গল্প দিয়ে শুরু…
একটি দৃশ্য কল্পনা করা যাক। শহরের ছোট্ট এক বিদ্যালয়, ছিমছাম, পরিপাটি। শিক্ষার্থীদের কলকাকলীতে মুখরিত বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। হঠাৎ একদিন, বিদ্যালয়ের সামনে হাজারখানেক মানুষ জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে লাগল। সম্প্রতি তাদের সরকার একটি আইন প্রণয়ন করেছে, এই আইনের বিরুদ্ধেই তাদের এ বিক্ষোভ। সেই সাথে তারা প্রতিহত করবে একটি দলকে, যারা আজই আসবে এই বিদ্যালয়ে।
মানুষগুলোর সাথে যোগ দিয়েছে শহরের নিরাপত্তাবাহিনী। তারাও সেই দলকে প্রতিহত করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু, কারা সেই দল? কোনো সন্ত্রাসীগোষ্ঠী কি? কিংবা ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী কোনো উগ্রপন্থী সংগঠন, যারা বিদ্যালয়ের ক্ষতি করতে চায়? কিন্তু না, দলটি ছিল নয়জন কিশোর-কিশোরীর। যারা শুধুমাত্র লেখাপড়া করার জন্য এখানে ভর্তি হতে চেয়েছিল। আর সবার আপত্তিটা ছিল এখানেই৷ এই দলটি কোনোমতেই যাতে ভর্তি হতে না পারে সেই চেষ্টায় রত ছিল সবাই। আর এর পেছনে একটিই কারণ ছিল, দলটির সকলেই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ।
উপরের দৃশ্যটি শুধুমাত্র কল্পনা হলেও চলত, যদিও এরকম একটি দৃশ্য কল্পনাতেও ভয়ানক। তবে এটি কোনো কাল্পনিক দৃশ্য ছিল না। আজ থেকে ৬৩ বছর আগে, আমেরিকার একটি শহরে এরকমই একটি দৃশ্যের অবতারণা ঘটেছিল। কিন্তু কেন? তা জানতে হলে আমাদের আরও একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।
অন্যায়ই যখন ন্যায়
সাল ১৯৫৪, তখন পর্যন্ত বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রে অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। তথাকথিত কালো মানুষেরা সাদাদের থেকে পৃথক জীবনযাপন করত। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা স্কুলব্যবস্থা ছিল, যাকে বলা হত ‘জিম ক্রো আইন’। এরকম একটি সময়, ১৯৫৪ সালের ১৭ মে, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত আইন জারি করল, বিদ্যালয় পৃথকীকরণ নীতিটি অবৈধ এবং অসাংবিধানিক। যে মামলার ফলে এই রায় প্রদান করা হল, তার নাম Brown v. The Board of Education বা ব্রাউন বনাম শিক্ষাবোর্ড। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই মামলাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নেওয়া প্রথম কোনো রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ।
১৯৫৪ সালে আদালত নির্দেশ দিলেও ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। কারণ তৎকালীন সমাজের পক্ষে এই রায় মেনে নেওয়া যথেষ্ট কঠিন ছিল। বর্ণবাদের যে বিষাক্ত বীজ তাদের মস্তিষ্কে যুগ যুগ ধরে রোপিত ছিল, তাকে উপড়ে ফেলা স্রেফ একটি নির্দেশের কর্ম ছিল না।
এরকম একটি সময়ে যে কয়েকটি বিদ্যালয় আদালতের নির্দেশ মেনে তথাকথিত কৃষ্ণাঙ্গদের স্কুলে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি করল, তাদের মধ্যে একটি ছিল লিটল রক সিনিয়র হাই স্কুল। আরকানসাসের রাজধানী লিটল রক শহরে স্কুলটি অবস্থিত। খুব আগ্রহের সহিত যে তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়নি তা বলাই বাহুল্য। কিছুটা সরকারি নির্দেশে, এবং কিছুটা NAACP-এর চাপে পড়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে রাজধানীর নাগরিক সভা এবং বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা।
পরিবর্তনের আশায়
বাধা সত্ত্বেও নয়জন শিক্ষার্থী রেজিষ্ট্রেশন করল। আমেরিকার একটি শহরের কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ভর্তি হলো নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকান কিশোর-কিশোরী। ইতিহাসের পাতায় তারাই পরিচিত দ্য লিটল রক নাইন নামে। তারা হলো মিনিজিন ব্রাউন, এলিজাবেথ একফোর্ড, আর্নেস্ট গ্রীন, থেলমা মাদার্শেড, মেলবা প্যাটিলো, গ্লোরিয়া রে, টেরেন্স রবার্টস, জেফারসন থমাস এবং কার্লোটা ওয়ালস। তাদের ভর্তির পেছনে বড় অবদান ছিল ডেইজি গ্যাস্টন বেইটস এর, যিনি ছিলেন আরকানসাস NAACP-এর প্রেসিডেন্ট এবং আরকানসাস স্টেট প্রেস সংবাদপত্রের প্রকাশক। এটি ছিল আফ্রিকান-আমেরিকানদের বেশ একটি প্রভাবশালী পত্রিকা।
ডেইজি বেইটস এবং আরাকানসাস NAACP-এর অন্যান্য সদস্যরা এই নয়জনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হলো যে এরা বাধা মোকাবেলা করতে সক্ষম। সেই সাথে স্কুল শুরুর এক সপ্তাহ পূর্বে তাদের কাউন্সেলিং করানো হলো এবং যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হলো, ক্লাসে কীভাবে তারা বর্ণবাদী আচরণের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে। এ যেন ঠিক কোন যুদ্ধের প্রস্তুতি! যদিও ব্যাপারটা আসলে অনেকটাই সেরকম ছিল, কারণ এই নয়জন সেই ধরনের পরিস্থিতিতেই পড়তে যাচ্ছিল, যা সুস্থ মানুষকেও সম্পূর্ণ অসুস্থ করে দিতে সক্ষম।
সেপ্টেম্বর ২, ১৯৫৭। আরাকানসাসের গভর্নর অর্ভ্যাল ফবাস ঘোষণা করলেন, তিনি জাতীয় নিরাপত্তারক্ষী পাঠাবেন বিদ্যালয়ে, যারা আফ্রিকান-আমেরিকান শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেবে। তার মতে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্যই এ সিদ্ধান্ত, এবং যদি তারা বিদ্যালয়ে প্রবেশের চেষ্টা করে, তবে রক্তপাতও ঘটতে পারে। ৩ তারিখ অভিভাবকেরা বিক্ষোভ করল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। যদিও ঐদিনই বিকেলে ফেডেরাল জাজ রোনাল্ড ডেভিস ঘোষণা করলেন যে সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ীই সব হবে।
পরদিন ৪ সেপ্টেম্বর, লিটল রক নাইনের নতুন স্কুলে প্রথম দিন। লিটল রক শিক্ষাবোর্ডের নিষেধ সত্ত্বেও তারা স্কুলে গেল। ৮ জনকে বেইটস গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসলেন, কেবল এলিজাবেথ একলা আসল। বাড়িতে ফোন না থাকায় সে জানতে পারেনি যে বেইটস তাদের সবাইকে একসাথে নিয়ে আসবেন। যা-ই হোক, গভর্নরের নির্দেশমতো প্রায় ২৭০ জন নিরাপত্তারক্ষী ছিল তাদের বিদ্যালয়ে প্রবেশে বাধা। সেই সাথে হাজারখানেক বিক্ষোভকারী চিৎকার করে পাথর ছুঁড়ছিল এবং তাদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল। সেদিনের একটি বিখ্যাত ছবি ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, যেখানে দেখা যায়, এলিজাবেথ নোটবুক হাতে নির্বিকারভাবে দৃপ্ত ভঙ্গীতে এগিয়ে যাচ্ছে স্কুলের দিকে, আর তাকে ঘিরে তীব্র মৌখিক আক্রমণে উদ্যত স্কুলের অন্যান্যরা।
সর্বোচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ
তীব্র বাধার মুখে পরবর্তী প্রায় দু’সপ্তাহ লিটল রক নাইনের পক্ষে স্কুলে যাওয়া সম্ভবপর হয়নি। এসময় দেশ-বিদেশে সংবাদপত্রে সেদিনের ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বর্ণবাদ এবং নাগরিক অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় মানুষের মনে। ফেডেরাল জাজ রোনাল্ড ডেভিস, গভর্নর ফবাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন, এবং স্বয়ং প্রেসিডেন্ট, ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার ফবাসকে নির্দেশ দিলেন নিরাপত্তারক্ষী সরিয়ে নিতে এবং লিটল রক নাইনকে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে বাধা না দিতে।
সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ, নিরাপত্তারক্ষী সরিয়ে নেওয়া হলো এবং লিটল রক পুলিশ বিভাগের দায়িত্বে ২৩ তারিখে শিক্ষার্থীরা পুনরায় বিদ্যালয়ে এলো। কিন্তু তখনও হাজারখানেক বিক্ষোভকারীর জমায়েত ছিল তাদের বাধা দেওয়ার জন্য। দাঙ্গা আসন্ন দেখে পুলিশ চটজলদি শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিল।
পরদিন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার, ফোর্ট ক্যাম্পবেল, কেনটাকি থেকে ১০১ এয়ারবোর্ন ডিভিশনের, ১২০০ সদস্যের একটি সেনাবাহিনী পাঠালেন এবং ১০,০০০ জাতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের জায়গায় তাদের নিযুক্ত করলেন। অবশেষে সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখ, সেনাবাহিনীর সহযোগীতায় লিটল রক নাইন প্রথমবারের মতো পূর্ণ দিবস ক্লাস করতে সক্ষম হলো।
অত্যাচার এবং অত্যাচার…
বছরের বাকি সময়টা লিটল রক নাইনের জন্য ছিল অগ্নিপরীক্ষা। সর্বত্র গঞ্জনা সহ্য করা যেন তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফবাস তো প্রতিনিয়তই প্রচার করে চলেছিলেন তার ইচ্ছার কথা, তাদেরকে যেন নির্বাসিত করা হয়। এছাড়াও তাদেরকে সহপাঠীদের কাছ থেকে নিয়মিত অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করতে হত। মেলবা প্যাটিলোর মুখে এসিড নিক্ষেপ করা হয়েছিল, নিয়মিত তাকে মারধোর করা হত। শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আফ্রিকান-আমেরিকান প্রতিকৃতি পোড়াত। গ্লোরিয়াকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। বিদ্যালয়ের কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা খেলাধুলায় তাদের অংশ নিতে দেওয়া হত না।
অত্যাচারের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে মিনিজিন ব্রাউন প্রতিবাদ করে তার বিরুদ্ধে করা আক্রমণকে। যার ফলে ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। গ্লোরিয়া রে-এর মাকে চাকরিচ্যুত করা হয়, কারণ তিনি তার মেয়েকে বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে নিতে অস্বীকৃতি জানান।
অবশেষে সাফল্য, কিন্তু…
এরকম অবর্ণনীয় অত্যাচারের মধ্যে কোনো মানুষের টিকে থাকার কথা না। কিন্তু তবুও ইস্পাতকঠিন এই শিক্ষার্থীরা হাল ছাড়ল না। ফলে ১৯৫৮ সালের ২৫ মে, আর্নেস্ট গ্রীন, প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে লিটল রক স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হলো। গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে বিখ্যাত নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র উপস্থিত ছিলেন শুধুমাত্র আর্নেস্ট গ্রীনকে দেখার জন্য।
১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে, লিটল রক নাইনের ভর্তির ১ বছর পর পর, গভর্নর ফবাস পুরো বছরের জন্য বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করলেন। আফ্রিকান-আমেরিকানদের ভর্তি নিষিদ্ধের জন্য গণভোটেরও ব্যবস্থা করেছিলেন, যেখানে নিষিদ্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ১৯,৪৭০ জন। পক্ষান্তরে ভর্তির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ৭,৫৬১ জন।
গ্রীন ছাড়া লিটল রক নাইনের আর কেউ এই বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। পরবর্তীতে তারা দেশের অন্যান্য বিদ্যালয় হতে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করে। ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে লিটল রক স্কুল পুনরায় চালু হয়।
কেমন আছেন তারা?
লিটল রক নাইনের অনেকেই তাদের পরবর্তী জীবন বেশ সাফল্যের সাথে কাটিয়েছেন। যেমন- আর্নেস্ট গ্রীন, প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের অধীনে ফেডেরাল ডিপার্টমেন্ট অব লেবার এ সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এলিজাবেথ একফোর্ড সাধারণ শিক্ষার সমতুল্য ডিপ্লোমা ডিগ্রী নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ব্রাউন অতিরিক্ত সহকারী সচিব হিসেবে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের অধীনে ডিপার্টমেন্ট অব দ্য ইন্টেরিয়র এ কর্মরত ছিলেন। প্যাটিলিও এনবিসি (NBC) এর প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। জেফারসন থমাস সেনাবাহিনীতে যোগদান করে ভিয়েতনামে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। পরবর্তীতে ব্যবসা বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করে বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানি এবং পেন্টাগনে হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরি করেন।
লিটল রক নাইন অধিকার আদায়ে তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ১৯৯৯ সালে, প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন লিটল রক নাইনের প্রত্যেক সদস্যকে কংগ্রেশনাল স্বর্ণপদকে সম্মানিত করেন। এছাড়াও তারা প্রত্যেকে ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রিত ছিলেন।
২০১০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, লিটল রক নাইনের প্রথম সদস্য হিসেবে, জেফারসন থমাস, প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে ইহধাম ত্যাগ করেন।