বেশ কয়েক বছর আগে ড্যানি বয়েলের একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিলো, যা ৬টি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড নমিনেশনও জিতে নেয়। চলচ্চিত্রটি হলো ‘127 Hours’.
নামটি পাঠকদের নিকট পরিচিত হবার কথা, চলচ্চিত্রটি দেখে থাকলে এতক্ষণে নিশ্চয় বলে উঠেছেন, ‘আহা! দারুণ ছবি ছিলো!’ প্রশংসা করার মতোই ছিলো ছবিটা, খুব সুন্দর দৃশ্যায়নের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে একটি মানুষের চরম সিদ্ধান্তহীনতার এক গল্পকে। পুরো চলচ্চিত্রটি একটি স্থানে আটকে থাকা একজন মানুষের দুর্দশা আর স্মৃতিগুলোকে ঘিরে নির্মিত। অ্যারন নামের এক তরুণ হিল হাইকিং এ যায়, এক পর্যায়ে পাহাড়ের সংকীর্ণ একস্থানে আটকে যায় তার হাত। জনমানবহীন এই দুর্গম স্থানে সাহায্যের জন্যে আপ্রাণ চিৎকার করেও কোনো সাহায্য খুঁজে পায় না অ্যারন। হাতও ছুটিয়ে আনতে পারে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, দিন গড়িয়ে রাত হয়, ক্ষুধা-তৃষ্ণা সবকিছুতে কাবু হয়ে যেতে শুরু করে সে। যখন বুঝতে পারে, এখান থেকে বের হওয়া সম্ভব নয়, আটকে থাকা মানে নিশ্চিত মৃত্যু, সেই মুহূর্তটি আসে তখনই, কঠিন এক সিদ্ধান্ত নেবার পালা। বেঁচে ফিরতে হলে তাকে অবশ্যই সেটি করতে হবে। পকেট থেকে ছুরি বের করে সে, হাতটা কেটে ফেলা ছাড়া বাঁচার আর কোনো উপায় ছিল না সে মুহূর্তে।
কঠিন এই কাজটি অ্যারন সম্পন্ন করে তারই অপর হাত দিয়ে। প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যেই সে সফল হয়, কাটা হাত কোনোরকমে ধরে নিয়ে ফিরে আসে লোকালয়ে। এই হলো অ্যারনের গল্প, ১২৭ ঘণ্টায় যেন বদলে যাওয়া নতুন এক অ্যারনের জন্ম হয়।
এ তো গেল সিনেমার কথা, বাস্তবের তেমনি একজন অ্যারনের নাম হলো লিউনাইড রোগোজোভ। তিনি ছিলেন একজন সার্জন, নিজ জীবন বাঁচাতে নিজের হাতেই তুলে নিতে হয়েছিলো স্কালপেল (অপারেশনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত ব্লেড)। একটি ব্লেড দিয়ে নিজের হাতে সামান্য কাটার মতো করে দেখুন, সাহস জড়ো করে উঠতে অক্ষম হয়ে পড়বেন আপনি। এসব মুহূর্তে সাহস ঠিকমতো জড়ো করা যায় না, সেই হিসেবে বলা যায়, নিজের শরীরে রীতিমত স্কালপেল ব্যবহার করে অপারেশন করাটা নিঃসন্দেহে অনেক কঠিন একটি কাজ। ইতিহাসে এমন বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে। অ্যান্টার্কটিকার বরফের মাঝে আটকা পড়া এক মহিলা, নাম হলো জেরি নিলসন, তার কোনো মেডিক্যাল জ্ঞান ছিলো না। তবু তিনি কেবলমাত্র ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সাহায্যে নিজের ব্রেস্ট ক্যান্সারের বায়োপসি করেছিলেন। প্রতিকূল পরিবেশে আসলে সাহসের কথা চিন্তাও করতে হয় না, জীবন বাঁচানোর তাগিদ মানুষকে কোন পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে, এই গল্পগুলোই আমাদের কাছে সেটা তুলে ধরে।
আমাদের আলোচিত লিউনাইড রোগোজোভও আটকে পড়েছিলেন এই অ্যান্টার্কটিকাতেই। অসম্ভব ঠাণ্ডা এক পরিবেশ, যা কল্পনারও অতীত। দক্ষিণ মেরুতে সূর্যের আলো পৌঁছায় আর কতটুকু, ভূগোল যারা ভালো বোঝেন, তাদের জানার কথা। দুই মেরুতে সূর্যের আলোর অভাবে তাপমাত্রা চলে যায় শূন্যেরও নিচে। শূন্য ডিগ্রী তাপমাত্রাতেই কিন্তু পানি বরফ হতে শুরু করে। এমন এক পরিবেশে আটকে থেকে নিজের শরীরে নিজ হাতে অপারেশনের সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কোনো রাস্তা ছিলো না রোগোজোভের।
প্রথমেই একজন সার্জন কীভাবে শেষ পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকাতে এসে আটকে গেলেন, সেই গল্পটি বলা যাক। রোগোজোভ ইসোফেগাল ক্যান্সার নিরাময়ের নতুন এক পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছিলেন। কাজ শেষ করলেন তিনি, নতুন পদ্ধতি, এবার স্বীকৃতি পাবার পালা, চিকিৎসক বোর্ডের সকল চিকিৎসকের কাছে প্রস্তাব রেখে সেই বোর্ড সম্মতি প্রকাশ করলেই কেবল সেই পদ্ধতি অনুমোদন পাবে।
দিন ধার্য করা হলো সেই সম্মেলনের। এর কিছুদিন আগেই হঠাৎ করে রোগোজোভের মনে ঘুরপাক খেতে শুরু করে দিলো অন্যকিছু। এসব আর তার কাছে ভালো লাগছে না। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, সোভিয়েত-অ্যান্টার্কটিকা অভিযানে যোগ দিবেন, কোনো এক দলের হয়ে দক্ষিণ মেরুতে বিশালাকার ট্রাক্টর চালাবেন। যেমন ভাবা তেমনই কাজ, ষষ্ঠ সোভিয়েত-অ্যান্টার্কটিকা এক্সপিডিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে অ্যান্টার্কটিকাতে একটি পোলার বেইজ নির্মাণের, এসবই ১৯৬০ সালের শেষদিকের গল্প। রোগোজোভ এই দলে যোগ দিলেন। তার ঘাড়ে দায়িত্ব পড়লো তিনগুণ ডিউটির। যেহেতু তিনি একজন সার্জন, দলে একজন চিকিৎসককে যেতেই হতো, সেটা তার দায়িত্বেই পড়লো। সেই সাথে সহকারী আবহাওয়াবিদ আর ট্রাক্টর চালানোর দায়িত্বও কপালে জুটে গেলো তার। ৩৬ দিন বিশাল সমুদ্রে কাটিয়ে রোগোজোভ সহ বারো জনের এই দল পৌঁছে গেলো অ্যান্টার্কটিকাতে, উদ্দেশ্য হলো রাশিয়ান বেইজ নির্মাণ।
সবকিছুই বেশ ভালোভাবে চলছিলো, রোগোজোভেরও মনে আনন্দের সীমা ছিলো না। আনন্দ শেষ হয়ে গেলো ১৯৬১ সালের ২৯ এপ্রিলের রাতে। রোগোজোভ আবিস্কার করলেন তার প্রচণ্ড পেট ব্যথা। স্পাইনাল কর্ডের বিভিন্ন অংশ রয়েছে, দশম থোরাসিক অংশটি অ্যাপেন্ডিক্স ও নাভীতে একসাথে স্নায়বিক সমন্বয় রক্ষা করে থাকে। যদি অ্যাপেন্ডিক্সে কোনো সমস্যা হয়, তাহলে ব্যথাটা অ্যাপেন্ডিক্সের সাথে নাভীতে অর্থাৎ পেটে অনুভব করবো আমরা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে রেফার্ড পেইন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
২৯ এপ্রিলের রাতে হঠাৎ করেই পেট ব্যথা শুরু হলো রোগোজোভের, তিনি লক্ষণ দেখেই বুঝে গেলেন এই ব্যাথা অ্যাপেন্ডিসাইটিসের। মাইনাস ৯৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রোগোজোভের পুরো দল আটকে পড়ে আছে জনমানবহীন শূন্য এক জায়গাতে। দলটি ফিরতে পারছে না, কোনো সাহায্যও আসা সম্ভব না বছরের এই সময়টাতে। দলে আর কোনো চিকিৎসাজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ নেই।
এমন প্রচণ্ড ব্যথা, আশেপাশে কোনো চিকিৎসক নেই, কোনো অপারেশন ব্যবস্থাপনা নেই, যদি অ্যাপেন্ডিক্স কেটে বের করা না হয়, রোগোজোভের জীবনও বাঁচানো সম্ভব নয়। সবকিছুই যেন রোগোজোভের প্রতিকূলে চলে আসে। রোগোজোভ আর ভেবে পান না তার এই মুহূর্তে কী করা উচিৎ।
মনকে শক্ত করে বাঁচার তাগিদেই রোগোজোভ নিয়ে ফেললেন কঠিন এক সিদ্ধান্ত, বাঁচতে তাকে হবেই। এমন কিছু নয় যে, অ্যাপেন্ডেকটোমি খুব কঠিন এক সার্জারি। শরীরের ম্যাকবার্নি পয়েন্টে ত্বক কেটে মাংসপেশি সরালেই পাওয়া যাবে অ্যাপেন্ডিক্স, অপারেশন টেবিলে খুবই সামান্য এক অপারেশন। কিন্তু রোগোজোভ যেমন পরিস্থিতিতে ছিলেন, নিজের শরীর নিজে কেটে অপারেশন করা, অজ্ঞান করারও অবস্থা নাই, অজ্ঞান করে ফেললে আর যা-ই হোক, অপারেশন হবে না।
কিন্তু রোগোজোভ তো রোগোজোভই, মনকে এতটাই শক্ত করেছেন, এসব ব্যাপারে তোয়াক্কাই করলেন না আর।
তার সহকর্মীদেরকে অনুরোধ করলেন একটি রুমকে যতটুকু সম্ভব জীবাণুমুক্ত করে আলোর ব্যবস্থা করতে। দলের তিনজনকে বেছে নিলেন অপারেশনের মুহূর্তে তাকে এটা ওটা এগিয়ে দেয়ার জন্য। যেহেতু তাদের কোনো সার্জারির অভিজ্ঞতা ছিলো না আগে কখনো, এসব কাটাকুটিতে তাদের অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার ভয়ও ছিলো রোগোজোভের মনে।
রোগোজোভ তাদেরকে বেশ ভালোভাবে কী কী করতে হবে তা বুঝিয়ে বললেন। এছাড়া এটাও বলে দিলেন, যদি তিনি অপারেশনের মাঝপথে অজ্ঞান হয়ে যান, তাহলে কীভাবে অ্যাড্রেনালিন পুশ করে জাগাতে হবে তাকে, কীভাবে বাইরে থেকে তার মুখে বাতাসের প্রবাহ সচল করতে হবে। প্রতিটি সেকেন্ড সুন্দর করে ম্যাপিং করে নিয়েছিলেন রোগোজোভ। কী কী ধরনের প্রতিকূলতা সৃষ্টি হতে সেই ব্যাপারেও ভাবলেন তিনি, সেসবের জন্যও সাবধানতা বজায় রাখলেন।
যথাসময়ে অপারেশনের উদ্দেশ্যে রোগোজোভ শুয়ে পড়লেন বিছানায়, পাশে তিন সহকারী। তিনি তার প্রিয় স্কালপেলটিকে তুলে নিলেন ম্যাকবার্নি পয়েন্টে কাটার উদ্দেশ্যে। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো রোগোজোভ কাজ করলেন নিজের বিপন্ন জীবন বাঁচিয়ে তোলার কাজে, একটুও ভুল হওয়া যাবে না। কত মানুষের অপারেশন করেছেন তিনি, এবার নিজের শরীর। ঠিকমতো দেখার সুযোগও পাচ্ছিলেন না কী করছেন নিজ শরীরের সাথে; ত্বক কাটা হলো, ভেতরের সবকিছু দেখতে হলে উঠে বসতে হবে। এক সহকারীকে বললেন, উপর থেকে একটি আয়না ধরতে, সেই আয়নাতে আবছা আবছা বুঝে নিয়ে পুরোটাই অনুমান আর স্পর্শের মাধ্যমে চালিয়ে গেলেন পুরো অপারেশন!
হাত দিয়ে স্পর্শ করে যাতে বুঝতে পারেন কী ধরছেন তিনি, এই উদ্দেশ্যে কোনো গ্লাভস ছাড়াই অপারেশন করেছিলেন রোগোজোভ। আয়নাতে সবকিছুই উল্টো দেখাচ্ছিলো, তাই অতি সাবধানে ভেবে ভেবে কাজ করছিলেন রোগোজোভ। প্রতি পাঁচ-দশ মিনিট কাজ করেই তিনি কিছুক্ষণ ভাবছিলেন, সাহস সঞ্চয় করছিলেন, তবু বাঁচতে হবে তাকে, হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।
একটু ভুল হলেই রোগোজোভের মৃত্যু হতে পারতো, কিংবা রোগোজোভ যদি অজ্ঞান হয়ে যেতেন কোনো কারণে, তাহলে সব সেখানেই শেষ হতে পারতো। এসব কিছু মাথাতে রেখেই ধীরে সুস্থে অপারেশন সম্পন্ন করতে হয়েছে তাকে।
অপারেশন শেষে দু’সপ্তাহের মতো বিশ্রাম নিয়ে আবারও কাজে ফিরে আসেন রোগোজোভ, একদম সুস্থভাবে। দলের চিকিৎসক হিসেবে বাকি সময় নতুন উদ্যমে কাজ করে গেছেন তিনি। আবহাওয়া ঠিক হবার পর তিনি চাইলেই রাশিয়াতে ফিরে আসতে পারতেন ইনজুরির কথা বলে, কিন্তু তিনি সেটাও করেননি। মিশন শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত দলের সাথেই ছিলেন। পুরো এক বছর পর দলের সাথে ফিরে আসেন দেশে। দেশে ফিরে তার গবেষণালব্ধ ইসোফেগাল ক্যান্সার নিরাময়ে নতুন পদ্ধতি নিয়ে আবারো কাজ শুরু করেন। জীবনের বাকি সময়টুকু তিনি সেইন্ট পিটার্সবার্গে জেনারেল সার্জারির একজন প্রফেসর হিসেবে কাজ করে যান।