‘আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট’- পৃথিবীর বুকে যত প্রভাবশালী, ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী নেতাদের আবির্ভাব হয়েছে, তাদের মধ্যে আজও তিনি সবচেয়ে বেশি সমাদৃত। নিষ্ঠুর, প্রচণ্ড উচ্চাকাঙ্ক্ষী, অপরাজেয় এই বীরযোদ্ধা তার শাসনামলে মেসিডোনিয়া থেকে পারস্য পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল জুড়ে যে রাজত্ব কায়েম করেছিলেন তা অতীতে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই অপরাজেয় সমরবিদ ইতিহাসের অন্যতম সফল সেনানায়ক হিসাবে পরিগণিত হন।
আলেক্সান্দ্রিয়া, বর্তমান মিশরের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, কায়রোর পরই যার অবস্থান। অতীতেও আলেক্সান্দ্রিয়া ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। আলেক্সান্ডারের মিশর দখলের পর তার নামানুসারে নামকরণ করা হয় শহরটির। ৩৩২ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে আরবদের দ্বারা মিশর আক্রমণের পূর্বে এই শহরটিই ছিল আলেক্সান্ডার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মিশরের রাজধানী। হেলেনীয় যুগে এই শহরটিই হয়ে উঠেছিল আধুনিক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র।
৩২৩ খ্রিস্টপূর্বে আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পরে সাম্রাজ্যের এই অংশের শাসনভার অর্পিত হয় তার অন্যতম সেনাপ্রধান প্রথম টলেমির ওপর। শাসক হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই টলেমি বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাদের মন জয় করা ছাড়া খুব বেশি দিন শাসনে টিকে থাকা যাবে না, কারণ মিশরীয়দের চোখে টলেমীয়গণ তাদের স্বদেশী শাসক নয়, তাদের দেহে বইছে না প্রাচীন মিশরীয়দের বিশুদ্ধতম রক্ত। তাই জনসাধারণের মনে স্থান পেতে টলেমীয় শাসকগণ নিজেদের কখনো ফারাও বলে দাবি করেছেন। তাছাড়াও গ্রিক ও মিশরীয়দের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করতে সেরাপিস নামক গ্রিক-মিশরীয় দেবতার উপাসনা প্রচলন করেন, সেই সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও শিক্ষাখাতে পৃষ্ঠপোষকতা ও পণ্ডিতদের মোটা অংকের বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন। এই পৃষ্ঠপোষকতার ফলাফল হচ্ছে The royal library of Alexandria।
প্রায় ৭ লাখ প্যাপিরাসের স্ক্রলের আধার এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২৮৮ খ্রিস্টপূর্বে প্রথম টলেমির নির্দেশে। টলেমির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হলেও এই গ্রন্থাগারের পেছনে যার সবচেয়ে বেশি অবদান তার নাম দিমিত্রাস অব ফেলিরোন। তিনি থ্রিওফাস্টাস, মতান্তরে অ্যারিস্টটলের ছাত্র ছিলেন। অ্যারিস্টটলের লাইসিয়ামের আদলেই গড়ে উঠেছিল পাঠাগারটি।
এই ৭ লাখ স্ক্রল, যা বর্তমানে প্রায় ১ লাখ মুদ্রিত বইয়ের সমতুল্য, এতে লেখা ছিল গণিত, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, ভূগোল, আইন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানের নানা মূল্যবান তথ্য। কালের আবর্তনে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এই পাঠাগার নিয়ে অনেক চমকপ্রদ উপকথা ছড়িয়ে আছে, আছে অনেক ইতিহাস।
বিভিন্ন মহাদেশের অসংখ্য পণ্ডিতের পদচারণায় মুখরিত থাকতো এই গ্রন্থাগার। ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি অঞ্চল থেকে পণ্ডিতরা এখানে এসে জড়ো হয়েছিলেন। আগত জ্ঞানান্বেষীরা এখানে সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনা, গবেষণা, ভাষণ প্রদান ও পাণ্ডুলিপি পুনর্লিখনের কাজে নিয়োজিত থাকতেন। জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ কোনো ভেদাভেদ ছিল না এই পাঠাগারে।আলেক্সান্দ্রিয়ার একজন নারী গণিতবিদের নাম অনেকেরই জানা- হাইপেশিয়া। এই পাঠাগার শুধু ইতিহাসবিদ নয়, সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য এক তীর্থস্থান হিসাবে গণ্য করা হতো। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল এই পাঠাগার থেকেই।
এখানে বসেই অ্যারিস্টারকাস বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত ঘুরছে, তা-ও কোপার্নিকাসের ১,৮০০ বছর পূর্বে। ইউক্লিড লিখেছিলেন Elements of Geometry, যা এখনো জ্যামিতি নিয়ে লেখা সবচেয়ে সফল এবং প্রভাবশালী পাঠ্যপুস্তক হিসাবে বিবেচিত হয়। এখানে জমাকৃত স্ক্রলগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে হেরোফিলাস বলেছিলেন, মানব মস্তিষ্কই হচ্ছে শরীরের নিয়ন্ত্রক এবং উন্মোচিত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের এক নতুন অধ্যায়।
বিজ্ঞানীদের নাম ও কীর্তি এখানেই শেষ নয়। ধারণা করা হয় অ্যাপোলোনিয়াস ও আর্কিমিডিস এর মতো জ্ঞানীরাও কোনোকালে এই পাঠাগারে এসেছিলেন তাদের জ্ঞান তৃষ্ণা মেটাতে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে আসা পণ্ডিতেরা এখানে সহনশীলতা, সমঝোতা ও সার্বজনীন জ্ঞানের আলয় গড়ে তুলেছিলেন। সময়ের স্রোতে আজ মূল পাঠাগারের শুধু ভগ্নাংশই বাকি আছে।
বই সংগ্রহের কৌশল
পাঠাগারটির সবচেয়ে বেশি বিকাশ সাধিত হয় প্রথম তিনজন টলেমীয় শাসনামলে। তারা জ্ঞান সংগ্রহকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছিলেন যে, কোনো জাহাজ আলেক্সান্দ্রিয়া বন্দরে এসে পৌঁছালে সবার আগে তন্ন তন্ন করে খোঁজা হতো নতুন কোনো স্ক্রল আছে কিনা। স্ক্রল সংগ্রহের জন্য মিশরের শাসকেরা কিছু লোক নিয়োগ করেছিলেন যাদের কাজ ছিলো জাহাজে আসা মানুষজনের কাছে কোনো ভালো স্ক্রল পেলে সেটার কপি তৈরি করে যতদ্রুত সম্ভব মূল স্ক্রলটি লাইব্রেরিতে দেওয়া। তাছাড়া শাসকেরা এথেন্সের বইমেলা থেকেও অনেক বই সংগ্রহ করতেন। কথিত আছে, একবার এথেন্সে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে মিশরের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয় যে, তাদের মজুদে থাকা বইগুলোর বিনিময়ে খাদ্য প্রদান করা হবে।
টলেমি ইউর্গারটাসের শাসনামলে তিনি এথেন্সের শাসকের কাছে Aeschylus, Sophocles এবং Euripides নাটকগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্করণ চেয়ে অনুরোধ করেন। আর বইগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জামিন হিসাবে এথেন্সকে দিতে হয়েছে প্রচুর পরিমাণে মূল্যবান ধাতু, যার বর্তমান মূল্য প্রায় কয়েক লাখ মার্কিন ডলার।
আলেক্সান্দ্রিয়ার এই বিখ্যাত পাঠাগারটি কিভাবে ধ্বংস হয়েছিল তা নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। তবে এই ক্ষেত্রে ঘুরে ফিরে যাদের নাম বারবার শুনতে পাওয়া যায় তারা হলেন- রোমান সেনানায়ক জুলিয়াস সিজার, আলেক্সান্দ্রিয়ার বিশপ থিওফিলাস ও মুসলিম খলিফা হযরত ওমর (রা)।
জুলিয়াস সিজার কর্তৃক মিশর আক্রমণ
জুলিয়াস সিজার ও ক্লিওপেট্রার সময় থেকেই ধীরে ধীরে পাঠাগারটি ক্ষয় হতে থাকে। রোমান লেখকদের বিভিন্ন বই থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ৪৮ খ্রিস্টপূর্বে সিজার যখন মিশর আক্রমণ করেন তখন দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে পাঠাগারটি ভস্মীভূত হয়। প্লুটার্কের বিবৃতিতে জানা যায়, শত্রুপক্ষ যখন তার জাহাজ আক্রমণ করে, তখন নিজেকে বাঁচানোর জন্য তিনি জাহাজের চারপাশে আগুন দিয়েছিলেন এবং আগুন পরবর্তীতে বন্দর থেকে আলক্সান্দ্রিয়া লাইব্রেরি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং আগুনে পাঠাগারটির সঞ্চিত স্ক্রলগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
যদিও প্লুটার্কের এই মতের সাথে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করেন। গ্রিক ইতিহাসবিদ স্ট্রাবো তারও প্রায় ৩০ বছর পর তার লেখায় আলেক্সান্ড্রিয়ার জাদুঘরের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন, আর গ্রন্থাগারটি জাদুঘরের ঠিক ভেতরেই অবস্থিত ছিল। সিজারের আক্রমণের সময় রয়্যাল লাইব্রেরির ক্ষতি হলেও তা পুরোপুরি বিনষ্ট হয়নি এই সময়ে। মার্ক অ্যান্টনি পরবর্তীতে ক্লিওপেট্রাকে প্রায় ২ লাখ প্যাপিরাসের স্ক্রল দিয়েছিলেন কিছুটা হলেও ক্ষতিপূরণ করতে।
খ্রিস্টান ধর্মের আধিপত্য ও থিওফিলাসের প্যাগান দমন
২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে বেশ কয়েকবার রোমানরা মিশর আক্রমণ করেছে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। ২৭২ খ্রিস্টাব্দে পালমাইরার (বর্তমান সিরিয়া) রানী জেনোবিয়া ও রোমান সম্রাট অ্যারেলিয়ানের মধ্যে হওয়া যুদ্ধে বিদ্রোহ দমন করতে অ্যারেলিয়ান লাইব্রেরির যে অংশটুকু অক্ষত ছিল সেখানে অগ্নিসংযোগ করে লাইব্রেরিটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় বলে ধারণা করা হয়।
প্রথম খ্রিস্টাব্দে সেইন্ট মার্কের হাত ধরেই আফ্রিকায় খ্রিস্টান ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। আলেক্সান্দ্রিয়ায় যিশু খ্রিষ্টের অনুসারীরা গড়ে তোলে চার্চ। অচিরেই তাদের ওপর নেমে আসে রোমানদের অত্যাচার।খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের অনেকে আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে পালিয়ে যায় রোমানদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে। অবশেষে যখন কন্সটেন্টাইন দ্য গ্রেট খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন, তখন ধীরে ধীরে সেখানে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
৩৯১ সালে সম্রাট থিওডোসিয়াস খ্রিস্টধর্ম ছাড়া বাকি সকল ধর্ম নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেন। তার নির্দেশে বিশপ থিওফিলাস প্যাগানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সকল মন্দির বন্ধের নির্দেশ দেন। প্যাগানরা অস্বীকৃতি জানালে প্যাগান মূর্তি ভাঙ্গার জন্য পুনরায় পাঠাগারটিতে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। যেহেতু স্ক্রলগুলোর অধিকাংশ প্যাগান ধর্মের সাথে সম্পর্কিত ছিল, তাই স্ক্রলগুলোতেও আগুন দেওয়া হয়। এভাবেই হারিয়ে যায় অমূল্য প্যাপিরাসের গায়ে লিখে রাখা নানা মূল্যবান তথ্য।
ওমর (রা) এর মিশর জয়
৬৪১ সালে মুসলিমরা আমর ইবন আল-আস এর নেতৃত্বে মিশর আক্রমণ করেন। তিনি খলিফাকে লিখে পাঠান এই স্ক্রলগুলোকে কী করবেন? উত্তরে খলিফা ওমর (রা) নাকি বলেছিলেন, যদি এগুলো কুরআনকে সমর্থন করে তাহলে রেখে দাও আর যদি না করে তাহলে ধ্বংস করে ফেল। যদিও এই বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো দলিল এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। সিরিয়ান এক খ্রিস্টান লেখকের বইয়ে সর্বপ্রথম এই ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই অনেকেই ধারণা করেন, ওমর (রা) এর মর্যাদাহানির জন্যই এই কাহিনী বানানো হয়েছে। তাছাড়াও মুসলিম আক্রমণেরও প্রায় ২০০ বছর আগে অর্থাৎ ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পাঠাগারটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ৪১৫ সালে বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ হাইপেশিয়াকে সিরিলের অনুসারীরা নির্মমভাবে হত্যার পরই বেঁচে থাকা পণ্ডিতেরা আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে পালিয়ে যান। দার্শনিক, ব্যাকরণবিদ, ভূগোলবিদ ও চিকিৎসকগণ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েন ও শিক্ষকতার মাধ্যমে তাদের জ্ঞান ছড়িয়ে দেন।
অনেকে মনে করেন, ধর্মান্ধতা হচ্ছে আলেক্সান্দ্রিয়ার রয়্যাল লাইব্রেরিটির ধ্বংসের কারণ। আবার অনেকে বলেন, পাঠাগারটি ধ্বংস হয়েছে বাজেট-স্বল্পতায়। তাছাড়াও অষ্টম টলেমীর সময় বাজেট স্বল্পতার কারণে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়ে যায়। আরও উল্লেখ করা উচিত যে ব্যাপারটি সাধারণত প্যাপিরাসের ওপর লেখা টিকে থাকে ২০-৩০ বছর। কম আর্দ্র স্থানে আরেকটু বেশি সময় টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকে। তাই যদি পাণ্ডুলিপিগুলো পুনরায় লেখা না হয়, তবে কালের আবর্তনে এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যায়।
পাঠাগারটি ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে বেশ কয়েক শতাব্দীর অর্জিত জ্ঞানও হারিয়ে গেছে। যে কারণেই পতন হোক না কেন, এরকম একটি মূল্যবান সংগ্রহশালার পতন মানবজাতিকে পিছিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া পাঠাগারটির সাথে হারিয়ে গেছে প্রাচীন অনেক শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীর কীর্তিগুলোও।
ফিচার ইমেজ : thesociable