১৯৪৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর জায়নবাদী ইহুদী সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি গুলি করে হত্যা করেছিল জেরুজালেমের ব্রিটিশ পুলিশের গোয়েন্দা কর্মকর্তা টম উইলকিনকে। লেহি তথা স্টার্ন গ্যাংয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং তাদের ঐ অপারেশনটি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম আমাদের এই সিরিজের পূর্ববর্তী লেখায়। ঐ হত্যাকান্ডের উদ্দেশ্য ছিল ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে ব্রিটিশদেরকে ফিলিস্তিন ত্যাগে বাধ্য করা এবং ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদীদের জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র ‘ইসরায়েল’ প্রতিষ্ঠা করা।
ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসবাদই যে সবচেয়ে কার্যকর পন্থা, এই উগ্র জায়নবাদী ধারণার প্রবর্তক অবশ্য লেহি না। ধারণাটি আরো পুরাতন হলেও কাকতালীয়ভাবে ফিলিস্তিনের বুকে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির লক্ষ্যে সর্বপ্রথম জায়নবাদী সংগঠনটির সৃষ্টি হয় উইলকিন হত্যাকাণ্ডের ঠিক ৩৭ বছর আগে, ১৯০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৯ তারিখে। সেদিন ইৎজাক বেন জাভি নামে এক রাশিয়া ফেরত ইহুদী সংগঠকের উদ্যোগে তার জাফ্ফা শহরের অ্যাপার্টমেন্টে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশ্বের প্রথম জায়নবাদী সংগঠন ‘বার গিওরা‘ (Bar-Giora)।
জায়নিজম (Zionism, צִיּוֹנוּת) বা জায়নবাদ শব্দটার উৎপত্তি হিব্রু ‘জায়ন’ (צִיּוֹן) শব্দটি থেকে। জায়ন মূলত জেরুজালেমে অবস্থিত একটি পর্বতের (আরবিতে সাহইউন পর্বত) নাম, কিন্তু বৃহত্তর অর্থে এটি ইহুদীদের কাছে সমগ্র জেরুজালেম এবং সর্বোপরি সমগ্র ইসরায়েলকেই প্রতিনিধিত্ব করে। জায়নবাদ হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত ইহুদী ধর্মাবলম্বীদেরকে একত্রিত করে ফিলিস্তিনের বুকে তাদের জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনের নাম। আর যারা এই জায়নবাদের অনুসারী, তারাই জায়নিস্ট বা জায়নবাদী (আরবিতে সাহইউনি)।
বিভিন্ন সময় অনেকেই ইহুদীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ধারণা হিসেবে জায়নবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিতি লাভ করে ১৮৯৬ সালে, যখন অস্ট্রিয়ান ইহুদী সাংবাদিক থিওডোর হার্জেল তার ‘ডের জুডেনস্টাট’ তথা ‘দ্য জিউইশ স্টেট‘ বইটি প্রকাশ করেন। এই বইয়ে তিনি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপে জাতীয়তাবাদের ধারণা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল। ইহুদীদেরকে অনেক দেশেই ভিন্ন একটি জাতি হিসেবে দেখা হতো। ফলে সে সময় সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ইহুদীরা বৈষম্য এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল এবং অনেক ইহুদী পরিবার দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছিল। তাদের অনেকেই গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল ফিলিস্তিনে, যা ছিল মুসলমান ও খ্রিস্টানদের পাশাপাশি ইহুদীদেরও আদি বাসভূমি এবং ধর্মীয় দিক থেকে পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
সে সময় ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের একটি অংশ। দীর্ঘ ছয় শতাব্দী অত্যন্ত গৌরবের সাথে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিশাল অংশ শাসন করার পর উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে অটোমান সাম্রাজ্য ক্রমে দুর্বল হয়ে আসছিল। ক্ষয়িষ্ণু অটোমান সাম্রাজ্য তখন বিভিন্ন সীমান্তে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঠেকাতেই এত বেশি ব্যস্ত ছিল যে, দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে ইহুদীরা এসে জেরুজালেমসহ আশেপাশের এলাকাগুলোতে স্থানীয় আরবদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে শক্তিশালী জনবসতি গড়ে তুলছিল, সেদিকে নজর দেওয়ার মতো সময়ই তাদের ছিল না।
ঠিক এ সময় থিওডোর হার্জেল তার বইয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ধারণা দেন, ইউরোপ জুড়ে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যে নির্যাতন চলছে, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে শুধুমাত্র ইহুদীদের জন্য একটি জাতিরাষ্ট্র গঠন করা, যেখানে ইহুদীদেরকে অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী বা অন্য কোনো জাতির উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতে হবে না। ভবিষ্যত ইহুদী রাষ্ট্র হিসেবে হার্জেল তার বইয়ে ফিলিস্তিনের নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে, ভবিষ্যত ইসরায়েল রাষ্ট্রটা যেন টিকে থাকতে পারে, সেজন্য তা প্রতিষ্ঠা করতে হবে কূটনীতির মাধ্যমে, আলোচনা এবং আন্তর্জাতিক সমর্থনের ভিত্তিতে। হার্জেলের এ ধারণাটি পরিচিত ছিল পলিটিক্যাল জায়নিজম বা রাজনৈতিক জায়নবাদ নামে।
কিন্তু সবার চিন্তাধারা হার্জেলের মতো ছিল না। পশ্চিম ইউরোপের সম্পদশালী এবং প্রতিষ্ঠিত ইহুদীরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের অবস্থান নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল, ফলে নতুন একটি রাষ্ট্র গঠনের ধারণা তাদের অনেককেই আকৃষ্ট করতে পারেনি। আবার অটোমান সাম্রাজ্যের স্থায়ী ইহুদী অধিবাসীরা, যারা শত শত বছর ধরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করছিল, তারাও নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে স্থানীয় আরবদের সাথে সংঘর্ষে যেতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু হার্জেলের প্রস্তাবটি রীতিমতো লুফে নেয় পূর্ব ইউরোপের দরিদ্র শ্রেণীর ইহুদীরা, যারা ছিল সুবিধাবঞ্চিত, নিপীড়িত এবং দেশত্যাগে বাধ্য।
আগে থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে ইহুদীরা ফিলিস্তিনে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে শুরু করেছিল, হার্জেলের ইহুদী রাষ্ট্রের ধারণার পর তাদের অভিবাসনের হার আরো বৃদ্ধি পায়। এই বহিরাগত ইহুদীদের একটি অংশ ছিল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই বল প্রয়োগের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদী রাষ্ট্র সৃষ্টি করে নেওয়ার পক্ষপাতী। রাজনৈতিক জায়নবাদীদের চেয়ে অনেক উগ্র এ মতাদর্শে বিশ্বাসীদেরকে বলা হতো প্র্যাক্টিক্যাল জায়নিস্ট বা বাস্তববাদী জায়নবাদী। এদেরই একজন ছিলেন ইৎজাক বেন জাভি।
বেন জাভি ছিলেন একজন রাশিয়ান ইহুদী। তার বাবার নাম ছিল জাভি শিমশি, যিনি ১৮৯৭ সালে থিওডর হার্জেলের সাথে মিলে বিশ্বের প্রথম জায়নিস্ট কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জায়নিস্ট আন্দোলনের জন্য তার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর, ১৯৫২ সালে ইসরায়েলি আইনসভা নেসেট কর্তৃক জাভি শিমশিকে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাবার আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত বেন জাভি নিজেও ১৯০৫ সালে রাশিয়াতে (বর্তমান ইউক্রেইন) ইহুদীদের উপর চলাকালীন নির্যাতনের সময় ইহুদীদের রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত গুপ্ত সংগঠনগুলোর সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
১৯০৭ সালে বেন জাভি রাশিয়া ছেড়ে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ফিলিস্তিনে চলে আসেন এবং জাফ্ফা শহরে বসতি স্থাপন করেন। সে সময় ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে আসা ইহুদীদের একটি বিশাল অংশ ছিল রাশিয়ান। এদের অনেকেই ছিল জার শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা উগ্র বামপন্থী বিপ্লবী গেরিলা সংগঠনগুলোর সদস্য, যারা জার শাসনের বিরুদ্ধে গুপ্তহত্যা এবং সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল। রাশিয়ার বিপ্লবে আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এদের অনেকেই ফিলিস্তিনে পালিয়ে আসে এবং রাশিয়াতে ইহুদীদের উপর চলা নির্যাতন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গুপ্ত সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
বিশ্বের অন্য অনেক অঞ্চলের তুলনায় অটোমান সাম্রাজ্যে দীর্ঘকাল জুড়ে ইহুদীরা মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই বসবাস করছিল। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে অটোমানদের শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে আসতে থাকে এবং তাদের কর্মকর্তারাও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হতে থাকে। ইউরোপ থেকে আসা বিপুল সংখ্যক ইহুদী ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় বসতি স্থাপন করতে শুরু করলে জমির সীমানা, পানির অধিকার প্রভৃতি নিয়ে স্থানীয় আরবদের সাথে তাদের সংঘর্ষ বাঁধতে থাকে।
সে সময় ইহুদীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল স্থানীয় আরব প্রহরীদের হাতে। কিন্তু অনেক সময়ই আরবদের সাথে সংঘর্ষের সময় প্রহরীরা ইহুদীদেরকে রক্ষার পরিবর্তে আরবদেরকে সাহায্য করত। বেন জাভি সিদ্ধান্ত নিলেন, ইহুদীদের জন্য যদি পৃথক রাষ্ট্র তৈরি করতে হয়, তাহলে প্রথমেই তাদেরকে নিজেদের বসতিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, আরবদের সাথে সংঘর্ষের সময় নিজেদেরকে রক্ষা করার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে। আর সেজন্য তাদেরকে গঠন করতে একটি সশস্ত্র সংগঠনের, যার কাজ হবে ইহুদীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, ইহুদীদের হয়ে লড়াই করা, ইহুদীদের উপর কেউ আক্রমণ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেওয়া।
১৯০৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে জাফ্ফার রাস্তা ধরে এক এক করে বেন জাভির আসবাবপত্রবিহীন অতি সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টটিতে হাজির হন আরো সাত জায়নবাদী, যাদের প্রত্যেকে ছিলেন রাশিয়া থেকে আগত ইহুদী কৃষক-শ্রমিক। সেই রাতে বেন জাভিসহ এই আট জায়নবাদী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক বিশ্বের প্রথম ইহুদী গুপ্ত সশস্ত্র সংগঠন, বার গিওরা। এই বার গিওরার হাত ধরেই পরবর্তীকালে সৃষ্টি হয় হাশোমার এবং হাগানা, যা ছিল বর্তমান আইডিএফ তথা ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের মূল ভিত্তি। হাশোমার এবং হাগানার উপর আমরা আলোচনা করব এই সিরিজের পরবর্তী পর্বে।
বার গিওরা নামটি বাছাই করা হয়েছিল প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইহুদী বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী নেতা সিমন বার গিওরার নামানুসারে। তাদের ব্যানারটিও তৈরি করা হয়েছিল সেই বিদ্রোহের প্রতীককে স্মরণ করে। আর তাদের মূলমন্ত্র ছিল, “রক্ত এবং অগ্নির মধ্য দিয়ে জুডার (ইয়াহুদা, ইসরায়েল) পতন ঘটেছিল, রক্ত এবং অগ্নির মধ্য থেকেই জুডা (ইয়াহুদা, ইসরায়েল) উদিত হবে।”
তাদের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা ছিল না। বার গিওরা এবং তার পরবর্তী সংস্করণগুলোর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইসরায়েল। আর বার গিওরার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বেন জাভি হয়েছিলেন ইসরায়েলের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট।
তথ্যসূত্র: Rise and Kill First: The Secret History of Israel’s Targeted Assassinations
এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলো
(১) সন্ত্রাসী সংগঠন লেহি’র গুপ্তহত্যা, (৩) ইহুদীদের নৈশ প্রহরী হাশোমারের ইতিহাস
ফিচার ইমেজ: The Daily Beast