আদি রোম নগরী ছিল রাজতন্ত্র ভিত্তিক। সেখান থেকে পরে জন্ম হয় রোমান রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্রের, যা টিকে ছিল সিজারের সময় পর্যন্ত। এরপর কায়েম হয় সম্রাটকেন্দ্রিক শাসন। আজকের পর্বে রোমের প্রারম্ভিক শাসনব্যবস্থা এবং প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত এর শাসকদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থাকবে।
রোমান সমাজের শ্রেণিবিন্যাস
রোমের সূচনালগ্নে বিভিন্ন জাতির মানুষ এক বিন্দুতে মিশেছিল। সকলেই রোমান, তবে তাদের সকলকে তিনটি গোত্রে ভাগ করা হয়েছিল। র্যামনেস, যাদেরকে অনেক ইতিহাসবিদ অ্যালবা লংগা থেকে আসা অভিবাসী বলে মনে করেন। এরা ছিল রোমের আদিগোষ্ঠী। এদের একটি অংশ পার্শ্ববর্তী পাহাড়ের স্যাবিন বসতির সাথে মিলে গড়ে তোলে টিট্টিস নামে নতুন বংশধারা। তৃতীয় গোত্রকে বলা হতো লুসেরাস, যারা মূলত ল্যাটিন ভাষাভাষী অন্যান্য গোত্র থেকে এসে রোমে বসতি গড়েছিল। প্রত্যেক গোত্র তৈরি হতো অনেকগুলো পরিবার বা ফ্যামিলিয়ার সমন্বয়ে। রোমানরা একে বলত জেন্টি (বহুবচনে জেন্টিস। প্রত্যেকটি জেন্টির একজন পূর্বপুরুষ ছিলেন, যাদের পরিবারের জনক মনে করা হতো এবং জেন্টির সদস্যরা নিজেদের নামের সাথে তার নাম যুক্ত করে পারিবারিক পরিচয় দিতেন)।
প্রতিটি গোত্রকে আবার দশটি ভাগ করা হয়েছিল, সে হিসেবে তিনটি গোত্র থেকে তিরিশটি ভাগ তৈরি হয়। এই ভাগকে বলা হতো কুইরিয়া। দশটি করে জেন্টি বা পরিবার একত্র হয়ে প্রতিটি কুইরিয়া গঠিত হতো। সুতরাং, পুরো রোম শহরে এরকম তিরিশটি কুইরিয়ার মধ্যে এরকম তিনশোটি পরিবার ছিল। এই তিনশো পরিবারকেই রোমের আদি জনগোষ্ঠী বলে ধরা হতো।
এদেরকেই পরে প্যাট্রিশিয়ান নামে অভিহিত করা হয়, যারা আভিজাত্য ও মর্যাদায় ছিল নাগরিকদের সবথেকে উঁচু শ্রেণি এবং সকল রকমের নাগরিক সুযোগ সুবিধা এরাই ভোগ করত। এ সময়ে তাদেরকেই শুধু রোমান নাগরিক গণ্য করা হতো, যারা যেকোনো একটি জেন্টির সাথে যুক্ত। এরা ছাড়া রোমে আর যারা বসবাস করত, তাদের মধ্যে ছিল দাসদাসী এবং স্বাধীন বাসিন্দা; যাদের কোনো শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা বা মতামত ছিল না।
পরিবারের পক্ষে তার বয়স্ক পুরুষ সদস্য কর্তার দায়িত্ব পালন করতেন। একে বলে হতো পাতের-ফ্যামিলিয়াস। তিনশোটি পরিবারের তিনশো পুরুষ সদস্যের সম্মিলনে বিখ্যাত রোমান সিনেটের সৃষ্টি। সিনেটের শাব্দিক অর্থ করলে রোমান ভাষায় তা দাঁড়ায়, ‘বুড়ো মানুষের দল’। সিনেটরদের সম্বোধন করা হতো পাত্রে, যার অর্থ- পিতা। সিনেট ছাড়াও তিরিশটি কুইরিয়ার প্রতিনিধিদের নিয়ে ছিল কমিতিয়া কুইরিয়াতা এবং তাদের সম্মেলনস্থল ছিল ফোরামের কাছাকাছি কমিতিয়াম নামে এক স্থানে।
কমিতিয়া কুইরিয়াতা ছিল রোমান নাগরিকদের রাজনৈতিক মতপ্রকাশের জায়গা। কুইরিয়াতে নাগরিকরা ভোটের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন বা পরিবর্তন করতে পারত। বহিঃশক্তির সাথে যুদ্ধ ঘোষণা বা শান্তিচুক্তি করতে গেলেও এখানে ভোটাভুটির প্রয়োজন হতো। তাছাড়াও সিনেট কাউকে রাজা নির্বাচন করলেও কুইরিয়া থেকে অনুমোদন নিতে হতো।
আগেই বলা হয়েছে, রোমের প্রতিষ্ঠাতা রাজার নাম ছিল রোমুলাস। তিনি প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে রাজার আসনে আসীন হয়েছিলেন। তবে তারপর থেকে রোমান সিনেটই রাজা নির্বাচন করত এবং বিভিন্ন বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দিত। উত্তরাধিকারসূত্রে রাজত্ব রোমের রীতি ছিল না, যদিও পরে এক জায়গায় এসে এর ব্যত্যয় ঘটেছিল। রাজার কাছেই ছিল সর্বময় ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার।
রোমুলাস থেকে শুরু হয়ে একে একে সাতজন রাজা প্রায় আড়াইশো বছর পর্যায়ক্রমে রোম শাসন করেন। রোমুলাসের পরের চারজন রাজা সিনেট থেকে নির্বাচিত হয়ে আসেন। ষষ্ঠ রাজা পঞ্চম রাজা থেকে সিনেটকে পাশ কাটিয়ে উত্তরাধিকারসূত্রে সিংহাসনপ্রাপ্ত হন, এখানে এসে প্রতিষ্ঠিত রীতির ব্যতিক্রম ঘটে। সপ্তম ও শেষ রাজা ষষ্ঠজনকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন।
১। রোমুলাস (৭৫৩-৭১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
রোমের প্রথম রাজা রোমুলাস শিশু রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে তার শাসনকালের বেশিরভাগ সময়েই আশেপাশের গোত্র ও নগরগুলোর সাথে লড়াই করতে ব্যস্ত ছিলেন। রোমের সুরক্ষা ও বৃদ্ধির জন্য জনসংখ্যার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রথম থেকেই তিনি নগরের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। আশেপাশের এলাকা থেকে দলে দলে মানুষ তার সময় রোমে এসে আবাস গড়ে তোলে। বিয়ের জন্য যখন নারীর স্বল্পতা দেখা দেয়, তখন রোমান সভ্যতা দীর্ঘস্থায়ী করার স্বার্থে রোমুলাস স্যাবিন নারীদের অপহরণ করার পরিকল্পনা প্রয়োগ করেন, যা আগের পর্বে আলোচিত হয়েছে।
তার সময়েই রোম ও স্যাবিন জাতির মধ্যে মৈত্রী স্থাপিত হয়। অনেক ঐতিহাসিকের ধারণা, রোমুলাস হার্শিলিয়া নামে স্যাবিন নারীকে তার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। রাজত্বকালের কিছু সময় স্যাবিন রাজা টাইটাসের সাথে যৌথভাবে শাসন করলেও টাইটাস শত্রুদের হাতে নিহত হলে রোমুলাস বাকি সময় একক রাজা হিসেবেই রাজকার্য পরিচালনা করেন। তার সময়ে তিনি রোমান সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি রাজকার্যে সহায়তার জন্য রোমান সিনেট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাথমিকভাবে রোমান সিনেটরদের সংখ্যা ছিল একশো, যা স্যাবিনরা রোমান নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তাদের জন্য নতুনভাবে আরও একশো আসন বরাদ্দ করা হয়।
রোমুলাস রোমান ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেন, যেখানে মাসের সংখ্যা ছিল দশ এবং বছর ৩০৪ দিনে গণনা করা হতো। আটদিনে এক সপ্তাহ এবং প্রতি নবম দিনে রোমানরা বাজার বসাত এবং রাজা নাগরিকদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন।
৭১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার অন্তর্ধান নিয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিকগণ কিংবদন্তির অবতারণা করেন। তাদের ভাষায়, দেবী জুনো হারকিউলিস ও ট্রোজান জাতিকে যখন আবার তার প্রিয়ভাজন করে নিলেন, তখন রোমুলাসের বিদায়ের উপযুক্ত সময় ঘনিয়ে এল। সূর্য মুখ লুকাল, বাতাস আর ঝড়ে পৃথিবী কম্পিত হতে থাকল। তখন প্রিয় পুত্রকে নিয়ে যেতে আগুনের রথে চড়ে মার্স মর্ত্যে নেমে এলেন এবং তাকে নিয়ে স্থান দিলেন দেবতাদের মাঝে, যেখানে রোমুলাস দেবতা কুইরিনাস হিসেবে তার জাতির সুরক্ষা বিধান করে যাবেন চিরকাল।
আধুনিক ঐতিহাসিকগণের মতে, আসল ঘটনা ছিল অত্যন্ত পাশবিক। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সিনেটররা ঝড়ের মধ্যে রাজাকে হত্যা করে তার দেহের ছিন্নবিচ্ছিন্ন অংশ পোশাকের আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ফেলেন। তারাই জনরোষ ঠেকাতে রোমুলাসের দেবত্ব প্রাপ্তির গল্প ফাঁদেন।
২। নুমা পম্পিলাস (৭১৫-৬৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
৭১৫ থেকে ধরা হলেও নুমা কিন্তু রোমুলাসের পরপরই রাজা হননি। রোমুলাসের অন্তর্ধানের পরে রোমান সিনেটের দশজন প্রতিনিধি এক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে শাসন করে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ জনতা নতুন রাজা নির্বাচনের দাবি জানায়। এখানে রোমান ও স্যাবিনদের মধ্যে রাজা কোন গোত্র থেকে হবে, তা নিয়ে মনোমালিন্য দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত রফা হয়, রোমানরা স্যাবিনদের থেকে তাদের পছন্দমতো একজনকে রাজা হিসেবে সমর্থন দেবে। তখন তারা টাইটাসের জামাতা নুমাকে বেছে নেয়।
রোমুলাস যতটা যুদ্ধবাজ ছিলেন, নুমা ছিলেন ঠিক ততটাই শান্ত ও ধর্মপ্রাণ। তিনি যুদ্ধের বদলে আলোচনার মাধ্যমে শান্তি আনাতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি রোমের প্রতিবেশীদের সাথে শান্তি স্থাপনে ব্রতী হন এবং তার সময় রোম অন্য সব রাজার তুলনায় শান্তিপূর্ণ সময় পার করছিল। তিনি যুদ্ধের দেবতা জ্যানুসের উদ্দেশে মন্দির নির্মাণ করলেও রোমের সুস্থির সময়ের প্রতীক হিসেবে মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেন, তার শাসনকালের পুরো সময় জুড়ে তা বন্ধই ছিল।
তিনি রোমান ক্যালেন্ডারে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস যোগ করে একে ১২ মাসে পরিণত করেন। তিনি বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেন এবং ধর্মীয় সংস্কার হাতে নেন। রোমান ধর্মের প্রধান পুরোহিত পদ ‘পন্টিফিক্স ম্যাক্সিমাস’ নুমাই সৃষ্টি করেন। এছাড়াও তিনি জুপিটার, মার্স ও কুইরিনাসের উপাসনার জন্য তিনজন পুরোহিত নিয়োগ দেন, যাদের ফ্ল্যামিনি বলা হতো। সালি নামে আর এক শ্রেণির পুরোহিত তার সময়ে আবির্ভূত হয়, যাদের প্রধান কাজ ছিল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে দেবতাদের উদ্দেশে নাচগান করা। নুমা তার সময় দেবী ভেস্টার কুমারীদের জন্যও আনুষ্ঠানিক পদ সৃষ্টি করেন।
প্রাচীন ইতিহাসবিদেরা দাবি করেন, নুমা নিম্ফ এগেরিয়ার পরামর্শে শাসনকাজ পরিচালনা করতেন এবং এগেরিয়ার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ৬৭৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়।
৩। টুলাস হোস্টিলিয়াস (৬৭৩-৬৪১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
আরো একজন যুদ্ধবাজ রাজা, যার সময় সামরিক শক্তির জোরে রোমের সীমানা বিস্তৃত হয়। হোস্টিলিয়াস সিনেটের জন্য আলাদা স্থাপনা নির্মাণ করেন, যা ‘কিউরিয়া হোস্টিলিয়া’ নামে পরিচিত। তিনি রোমের প্রতিবেশী ফিডেনা, ইরট্রুস্কান শহর ভেই এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় থাকা স্যাবিন গোত্র, যারা রোমের অন্তর্ভুক্ত ছিল না- তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালান এবং জয়লাভ করেন। ল্যাটিন রাজাদের সাথেও তার সময় রোমের সংঘর্ষ শুরু হয় এবং তাদের অনেকের সাথে তিনি মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন করেন। তবে তার সময়ের সবথেকে বিখ্যাত ঘটনা বোধহয় অ্যালবা লংগার সাথে রোমের সংঘাত।
অ্যালবা লংগা তখন ল্যাটিন কনফেডারেসির প্রধান শহর, কিন্তু ভবিষ্যতের পরাশক্তি রোম তা মানবে কেন? কাজেই কনফেডারেসির নামমাত্র সদস্য হলেও এর পুরো ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ইচ্ছা থেকে হোস্টিলিয়াস অ্যালবা লংগা আক্রমণ করেন। অযথা রক্তপাত এড়াতে দু পক্ষই নিজের সেরা সৈন্যদের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রস্তাবে রাজি হয়। যারা জিতবে, তাদের রাজার বশ্যতা স্বীকার করে নেবে। প্রত্যেক পক্ষই তাদের তিনজন করে যোদ্ধাকে নির্বাচন করে।
কাকতালীয়ভাবে তারা প্রত্যেক পক্ষের তিনজনই ছিল ট্রিপলেট, উপরন্তু তাদের মা’রাও ছিল পরস্পরের বোন। এক পক্ষের ভাইদের নাম ছিল হোরাশি, অন্য পক্ষের কুইরিয়াতি। কে কোন রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছিল তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশ মতানুসারে, হোরাশিরা ছিল রোমান, আর কুইরিয়াতিরা অ্যালবান।
নির্দিষ্ট দিনে দু পক্ষের সৈন্যরা খোলা মাঠের বিপরীত প্রান্তে শিবির স্থাপন করে। দু পক্ষের যোদ্ধারা নিজ নিজ সৈন্যদের হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের দিকে অগ্রসর হয়। তরবারির সাথে তরবারির আঘাতে স্ফূলিঙ্গ ছোটে। কয়েকবার সংঘর্ষের পরেও কেউ কাউকে যখন কাবু করতে পারছিল না, তখনই পরিস্থিতির মোড় ঘুরে যায়। কুইরিয়াতি ভাইদের আঘাতে দুই হোরাশি ভাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আসন্ন জয়ের সম্ভাবনায় অ্যালবান সেনারা তখন উল্লসিত, আর রোমান সেনাদের মুখে পরাজয়ের ছায়া ঘনিয়ে আসছে।
কিন্তু তৃতীয় হোরাশি কিন্তু সাহস হারায়নি। সে ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত এবং দেখতে পাচ্ছিল, তিন কুইরিয়াতিই বেশ আহত। কাজেই তাদের পক্ষে বেশিক্ষণ লড়াই চালান সম্ভবপর নয়। একজন একজন করে সে তাদেরকে সহজেই ঘায়েল করতে পারবে। কাজেই তৃতীয় হোরাশি দৌড়ে পালানোর ভান করলো। প্রত্যাশামতো কুইরিয়াতিরা পিছু নিলেও ক্ষত থেকে রক্তপাতের কারণে তাদের গতি ছিল শ্লথ, এবং তারা একজন আরেকজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। এ সুযোগে তৃতীয় হোরাশি ঘুরে দাঁড়ায় এবং একজন একজন করে তাদের সবাইকে হত্যা করে।
সে যখন বিজয়ী সেনাদের অগ্রভাগে জয়োল্লাস করতে করতে শহরে ফিরে আসছিল, তখন তার বোন, যার সাথে কুইরিয়াতি এক ভাইয়ের বিয়ের কথা ছিল, তাকে তীব্রভাবে তিরস্কার করে। এতে সে ক্ষিপ্ত হয়ে বোনকে মেরে ফেলে। বিচারে তার মৃত্যুদণ্ড হলে তৎকালীন রীতি অনুযায়ী, সে জনতার কাছে আবেদন করলে তারা তাদের বীরকে প্রাণভিক্ষা দেয়।
এদিকে চুক্তি অনুযায়ী, অ্যালবা রোমের অধীনে চলে আসলেও এর একনায়ক মেটিয়াস ইট্রুস্কানদের সাথে যুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতার চেষ্টা করলে হোস্টিলিয়াস তাকে কয়েকটি ঘোড়ার সাথে বেঁধে বিভিন্ন দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে দিয়ে তাকে হত্যা করেন। তিনি অ্যালবা ছারখার করে দিয়ে এর সমস্ত জনগোষ্ঠীকে রোমে অভিবাসনের জন্য বাধ্য করেন।
প্রাচীন ঐতিহাসিকদের মতে, হোস্টিলিয়াস ধর্মকর্মে সময় দিতেন না বলে দেবতারা অসন্তুষ্ট হন। তার শেষ বয়সে রোমে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব ঘটে, রাজা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় জুপিটারের উদ্দেশে তিনি ধর্মীয় আচার আয়োজন করলেও বেখেয়ালে তাতে ত্রুটি হয়। ফলে রাগান্বিত জুপিটার বজ্রের আঘাতে তাকে ভস্মে পরিণত করেন এবং তার প্রাসাদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
৪। অ্যাঙ্কাস মার্সিয়াস (৬৪১-৬১৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
হোস্টিলিয়াসের পরে রাজা নির্বাচিত হন নুমার নাতি অ্যাঙ্কাস মার্সিয়াস। তিনি ল্যাটিনদের সাথে পূর্বসূরীর সূচিত যুদ্ধ সফলতার সাথে পরিসমাপ্ত করেন। বহু ল্যাটিন শহর রোমের অধীনস্থ হয়।এদের অধিবাসীদের রোমে স্থানান্তরিত করে হয়, তবে রোমের আদি পরিবার বা প্যাট্রিশিয়ানদের থেকে আলাদা করার জন্য তাদের নাম দেওয়া হয় প্লেবেইয়ান। এদের মধ্যে ছিল কৃষক, কারিগরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। কালক্রমে এরাই হয়ে ওঠে রোমের অর্থনীতি ও সামরিক বাহিনীর মূল চালিকাশক্তি, যদিও একটা লম্বা সময় পর্যন্ত তাদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না।
মার্সিয়াস অ্যাভেন্টাইন ও জ্যানিকুলাম পাহাড়ের বসতি রোম নগরের মধ্যে নিয়ে আসেন। তার সময় সিলিয়ান ও প্যালাটাইন পাহাড়ের মাঝে নিচু জায়গাতে শহর প্রতিরক্ষার জন্য পরিখা খনন করেন। তার সময় প্রথম রোমান উপনিবেশ স্থাপিত হয় টিবের নদীর মুখে অস্টিয়াতে, যেখানে রোমানরা তাদের সর্বপ্রথম বন্দর স্থাপন করে। তিনি টিবের নদীর উপর দিয়ে প্রথম কাঠের সেতু তৈরি করেন (পন্স সিবিলিকাস) এবং ক্যাপিটোলাইন পাহাড়ের উপর জেল নির্মাণ করেন।
তার নির্দেশেই প্রথম ধর্মীয় আইন-কানুন জনসম্মুখে উন্মুক্তভাবে লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়, যা এর আগে পর্যন্ত একান্তভাবেই পুরোহিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। নুমার মতো তারও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল বলে মনে করা হয়।
৫। লুসিয়াস টার্কুইনাস প্রিসকাস (৬১৬-৫৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
টার্কুইনাসের সিংহাসনে আরোহণের কাহিনী বেশ চমকপ্রদ। তার বাবা, দেমেরতাস ছিলেন গ্রিসের করিন্থ নগরের এক ধনবান অভিজাত। জনরোষে অভিজাততন্ত্রের পতন হলে তিনি তার পরিবার ও ধনদৌলত নিয়ে পালিয়ে ইট্রুরিয়াতে চলে আসেন। এখানে তার ছেলে লুকোমোর জন্ম। পরিণত বয়সে লুকোমো টানাকুইল নামে এক বুদ্ধিমতি ইরট্রুস্কান নারীকে বিয়ে করে রোমে চলে আসেন। কিংবদন্তি আছে, তারা যখন জ্যানিকুলাম পাহাড়ে ওপর থেকে রোমের দিকে দৃষ্টিপাত করেন, তখনই এক ইগল পাখি লুকোমোর ক্যাপ নিয়ে উড়ে যায়।
কিন্তু, কিছু সময় পর আবার সে তা ফেরত নিয়ে আসে। এ থেকে লুকোমো ও টানাকুইল রোমে তার উচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্তির লক্ষণ দেখতে পান। রোমে এসে তিনে রাজার সুনজরে পড়েন এবং নিজের নাম বদলে রাখেন লুসিয়াস টার্কুইনাস, যার সাথে লিভি পরে প্রিসকাস যোগ করেন। মার্সিয়াসের মৃত্যু হলে সিনেট ও জনতার অনুমোদনে তিনি সিংহাসনে বসেন, যদিও এতে মার্সিয়াসের ছেলেরা অসন্তুষ্ট হয়েছিল, যা পরে তার সর্বনাশ ডেকে আনে।
টার্কুইনাসকে ঐতিহাসিকরা ‘টার্কুইনাস দ্য এল্ডার’ নামেও অভিহিত করেন, রোমের সপ্তম রাজা টার্কুইনাসের থেকে আলাদা করার জন্য। তার থেকেই রোমে সূচনা হয় ইরট্রুস্কান বংশীয় রাজাদের শাসন, যার সমাপ্তি সপ্তম রাজার পতনের মাধ্যমে। তিনি সামরিক অভিযান চালিয়ে বহু শহর রোমের পদানত করেন এবং রাজ্যের আয়তন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে অশ্বারোহীর সংখ্যা বাড়ান।
টার্কুইনাসের রাজত্বকালে স্যাবিন সেনারা এক বিশাল বাহিনী নিয়ে রোমের কাছে এনিও নদের অপর পাড়ে ছাউনি ফেলে। তারা নদী পাড়ি দেয়ার জন্য কাঠের সেতু তৈরি করতে থাকলে টার্কুইনাস জ্বলন্ত নৌকার সাহায্যে তা ভস্মীভূত করে দেন এবং পাল্টা আক্রমণে তাদের পরাজিত করে। তিনি তার স্ববংশীয় ইরট্রুস্কানদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালান এবং অনেক ইরট্রুস্কানকে জোরপূর্বক রোমে স্থানান্তর করেন এবং অনেককে দাস হিসেবে বিক্রি করে দেন।
তার আমলেই ইরট্রুস্কানদের যোগ করে সিনেটের সদস্যসংখ্যা তিনশোতে রূপান্তরিত করা হয়। টার্কুইনাসের বিরুদ্ধে অ্যাপেনাইনের দক্ষিণের বারোটি শহর একজোট হলেও ইরেটামের যুদ্ধে তারা হেরে যায় ও বশ্যতা স্বীকার করে নেয়।
যুদ্ধে প্রাপ্ত ধনসম্পদ দিয়ে টার্কুইনাস রোমে বিশাল বিশাল সৌধ স্থাপন করেন। তিনি ক্যাপিটোলাইন পাহাড়ে জুপিটারের মন্দির স্থাপন করেন, মতান্তরে তিনি নির্মাণকাজ শুরু করলেও পরবর্তী রাজার সময় তা সমাপ্ত হয়। টার্কুইনাস রোমান ফোরামের আনুষ্ঠানিক স্থাপনা নির্মাণ করেন এবং ইট্রুস্কান মডেলে রোমের চারিদিকে পাথরের দেয়াল দিয়ে দেন। তিনি প্যালাটাইন ও অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ের মাঝের পানি নিষ্কাশন করে এখানে সার্কাস ম্যাক্সিমা নামে ইরট্রুস্কানদের মত চ্যারিয়ট দৌড়ের স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন। তবে তার সবথেকে বড় এবং স্থায়ী কীর্তি ‘ক্লোয়েকা ম্যাক্সিমা’, পয়ঃনিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে রোম নগর জুড়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা যা এখনো বিদ্যমান। এছাড়াও তিনি অনেক ইরট্রুস্কান রীতিনীতি রোমের সংস্কৃতিতে যুক্ত করেন।
টার্কুইনাস তার মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন ইরট্রুস্কান সার্ভিয়াস টুলিয়াসের সাথে। তার ইচ্ছা ছিল, সার্ভিয়াস উপযুক্ত সময় রোমের রাজা হবেন। এদিকে মার্সিয়াসের ছেলেদের ভাড়া করা আততায়ীর আঘাতে টার্কুইনাস মারা যান। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তার বুদ্ধিমতি স্ত্রী টানাকুইল প্রচার করেন যে, টার্কুইনাস অসুস্থ এবং তার প্রতিনিধি হিসেবে সার্ভিয়াস শাসন পরিচালনা করবেন। তার বুদ্ধিতে সিনেটকে পাশ কাটিয়ে সার্ভিয়াস রাজার আসনে অভিষিক্ত হন এবং পরে যখন টার্কুইনাসের মৃত্যুসংবাদ জানাজানি হয়, ততদিনে তিনি স্থায়ী হয়ে যান।
৬। সার্ভিয়াস টুলিয়াস (৫৭৯-৫৩৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
সার্ভিয়াসের জন্ম পরিচয় নিতে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত রয়েছে। এক মত অনুযায়ী, তিনি ছিলেন এক ইরট্রুস্কান দাসীর সন্তান, আরেক মত অনুযায়ী, তার বাবা ছিলেন রোমের অদূরে এক শহরের অভিজাত পরিবারের প্রধান। রোমানরা শহর আক্রমণ করে সবাইকে হত্যা করলেও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে ধরে নিয়ে এসে রানি টানাকুইলের সহচরী করা হয়। সার্ভিয়াসের জন্মের পর একরাতে তার ঘুমন্ত অবস্থায় টানাকুইল তার মাথা ঘিরে জ্বলন্ত শিখা এবং আরো কিছু লক্ষণ দেখে বুঝতে পারেন, দেবতারা এই ছেলের জন্য বড় কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন। টানাকুইল ও টার্কুইনাসের পৃষ্ঠপোষকতায় সার্ভিয়াস বেড়ে ওঠেন এবং বিভিন্ন যুদ্ধে নিজের দক্ষতা ও বীরত্বের দৃষ্টান্ত রাখেন। ফলে, টার্কুইনাস তার হাতেই নিজের মেয়েকে তুলে দেন।
সার্ভিয়াসের সময় রোম যুদ্ধবিগ্রহ থেকে তুলনামুলকভাবে মুক্ত ছিল। তিনি নুমার মতো ধর্মীয় আইনকানুনের প্রণয়ন এবং রোমান সেনাবাহিনীতে অনেক সংস্কার সাধন করেন। তার সময় ইরট্রুস্কানরা রোমের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করলে তিনি পুনরায় তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। সার্ভিয়াস ল্যাটিন রাজ্যগুলির সাথে মৈত্রী আরও দৃঢ় করেন এবং সব জাতির উপাস্য অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ে চন্দ্রদেবী ডায়ানার মন্দির নির্মাণ করেন, যেখানে যেকোনো জাতির লোকই পুজো দিতে পারত। তিনিই প্রথম রোমান রাজা, যিনি আদমশুমারির ব্যবস্থা করেন এবং জনসাধারণকে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা অনুযায়ী পাঁচভাগে ভাগ করেন। তিনি রোমের প্রতিরক্ষা সুদৃঢ় করার জন্য প্রথমবারের মতো সাত পাহাড় ঘিরে প্রাচীর তুলে দেন, যা ইতিহাসে ‘সার্ভিয়ান ওয়াল’ নামে বিখ্যাত।
টার্কুইনাসের দুই ছেলে লুসিয়াস টার্কুইনাস সুপারবাস ও আরনাসের বিয়ে হয়েছিল সার্ভিয়াসের দুই মেয়ের সাথে। এক মেয়ে, টুলিয়া অন্তর ছিল হিংসা আর নিচতায় পরিপূর্ণ। তার বোনের স্বামী লুসিয়াস টার্কুইনাসের মধ্যে সে তার অপকর্মের উপযুক্ত সহযোগী খুঁজে পায়। তারা চক্রান্ত করে নিজ নিজ স্বামী ও স্ত্রীকে হত্যা করে এবং তাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবার আগেই নিজেরা বিয়ে করে। এদিকে প্রায় আশি বছরের বেশি বয়স হয়ে গিয়েছিল রাজা সার্ভিয়াসের। রোমান সিনেট তার আইন সংস্কার নিয়ে আগে থেকেই খুশি ছিল না, এর মধ্যে শেষ বয়সে সার্ভিয়াস রোমান জনগণের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে শাসনতন্ত্রের পরিবর্তনের চিন্তা করছিলেন।
সিনেট একে তাদের ক্ষমতার ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখে। এমন অবস্থায় টার্কুইনাস রাজার বিরুদ্ধে সিনেটে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিলে বেশিরভাগ সিনেটর তাকে সমর্থন দেন। সার্ভিয়াসের জানতে পেরে সিনেটে এসে তাকে যখন ভর্ৎসনা করছিলেন, তখন এক মত অনুযায়ী, টার্কুইনাস তাকে ধাক্কা দিয়ে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেন ও তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। তার বিশ্বস্ত অনুচররা যখন তাকে প্রাসাদে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন টার্কুইনাসের অনুসারীরা এসে তাকে হত্যা করে। এদিকে টুলিয়া সিনেটে কী হচ্ছে, তা জানতে সশরীরে এসে উপস্থিত হয়। সেখান থেকে ফিরে যাবার পথে রাস্তায় পড়ে থাকা বাবার মৃতদেহ দেখতে পেয়ে সে তার ওপর দিয়েই তার ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে দেয়।
অন্য মতে, টার্কুইনাস ও সার্ভিয়াসের অনুসারীদের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষে রাজা নিহত হন। কন্যা টুলিয়া প্রাসাদের দখল নিতে যাবার পথে রাস্তায় পড়ে থাকা বাবার মৃতদেহের উপর দিয়েই তার ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে দেয়।
৭। লুসিয়াস টার্কুইনাস সুপারবাস (৫৩৪-৫০৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
‘টার্কুইন দ্য প্রাউড’ নামে পরিচিত টার্কুইনাস স্বেচ্ছাচারী হলেও রাজকার্যে ছিলেন কুশলী। তার সময় রোম সফলতার সাথে প্রতিবেশী ভলসি, গ্যাবি ও রুটুলিদের সাথে যুদ্ধ করে। তিনি ভলসিয়ানদের শহর পোমেশিয়া আক্রমণের মাধ্যমে তাদের সাথে সংঘাতের সূত্রপাত করেন। দখল করা ভূমিতে তিনি দু’টি রোমান কলোনি স্থাপন করেন- সিগনিয়া ও সিরসেই। লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে তিনি দেবতাদের উদ্দেশে মন্দির নির্মাণ করেন।
গ্যাবি দখলের ঘটনায় টার্কুইনাস ধূর্ততা প্রতীয়মান হয়। তার সন্তান সেক্সটাসকে তিনি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বহিস্কার করলে সে রোমের অদূরে গ্যাবি শহরে আশ্রয় প্রার্থনা করে। সেখানে সে ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে শহরের প্রধানদের একজন হয়ে ওঠে। এসবই ছিল সেক্সটাসের ভণ্ডামি, সে সবসময় টার্কুইনাসের পরামর্শেই কাজ করছিল। সেক্সটাস যারা রোমানদের প্রতিরোধ করতে পারে, এমন সবাইকে ছলচাতুরির মধ্য দিয়ে সরিয়ে দেয়, ফলে গ্যাবি সহজেই রোমানদের হস্তগত হয়। পরবর্তী সময়ে প্রধানত এই সেক্সটাসের কারণেই টার্কুইনাসকে পালিয়ে যেতে হয় এবং রোমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে।
পরবর্তী পর্ব- ‘রেপ অভ লুক্রেশিয়া’ এবং রোমান প্রজাতন্ত্রের উদ্ভব