প্রাচীন ও মধ্যযুগে দুরপাল্লার পথ পাড়ি দেয়ার ক্ষেত্রে সমুদ্রপথকেই বেছে নেয়া হতো। আজকের মতো বিমান, ট্রেন কিংবা বাস সেই সময়ে ছিল না। স্থলপথে দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দেয়া ছিল একইসাথে বিপদসংকুল ও সময়সাপেক্ষ। তখন জাহাজই ছিল মূল ভরসা। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ব্যবসাবাণিজ্যের সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছিল সমুদ্রপথে। ব্যবসায়ী, যাত্রী কিংবা পরিব্রাজকেরা জাহাজে করে দীর্ঘ সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে একদেশ থেকে বা এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে বা দেশে যেতেন। তবে সমুদ্রপথও একেবারে নিষ্কণ্টক ছিল না। এই পথে জলদস্যুদের উৎপাত জনজীবনে আতঙ্ক তৈরি করতো। হুট করে এসে সবকিছু ডাকাতি করে নিয়ে যাওয়া কিংবা জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করতো তারা। তারা ছিল সাক্ষাৎ যমদূত।
জলদস্যুদের সমুদ্রপথে দস্যুপনার একটি বিশেষ কৌশল ছিল। সাধারণত জলদস্যুদের দেখলেই জাহাজের নাবিকেরা গতি বাড়িয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। তাই জলদস্যুরা এক নতুন কৌশল হাতে নিল। তারা বন্ধুভাবাপন্ন দেশের পতাকা জাহাজে টানিয়ে রাখা শুরু করলো, যাতে নাবিকেরা বুঝতে না পারে যে এটি জলদস্যুদের জাহাজ। এভাবে ছদ্মবেশ নিলে জাহাজের নাবিকদের কাছে অনায়াসে চলে যেতে পারতো জলদস্যুরা। ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ ব্যাপারটি এভাবেই এসেছে। ছদ্মবেশে প্রতিপক্ষের উপর আক্রমণ চালানোকেই মূলত ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ বলা হতো। তাই এটি বলাই যেতে পারে যে ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।
আধুনিক সময়ে ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ এর অর্থ কিছুটা বদলে গিয়েছে। বর্তমানে এটি দ্বারা নির্দেশ করা হয় এমন কোনো গোপন নেতিবাচক কার্যক্রমকে, যেটি এক পক্ষ সংঘটিত করলেও আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যেন আরেকপক্ষ সেটি সংঘটিত করেছে। অর্থাৎ একপক্ষ কোনো অপরাধ না করেও ফেঁসে যেতে পারে। উদাহরণ দিলে বুঝতে আরেকটু সহজ হবে।
ধরুন, আপনি ‘ক’ এমন একটি এলাকায় বসবাস করেন, যেখানে ‘খ’ এর সাথে আপনার সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। এখন ‘খ’-কে ফাঁসিয়ে দেয়ার জন্য আপনি নিজের ঘরে নিজেই অগ্নিসংযোগ করলেন বা রাতের অন্ধকারে আপনার কাঁচা ফসলগুলো কেটে রেখে দিলেন। স্বাভাবিকভাবে আপনার ক্ষতি হয়েছে, এমন কাজগুলোর জন্য দায়ী করা হবে ‘খ’-কে, কারণ সে আপনার শত্রু। এখন হয়তো আপনি ন্যায়বিচারের জন্য সালিসের দ্বারস্থ হবেন এবং সালিসে ‘খ’-কে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করা হবে। এভাবে আপনি নিজের ক্ষতি করে হলেও ‘খ’-কে একচোট দেখে নেবেন। আপনি নিজের ক্ষতি করার জন্য যে কাজগুলো করেছেন, এটিই ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। অর্থাৎ গোপন নেতিবাচক কাজটি সম্পন্ন করবেন আপনি, অথচ এর দায় বর্তাবে আপনার শত্রুর হাতে।
ইতিহাসে অনেকবারই ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ এর ব্যবহার দেখা গিয়েছে। শুরুতে হিটলারের ‘রাইখস্ট্যাগ ফায়ার’ দিয়েই শুরু করা যাক।
জার্মানিতে হিটলারের যখন উত্থান ঘটছে, তখন কমিউনিস্টদের সাথে হিটলারের রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছিল৷ তখন জার্মানির রাস্তায় হিটলারের উগ্র ডানপন্থীদের সাথে বামপন্থী জার্মান কমিউনিস্টদের সহিংসতা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। হিটলার কমিউনিস্টদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানোর জন্য একটি অজুহাত খুঁজছিলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানির তৎকালীন পার্লামেন্ট রাইখস্ট্যাগে আগুন দেয় হিটলারের প্রতিনিধিরা, কিন্তু দোষ চাপানো নয় একজন ডাচ কমিউনিস্টের উপর। পুরো জার্মানিতে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। যেসব জার্মান মধ্যবিত্ত ও পুঁজিপতিরা কমিউনিস্ট বিপ্লবের আশঙ্কায় সম্পদ হারানোর ঝুঁকিতে ছিলেন, তারাও এই সুযোগে কমিউনিস্ট দমনে হিটলারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। এভাবে হিটলার তার নিজ দেশের পার্লামেন্টকে পুড়িয়ে ফেললেও সেটার দায় বর্তায় কমিউনিস্টদের ঘাড়ে। ফলে তাদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানোর বৈধতার সুযোগ তৈরি হয়।
১৯৫৪ সালের কথা। মিশরে তখন মুসলিম ব্রাদারহুডের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। অপরদিকে ব্রিটিশদের একটি অংশ সুয়েজ খাল থেকে ব্রিটিশ সেনাদের অপসারণ চাচ্ছে, আরেকটি অংশ সৈন্যদের বহাল রাখতে চাচ্ছে। আমেরিকা চাচ্ছে মিশরে দানা বেঁধে ওঠা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন সফল হোক। কিন্তু এই আন্দোলন সফল হলে ব্রিটিশ সৈন্যরা মিশরের মাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হবে, যেটি ইসরায়েলের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক হবে না। ইসরায়েলের আশঙ্কা ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের সরকার ইসরায়েলে সামরিক আক্রমণের দিকে পথ বাড়াবে। তাই ইসরায়েলে মিশরে বোমা হামলার পরিকল্পনা করে। এগুলোর দায়ভার যেন মুসলিম ব্রাদারহুডের উপর বর্তায়, সে ব্যবস্থাও তারা করে রেখেছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশরা যেন মিশরে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের সরকার ইসরায়েলে কোনো আক্রমণ পরিচালনা করতে না পারে। মিশরে ইসরায়েলের এই বোমা হামলা ছিল ‘ফলস ফ্ল্যাগ মিশন’।
১৯৩৯ সাল। হিটলার পোল্যান্ডে আক্রমণ চালাবেন। কিন্তু তার দরকার একটি যুতসই কারণ, যেটি পোল্যান্ডে তার আক্রমণকে বৈধতা দিবে। তিনি তার সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্যকে দিয়ে জার্মানি ও পোল্যান্ডের সীমান্তবর্তী স্থানে জার্মানির সীমানায় অবস্থিত একটি রেডিও স্টেশনে হামলা করালেন। তার সৈন্যরা আক্রমণের পর সুপরিকল্পিতভাবে ঘোষণা দিল যে সেই রেডিও টাওয়ারসহ পুরো এলাকাটি এখন পোল্যান্ডের অংশ হিসেবে গণ্য হবে। হিটলার পরের দিন ঘোষণা দিলেন যে পোল্যান্ড তার দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে এবং পোল্যান্ডে সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করলেন।
ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে। আধুনিক সময়ে শত্রুর উপর হামলা চালানোর বা যু্দ্ধ ঘোষণা করার প্রেক্ষাপট রচনার ক্ষেত্রে ‘ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন’ একটি বহুল চর্চিত পদ্ধতি। এক্ষেত্রে এই কৌশল বেশ কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হলেও এটি দিনশেষে রক্তপাত বৃদ্ধিতেই সহায়তা করে।