১৯৬২ সালের জুন মাস নাগাদ শিক্ষার্থীরা প্রায় ৫০ মিটারের মতো পথ খনন করে ফেলে। সীমান্তের অনেকটাই কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। একটানা ৩৮ দিন কাজ করে তারা এতটা পথ অতিক্রম করেছে। প্রতিদিন নিয়ম করে ৮ ঘণ্টা কাজ করত তারা। এনবিসির দেয়া অর্থে তারা নতুন সরঞ্জামাদি কিনেছিল। খননকাজ যাতে দ্রুত এগোয়, সেজন্য নিয়োগ দেয়া হয়েছিল আরো জনবল। এক চাকার ঠেলাগাড়িটাকে হটিয়ে সহজে মাটি বহন এবং চলাচলের সুবিধার্থে লোহার পাত কেনা হয়েছিল। রেললাইনের মতো পাত বিছিয়ে মালবাহী দু’চাকার গাড়ি বসানো হয়েছিল একটা।
সেজন্যই সুড়ঙ্গটা খুব শীঘ্রই উচ্চ-প্রযুক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠেছিল। জোয়াকিম ছিল এর প্রধান উদ্ভাবক। সুড়ঙ্গের দেয়াল জুড়ে সারিবদ্ধভাবে বাতি স্থাপন করেছিল সে। মাটি বহনের গাড়িটাতে একটা মোটর লাগিয়ে নিয়েছিল যেন সেটা দ্রুত চলাচল করতে পারে। বাইরের তাজা বাতাস যেন সুড়ঙ্গের মধ্যেও চলাচল করতে পারে, সেজন্য বিশালাকারের পাইপ লাগিয়েছিল সে।
সবকিছুই রেকর্ড করে রেখেছিল টু ব্যাভারিয়ান ব্রাদার। এনবিসির ধারণকৃত দৃশ্যে কোনো শব্দ ছিল না। কেননা, সুড়ঙ্গের মধ্যে একটা টেপ রেকর্ডার নামানোর মতো জায়গা ছিল না। অবশ্য একসময় তারা মাইক্রোফোন নামাতে পেরেছিল। বাস, ট্রাম চলাচলের শব্দ ছাড়াও তারা পথচারীদের হাঁটাহাঁটির শব্দ শুনতে পেত স্পষ্টই। জোয়াকিম আর তার দলবল বেশ উৎসুক হয়ে উঠেছিল এসব শব্দ শুনে। এ উদ্যমেই তাদের কাজ আরো দ্রুত হতে থাকে।
পূর্বদিকে আরো কিছু দূর খনন করার পরেই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। খনন করে তারা যতটাই সামনে এগোচ্ছিল, শব্দের ব্যাপকতা ততই কমতে শুরু করল। একটা সময় সুড়ঙ্গের উপর থেকে আর কোনো শব্দই পাওয়া গেল না। একদম সুনসান নীরবতা। তবে হঠাৎ হঠাৎ গাড়ির শব্দ পাওয়া যায়। কিছু সময় ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর তারা বুঝতে পারল যে, তারা আসলে সীমান্তের এতটাই কাছে চলে এসেছে যেখানে সীমান্তরক্ষীরা গাড়িতে চড়ে নির্দিষ্ট সময় পরে টহল দেয়। বার্লিন প্রাচীরের পাশেই এই অংশটাতে কেবল টহলই দেয়া হয় না। বরং সীমান্তরক্ষীরা সুড়ঙ্গ খননকারীদের সন্ধানে মাঝেমধ্যে অভিযানও চালায়। তারা এখন আছে এক মৃত্যুখাদে। সামনে হয় মৃত্যু, নাহয় মুক্তি। পিছু হটার কোনো পথই আর নেই তাদের কাছে।
তারাই যে প্রথম সুড়ঙ্গ খনন করেছে, এমনটা কিন্তু নয়। বরং এর আগে আরো অনেকেই সুড়ঙ্গ খোঁড়ার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে এ জন্যই বলা, তারা কেউই আসলে সফল হতে পারেনি। এলাকার পরিবেশ আর পরিস্থিতি তখন গরম। ঘন ঘন অভিযান আর টহল দেয়া হচ্ছে। গেল সপ্তাহেই দুজন মানুষকে সুড়ঙ্গ খননরত অবস্থায় পাওয়া গেছে। উপর্যুপরি গুলিতে একজন নিহত হয়েছে আর অন্যজন মারাত্মক রকমের আহত হয়েছে।
সীমান্তরক্ষীদের কাছে বিশেষ একধরনের যন্ত্র ছিল, যেটি মাটিতে রেখে তারা শব্দ শুনতে পেত। কোনো ধরনের শব্দ যদি শোনা যেত, তারা তৎক্ষণাৎ সেখানে গর্ত খুঁড়ে ফেলত। তারপর হয় গুলি চালাত, নাহয় একটা ডিনামাইট ছুঁড়ে ফেলে দিত ভেতরে। প্রতিবার খোঁড়ার সময় এসব কথা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খেত; কল্পনাতেও দেখতে পেতাম এসব। কেবল এটাই মনে হতো, এই বুঝি মাথার উপরের মাটি সরে গেল। মানুষের চিন্তা হয় পায়ের নিচের মাটি সরে যাবার, আর আমাদের তখন মাথার উপরের মাটি নিয়ে চিন্তা ছিল।
– জোয়াকিম রুডলফ
এমনকি খনন কাজ চলাকালীন সীমান্তরক্ষীদের কত্থাবার্তার শব্দ শুনতে পেত তারা। তাদের ভয় ছিল,
যদি আমরা তাদের শুনতে পাই, তাহলে হয়তো তারাও আমাদের শুনতে পাবে। তাই সুড়ঙ্গে ঢুকে কাজ ব্যতীত কথা বলা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলাম আমরা।
ভ্যাপসা গরম থেকে বাঁচতে যে ফ্যানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেগুলো পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। গুমোট পরিবেশে অসহ্য গরমে সুড়ঙ্গে কাজ করা তখন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল প্রায়। শ্বাস নেয়াই দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল। নিজেদের হাঁসফাঁস করা নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দই তারা শুনতে পেত না তখন।
তারপর সেখানে এমন কিছু শব্দ শোনা গেল যে, আমরা আর কাজ করার সাহস পেলাম না। ওরা কি স্ট্যাসির সদস্য? ওরা কি আমাদের ধরতে আসছে?
– জোয়াকিম রুডলফ
এক সন্ধ্যায়, জোয়াকিম খনন করার সময় একটা শব্দ শুনতে পায়। অনেকটা অনবরত টপটপ করে জল পড়ার শব্দের মতোই। প্রথমে সে বুঝে উঠতে পারে না, এটা কীসের শব্দ। পরে টের পায়, সুড়ঙ্গের কোথাও একটা পানির পাইপ ফুটো হয়ে গেছে, সেখান থেকেই টপটপ করে পানি পড়ছে সুড়ঙ্গের ভেতরে। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই সুড়ঙ্গের মধ্যে জলের প্রবাহ দেখা গেল। তারা বুঝতে পারছিল যে, যদি জল এভাবেই বাড়তে থাকে, তাহলে সুড়ঙ্গটা তলিয়ে যাবে; সুড়ঙ্গটা হারাবে তারা।
কী করবে তা বুঝতে না পেরে এক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলো তারা। পশ্চিম বার্লিনের পানি সরবরাহ কর্তৃপক্ষকে সরাসরি তারা জানায় ব্যাপারটা নিয়ে, যেন তারা পানির পাইপটা সরকারি তত্ত্বাবধানে ঠিক করে দেয়। মজার বিষয় হচ্ছে, খননকারীদের অবাক করে দিয়ে তারা রাজিও হয়ে যায়। কিন্তু পাইপ ঠিক করার পরও, সুড়ঙ্গটি জলমগ্ন ছিল। এ থেকে শুকনো অবস্থায় ফিরে আসতে প্রায় মাসখানেক বা তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
তবে তারা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছিল। পূর্বের বেজমেন্ট থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে আছে এখন তারা। এতদিনের ক্লান্তি, কষ্ট যেন সফলতার মুখ দেখতে যাচ্ছে অবশেষে। যাদেরকে তারা এই সুড়ঙ্গ দিয়ে পার করাতে চেয়েছে, এমনকি তারাও প্রস্তুত হয়ে আছে; অপেক্ষার প্রহর গুনছে। হাসোর বোন, উলির প্রেমিকাসহ আরো অনেকজন।
দ্য সেকেন্ড টানেল
১৯৬২ সালের জুলাই মাসের কথা। বার্লিন প্রাচীর ওঠার প্রায় এক বছর হয়ে এসেছে। ট্র্যাপওয়ার, ল্যান্ডমাইনস, বৈদ্যুতিক তার, স্পাইকস, স্পটলাইটসহ আরো নিত্যনতুন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে সীমান্তে। যদি এসব কিছুই একজন মানুষকে পালানো থেকে ব্যর্থ হয়; তাহলে সীমান্তরক্ষীরা আছে সর্বদাই পাহারায় পিস্তল, মেশিন গান, মর্টার, অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক রাইফেল এবং ফ্লেম-থ্রোয়ার নিয়ে। কিন্তু এরপরও পালানোর খবর শোনা যেত প্রায় প্রতি মাসেই। গাড়ির মধ্যে লুকিয়েই হোক, আর নকল পাসপোর্ট ব্যবহার করেই হোক।
কবে এই সুড়ঙ্গের পানি শুকাবে? কবে সুড়ঙ্গ আবার শুকনো হবে? কবে থেকে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হবে? এ আশায় আর অপেক্ষায় তো সুড়ঙ্গ খননকারীরা কেবল বসে থাকতে পারে না। তাই তারা দ্রুত চিন্তা করতে থাকল, কী করা যায়! অবশেষে, তারা জানতে পারল, পূর্ব দিকে একটা সুড়ঙ্গ খনন করা হয়েছিল। সেটা ব্যর্থ হয়েছিল। মানে সুড়ঙ্গটা এখনও অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে। আর পরিত্যক্তও বটে।
অন্য সুড়ঙ্গের শিক্ষার্থীরা জোয়াকিম এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করল অবশেষে। তারাই প্রথমে সম্মিলিতভাবে কাজ করার আহ্বান জানায়। জোয়াকিম এবং অন্যরাও ভেবে দেখে যে, যদি তারা একত্র হয়, তাহলে দু’পক্ষের জন্যই সেটা সুবিধাজনক হয়।
খুব সহজেই অতিক্রম করার একটা সুযোগ যেন আমাদের কাছে স্বেচ্ছায় এসে ধর্না দিল। একদিকে সুড়ঙ্গবিহীন এক দল খননকারী আমরা। আর অন্যদিকে টানেলারবিহীন একটা আস্ত সুড়ঙ্গ।
– জোয়াকিম রুডলফ
অন্য সুড়ঙ্গটা পূর্ব বার্লিনের একটা কটেজের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসার রাস্তা করেছিল। তারা আশা করেছিল, প্রায় ৮০ জন এই সুড়ঙ্গের মাধ্যমে হামাগুড়ি দিয়ে পালাতে সক্ষম হবে। কিছুদিন পরে জোয়াকিম এবং অন্যরা সেই সুড়ঙ্গটা দেখতে গেল। যা দেখল, তাতে বেশ অবাকই হলো তারা।
জোয়াকিমের সুড়ঙ্গে লাইট, টেলিফোন, মোটর চালিত কপিকল এবং বাতাস সঞ্চালনের জন্য বড় পাইপের ব্যবস্থাও ছিল। কিন্তু এখানকার চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। আলো কিংবা বাতাস সঞ্চালনের কোনো ব্যবস্থাই নেই এখানে। উপরন্তু, সিলিং এতটাই খাটো যে, হামাগুড়ি দেয়াটাও হয়তো অনেক কষ্টসাধ্য হবে। আর যখনই সুড়ঙ্গের উপর দিয়ে কোনো গাড়ি যায়; তখনই খানিকটা মাটি ঝরে পড়ে এর কম্পনে।
তা সত্ত্বেও, তারা এটিই বেছে নিল। সিদ্ধান্ত হলো, একেই একটু বড় করে খনন করা হবে। আর যেটুকু খনন করা বাকি, সেটুকুও করে ফেলবে কটেজের নিচে পৌঁছে যাওয়া অবধি। শেষমেশ সুড়ঙ্গ প্রস্তুত। পালিয়ে যাওয়া লোকেদের বিবরণ দেয়ার জন্য এখন তাদের একজন বার্তাবাহকের দরকার ছিল।
ওল্ফডিটের স্টার্নহাইমার ছিল পশ্চিম বার্লিনে বসবাসকারী আরেকজন ছাত্র। ইতোমধ্যেই সুড়ঙ্গের ব্যাপারে জানতে পেরেছে সে। সীমান্তের ওপারে, পূর্ব পাশে তার প্রেমিকা আটকা পড়েছিল। তাকে ফিরিয়ে আনতে তাই একজন স্বেচ্ছসেবী হয়ে সুড়ঙ্গ খননকারীদের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক ছিল সে। মেয়েটির নাম ছিল রেনাটা। তাদের বন্ধুত্ব আর প্রণয় হয়েছিল পত্রমিতালীর মাধ্যমে। স্টার্নহেইমারের অবশ্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল, যেটা অন্যদের ছিল না। সে জন্মসূত্রেই পশ্চিম জার্মানির নাগরিক ছিল। যে কারণে সে পূর্ব জার্মানিতে অবাধে চলাচল করতে পারতো। পরের কয়েক সপ্তাহ সে ঘন ঘন পূর্ব বার্লিনে যাতায়াত করে এবং লোকজনকে খবরাখবর দিতে থাকে।
আগস্টের ৭ তারিখ চূড়ান্ত দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয় শেষমেশ। ঠিক তার আগের দিন সবাই মিলে একটা সভার আয়োজন করা হয়। সবার মধ্যে স্টার্নহেইমার একজনকে লক্ষ্য করে, যাকে এর আগে সুড়ঙ্গের কোনো পাশের লোকেদের সঙ্গে দেখেছে বলে, মনে করতে পারে না। তার নাম ছিল জিগফ্রিড উঝে; পেশায় নাপিত ছিল লোকটা।
জানা যায়, চূড়ান্ত নির্দেশনা সরবরাহ করার জন্য যখন একজন স্বেচ্ছাসেবী পূর্বে গিয়েছিল; তখন উঝে নিজে থেকেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিল যোগদানে। সভা শেষে সবাই নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেল। কিন্তু উঝে গেল অন্য একটা অ্যাপার্টমেন্টে। সেই অ্যাপার্টমেন্টের সাংকেতিক নাম ছিল ‘অরিয়েন্ট’। সেখানে উঝে স্ট্যাসির এক কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে।
উঝে আসলে স্ট্যাসির একজন ইনফর্মার ছিল; যে কিনা মাত্র মাস ছয়েক আগেই নিয়োগ পেয়েছে। সেখানে উঝে জানিয়েছিল যে, মোটামুটি ১০০ জন লোক বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে পালাবে। স্ট্যাসির লোকজন কালক্ষেপণ না করেই জোয়াকিমের সুড়ঙ্গের পেছনে লোক লাগিয়ে দিল।
মৃত্যুফাঁদ
অবশেষে পালানোর কাঙ্ক্ষিত সেই দিন এল। পূর্ব বার্লিনের ওল্ফডিটের প্রেমিকা রেনাটাসহ আরো যারা যারা পালানোর জন্য প্রস্তুত, তারা তৈরি হয়ে নিল। ধীরে ধীরে তারা সেই কটেজে এসে মিলিত হতে থাকল। তবে সবাই নির্দিষ্ট একটা সময়ে না এসে; বরং ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আর ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে আসতে শুরু করলো। কেউ হেঁটে, কেউ বা বাসে কিংবা ট্রামে করে।
পলায়নরত প্রত্যেকেই একটা চাপা আতঙ্কের মধ্যে ছিল। তাদের মধ্যে অনেকেই আগের রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারেনি। তাদেরকে বারবার ব্যাগ গোছাতে হয়েছে। প্রত্যেকের সঙ্গে কেবল একটা মাত্র ব্যাগই নেয়া যাবে। তাই কোন জিনিসটা নেবে, আর কোনটা রেখে যাবে- এ দ্বন্দ্বেই বারবার ব্যাগ গোছানো। তখন তাদের মনে কেবল একটাই আশা, একবার যদি তারা পশ্চিমে চলে যেতে পারে, তাহলে সেখান থেকেই এক নতুন জীবনের যাত্রা শুরু হবে।
কটেজে পৌঁছানো মাত্রই পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক স্ট্যাসি তাদের কার্যক্রম শুরু করল। সুড়ঙ্গ খননকারীদের শব্দ শোনার যন্ত্র চালু করল তারা। সীমান্ত ব্রিগেডের কমান্ডার সৈন্যদের আদেশ দিলেন, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সৈন্যদের নিয়ে গাড়িতে করে টহল দিতে। জলকামান সমেত একটা অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনেরও নির্দেশ দিলেন। আর এই ঘাঁটিটা ছিল সেই কটেজের একদম কাছে। সবশেষে সাদা পোশাকে থাকা স্ট্যাসির এজেন্টরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল কটেজের আশেপাশে। তারা অপেক্ষায় থাকল শিকারের। ফাঁদ পাতা সম্পন্ন।
ঐদিকে টানেলে জোয়াকিম, হাসো এবং উলিরা প্রস্তুত তাদের বিরাট সাফল্য অর্জনের জন্যে। এতদিনের কষ্টের ফল পেতে তারা উদগ্রীব। যদিও ভেতরে ভেতরে প্রত্যেকেই আতঙ্কগ্রস্ত। এমন দুঃসাহসিক কাজ তারা করে ফেলবে, নিজেরাও তা কল্পনা করতে পারেনি। এমনকি তাদের কোনো নিশ্চয়তাও নেই যে, তারা কটেজে সঠিকভাবে পৌঁছাতে পারবে কি না।
প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছুই তারা সংগ্রহ করল- কুড়াল, হাতুড়ি, ড্রিল মেশিন এবং রেডিও। এমনকি তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত একটা পিস্তল এবং একটা পুরাতন মেশিনগানও জোগাড় করে ফেলল।
যদি কোনো কারণে স্ট্যাসির সদস্যদের কাছে ধরা পড়ে যাই, তাহলে নিজেদের রক্ষার জন্য আমরা অস্ত্রগুলো আমাদের সঙ্গে রেখেছিলাম।
– জোয়াকিম রুডলফ
খুবই আস্তে আস্তে, একদমই নিঃশব্দে তারা সুড়ঙ্গ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে যাত্রা শুরু করল। যখন তারা শেষ অবধি পৌঁছে গেল, তাদের মাথার উপর কেবল এখন কটেজের ফ্লোর। তখন বিকেল চারটা বাজে মাত্র। কটেজ লাগোয়া সড়কে পালাবার জন্য লোকজনের আনাগোনা বাড়ছে। যখন পালাবার আর কোনো পথই রইল না, তখনই চারপাশ থেকে স্ট্যাসি এজেন্টরা এসে তাদের সবাইকে ঘিরে ধরল। সবাইকে একত্র করে গাড়িতে নিল আর চলে গেল দূরে কোথাও।
নিচে তখনও জোয়াকিম, হাসো এবং উলি প্রাণপণ চেষ্টা করছে কটেজের মধ্যে ঢোকার। অথচ তাদের অভিযান যে ব্যর্থ হয়েছে, সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।
তখনই আমরা পশ্চিম থেকে আসা রেডিওর সংকেত শুনতে পাই। আমাদের ফিরে যাবার জন্য তারা চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু আমরা থামতে পারলাম না। কেননা, আমরা ভাবছিলাম যে কটেজে তখনও লোকজন আসছে; আর তাদের আশাকে আমরা নিরাশায় পরিণত করতে পারি না। – জোয়াকিম রুডলফ
অবশেষে তারা মেঝে ফুঁড়ে লিভিং রুমে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো। কিন্তু উপর থেকে সূর্যের আলো সুড়ঙ্গ অবধি পৌঁছে গেলেও তারা সাথে সাথেই উপরে উঠে এল না। প্রথমে আয়নার একটা ভাঙা টুকরো দিয়ে দেখে নিল, কেউ তাদের ধরার জন্য ওঁৎ পেতে আছে কি না। লিভিং রুমটাতে সোফা, চেয়ার এবং আসবাবপত্র ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সবকিছুই কেমন যেন এক নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে।
যেহেতু তারা এত দূর চলে এসেছে, সেহেতু ফেরার আর কোনো পথ নেই। তারা খুবই সতর্কতার সাথে মেঝেতে উঠে এল। নিজেদের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন তারা চেপে ধরে রেখেছিল। জোয়াকিম একদম বুকে ভর দিয়ে শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেল জানালার কাছে। মাথাটা খানিকটা উঠিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরে চোখ রাখল সে।
জানালাতে চোখ রাখামাত্রই আমি লোকটাকে দেখতে পেলাম। শক্তপোক্ত গড়নের শরীর; সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে। তীক্ষ্ণ চোখজোড়া যেন আমাদেরকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি তখন জানালার নিচে গুটিসুটি হয়ে পড়ে আছি। কেউ না বলে দিলেও, কোনো ইউনিফর্ম বা সংকেত না থাকলেও- আমি নিশ্চিত ছিলাম, লোকটা স্ট্যাসির এজেন্ট।
– জোয়াকিম রুডলফ
তারা মারাত্মক রকমের আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ল। তারা জানতো, অভিযান সফল হয়নি। কিন্তু তারা তখনও এটা জানত না যে, এই লিভিং রুমের দরজার ঠিক সামনেই একদল সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে; যাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে কালাশনিকভ*।
এখানে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল, যেটা এখনও ফাইলবন্দী করা আছে স্ট্যাসির সদর দপ্তরে। প্রতিবেদনে বলা আছে যে, সৈন্যরা কেবলই লিভিং রুমে ঢুকতে যাচ্ছিল, এমন সময় তারা সুড়ঙ্গ খননকারীদের মুখে মেশিনগান সম্পর্কিত কিছু একটা শুনতে পায়। তাই তারা সাময়িক বিরতি দেয় এবং সাহায্যের অপেক্ষায় থাকে। কেননা, একটা মেশিনগানের কাছে কয়েকটা কালাশনিকভ কিছুই না।
ঠিক এই সাময়িক বিরতিটাই বাঁচিয়ে দিয়েছিল খননকারীদের জীবন। তারা ইতোমধ্যেই সুড়ঙ্গে নেমে পড়েছে। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে যত দ্রুত সম্ভব পশ্চিমের দিকে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করেছে। তারা এতটাই দ্রুত চলছিল যে, তাদের পিঠে থাকা সরঞ্জাম আর অস্ত্রের ব্যাগটা দুলুনি খেয়ে আবার তাদের শরীরেই আঘাত করছিল।
তারা জানত, যেকোনো সময় সৈন্যরা দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করতে পারে। সুড়ঙ্গ ধরে তাদের অনুসরণ করতে পারে। এমনকি ডিনামাইট বা গুলি করে তাদের নিশ্চিহ্নও করে দিতে পারে। তাদের আশঙ্কামতোই ঘটেছিল, তবে প্রথমটুকু মিলে গেলেও পরেরটুকুর জন্য তাদের ভাগ্য সহায় ছিল। খানিক বাদেই সৈন্যদের দল দরজা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। কাউকে না পেয়ে তারা সুড়ঙ্গেও নেমে পড়ে। কিন্তু সুড়ঙ্গটা পুরোপুরি খালি। শূন্য।
মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সৈন্যদলের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল সুড়ঙ্গ খননকারীরা। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই নিজেদের প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল তারা। কিন্তু স্ট্যাসির সৈন্যরা একদম ব্যর্থ হয়নি এই অভিযানে। কেননা, জিজ্ঞাসাবাদ বা জেরা করার মতো বেশ কয়েকজন মানুষকে তুলে আনতে পেরেছিল তারা। শুরুতেই যদি স্ট্যাসি ঐ অভিযানটা না চালাত, তাহলে হয়তো তাদের শূন্য হাতেই ফিরতে হতো।
টীকা:
* কালাশনিকভ – বিশ্বের অন্যতম মারাত্মক আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭ এর উদ্ভাবক ছিলেন রাশিয়ার মিখাইল কালাশনিকভ। তাই রাশিয়ানরা একে-৪৭ কে কালাশনিকভ বলেই অভিহিত করে থাকে।