টিকে রয়েছে এখনো।

আজকের সময়ে কল্পনা করতে কষ্ট হলেও সেসব শহরও নিজ যুগের তুলনায় সবদিক থেকে এগিয়ে ছিল। শিক্ষা, চিকিৎসা, বিপণন ব্যবস্থা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং নিজস্ব সংস্কৃতির গুণেই তারা সমসাময়িক অন্যসব সভ্যতা থেকে এগিয়ে গিয়েছিল। তাই তো তারা মানব ইতিহাসে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে, সেই সঙ্গে প্রতিনিয়ত তাদের ব্যাপারে আরও জানছি আমরা। এই লেখায় খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে সবচেয়ে প্রাচীন সমৃদ্ধ শহরগুলোর ব্যাপারে জানব।

১. জেরিকো – খ্রিস্টপূর্ব ৭,০০০ বছর

মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে পুরনো সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় জেরিকো শহরকে, যে সময় থেকেই মূলত সভ্যতা গড়ার ধারণাটি তৈরি হয়। শহরটি সমৃদ্ধ হওয়ারও হাজারখানেক বছর আগে থেকে জেরিকো গড়ে উঠতে শুরু করে। মৃত সাগর এবং নেবোর মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে এটি, যার ছিল ফসল উৎপাদনের জন্য সহজ সেঁচ ব্যবস্থা। ওই অঞ্চলের সবচেয়ে সমৃদ্ধ মরূদ্যান হিসেবে বিবেচনা করা হতো জেরিকোকে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, জেরিকো রপ্তানিনির্ভর একটি শহর ছিল, যারা সেই সময়ের সবচেয়ে দামি তেল উৎপাদন করতো।

 জেরিকো স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ করে তুলেছিল নিজেকে; Image Source: carolinafotyga.com

কিন্তু শুরুর দিকে জেরিকো ছিল কতগুলো যাযাবর মানুষের আবাসস্থল। তারপর শহরের বাসিন্দারা একসময় সীমানা দেয়াল তৈরির উদ্দেশ্যে বড় বড় পাথর সংগ্রহ করে সেগুলো এক জায়গায় বসাতে শুরু করে। তারা প্রথমদিকে শিকার করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। এরপর কৃষিকাজের সঙ্গে জড়াতে থাকে। শহরটি সমৃদ্ধ হতে শুরু করলে আশপাশে আরও কিছু গ্রাম গড়ে ওঠে একে ঘিরে, যারা জীবিকার জন্য জেরিকোর উপর নির্ভরশীল ছিল।

উৎকর্ষের প্রমাণ হিসেবে জেরিকো স্থাপত্যকলায় সমৃদ্ধ করে তুলেছিল নিজেকে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় আচারগুলো তারা নিয়মিত পালন করতো। মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম প্রতিকৃতি তৈরির চেষ্টা করেছিল তারা, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের কঙ্কালের উপর বিভিন্ন আঁকিবুকি থেকে। জেরিকো নিয়ে যত গবেষণা হচ্ছে, ততই প্রাচীন শহরটি মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে।

২. উরুক – খ্রিস্টপূর্ব ৩,৫০০ বছর

অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, উরুক মূলত বাইবেলে বর্ণিত ইরেচ শহর। জেনেসিসের ভাষ্য অনুযায়ী, বাদশাহ নমরুদ উরুক শহরটির গোড়াপত্তন করেছিলেন। বর্তমান ইরাকের রাকা শহরেই এর অবস্থান ছিল এবং শহরের জনসংখ্যা ছিল চার হাজারের মতো। তাদের সবাই কাজ করতেন, বিশেষ করে কৃষিকাজে উরুক অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। ইউফ্রেতিস নদীর তীরবর্তী এলাকায় অবস্থান করায় তাদের সেঁচ ব্যবস্থা ছিল সহজসাধ্য, যার মাধ্যমে তারা আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। মূলত কৃষিপণ্য রপ্তানি করেই তারা নিজেদের সমৃদ্ধ করেছিল। পাশাপাশি শিক্ষা, সাহিত্য, হস্তশিল্প এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় উরুকের জনগণ অবদান রাখতে শুরু করে। তাইগ্রিস এবং ইউফ্রেতিসের মধ্যবর্তী উরুক মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অংশীদার হয়েছিল।

উরুকের আবিষ্কৃত ধ্বংসাবশেষের একটি অংশ; Image Source: thoughtco.com

উরুক শহরটি দুটো প্রধান অংশে বিভক্ত ছিল, যাদের নাম এবং পরিচিতিতে এখানকার বাসিন্দারের ধর্মীয় চর্চার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ধর্মীয় ব্যাপারগুলোতে উরুক যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিল, তাদের পৌরাণিক বর্ণনাগুলো থেকে এমনটাই জানা যায়।

৩. মারি – খ্রিস্টপূর্ব ২,৪০০ বছর

মেসোপটেমীয় সভ্যতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল মারি। ব্যবসা-বাণিজ্যে তারা সমসাময়িক অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। বর্তমান সিরিয়া ভূখণ্ডের প্রাচীন শহর মারির জনসংখ্যা ছিল প্রায় পঞ্চাশ হাজার। তারা কৃষিপণ্য, কাঠ এবং মৃৎশিল্প রপ্তানি করত আশপাশের এলাকাগুলোতে। এর ফলে তাদের অর্থনীতি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছিল। জনগণের মাঝে খাদ্যশস্য বিতরণেও ছিল বৈচিত্র্য, বিশেষ করে সামাজিক প্রতিপত্তি অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ করা হতো সবার মাঝে।

নিজের গৌরব জানান দিচ্ছে প্রাচীন শহর মারি; Image source: pexels.com

১৯৩০ সালে ফ্রান্সের একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ মারিদের কিছু ঐতিহাসিক কাগজপত্রের সন্ধান পান, যেগুলো বিলুপ্ত আক্কাদিয়ান ভাষায় লেখা হয়েছে। এগুলো ছিল মূলত সেসময়কার সরকারি গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, আয়-ব্যয়ের হিসাব আর ব্যক্তিগত চিঠি। এ আবিষ্কার পৃথিবীর প্রাচীন ভাষা এবং সভ্যতা নিয়ে গবেষণার নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে।

সমৃদ্ধ মারি শহরটি বেশ কয়েকবার বিধ্বস্ত হয় সামরিক অভিযানের ফলে। আশেপাশের শত্রু জনপদগুলো মারিতে প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করতো, যার কারণে শহরটির শাসনক্ষমতাও বদলেছে বারবার। আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য একসময় শহরটির দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং প্রায় বিধ্বস্ত মারিতে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করে। আক্কাদিয়ানদের শাসনামলে মারি নিজেকে বিকশিত করতে শুরু করে, যার মাধ্যমে তারা আঞ্চলিক পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে মারি আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং আধুনিক সিরিয়া সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য উঠে আসে। বিশেষ করে প্রাচীন রাজনীতি এবং সরকার ব্যবস্থা নিয়ে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে আরও।

৪. ইয়েন সু – খ্রিস্টপূর্ব ১,৩০০ বছর

ইয়েন সু বিখ্যাত হয়ে আছে প্রাণীর হাড়ের উপর প্রাচীন ভাষায় লিখিত দৈববাণীর জন্য। এর মাধ্যমেই চীনাদের ভাষার ব্যবহার নিয়ে ধারণা পাওয়া যায়। বড় প্রাণীর হাড় এবং কচ্ছপের খোলসের উপর তারা নিজেদের ভবিষ্যদ্বাণী ব্রোঞ্জে খোদাই করে দিত। তারপর যখন কালি ও তুলির যুগ এলো, তখন তাদের লেখার নিয়মও বদলে গেলো। হাড়ের বদলে মাটির ছোট ছোট খণ্ডের উপর কালির আঁচড় বসাতো তারা। সর্বপ্রথম ১৮৯৯ সালে চীনাদের প্রাচীন এই নগরীর খোঁজ পাওয়া যায়, যেখান থেকে চীনাদের সুপ্রাচীন ভেষজ ঔষধ ব্যবহারের প্রমাণ মেলে।

ইয়েন সু নিয়ে আস্ত জাদুঘর আছে চীনাদের; Image Source: trip.com

ইয়েন সু ছিল চীনের প্রাচীনতম রাজধানীগুলোর মধ্যে অন্যতম। শাং বংশের রাজত্বকালে এই নগরীই ছিল তাদের সর্বশেষ রাজধানী। শাং বংশ ২৫৫ বছর ধরে ঐ অঞ্চল শাসন করেছিল, এবং বারোজন রাজা বংশপরম্পরায় শহরটির দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমান চীনের একেবারে উত্তরে হেনান প্রদেশের আনায়াং শহরের অদূরেই ঐতিহাসিক ইয়েন সু শহরের অবস্থান। তাদের বাড়ি-ঘর তৈরিতে কাঠের ব্যবহার ছিল এবং ঘরগুলোতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য তাদের যথাযথ প্রস্তুতি ছিল, সেই সঙ্গে ধর্মীয় আচারের স্থানগুলো রক্ষায় তারা বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। ইয়েন সুর অধিবাসীরা দিন গণনা করত। সাম্প্রতিককালে তাদের আবিষ্কৃত এলাকাগুলোতে ব্রোঞ্জের তৈরী ক্যালেন্ডারের খোঁজ পাওয়া যায়।

৫. ব্যাবিলন – খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ বছর

এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাচীন নগরগুলোর ভেতর ব্যাবিলন সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জানা যায়। ইরাকের রাজধানী বাগদাদের প্রায় ৯৪ কিলোমিটার দক্ষিণে বাবিল প্রদেশে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার প্রাচীন সমৃদ্ধ শহরটির অবস্থান। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবিলনও সমৃদ্ধ আর ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। একসময় তৎকালীন বিশ্বরাজনীতির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি পায় শহরটি। ঐতিহাসিকদের তথ্যমতে, ব্যাবিলন শহরটিকে বেশ কয়েকবার ভগ্নদশা থেকে পুনরায় তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধ-বিগ্রহের কারণেই এমনটা হয়েছিল বলে তারা মনে করেন।

প্রাচীন সভ্যতার ব্যাবিলন; Image Source: theasian.asia

বারবার শহর সংস্কারের কারণেই হয়তো তাদের স্থাপত্যকলা অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নান্দনিক দালানকোঠা, অবকাঠামোগত এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ফলে তারা অন্যদের চেয়ে ভিন্ন হতে পেরেছিল। পরবর্তীতে শহরের চারপাশে নগররক্ষা দেয়াল তৈরি করা হয় বেশ কয়েক দফায়। দেয়ালগুলো বেশ প্রশস্ত ছিল, যার কারণে বাইরে থেকে শহরকে অনেক বড় দেখালেও বাস্তবে ততটা বড় ছিল না। ‘ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যান’ আজও মানুষের কাছে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। বুক অভ জেনেসিসসহ বেশ কিছু প্রাচীন ধর্মীয়গ্রন্থে ব্যাবিলন শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রভাবশালী এই শহরটির গৌরব অবশ্য বেশিদিন টেকেনি, পারস্যের রাজা সাইরাস একসময় ব্যাবিলনের পতন ঘটান।

শহরটি পুনরায় আবিষ্কারের পর একে রক্ষায় বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেয় ইরাক সরকার। বিশ্ব ঐতিহ্যের পরিচয় বহন করা শহরটির ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণে সাদ্দাম হোসেন কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ২০০৩ সালে আমেরিকা ইরাক দখল করে নিলে ব্যাবিলনের সংস্কারকাজও থেমে যায়। আমেরিকানরা প্রাচীন এই সমৃদ্ধ শহরটির ধ্বংসাবশেষের উপর তাদের সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে। ফলে, ব্যাবিলন সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারই আবার কালের গর্ভে হারিয়ে যায়।

৬. কার্থেজ – খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ বছর

প্রাচীন কার্থাজিনিয়ান সভ্যতার রাজধানী কার্থেজের অবস্থান বর্তমান তিউনিসিয়ায়। সেই সময় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান ব্যবসায়িক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, যার কারণে ক্রমেই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পেরেছিল তারা। প্রথমদিকে কার্থেজ ফিনিশিয়ান উপনিবেশের অংশ থাকলেও একসময় পুনিক সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ফলাফল হিসেবে আশপাশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে কার্থেজ।

প্রাচীন কার্থেজের অবস্থান বর্তমান তিউনিসিয়ায়; Image Source: wondermondo.com

খ্রিস্ট পরবর্তী সময়ে রোমানরা যখন একসময় নগর সভ্যতার হাল ধরতে শুরু করে, তখন তাদের হাতে কার্থেজ ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও রোমানরা শহরটিকে আবার পুনঃস্থাপন করেছিল। তারপর বাইজান্টাইনদের হাত থেকে শহরটিকে মুক্ত রাখার জন্য উমাইয়া বাহিনী কার্থেজ ধ্বংস করে ফেলে আবার। মুসলিম শাসনামলে কার্থেজ দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে, কিন্তু ক্রুসেডাররা দুর্গের পতন ঘটিয়ে শহরটি দখল করে নেয় এবং এর অধিবাসীদের হত্যা করে।

১৯১৯ সালে কার্থেজ তিউনিসিয়ার উপকূলীয় শহর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আবার। সর্বপ্রথম ১৮৩০ সালে কার্থেজকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত করে এর উপর জরিপ করা হয়। তারও প্রায় শত বছর পর ১৯২০ সালে ফ্রান্সের সহায়তা নিয়ে কার্থেজে খননকাজ শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।

ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি:

১) দ্যা রিচেস্ট ম্যান ইন ব্যাবিলন

This article is about the ancient greatest cities before Christ and how they became greatest in human civilization.

Necessary sources are hyperlinked in the article.

Featured Image: businessinsider.com

Related Articles

Exit mobile version