১৯০০ সাল এবং তার আশেপাশের সময়ে পৃথিবীর ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো ছিলো ইউরোপের অধীনে। বিজ্ঞানের দিক থেকে উন্নতি তো বটেই, শিল্প-কারখানা এবং ধন-সম্পদের দিক দিয়েও ইউরোপিয়ানদের ধারে-কাছে কোনো দেশ ছিলো না। সেসময় এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উপনিবেশ ছিল। সমুদ্রে বাণিজ্যের যে জাহাজ চলতো, তার প্রায় সবগুলোই ছিল ইউরোপীয়দের অধীনে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের যে ধরনের দাপট দেখা যায়, সেসময় আজকের মতো ছিল না। বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বড় যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে তার অন্যতম কারণ ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আজকের লেখায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের একটি ঘটনা নিয়ে কথা বলা হবে, যে ঘটনা পুরো পৃথিবীকে এই যুদ্ধের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলো।
বসনিয়া ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি দেশ। সারাজেভ হচ্ছে দেশটির রাজধানী এবং বৃহত্তম শহর। ১৯১৪ সালের জুন মাসের ২৮ তারিখে আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রী এই শহরটিতে যান। আর্চডিউক ছিলেন তৎকালীন সময়ের অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী। এই সাম্রাজ্যের মুকুট পরবর্তীতে তারই পরার কথা।
সারাজেভ বসনিয়ার রাজধানী হলেও সে সময় এই অঞ্চলটি এই সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। সেই শহরটিতে যাওয়ার পরে তারা দুজন যখন একটি সড়ক দিয়ে গাড়ি করে যাচ্ছিলেন তখন পাশ থেকে একজন গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছুড়ে মারে। বোমাটি গাড়ির পেছনে দিকে আঘাত করে এবং ফেটে যায়। গাড়ির পেছনের দিকে যে সৈন্যটি ছিল সে গুরুতর আঘাত পায়। কিন্তু আর্চডিউক এবং তার স্ত্রী অক্ষত থাকেন। তখনকার মতো তাদেরকে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং আহত সৈন্যটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেদিন এই ঘটনার পরে আর্চডিউক তার সাথে আসা লোকজনদের বলেন, তিনি তার পরিকল্পনাতে পরিবর্তন আনতে চান। প্রথমে তিনি হাসপাতালে যেতে চান তার আহত সৈন্যকে দেখতে। তিনি এবং তার স্ত্রী আবারও গাড়িতে করেই রওনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু গাড়ির চালককে বলা হয়নি যে তারা তাদের পরিকল্পনাতে পরিবর্তন এনেছেন এবং আগে তারা হাসপাতালে যাবেন। এর পরের ঘটনা যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের লেখা বই World Crisis-এ বর্ণনা করা হয়েছে।
আর্চডিউক এবং তার স্ত্রীর সাথে মোট চারটি গাড়ি রওনা দেয়। মূল যে পরিকল্পনা ছিল সে অনুযায়ীই প্রথমে সব চলছিলো। প্রচুর জনগণের ভিড়ের মধ্যে গাড়িগুলো খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছিলো। ফ্রাঞ্জ জোসেফ নামক একটি সড়কের প্রবেশপথে এসে গাড়িটি আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী পথের দিকে মোড় নেয় এবং এগোতে থাকে। সেই গাড়ির ভেতরে রাজ্যের অতিথিদের দিকে মুখ করে বসে ছিলেন গভর্নর নিজে।
গাড়ি সেই পথে এগিয়ে যেতে থাকলে তিনি গাড়ির চালক, যাকে শৌফার (Chauffeur) বলে, তাকে বলেন যে, সে ভুল পথে যাচ্ছে। আগে হাসপাতালে যেতে হবে। তখন শৌফার গাড়িটির গতি ধীর করে রাস্তার ডান পাশের ফুটপাথের কাছাকাছি চলে আসে। ঠিক তখনই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক মাত্র তিন গজ দূর থেকে দুটি গুলি করে। গাড়িতে থাকা আর্চডিউকের গ্রীবার ধমনীতে গিয়ে একটি গুলি বিদ্ধ হয়ে ঢুকে যায় এবং ডিউক-পত্নীর উদরের ভেতর আরেকটি গুলি বিদ্ধ হয়। সেখানেই তারা দুজন মারা যান।
এই খুনটি যে করে সেই আততায়ীর নাম গেব্রিল প্রিন্সিপ, ১৯ বছর বয়সী এক তরুণ। শুনানির সময় সে বলে, সে দুবার ফার্দিনান্দকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলি করার পর সে নিজে আত্মহত্যা করার জন্য হাত তুললে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে ধরে ফেলে এবং মারধর করে। সেখান থেকে তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। প্রিন্সিপ শেষে এটাও বলে যে, সে কোনো আসামী নয় এবং সে কোনো ভুল করেনি। সে একজন খারাপ মানুষকে মেরে ফেলেছে এবং তার কাছে মনে হয়েছে এটাই সঠিক। এরপরে জেলে নিয়ে যাওয়ার পরে সে অনেকবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু সফল হয়নি। আবার তার বয়সের কথা চিন্তা করে তাকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়া যাচ্ছিলো না। পরবর্তীতে অপুষ্টিতে ভুগে এবং যক্ষ্মাতে আক্রান্ত হয়ে সে মারা যায়।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ছয় সপ্তাহ পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই ঘটনার পরেই ইউরোপের কিছু দেশের জন্য পুরো বিশ্ব প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দেখা পায়। সেসময় ইউরোপের কেন্দ্রীয় শক্তিধর দেশ ছিল জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইটালি। এবং আঁতাত বা বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ ছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং রাশিয়া। তিনটি করে শক্তিধর দেশগুলো দুটি গ্রুপে বিভক্ত ছিল। দুই গ্রুপের মধ্যে একে অন্যের সাথে শত্রুতা ছিল। নিজেদের শক্তি দেখানোর জন্য তারা নিজেদের দেশে অস্ত্র বৃদ্ধি করে যাচ্ছিলো।
এরকম শত্রুভাবাপন্ন অবস্থায় যখন আগুনে ঘি ঢালার মতো আর্চডিউক এবং তার স্ত্রীকে বসনিয়াতে হত্যা করা হলো, তখন যুদ্ধ শুরু হওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই ঘটনার পরে জার্মানরা বলে, যদি যুদ্ধ হয় তাহলে তারা অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে সহায়তা দেবে এবং তাদের পক্ষে থাকবে।
জার্মানদের এই ঘোষণার পর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সুযোগ আসে সার্বিয়াকে একটি চরমপত্র দেয়ার। কারণ গেব্রিল প্রিন্সিপ, যে কিনা আর্চডিউককে হত্যা করেছিলো, সে নিজে ছিল একজন সার্ব এবং Black Hand Organisation এর সদস্য। অস্ট্রিয়ার এই চরমপত্র ছিল যে, সার্বিয়াকে অস্ট্রিয়ার অধীনে থাকতে হবে। আর যদি এই শর্ত মেনে না নেয়া হয় তাহলে তারা সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। সার্বিয়া সব শর্ত মেনেও নেয়, শুধু একটি বাদে। এসময় রাশিয়া সার্বিয়ার দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় এবং যুদ্ধের জন্য সমবেত হওয়ার ও প্রস্তুতি নেয়ার ঘোষণা দেয়। এরপর অস্ট্রিয়া ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়।
রাশিয়ার এরকম সমবেত হওয়াটা জার্মানদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদের পরিকল্পনা ছিলো বেলজিয়ামকে দিয়ে ফ্রান্স আক্রমণ করা। যা-ই হোক, আগস্টের ১ তারিখে জার্মানরা রাশিয়ার বিপক্ষে এবং ৩ তারিখে ফ্রান্সের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মান বাহিনী যখন বেলজিয়ামে প্রবেশ করে তখন ব্রিটেনরা রুখে দাঁড়ায়। বেলজিয়ামকে রক্ষা করার একটি চুক্তি হয়েছিলো ১৮৩৯ সালে। সেই চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন বেলজিয়ামকে রক্ষা করবে। সেজন্য ১৯১৪ সালের আগস্টের ৪ তারিখ ব্রিটেন পুরো শক্তির বিপক্ষে অর্থাৎ জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি এবং ইটালির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আসলে ঐ মাসের ৩ তারিখে যখন জার্মানরা বেলজিয়াম আক্রমণ করে, তখনই যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এরপরে মিত্র বাহিনীর কেউ আর চুপ থাকতে পারেনি।
আর্চডিউক ফার্দিনান্দ এবং তার স্ত্রীর উপর হামলার সূত্র ধরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। হয়তো পরে যুদ্ধটি হতো, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড যুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ এবং প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
তথ্যসূত্র
[১] Making History – World History from 1914 to the Present – Christopher Culpin.
[২] The World Crisis – Winston Churchill
ফিচার ইমেজ সোর্স: VELVET Life