মাও সে তুং ওরফে চেয়ারম্যান মাও। চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও গৃহযুদ্ধের অবিস্মরণীয় নেতা। লড়েছেন জাতীয়তাবাদী কুয়োমিন্টাং ফৌজ, জাপান, চীনা ভূস্বামী এবং যুদ্ধবাজ নেতাদের সাথে। গড়েছেন সুবিশাল এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ফিরিয়ে দিয়েছেন চীনের লুণ্ঠিত মর্যাদা।
সময়টা হচ্ছে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ এবং ষাটের দশক। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম। বিশ্বে দুই শিবিরের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। এমন একটা সময়ে চীনের মতো একটা দেশের হাল ধরা অত্যন্ত কঠিন। মাও চাইতেন খুব দ্রুত চীনকে বিশ্বের দরবারে শক্তিশালী একটি দেশ হিসেবে উপস্থিত করতে। স্টালিন যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে তিরিশের দশকে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন তেমনই একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখতেন চেয়ারম্যান মাও। সেই স্বপ্ন সাকার করার প্রচেষ্টা হিসেবে চীনে শুরু হয় ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামের এক বিরাট আন্দোলন। কী হয়েছিল এর পরিণতি? দেখা যাক।
পটভূমি
পঞ্চাশের দশকে চীন মোটামুটি ভালোভাবেই কম্যুনিস্ট পার্টির হাতে চলে এসেছে। পার্টির শত্রুরা একরকম নিশ্চিহ্ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো প্রকাণ্ড শক্তি তখন বন্ধু। কাজেই চেয়ারম্যান মাও সুযোগ পেলেন কম্যুনিস্ট শাসন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার।
সোভিয়েতদের মত মাও সে তুং শুরুতেই বিরোধীদের উপর চড়াও হতে চাননি। ১৯৫৬ এর হান্ড্রেড ফ্লাওয়ার্স ক্যাম্পেইন এর সময়ে তিনি খোলাখুলিভাবে সমালোচনা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। পরে তাদের সুর চড়া হলে মাও সেসব বন্ধ করে দেন। অনেকটা এ সময়েই শুরু হয় অ্যান্টি রাইটিস্ট ক্যাম্পেইন’। দল ও দলের বাইরে বিরোধীদেরকে চুপ করিয়ে দেওয়া হয় এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে। ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে মাও যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে, তখন সোভিয়েত নেতা নিকিতা খ্রুশ্চেভ দম্ভোক্তি করেন যে ১৫ বছরের মধ্যে তার দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।
মাও সোভিয়েতদের রীতিনীতির ভক্ত ছিলেন। দেশে ফিরে তিনি ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামক এই নীতি ঘোষণা করেন। সেই সাথে আশাবাদ দেখান যে পনেরো বছরের মধ্যে চীন গ্রেট ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে যাবে।
মাওয়ের মতে, চীনের দ্রুত পরিবর্তনের পেছনে মূল সূত্রটা হচ্ছে জনগণের একটা বিরাট অংশকে ঢেলে সাজিয়ে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে চাষাবাদ করা। বাড়তি ফসল থেকে যে বিপুল আয় হবে, সেটা দিয়ে দেশে কলকারখানা বানানো, যাতে রাতারাতি উৎপাদন বেড়ে যায়। ঝৌ এন লাই থেকে শুরু করে অনেক নেতাই এরকম হঠকারী পরিকল্পনাকে সমর্থন করতেন না। অভিজ্ঞ পরিকল্পনাকারী আর প্রকৌশলীবিদেরা বললেন, এত দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব না। এই বিরোধিতায় মাও গেলেন ক্ষেপে। তিনি নেতাদেরকে দুষলেন, বিরোধীদের দুষলেন, পরিকল্পনার সাথে মিশিয়ে দিলেন রাজনীতি। ঘোষণা করলেন, যারাই গ্রেট লিপের বিরোধিতা করবে, তারা মাও এর প্রতি, সমাজতন্ত্রের প্রতি অনুগত নয়। ফলে চাটুকারের দলের হাতে চলে এলো নিয়ন্ত্রণ।
গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড
গ্রেট লিপের প্রথম প্রভাব পড়লো কৃষিখাতে। সমস্ত গ্রামগুলোকে প্রায় ২৩ হাজার বিরাট কমিউনের মধ্যে আনা হল। এগুলোতে কাজকর্ম সবই চলতো সামরিক কেতায়। থাকার জন্য আলাদা ব্যারাক ছিল। গ্রামবাসীদেরকে বিউগল বাজিয়ে সকালে ডেকে তোলা হতো। প্যারেড করতে করতে এই বিরাট কর্মীবাহিনী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মাঠে নামতো। বাচ্চাকাচ্চারা থাকতো ডে কেয়ার সেন্টারে। এই কমিউনগুলোতে খাওয়া দাওয়াও হতো বিশাল সব হলঘরে। ব্যক্তিগত বাসা বা জমি বলে আর কিছু রইলো না চীনে। সবই এই কমিউনগুলোর অধীনে চলে গেল। শীত-গ্রীষ্ম নির্বিশেষ মাসে ২৮ দিন কাজ করতে হতো এখানে। কাজ না করলে শাস্তি দেওয়া হতো, অপমান করা হতো, খাওয়া মিলতো না। কমিউনের ওপরে নজর রাখতে শহর থেকে এল বেতনভূক কর্মচারী আর রাজনৈতিক কমিশনারেরা।
চীনের সমাজে তখন সর্বত্র মাওপন্থীদের আনাগোনা। আনুগত্যই যেহেতু টিকে থাকার শেষ পন্থা, মানুষ তখন সেটাকেই আঁকড়ে ধরলো। প্রাদেশিক নেতারা বেইজিংয়ে গিয়ে বিরাট সম্ভাব্য উৎপাদনশীলতার স্বপ্ন দেখাতেন। তারপরে প্রদেশে ফিরে এসে কমিউনগুলোতে বলে পাঠাতেন, যেভাবেই হোক এত গম বা এত স্টিল উৎপাদন করতে হবে। কমিউনগুলো তাদের লোকেদেরকে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটিয়েও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারতো না। তারা তখন প্রাদেশিক নেতাদেরকে মিথ্যা রিপোর্ট পাঠাতো, বলতো দারুণ সাফল্য এসেছে। সেই মিথ্যা রিপোর্ট আবার যেত বেইজিং এ। মাও ভাবতেন দারুণ সাফল্য এসেছে।
কমিউনগুলো যা উৎপাদন করতো, তার একটা অংশ সরকারকে দিতে হতো। মিথ্যা রিপোর্ট পেয়ে মাও বাড়তি চাহিদা জানিয়ে পাঠাতেন। এই চাহিদা মিটিয়ে কমিউনগুলোতে খাওয়ার মতো কিছুই থাকতো না। প্রাথমিকভাবে কিছু অঞ্চলে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল বটে, কিন্তু সামগ্রিক চিত্রটা আসলে নেতিবাচকই ছিল। গ্রামাঞ্চলে জীবনযাত্রার মান কমতে লাগলো, সরকারের চাহিদা বাড়তে লাগলো, চলতে লাগলো মিথ্যা রিপোর্টের এই দুষ্টচক্র। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৫৮ সালে শস্য উৎপাদন হয়েছিল ২০০ মিলিয়ন টন। অথচ সরকারি রিপোর্টে বলা হয় ৩৭৫ মিলিয়ন টন শস্য উৎপাদিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার কাজেই শস্য রপ্তানি বাড়িয়ে দিল। রাতে কাজ করেও এই বিপুল ঘাটতি পোষানো যাচ্ছিল না।
কিছু কিছু আঞ্চলিক ও কেন্দ্রীয় নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তা মাঝে মধ্যে গ্রেট লিপের ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলতেন। কথা বলতেন মিথ্যা রিপোর্টের প্রসঙ্গেও। কিন্তু এই অপরাধের সাথে জড়িয়ে তো সকলেই ছিল। কাজেই অভিযোগ করা হলো, এসব বিরোধীতাকারীরা আসলে পুঁজিবাদী চিন্তাভাবনা লালন করে। নেমে এল নির্যাতনের খড়গ। ঝৌ এন লাই এর মতো দুঁদে নেতাকে পর্যন্ত সবার সামনে আত্মতিরস্কার করতে হয়েছিল গ্রেট লিপের বিরোধিতা করবার জন্য। অনেক কর্মকর্তা আবার বলতেন, কৃষকেরা নাকি বাড়তি শস্য লুকিয়ে রাখছে। লাল ফৌজ এসে ঘরদোর ভেঙে তুলকালাম চালাতো এই শস্যের খোঁজে, যেটি আসলে ছিলই না। দুর্ভিক্ষের আশংকা দেখা দিল সর্বত্র। চীন কিন্তু তবুও শস্য রপ্তানি করা থামালো না।
ওদিকে শিল্পখাতে শুরু হয়েছে আরেক রগড়। দেশে তখন হরদম নতুন কলকারখানা বসানো হচ্ছে। দিন-রাত কাজ করছে লোকেরা সেখানে। প্রকৌশলীরা বারবার সাবধান করতেন যে এভাবে চললে দামি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবে, দুর্ঘটনা ঘটবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! বাড়তি উৎপাদনের নেশায় পণ্যের মানকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এদিকে যন্ত্রপাতি অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে নষ্ট হয়ে যেতে থাকলো। ১৯৬২ সালের মধ্যে শিল্পখাতের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসে।
চার শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
গ্রেট লিপের সময়, ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত গোটা চীন জুড়ে এক উদ্ভট আন্দোলন শুরু হয়। মাও বললেন ইঁদুর, মশা, মাছি আর চড়ুই পাখি হচ্ছে মানুষের শত্রু। দেশময় লোকে এসব মেরে বেড়াতে লাগলো। মিলিটারি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই এই কাজে অংশ নিল। আপাতদৃষ্টিতে পরিচ্ছন্নতা অভিযানের মত লাগলেও চড়ুই পাখি হত্যার ফল কিন্তু হলো সুদূরপ্রসারী। চড়ুই পাখি অনেক ক্ষতিকর পোকামাকড় খায়। এখন সেগুলোতে সমস্ত ক্ষেত ছেয়ে গেল। পরে মাও চড়ুইয়ের বদলে ছারপোকাকে জনগণের শত্রু হিসেবে ঘোষণা দিলে ছোট্ট পাখিগুলো কোনোমতে রক্ষা পায়।
দুর্ভিক্ষ ও গ্রেট লিপের অবসান
মাও যে গ্রেট লিপের ফলে সৃষ্ট খাদ্যাভাব এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের কথা জানতেন না, তা নয়। পরিকল্পনায় ছোটখাট গলদের কথা তিনি স্বীকার করে নিতেন। কিন্তু গ্রেট লিপের কোনো মৌলিক সমালোচনা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তার একগুঁয়ে, জেদি স্বভাবের কারণেই এমনটা হতো। এছাড়া চেয়ারম্যান মাও আজীবন কাটিয়েছেন যুদ্ধ আর সংগ্রামের মধ্যে। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে বহু অসম্ভবকে সম্ভব করে তিনি চীনের ক্ষমতা পেয়েছেন। এ কারণেই দুঃসাহসিক আর প্রায় অসম্ভব হলেও গ্রেট লিপ অন্তত তার কাছে একটি যৌক্তিক পরিকল্পনা ছিল। একবার তো তিনি বলেই বসলেন, হাতের দশটা আঙ্গুলের মধ্যে নয়টা যদি গ্রেট লিপের সাফল্যের প্রতীক হয় তো দশ নম্বরটা হচ্ছে ব্যর্থতার প্রতীক। কাজেই এই সীমিত ব্যর্থতা মেনে নিতে হবে, কারণ সাফল্যের পরিমাণ ব্যাপক।
বাস্তবে কিন্তু সাফল্যের পরিমাণ মোটেও ব্যাপক ছিল না। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত চীনে মহা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ঘরে খাবার নেই, কমিউনগুলোতে উৎপাদিত ফসল কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যা বাকি থাকে, তাতে সকলের ক্ষুন্নিবৃত্তি সম্ভব নয়। মরতে লাগলো মানুষ। অহংকারী মাও রেড ক্রসের সাহায্যের আবেদন ফিরিয়ে দিলেন। কত মানুষ যে এই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল, তা আজ সঠিক করে বলা সম্ভব না। চীন সরকার পরবর্তী দুই দশক কোনো আদমশুমারী করেনি। পরবর্তী ১৯৮২ সালের আদমশুমারীর ফলাফল প্রকাশ পেলে হিসেব করে দেখা গেলো, অন্তত ৩ কোটি মানুষ (প্রকারান্তরে ২ কোটি থেকে সাড়ে চার কোটি) এই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছে। চীনের গ্রামাঞ্চলে সে সময়ে নরমাংস ভক্ষণের মতো ভয়ানক ঘটনাও নাকি দেদার ঘটেছে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এমন ভয়ানক দুর্ভিক্ষের পরেও কীভাবে মাও জনপ্রিয় হন? উত্তরটা হচ্ছে, সে আমলে চীনা সমাজে মাও সে তুং রীতিমতো দেবতার পর্যায়ে চলে গিয়েছেন। গ্রামবাসী নাকি দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর আগেও মাওকে ডাকতেন। তাছাড়া তারা মনে করতেন, মাও হয়তো আসল চিত্রটা জানেন না। কিন্তু সত্যটা হচ্ছে, মাও বুঝতে পারছিলেন তার গ্রেট লিপের ফলেই কোটি মানুষ মারা যাচ্ছে।
১৯৬০ সালে মাও তার পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসেন। ভুল পরিকল্পনা, দুর্ভিক্ষ আর অন্যান্য জটিলতার কারণে পার্টিতে তার অবস্থান খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এই অবস্থা পালটে দেওয়ার জন্য মাও শুরু করেন আরেক ন্যাক্কারজনক আন্দোলন: সাংস্কৃতিক বিপ্লব(১৯৬৬-১৯৭৬)। তবে সে আরেক কাহিনী।
ফিচার ইমেজ – wikimedia commons
তথ্যসূত্র – Andrew G. Walder, China under Mao, A revolution derailed, Harvard University Press, 2015