খাদ্যপ্রেমীদের কাছে জিভে জল আনা খাবারের তালিকায় শীর্ষে পিজ্জা থাকবে না, তা কি হতে পারে? ৬ ইঞ্চি বলুন আর ১২ ইঞ্চিই বলুন না কেন, খেতে গেলে পুরোটাই সাবাড় করা কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। টপিংসের ধরন অনুযায়ী আছে নানান রকম। নানা প্রকারের সবজি, মাংস আর গলে যাওয়া পনিরগুলো দেখে যিনি আকর্ষণ পান না, তার জন্য সকলের সমবেদনা ছাড়া আর কী-ইবা থাকতে পারে! তবে এত পছন্দনীয়, এত মুখরোচক, এত আকর্ষণীয় খাবারটির শুরুর কথা জানেন কি? চলুন জেনে নেয়া যাক এই লোভনীয় পিজ্জার শুরুর কথা।
পিজ্জার ইতিহাস
সেই ৬০০ খ্রিস্টাব্দে গ্রীক উপনিবেশে গড়ে ওঠে ইতালির নেপলস শহর, যা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ‘উন্নয়নশীল নদী সরোবরের শহর’ হিসেবে পরিচিতি পায়। এই নেপলস স্বাধীন একটি রাজ্য, কিন্তু এখানকার মানুষগুলো খুব গরিব হওয়ায় শহরের কুখ্যাতিও কম ছিল না। এখানকার জনগণের বেশিরভাগ সময়ই কাটতো বাইরে কাজ করে। ঘরে থাকার ফুসরত হতো না। তাই তাদের বাসাগুলোও ছিল কোনোরকমে এক রুমের আদলে। তো তাদের খাবার জন্য প্রয়োজন ছিল এমন কিছু, যা কম খরচে দ্রুত খাওয়া যায়। ১৬০০ সালের কথা, তাদের রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে ছোট ভ্রাম্যমান দোকানে তখন শুরু হয় সমতল রুটির উপর বিভিন্ন টপিংস দিয়ে তৈরি একপ্রকার খাবার, যা যেকোনো বেলায় চলার পথে তারা খেতে পারতেন। বুঝতেই পারছেন, এই সেই পিজ্জা। অনেক লেখকের ভাষায় তাদের এই খাদ্য গ্রহণের পদ্ধতিকে ‘বিরক্তিকর’ বলেও উল্লেখ করা রয়েছে!
১৮৩০ সালের আগপর্যন্ত খোলা আকাশের নিচেই বিক্রি চলতো এই টপিংস দেয়া রুটির। নেপলসের প্রথম পিজ্জার দোকান হিসেবে খ্যাত ‘অ্যান্টিকা পিজ্জারিয়া পোর্ট-অ্যালবা’।
১৮৬১ সালে ইতালি সমন্বিত হবার পর রাজা প্রথম আম্বারটো এবং রানী মার্গারিটা ইতালি ভ্রমণে বের হন এবং ১৮৮৯ সালে নেপলসে আসেন। কথিত আছে, রাজা-রানী তাদের একঘেয়ে রন্ধনপ্রণালীর ফরাসি খাবারের প্রতি বিরক্ত হয়ে হুকুম করেন শহরের ‘পিজ্জারিয়া ব্র্যান্ডি’ থেকে সেই পিজ্জার মালামাল সংগ্রহ করে পিজ্জা বানানো হোক। বলে রাখা ভালো, বর্তমানে ‘পিজ্জারিয়া ব্র্যান্ডি’ নামে পরিচিত এই খাবার দোকানটি যাত্রা শুরু করেছিল ১৭৬০ সালে। তখন এর নাম ছিল ‘ডা পিয়েট্রো পিজ্জারিয়া’।
পিজ্জারিয়া ব্র্যান্ডটির রাফায়েলে এস্পোসিটো নামের এক রুটির কারিগরকে আনা হয় পিজ্জা বানানোর জন্য। রাফায়েলে বিশেষ ধরনের এক পিজ্জা তৈরি করেছিলেন- সাদা মোজারেলা পনির, লাল টমেটো সস এবং সবুজ পুদিনা পাতা দিয়ে টপিংস দেয়া পিজ্জা। এই পিজ্জাতে তিনি ইতালির পতাকাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। এই পিজ্জার নাম দেন পিজ্জা মোজারেলা।
রানীকে দেওয়া হয় সেই পিজ্জা। রানী এতোটাই অভিভূত হয়েছিলেন এই পিজ্জার স্বাদে যে, সর্বস্তরে পিজ্জার প্রসারের কথা বলেছিলেন। এরপর থেকে এই ধরনের উপাদান সমন্বিত পিজ্জাগুলো ‘মার্গারিটা পিজ্জা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৮৬১ সালে রানীর অনুমোদন সত্ত্বেও উনবিংশ শতকের শেষের দিকে গিয়ে নেপলসের বাইরে এই পিজ্জা পরিচিতি পেয়েছিল। তখন অনেক ইতালীয় ব্যক্তিবর্গ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে আমেরিকা যাত্রা করেছিলেন এবং তাদের সাথে ছিল সেই পিজ্জার রন্ধনপ্রণালী এবং সুস্বাদ।
সেই সময়ে মার্গারিটা পিজ্জা ছাড়াও আরও এক ধরনের জনপ্রিয় পিজ্জা ছিল মার্গারিটা পিজ্জার আগেই। সেটির নাম ছিল ‘ম্যারিনারা পিজ্জা’। এর নাম ম্যারিনারা দেওয়ার পেছনে কারণ ছিল। এই পিজ্জা বানাতেন লা ম্যারিনারা নামের এক মহিলা, এক নাবিকের সহধর্মিণী। নাবিক যখন তার সমুদ্রযাত্রা শেষে বাড়ি ফিরে আসতেন তখন ম্যারিনারা তাকে এই পিজ্জা বানিয়ে দিতেন। এই পিজ্জায় টপিংস হিসেবে টমেটো, পেঁয়াজ, অরিগ্যানো এবং বেশি করে জলপাই তেল ব্যবহার করতেন। বুঝতেই পারছেন, ম্যারিনারা পিজ্জা এবং মার্গারিটা পিজ্জা উভয়ই বর্তমানে প্রচলিত পিজ্জাগুলোরই নামান্তর। এই দুটি পিজ্জা এখনো ইতালিতে ‘বিশুদ্ধ পিজ্জা’ হিসেবে সুপরিচিত।
যুক্তরাষ্ট্রে পিজ্জা
এক সাগর পাড়ি দিয়ে এই পিজ্জা নেপলস শহর থেকে চলে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, বোস্টন, শিকাগো সহ অন্যান্য শহরগুলোতে। নেপলসের মানুষেরা সেখানে কারখানায় কাজ করতে গিয়েছিল। তাদের সত্যিকার অর্থে পিজ্জা বা রান্নাবান্না নিয়ে জীবিকা গড়ার উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তাদের মাধ্যমেই খুব কম সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে পিজ্জার স্বাদ এবং সুঘ্রাণ জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়।
১৯০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পিজ্জারিয়া বা পিজ্জার দোকান গড়ে ওঠে মানহাটানের স্প্রিং স্ট্রিটে। এর নাম দেয়া হয়েছিল এর প্রতিষ্ঠাতা জেনারো লোম্বারডি এর নামানুসারে ‘জি লোম্বারডিস’। এটি ছিল একটি লাইসেন্সযুক্ত পিজ্জার দোকান। এই দোকানটি এখনো সেই আগের স্বাদের পিজ্জা বিক্রি করে যাচ্ছে, তবে ১৯০৫ সালের সে স্থান পরিবর্তন করা হয়েছে।
১৯৩০ সালের দিকে পিজ্জা ব্যবসা হঠাৎ করেই রমরমা হয়ে ওঠে। ইতালিয়ান-আমেরিকানরা একের পর এক পিজ্জারিয়া খুলতে থাকে মানহাটন, নিউ জার্সি এবং বোস্টনে। ১৯৪৩ সালে শিকাগোতে ‘শিকাগো-স্টাইল’ পিজ্জার দোকান খোলেন সুয়েল নামক এক ব্যক্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পিজ্জার জনপ্রিয়তা যেন আরও বেড়ে গেল। শহর থেকে শহরতলী, পূর্ব থেকে পশ্চিম, সবদিকেই পিজ্জার জয়জয়কার। সেই নেপলসের গরিবের খাদ্য হিসেবে নয়, বরং ফাস্টফুড এবং ফানফুড হিসেবে এর প্রসার বাড়তে থাকে। টপিংসের ধরনে এলাকাভিত্তিক বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধফেরত এক সৈনিক, ইরা নেভিন, গ্যাসচুল্লি চালিত পিজ্জা ওভেন উদ্ভাবন করেন যার ব্যবহারে কাঠ-কয়লার ঝামেলায় না গিয়ে এবং স্বল্পমূল্যে পিজ্জা তৈরির পথ উন্মুক্ত হয়।
পিজ্জার আসল প্রসার হয়েছিল ১৯৫৮ সালে ‘পিজ্জা হাট’ এর পথযাত্রার মাধ্যমে। এরপর ১৯৫৯ সালে ‘লিটল সিজারস’, ১৯৬০ সালে ‘ডমিনোস’ এবং ১৯৮৯ সালে ‘পাপা জনস’ এর মতো বিখ্যাত পিজ্জা কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠার পর পিজ্জা পৌঁছে যেতে থাকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে। পিজ্জা হাট এবং ডমিনোস বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে শাখা সৃষ্টির মাধ্যমে পিজ্জা তৈরিতে সুখ্যাতি লাভ করেছে। ১৯৫৭ সালে ‘সেলেন্টানো’ নামক কোম্পানি প্রথম হিমায়িত পিজ্জা বাজারে আনে যা যেকোনো হিমায়িত খাবারের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আবার ফিরে যাওয়া যাক পিজ্জার উৎপত্তিস্থল সেই নেপলস শহরে। ১৯৮৪ সালে ‘অ্যাসোসিয়াজিওনে ভেরাসে পিজ্জা নেপলেটানা’ বা বাংলায় ‘প্রকৃত নেপলসের পিজ্জা সংস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই সংস্থা থেকে প্রকৃত পিজ্জা তৈরির বেশ কিছু নীতিমালাও প্রকাশ করা হয়, যেমন- পিজ্জা বানাতে হবে কাঠ পুড়িয়ে তৈরি আগুনে ডোমাকৃতির চুলায়, কোনোভাবেই এটাকে রোল করা যাবে না এবং কোনো বিশেষ পিজ্জা মেকারও ব্যবহার করা চলবে না। এছাড়াও উল্লেখ রয়েছে পিজ্জার ব্যাস ৩৫ সেন্টিমিটারের বেশি হবে না এবং পুরুত্ব হতে হবে ১ সেন্টিমিটারের তিনভাগের একভাগ। এই সংস্থা থেকে বিশ্বের বেশ কিছু পিজ্জার কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করেও তাদের প্রকৃত পিজ্জার প্রসারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নেপলসের পিজ্জাগুলোর রুটিটি অনেক নরম এবং নমনীয় হয়। রোমে আবার পাতলা কড়মড়ে রুটির পিজ্জা বেশি জনপ্রিয়।
১৯৬২ সালে ‘হাওয়াইয়ান পিজ্জা’ উদ্ভাবিত হয় যেটিতে টপিংস হিসেবে আনারস এবং মাংস ব্যবহার করা হতো। এটি কানাডার একটি রেস্টুরেন্টে বিক্রি হতো।
কানাডায় পিজ্জা
কানাডার কথা যখন এসে গেল, তখন কানাডায় পিজ্জা সম্পর্কে একটু বলা যাক। কানাডায় পিজ্জা পরিচিতি পায় ১৯৫০ সালের শেষের দিকে। ১৯৬০ সালের দিকে কানাডাতেও পিজ্জা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, গড়ে ওঠে ছোট ছোট পিজ্জারিয়া এবং রেস্টুরেন্টগুলোতেও পাস্তা, স্যান্ডউইচ, স্যুপের পাশাপাশি পিজ্জার প্রচলন শুরু হয়। ধীরে ধীরে পরিচিতি পায় ‘কানাডিয়ান পিজ্জা’। এই পিজ্জার বিশেষ টপিংস হিসেবে টমেটো সস, মোজারেলা পনির, মাশরুম এবং শূকরের মাংস ব্যবহার করা হতো। কানাডিয়ান পিজ্জার রুটিটি অনেক ধরনের হয়, তাই যার যেটি পছন্দ সে সেটিই খেতে পারবে।
তাহলে যে পিজ্জাই খান না কেন, মেক্সিকান পিজ্জা বা ঢাকা পিজ্জা, পিজ্জা হাট থেকে বা ডমিনোস থেকে, পিজ্জার শুরুটি কিন্তু সেই অনুন্নত গরিব খেটে খাওয়া মানুষগুলোর থেকেই এসেছে যা অনেকেরই অজানা। বেশিরভাগেরই ধারণা, আমেরিকাই বুঝি এর জন্মদাতা। এবার থেকে পিজ্জা খাবার আগে একবার অন্তত নেপলসের সেই শহরটিকে স্মরণ করবেন একবার হলেও, মজাদার পিজ্জার শুরুর কথা।
ফিচার ইমেজ- scoopwhoop.com