ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সিপাহী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যে ক’জন মানুষের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে অন্যতম একজন আজিমুল্লাহ খাঁন। উপমহাদেশের ইতিহাসে তিনি একজন একজন সুদর্শন, চৌকস ও শিক্ষিত বিদ্রোহী নেতা হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত হলেও ইংরেজ ঐতিহাসিকগণের একটি বড় অংশ তাকে চিহ্নিত করেছেন ধূরন্ধর ও বেঈমান রুপে। মারাঠা নেতা নানা সাহেবকে বিদ্রোহে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনিই। আসুন তবে জেনে আসা যাক আজিমুল্লাহ খাঁন সম্পর্কে।
কে এই আজিমুল্লাহ খাঁন?
দূর থেকে এসে ফিরিঙ্গিরা, মন্তর দেখিয়ে তল্লাটে,
লুটছে তারা প্রিয় জন্মভূমি আমাদের, দুই হাতে।
আজ শহীদেরা আমাদের পুরো জাতিকে ডাকছে,
ভাঙ্গো গোলামির শিকল, আগুন জ্বালো আংগারে,
হিন্দু, মুসলিম, শিখ প্রিয় সকল ভাইয়েরা,
সবাইকে আজাদির সালাম।
উপরের কবিতাটি আজিমুল্লাহ খাঁনের লেখা ‘আযাদীর কবিতা’ নামক কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন। আজিমুল্লাহ খাঁনের পুরো নাম আজিমুল্লাহ খাঁন ইউসুফজাই। তিনি ক্রান্তিদূত আজিমুল্লাহ খাঁন কিংবা দেওয়ান আজিমুল্লাহ খাঁন নামেও পরিচিত। তিনি ছিলেন মারাঠা পেশোয়া (ছত্রপতি বা রাজার অধীন প্রধানমন্ত্রী) দ্বিতীয় নানা সাহেবের সেক্রেটারি ও পরে প্রধানমন্ত্রী বা দেওয়ান। এই দ্বিতীয় নানা সাহেব হচ্ছেন দ্বিতীয় বাজি রাওয়ের দত্তক নেওয়া সন্তান। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনিই ছিলেন মারাঠাদের পেশোয়া। দ্বিতীয় নানা সাহেবের অন্য নাম হচ্ছে ধন্দু পান্তে। বিভ্রান্তি এড়াতে বলে রাখা ভালো, মারাঠা পেশোয়া প্রথম বাজী রাওয়ের ছেলে বালাজী বাজী রাও-ও ‘নানা সাহেব’ নামেও পরিচিত।
আজিমুল্লাহ খাঁনের উত্থান
আজিমুল্লাহ খাঁন ১৮৩৭ সালের দিকে দুর্ভিক্ষপীড়িত হয়ে ভারতের কানপুরে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বড় হন। তিনি সেখানে ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজী ভাষায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। তিনি বেশ কয়েকজন ইংরেজ কর্মকর্তার সাথে কাজ করার পর নিয়োগ পান ব্রিগেডিয়ার জন স্কটের অনুবাদক হিসেবে। ১৮৫১ সালে দ্বিতীয় পেশোয়া বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পর তিনি তার দত্তক পুত্র নানা সাহেবের কোর্টে সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন।
বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পর নানা সাহেবের সাথে তখন ইংরেজদের বিবাদ চলছিল। কারন নির্বাসিত মারাঠা পেশোয়া বাজি রাওকে ইংরেজরা একটি নির্দিষ্ট ভাতা প্রদান করত। কিন্তু বাজি রাওয়ের মৃত্যুর পর তার দত্তক পুত্র নানা সাহেব তার উত্তরাধিকারী মনোনীত হলে তারা সেই অর্থ প্রদান বন্ধ করে দেয়। যুক্তি হিসেবে তারা দাঁড় করায় যে, উত্তরাধিকারী হলেও নানা সাহেব বাজি রাওয়ের রক্তের সম্পর্কের কেউ নন। মূলত ১৮৫০ সালের দিকে কোম্পানির মুনাফা কম হওয়ায় তারা তাদের খরচ কমানোর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। তারই অংশ হিসেবে নানা সাহেবকে তারা ভাতা না দেওয়ার মোক্ষম একটি যুক্তিও পেয়ে যায়।
সেসময় ভারতীয় উপমহাদেশের কোণঠাসা রাজাদের যেহেতু ইংরেজদের দয়ার নির্ভর করা ছাড়া উপায় ছিল না। তাই এমন বিষয়ে তারা কোম্পানির ‘কোর্ট অব ডিরেক্টরসদের’ সভায় আপিল করে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ের চেষ্টা করতেন। নানা সাহেব তার মাসোহারা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে নেওয়ার জন্য তার দেওয়ান আজিমুল্লাহ খাঁনকে ইংল্যান্ড পাঠান। আজিমুল্লাহ খাঁনের এই ইংল্যান্ড যাত্রা ‘মারাঠা মিশন’ হিসেবে পরিচিত।
মারাঠা মিশন
১৮৫৩ সালে তিনি নানা সাহেবের পক্ষে ইংল্যান্ড গমন করেন। উদ্দেশ্য নানা সাহেবের সাথে নানা অন্যায়ের ফিরিস্তি তুলে ধরে তার একটা বিহীত করা, এবং প্রধানত নানা সাহেবের বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাতা পূণর্বহালের চেষ্টা করা। তার ইংল্যান্ড গমন একটি আলোচিত ঘটনা ছিল। চার্লস ডিকেন্স, কার্লাইল, মেরিডিথ, টেনিসন, ব্রাউনিং, থ্যাকারি প্রমুখ লেখকদের সাথেও তার সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে যে কাজের জন্য আজিমুল্লাহ খাঁন লন্ডনে গিয়েছিলেন, বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করে, এবং বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে বুঝতে পারলেন ইংরেজদের কাছে কাছে ধর্ণা দিয়ে কোনো লাভ নেই। সেই সাথে ইংল্যান্ডের নানা বিষয় স্বচক্ষে অবলোকন করে চরম ব্যথিত হন তিনি। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে ১৮৫৫ সালে হতাশ আজিমুল্লাহ খাঁন লন্ডন থেকে বিদায় নেন। তবে সরাসরি ভারতে এলেন না তিনি। বেড়িয়ে পড়লেন ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়ানোর রাস্তা খুঁজতে।
বিদ্রোহের দূত
ঘটনাচক্রে আজিমুল্লাহ খাঁন জানলেন, রুশ সৈন্যদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে ব্রিটিশ-ফরাসি মিলিত বাহিনী। দেরি না করে ইংরেজদের ব্যর্থতা অনুসন্ধানে তিনি সোজা চলে গেলেন কনস্টান্টিনোপোল। তখন কনস্টান্টিনোপোল উসমানীয় সাম্যাজ্যের অধীনে। তিনি সেখানে কিছুকাল অবস্থান করে, সেখান থেকে পরে তিনি ক্রিমিয়ান যুদ্ধক্ষেত্রেও পৌঁছান। এসময় তার সাথে ছিলেন টাইম ম্যাগাজিনের বিখ্যাত সাংবাদিক উইলিয়াম রাসেল।
নিরাপদ দূরত্বে থেকে যুদ্ধ অবলোকন করার পাশাপাশি এসব যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজদের ব্যর্থতা নিজ চোখে অবলোকন করে বিদ্রোহের মাধ্যমে ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা শাণিত করেন। সেই সাথে বিদ্রোহের বিষয়ে তিনি সেখানে রুশ ও তুর্কি গোয়েন্দাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করেন। তিনি আসার পথে একটি ফরাসি প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে আসেন এবং তা ব্যবহার করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান।
সিপাহী বিদ্রোহ, নানা সাহেব ও আজিমুল্লাহ খাঁন
কানপুরে সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন নানা সাহেব। প্রথমে কোষাগার দখলে নিয়ে তিনি গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোডের নিয়ন্ত্রণ নেন। অতঃপর তিনি কানপুর দখলে নেওয়ার জন্য বের হন। পথিমধ্যে বিদ্রোহী সিপাহীদের একটি দলের সাথে তার দেখা হয় যাদের গন্তব্য ছিল দিল্লিতে সম্রাট বাহাদুর শাহর নিকট। নানা সাহেব তাদের সাথে বাহাদুর শাহর নিকট যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও আজিমুল্লাহ খান পরামর্শ দেন, সম্রাটের কাছে যাওয়ার চেয়ে কানপুর দখলে নিয়ে নেতৃত্ব দেওয়াটাই তার জন্য বেশি সম্মানের হবে।
নানা সাহেব সেই সিপাহীদেরকেও প্রস্তাব দেন তার সাথে কানপুর দখলে অংশ নেওয়ার জন্য। প্রথমে তারা রাজি না হলেও দ্বিগুন ভাতা দেওয়ার শর্তে তারা রাজি হয়ে তার সাথে অভিযানে অংশ নেয়। ৫ জুন নানা সাহেব কানপুর অবরোধ করেন। তবে নানা কারণে সুশৃঙ্খল আক্রমণ চালাতে পারেননি। কিন্তু ২৩ জুন ১৮৫৭ সালে পলাশী ট্রাজেডির শতবর্ষ পূর্ণ হয়। শততম বছরে ইংরেজ শাসনের পতন ঘটবে এই বিশ্বাস তখন চারদিকে বেশ প্রভাব ফেলেছিল। সম্ভবত সে কারণেই এবার সিপাহীরা নতুন উদ্যমে আক্রমণ চালায় এবং কানপুরে ইংরেজ অবস্থানের পতন ঘটে। কিন্তু সিপাহীরা বিদ্রোহী হলেও সুশৃঙ্খল বাহিনী বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু গড়ে তুলতে পারেননি নানা সাহেব, আজিমুল্লাহ খাঁন, তাতিয়া তোপে প্রমুখ বিদ্রোহী নেতারা। যার ফলে খুব সহসাই ইংরেজদের কাছ পরাজিত হন নানা সাহেব। ইংরেজ বাহিনী এসব এলাকায় নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতন চালিয়ে ভীতির সৃষ্টি করে।
আজিমুল্লাহ খাঁনদের হারিয়ে যাওয়া
কানপুরে বিদ্রোহীদের নেতা নানা সাহেব, তাতিয়া তোপে, লক্ষী বাঈ, আজিমুদ্দিন খাঁন প্রমুখ বেড়ে উঠেছিলেন একই সাথে। তাদের পরিণতিও হয় প্রায় একই ধরনের। পরাজিত, বিধ্বস্ত। ধারণা করা হয়, নানা সাহেব পালিয়ে গিয়েছিলেন নেপালের রাজা জং বাহাদুর রানার আশ্রয়ে। তাতিয়া তোপে বারংবার চেষ্টা করেও শেষ হাসি হাসতে পারেননি। বন্ধু মানসিংহের বিশ্বাসঘাতকতায় ইংরেজদের বিচারে ফাঁসিতে জীবন দেন তিনি। আর লক্ষী বাঈ জীবন দেন যুদ্ধক্ষেত্রেই।
আজিমুল্লাহ খাঁনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল ঠিক জানা যায়না। বিদ্রোহ শুরুর পর থেকেই আজিমুল্লাহ খাঁন হারিয়ে যান ইতিহাসের পাতা থেকে। সম্ভবত তিনি বিদ্রোহে নিহত হয়েছিলেন অথবা বিদ্রোহের পর খুব সম্ভবত তাকে কোনো বিচার ছাড়াই হত্যা করা হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি বিদ্রোহের পর নেপালে আশ্রয় নিয়ে পরবর্তীতে মারা যান। তবে তার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক, একটি মহাবিদ্রোহের যে রুপরেখা তিনি এঁকেছিলেন তা সফল না হলেও ভারতীয় মহাদেশের ইতিহাসে এই বিদ্রোহের আবেদন মুক্তিকামী মানুষের মনে মুক্তির গান শুনিয়ে যাবে যাবে যুগ যুগ ধরে।
সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইটি: