বাইবেলে উল্লেখিত ডেভিড বনাম গোলিয়াথের অসম যুদ্ধের কথা আগে কোথাও শুনেছেন নিশ্চয়ই? না জানলেও ক্ষতি নেই। বিশাল দেহাবয়বের গোলিয়াথ গর্ব করেছিল- পুরো সেনাবাহিনীতে তার সাথে পাল্লা দেয়ার মতো কেউ নেই। শেষপর্যন্ত ডেভিড ঠিকই তাকে পরাজিত করে। বর্তমান বিশ্বে কোনো লড়াইয়ে যখন একপক্ষ অপরপক্ষের চেয়ে শক্তিমত্তায় ঢের এগিয়ে থাকে, সেই ধরনের পরিস্থিতিকে ডেভিড বনাম গোলিয়াথ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে এই ধরনের অসম যুদ্ধ সংঘটিত হয় দুর্বল ফিনল্যান্ড ও শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে, যার সাথে ডেভিড বনাম গোলিয়াথের যুদ্ধের মিল পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিবিদগণ জার্মানির সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে বেশ ভয়ে ছিলেন। তাদের আশঙ্কা ছিল হয়তো প্রতিবেশী দেশগুলোকে হিটলারের বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, যেগুলো থেকে পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল ভূখণ্ডে আক্রমণ চালানো হবে। এই ভয় থেকেই সোভিয়েত নেতারা প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর বাড়তি প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন, ফিনল্যান্ড ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝখানে কিছু জায়গা নিয়ে ‘বাফার স্টেট’ গড়ে তোলা হবে। এই ‘বাফার স্টেট’-এ পরিষ্কার সোভিয়েত আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চিন্তা করা হয়েছিল যাতে হিটলারের সেনাবাহিনী যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করবে তখন ফিনল্যান্ড নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকলেও বাফার স্টেটের কারণে সোভিয়েতরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। সোভিয়েতরা যেহেতু ফিনল্যান্ডদের তুলনায় সবদিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিল, তাই তারা ধরেই নিয়েছিল তাদের প্রস্তাবে ফিনল্যান্ডের নেতারা কোন দ্বিমত করতে পারবে না।
কয়েক মাস ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতারা আলোচনার নামে বারবার ফিনল্যান্ডকে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করছিল। কিন্তু শক্ত মেরুদন্ডের ফিনিশ নেতারা আলোচনায় কখনও সম্মত হননি। হবেনই বা কীভাবে? সোভিয়েত ইউনিয়নের এই দাবি ছিল ফিনল্যান্ডের সার্বভৌমত্বের জন্য পুরোপুরি হুমকিস্বরূপ। সামরিক সক্ষমতার জোরে অন্য দেশের স্বাধীন ভূখন্ডের দাবি তো চাইলেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। শুধু তা-ই নয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন রুশ-ফিনিশ সীমান্তের ভূমি বাদ দিয়ে বেশ কিছু দ্বীপের কর্তৃত্বও চেয়েছিল, যেগুলোতে তাদের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। আলোচনার টেবিলে ফিনল্যান্ডের নেতারা সোভিয়েত চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেই তাদের প্রস্তাব বারবার নাকচ করে দিচ্ছিলেন। তবে তারা এটাও জানতেন যে শেষপর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবি আদায়ের জন্য যদি যুদ্ধের প্রয়োজন হয়, তবে সেটাই করবে। ঐতিহাসিকভাবে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও ফিনল্যান্ডের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের কূটনৈতিক সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না। ফিনল্যান্ডের সাধারণ জনগণও চায়নি তাদের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাবে রাজি হোক।
ফিনল্যান্ডের নেতারা যুদ্ধ ছাড়া শুধু কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের ভূখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে হস্তান্তর করতে রাজি ছিলেন না। দরকারে যুদ্ধ হোক, তারপরও নিজেদের সার্বভৌমত্ব অন্য দেশের কাছে বিলিয়ে দেয়া যাবে না– এই ছিল তাদের মনোভাব। অপরদিকে অল্প কিছুদিন আগে জার্মানির সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতারা ‘নন-অ্যাগ্রেশন প্যাক্ট’ চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও হিটলারের উপর ভরসা রাখতে পারছিলেন না তারা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র থেকে তারা জানতে পেরেছিলেন, শেষপর্যন্ত জার্মানি চুক্তি ভেঙে ঠিকই আক্রমণ করবে। সোভিয়েত নেতাদের ধারণা অবশ্য অমূলক ছিল না। চুক্তি ভেঙে হিটলারের সেনাবাহিনী ঠিকই সোভিয়েত ইউনিয়নে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান ‘অপারেশন বারবারোসা’ পরিচালনা করে। ফিনল্যান্ডের সাথে আলোচনায় কোন সমঝোতায় পৌঁছতে না পারায় শেষপর্যন্ত সামরিক অভিযানের মাধ্যমেই ফিনল্যান্ডের অধিকৃত জায়গা দখল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এর মধ্যে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়। সোভিয়েত-ফিনল্যান্ড সীমান্তে সোভিয়েত সীমান্তরক্ষীদের উপর বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সরাসরি এই বোমা হামলার দায়ভার ফিনল্যান্ডের উপর চাপিয়ে দেয়। সোভিয়েত গণমাধ্যমে সীমান্তে বোমা হামলার ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর দেশটির জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরবর্তীতে প্রায় সব ইতিহাসবিদ দাবি করেছেন, সীমান্তরক্ষীদের উপর বোমা হামলা করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের পাশ থেকেই। এতে ফিনল্যান্ডের জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ তারা পাননি। অনেকে মনে করেন, ফিনল্যান্ডে সামরিক অভিযান চালানো তথা যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়ার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের দরকার ছিল একটি মোক্ষম অযুহাত। এজন্য প্রয়োজনে নিজ দেশের সীমান্তরক্ষীদের উপর বোমা হামলা চালাতেও তারা কুণ্ঠাবোধ করেনি। ১৯৩৯ সালের ৩০শে নভেম্বর পর্যাপ্ত পরিকল্পনা ছাড়াই সাড়ে চার লাখ সশস্ত্র সেনা নিয়ে সোভিয়েত রেড আর্মি ফিনল্যান্ডে আক্রমণ চালায়।
সোভিয়েত রেড আর্মি যুদ্ধে জেতার জন্য খুব বেশি পরিকল্পনা হাতে নেয়নি। তাদের ধারণা ছিল, রেড আর্মির সাঁড়াশি আক্রমণের সামনে হয়তো অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনী অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে। কিন্তু তাদের ভুল প্রমাণ করতে শুরু করে ফিনল্যান্ডের সৈন্যরা। সাধারণত কোনো শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তুলনামূলক দুর্বল সেনাবাহিনী যে সাধারণ কৌশল অবলম্বন করে, ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনীও সেই কৌশলই গ্রহণ করেছিল। সরাসরি যুদ্ধের জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের যোগান ছিল ফিনল্যান্ডের, তাই তারা গেরিলা কৌশলের আশ্রয় নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধের বড় এক কৌশল ছিল যুদ্ধ বিলম্বিত করা, যাতে কুখ্যাত রাশিয়ান শীতের কবলে পড়ে প্রতিপক্ষ নাস্তানাবুদ হয়। কিন্তু ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজের জালে নিজেই ফেঁসে গিয়েছিল। নভেম্বর মাসে ফিনল্যান্ডে তাপমাত্রা নেমে এসেছিল -৪৫° সেলসিয়াসে। এতে পুরো ফিনল্যান্ড বরফে ঢেকে যায় এবং সোভিয়েতদের রণকৌশল অকার্যকর হয়ে পড়ে।
ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনী প্রথমদিকে সোভিয়েত রেড আর্মির বিরুদ্ধে বেশ শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুললেও পরবর্তীতে সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিন রণকৌশল পরিবর্তন করেন এবং নতুন সৈন্যদল নিয়োগ দেন। সোভিয়েত ট্যাংক ডিভিশনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় ফিনিশ সেনাবাহিনীর। বরফের ক্যামোফ্লেজ কাজে লাগিয়ে ফিনল্যান্ডের স্নাইপাররা অসংখ্য সোভিয়েত সৈন্যকে হত্যা করে। কিংবদন্তি ফিনিশ স্নাইপার সিমো হায়েহা একাই পাঁচশো সোভিয়েত সৈন্য হত্যা করেন। এছাড়াও গেরিলা কৌশলে ‘হিট এন্ড রান’ পদ্ধতিতে সোভিয়েত সৈন্যরা প্রথমদিকে খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। পুরো দেশ বরফে ছেয়ে যাওয়ায় সামরিক বাহিনীর যাতায়াতেও বেশ সমস্যা হচ্ছিল। অনেক সময় ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনী সদস্যরাই সোভিয়েতদের যাতায়াতে বিঘ্ন ঘটানোর জন্য রাস্তাঘাটে বড় কাঠের টুকরা কিংবা ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই যুদ্ধে ফিনল্যান্ডের পক্ষে মারা যায় পঁয়ষট্টি হাজার মানুষ, অপরদিকে প্রায় আড়াই লাখ সোভিয়েত সৈন্য এই যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করে।
ফিনল্যান্ড যুদ্ধ বিলম্বিত করার মাধ্যমে বাইরের সাহায্যও চেয়েছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠায় বন্ধুপ্রতীম দেশগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেনি। প্রথমদিকে সোভিয়েত রেড আর্মির বিরুদ্ধে সফলতা আসলেও পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন সামরিক কৌশলে পরিবর্তন আনেন এবং নতুন সৈন্যদল হাজির করান। নতুন কৌশলের কাছে ফিনল্যান্ডের সবধরনের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধিদল বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য মস্কোর সাথে চুক্তিতে রাজি হয়। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে করা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ফিনল্যান্ড স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রেখেই মোট ভূখণ্ডের এগারো শতাংশ জায়গা সোভিয়েতদের কাছে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এছাড়াও সোভিয়েতরা ফিনল্যান্ডে নিজেদের পুতুল সরকার স্থাপন করে। এই অসম যুদ্ধে ফিনল্যান্ডের পরাজয় ঘটলেও সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে চার মাসের মতো প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হয় দেশটির সেনবাহিনী। ‘উইন্টার ওয়ার’ হিসেবে ইতিহাসে স্থান পাওয়া এই যুদ্ধ ছিল ফিনিশ জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ, অপরদিকে সোভিয়েতদের জন্য ছিল জোর খাটিয়ে দুর্বল প্রতিবেশী দেশের উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের যুদ্ধ।