রোমের রাস্তা ধরে ধীর পায়ে ফোরামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি। তার উষ্কখুষ্ক চুল, দীর্ঘ ও অপরিষ্কার দাড়ি, ছিন্নভিন্ন পোশাক আর চলাফেরা দেখে হঠাৎ করে তাকে বর্বর বলে ভ্রম হতে পারে। কিন্তু ওয়াকিবহাল পথচারীরা সরে দাঁড়াচ্ছিলেন। কে তিনি? বেখবর রোমবাসীদের এই প্রশ্নের জবাবে তারা জবাব দিলেন, “তিনি রোমান সেনাবাহিনীর একজন বীর সেঞ্চুরিয়ন। অনেক লড়াইতে তিনি অংশ নিয়েছেন এবং রোমের অনেক জয়ের সাক্ষী আজকের এই ভিখারিবেশী বৃদ্ধ।”
এককালের সেঞ্চুরিয়ন ফোরামে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে তার দুর্ভাগ্যের কথা জানান দিলেন। তিনি একজন প্লেবেইয়ান। বছরের পর বছর ধরে রোমের জন্য যুদ্ধে ব্যস্ত থাকায় নিজের খামারে সময় দিতে পারেননি। উপরন্তু শত্রুদের হামলার সময় তার খামার ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো। পরিবার পরিজন নিয়ে বাঁচতে তিনি বারবার ধনী প্যাট্রিশিয়ানদের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু রোমের ডাকে সাড়া দিয়ে বারবার যুদ্ধে যাওয়ার ফলে সেই ঋণ শোধ করার সামর্থ্য তার হয়নি।
ফলে ধীরে ধীরে তিনি সব সম্পত্তি হারিয়ে আজ নিঃস্ব। তার সর্বশেষ অধিকার, নিজের স্বাধীনতা, তা-ও আজ ধনী প্যাট্রিশিয়ান ঋণের দাবিতে ছিনিয়ে নিয়ে তাকে দাসে পরিণত করতে চলেছে। “এটাই কি রোমের জন্য লড়াই করার পুরস্কার?” জনসমক্ষে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বৃদ্ধ সেঞ্চুরিয়ন ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখিয়ে জানতে চাইলেন। “কখনোই না!” সমবেত জনতা গর্জে উঠল। বৃদ্ধ সেঞ্চুরিয়নের কাহিনী শুনে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হলো প্রবল চাঞ্চল্য।
ইতোমধ্যে রোমের অনেক দিক থেকে আরও প্লেবেইয়ান এসে উপস্থিত। তাদের দুর্ভাগ্যের আরো ঘটনা বর্ণনা করলে উপস্থিত জনতার চাঞ্চল্য পরিবর্তিত হয় জনরোষে। তারা পাশে থাকা সিনেট ভবন ঘেরাও করে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার দরুন প্যাট্রিশিয়ান অভিজাত কর্তৃক রোমান নাগরিকদের দাসে পরিণত করা বন্ধ করার জন্য সোচ্চার হয়। কন্সালদের সাথে দেখা করে তারা অবিলম্বে আইন সংশোধনের দাবী জানায়।
কন্সালরা তাদের শান্ত হবার অনুরোধ জানিয়ে সিনেটরদের সাথে জরুরি বৈঠক ডাকেন। যথেষ্ট সংখ্যক সিনেটর সেখানে না থাকায় বৈঠক শুরু হতে দেরি হচ্ছিল। যারা বাড়িতে ছিলেন তারাও উত্তেজিত জনতার ভিড় ঠেলে সিনেটে আসতে সাহস পাচ্ছিলেন না। এতে সাধারণ রোমানরা মনে করলো তাদের দাবী মানতে গড়িমসি করা হচ্ছে। এতে তারা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত সিনেটররা অনুধাবন করেন যে, বাড়িতে থাকলেই বরং উত্তেজিত জনতার হামলার আশঙ্কা আছে, তাই তারা সিনেটে এসে হাজির হন।
উপরের ছোট্ট ঘটনাটি প্রাচীন ঐতিহাসিক লিভির যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘অ্যাব উরবে কনডুইটা (Ab Urbe Condita)’ বা ল্যাটিন ভাষায় রচিত রোমের ইতিহাসের থেকে উদ্ধৃত। প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ানদের মধ্যে সংঘাতের প্রথম ফুলকি এখান থেকেই রচিত হয় বলে তিনি দাবী করেন। ইতিহাসে রোমের দুই সামাজিক শ্রেণীর এ লড়াই ‘স্ট্রাগল অফ দ্য অর্ডার’ বা ‘কনফ্লিক্ট অফ দ্য অর্ডার’ নামে বিখ্যাত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ থেকে ২৮৭ অব্দ পর্যন্ত চলমান এ সামাজিক সংগ্রামের মাধ্যমে রোমান রিপাবলিকের সমাজ ও প্রশাসন ব্যবস্থা ক্রমে ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে মোটামুটিভাবে একটি সুস্থির অবস্থায় আসে।
রোমান সমাজে শ্রেণীবিন্যাস
প্যাট্রিশিয়ান: এরা ছিল সমাজের অভিজাতশ্রেণী। এদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন রোমের আদি বাসিন্দা এবং তাদের রক্ত সম্পর্কিত বংশধরেরাই প্যাট্রিশিয়ান বলে গণ্য হত। প্যাট্রিশিয়ানরা রোমান সিনেটের সদস্য হতে পারত। তারা আজীবন সেই পদ অধিকার করে থাকতে পারত। তারা রাষ্ট্রের সবরকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। আইন প্রণয়ন, যুদ্ধ পরিচালনাসহ রোমের নিজস্ব ও দখলকৃত এলাকার ভূসম্পত্তি তারাই অধিগ্রহণ করত, যদিও আইন অনুযায়ী তা সাধারণ জনতার মধ্যে ভাগ করে দেয়ার কথা ছিল।
প্লেবেইয়ান: প্লেব শব্দের অর্থ ‘অনেক’। প্যাট্রিশিয়ান ও দাস ছাড়া রোম ও তার আশেপাশের এলাকায় যারা বসবাস করত তাদের সবাইকে লিভি প্লেবেইয়ান বলে বর্ণনা করেছেন। রোমের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এদের মাঝে ছিল কৃষক, কারিগর, সাধারণ শ্রমিক থেকে শুরু করে অন্যান্য পেশার মানুষ, যাদের কোনোরকম রাজনৈতিক অধিকার তো ছিলই না, অধিকন্তু তাদের সামাজিক অধিকারও ছিল অত্যন্ত সীমিত। রোমের নাগরিক হলেও অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতো তাদের দিন কাটাতে হতো। তাদের অধিকাংশই ছিল দরিদ্র এবং প্যাট্রিশিয়ানদের কাছে ঋণগ্রস্ত। যেকোনো যুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে তাদের সেনাবাহিনীতে অংশ নিতে হতো।
এখানে বলে নেয়া আবশ্যক যে আধুনিক অনেক ঐতিহাসিক এই সামাজিক বিভাজনকে অতি সরলীকরণের দোষে দুষ্ট বলে মনে করেন। তাদের মতে প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ান জটিল কাঠামোবদ্ধ রোমান সমাজের চরম বিপরিতপ্রান্তকে নির্দেশ করে, যেখানে প্যাট্রিশিয়ানরা সমাজের উচ্চতম এবং প্লেবেইয়ানরা দরিদ্র ও নিগৃহীত, সমাজের শেষপ্রান্তে যাদের অবস্থান। এর মধ্যখানে ছিল প্যাট্রন, যারা সম্পদশালি কিন্তু অভিজাত নয়; ক্লায়েন্ট, যারা প্যাট্রন অথবা প্যাট্রিশিয়ানদের জমিতে জীবন ও জীবিকার বিনিময়ে কাজ করত। তবে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা লিভির সরলীকরণকে ধরে নিয়েই অগ্রসর হব।
রোমান প্রজাতন্ত্রের প্রাথমিক অবস্থা
মনে রাখতে হবে, রোমের প্রথমদিকে তা ছিল মূলত ক্যাপিটোলাইন, প্যালাটাইন ও পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষের সমষ্টি, বিশাল বিশাল স্থাপনা আর মনোরম কারুকার্য শোভিত মহানগরী নয়। চারদিকে শক্তিশালী প্রতিবেশী দিয়ে পরিবেষ্টিত রোমকে তার প্রতিরক্ষা ও সীমানা বিস্তারের জন্য প্রায়শই যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছে। আজ হয়তো পরাজিত শত্রুর লুণ্ঠিত পণ্যসামগ্রী নিয়ে শহরে উৎসব চলছে, পরদিনই আবার অন্য আরেক শত্রু শহরের দোরগোড়ায় উপস্থিত। এজন্য তার সমাজ ছিল সামরিক মনোভাবাপন্ন।
রাজতন্ত্রের পতনের পরবর্তী অস্থিরতার মধ্যে রোম কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। টার্কুইনাসের সিংহাসন পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা প্রতিরোধের সাথে যুক্ত হয় ইট্রুস্কান রাজাদের সাথে বিরোধ। তা শেষ হতে না হতেই একুই আর ভলসিদের সাথে লড়াই। এ সময় পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল জুড়েই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছিল। গ্রীকদের সাথে পার্সিয়ানদের সংঘাত, কার্থেজের সাথে ইটালিয়ান উপদ্বীপের অন্যান্য জাতির মনোমালিন্য এবং ইরট্রুস্কান ও কিউমিদের মধ্যে চলছিল উত্তেজনা।
আমরা এখানে লিভির বর্ণনা অনুসরণ করবো। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মধ্যে এর খুঁটিনাটি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ঘটনার ধারা অনেকটা এরকমই ছিল এ বিষয়ে তারা মোটামুটি একমত।
লিভির মতে, ভার্জিনিয়াস ও ভেটুসিয়াস কন্সাল নির্বাচিত হওয়ার পর তারা লক্ষ্য করলেন- অ্যাভেন্টাইন পাহাড়ে রাতের বেলা প্রায়শই প্লেবেইয়ানরা শলা-পরামর্শের জন্য মিলিত হয়। রোম তখন ইতালীয় অনেক গোত্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এদিকে প্লেবেইয়ানরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল। এতে ভীত হয়ে তারা সিনেটের সভা আহবান করলেন। তারা জানতেন প্লেবেইয়ানদের মূল ক্ষোভ ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় দাসত্বে আবদ্ধ হওয়া নিয়ে।
তখন সিনেটর টাইটাস প্রস্তাব করলেন সকল রোমান নাগরিকের ঋণ মওকুফ করে দিতে এবং এই কারণে যারা দাস হয়েছে সকলকে মুক্ত করে দিতে। পাব্লিয়াসের মত ছিল শুধুমাত্র যারা যুদ্ধে যাওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি তাদের এই সুবিধা দিতে। অন্যদিকে সিনেটর ক্লডিয়াস কোনো ঋণ মওকুফের তীব্র বিরোধিতা করে একজন ডিক্টেটর নিয়োগ দিতে পরামর্শ দেন যিনি প্লেবেইয়ানদের বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করবেন। তার প্রস্তাবই গৃহীত হয় এবং ভ্যালেরিয়াসকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়। তার নেতৃত্বে রোমানরা একুই ও ভলসিদের পরাজিত করার পর তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। এদিকে রোমান সিনেট প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যুদ্ধের পর প্লেবেইয়ানদের ঋণ মওকুফের পদক্ষেপ নেয়া হবে। দিনের পর দিন পার হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু সেরকম কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছিল না।
প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ানদের সংঘাতের প্রেক্ষাপট
বেশিরভাগ প্লেবেইয়ান ছিল দরিদ্র শ্রেণীর। তারা শহরের বাইরে তাদের ছোট খামারে কাজ করত। কিন্তু রোম অধিকাশ সময় যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণে তাদেরকে দীর্ঘ সময় খামার থেকে দূরে থাকতে হত। এছাড়া অনেক সময়ই যুদ্ধগুলো সংঘটিত হতো রোমের আশেপাশে, যাতে তাদের অনেকের খামার ও ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যেত। এসব কারণে তারা প্যাট্রিশিয়ানদের থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হতো, কিন্তু একই কারণে সেই ঋণ পরিশোধ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলত। ফলে তাদের যাবতীয় জমিজমা, সহায়-সম্পত্তি প্যাট্রিশিয়ানরা দখল করে নিত এবং চরম পরিস্থিতিতে তাদেরকে এবং তাদের পরিবার পরিজনকে দাসে পরিণত করত। তৎকালীন অনেক রোমান নাগরিক এভাবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। মূলত এর ফলেই প্লেবেইয়ানদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছিল।
প্যাট্রিশিয়ানরাই সিনেট নিয়ন্ত্রণ করত। রাজতন্ত্রের পতনের পর প্লেবেইয়ানরা অবস্থার উন্নতি হবে আশা করলেও তা বাস্তবে রূপ পায়নি, বরং একজন স্বৈরাচারের কাছ থেকে কয়েকজন স্বৈরাচারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় মাত্র। কন্সালরা ছিল প্যাট্রিশিয়ান, সিনেট প্যাট্রিশিয়ান, রাষ্ট্রের সমস্ত পদ প্যাট্রিশিয়ানদের অধিকারে। তারা তাদের ইচ্ছামতো আইন বানাত আর সবাইকে তা মানতে হতো। সমস্ত জমিজমা, যুদ্ধের লব্ধ সম্পদ সবই তারা নিয়ে যেত। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্লেবেইয়ানদের কোনো কণ্ঠ ছিল না, যদিও তারা যেকোনো যুদ্ধে পদাতিক হিসেবে বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য থাকতো এবং সেনাবাহিনীর একটা বড় অংশ তাদের নিয়েই গঠিত হত।
প্যাট্রিশিয়ানরা প্লেবেইয়ানদের রোমের নাগরিক হিসেবেই গণ্য করত না। প্লেবেইয়ানদের বাস ছিল মূলত অ্যাভেন্টাইন পাহাড় জুড়ে, যা রোমের সীমানাপ্রাচীরের মধ্যেই ছিল। কিন্তু অ্যাভেন্টাইন রোম প্রপার, বা রোমের ধর্মীয় প্রাচীর যাকে পোমেরিয়াম বলা হত, তার বাইরে গণ্য হত। পোমেরিয়াম শুধুমাত্র ক্যাপিটোলাইন আর প্যালাটাইন পাহাড়কে ঘিরে ছিল, যেখানে প্যাট্রিশিয়ানরা বসবাস করত।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪ অব্দ: সংঘাতের সূত্রপাত – প্রথম সেসেশান
শেষ পর্যন্ত ৪৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্লেবেইয়ানদের ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। তারা সিসিনার নামে এক নেতার নেতৃত্বে শহর ত্যাগ করে রোমের উত্তরে এনিও নদীর অপর তীরে স্যাক্রেড মাউন্টে গিয়ে ওঠে, এবং দাবী মেনে না নিলে পাকাপাকিভাবে রোম ত্যাগ করে এখানে তাদের বাসস্থান গড়ে তোলার হুমকি দেয়। প্লেবেয়াইনদের অনুপস্থিতিতে রোমের স্বাভাবিক সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। সেনাবাহিনীর বড় অংশ হারিয়ে সিনেটররাও শহরের সুরক্ষার ব্যাপারে ভীত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আলোচনার জন্য তারা মেনেসিয়াসকে প্রেরণ করেন।
প্যাট্রিশিয়ানরা প্লেবেইয়ানদের ঋণ মওকুফের দাবী মেনে নেয় এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য প্লেবেইয়ানদের মধ্য থেকে দুইজন ট্রিবিউন (tribuni plebei) এবং তাদের সাহায্যকারী হিসেবে এডিল (Aediles) নিযুক্ত করে। এরা সিনেট ও অন্যান্য কমিটিতে প্লেবেইয়ানদের হয়ে কথা বলত এবং কোনো আইন প্লেবেইয়ানদের স্বার্থের পরিপন্থী হবে মনে করলে তারা ভেটো দিতে পারত। তাদের নিরাপত্তা বিধান করত রাষ্ট্র। লিসিনাস ও অ্যালবিনাস প্রথমে ট্রিবিউন হিসেবে দায়িত্ব নেন। প্রথমে দুজন হলেও পরে তাদের সংখ্যা দশজনে উন্নীত হয়।
প্লেবেইয়ানরা নিজেদের কমিটি করার রাষ্ট্রীয় অনুমতি পায়। তাদের এই কমিটির নাম ছিল প্লেবেইয়ান কাউন্সিল (Concilium Plebis)। তারা আইন পাশ করতে পারত, তবে তা শুধুমাত্র প্লেবেইয়ানদের উপর কার্যকর হতো। প্যাট্রিশিয়ানদের উপর এর কোনো প্রভাব ছিল না।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৩-৪৫৩ অব্দ
রোম এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। প্লেবেইয়ানরা তাদের নব্য অধিকার ব্যবহার করে রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করছিল, অন্যদিকে প্যাট্রিশিয়ানদের মধ্যে প্লেবেইয়ান বিরোধী মনোভাব ছিল ক্রমবর্ধমান। রোমে দুই পক্ষের মধ্যে বিবাদ দিনে দিনে বাড়ছিল, যার ফলশ্রুতিতে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধিশালী রোমের অবক্ষয়ের সূচনা হয়। নিজেদের সদ্যপ্রাপ্ত ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে প্লেবেইয়ানরা অনেক ক্ষমতাশালী প্যাট্রিশিয়ানদের হয়রানি করা শুরু করে, প্যাট্রিশিয়ানরাও পাল্টা তাদের অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আনতে থাকে।
মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে ৪৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, যার পুনরাবৃত্তি ঘটে ৪৫৬ ও ৪৫৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সামরিক দিক থেকেও রোম দুর্বল হয়ে পড়ে। ৪৭৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ইট্রুস্কান শহর ভেইয়ের বাহিনী টিবের নদীর অপরপ্রান্তে রোমের বিপরীতে জ্যানিকুলাম পাহাড় দখল করে নেয়, এবং প্রায় দুই বছর পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে। ৪৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হার্ডোনিয়াস অতর্কিতে ক্যাপিটোলাইন পাহাড় দখল করে নেয়। তাকে সেখান থেকে পিছু হটাতেও রোমান বাহিনীকে যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হয়। এ সমস্ত ঘটনা প্রমাণ করে যে, সময়টা রোমের জন্য ছিল টালমাটাল, এবং দ্রুত কিছু করা না গেলে শত্রুরা রোমের নামনিশানা মুছে দেবে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৫২-৪৫০ অব্দ: দ্বিতীয় সেসেশানের পটভূমি
রোমান নাগরিকদের জন্য সমতাসূচক একটি আইন করার লক্ষ্যে রোমান সিনেটে ৪৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সোলোন এর প্রণীত আইন পরীক্ষানিরীক্ষা করার মানসে এথেন্সে তাদের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। ৪৫২ সালে তারা ফিরে এলে তাদের মতামতের উপর ভিত্তি করে রোমান জনগণের জন্য একটি বিধিমালা তৈরির খাতিরে তৎকালীন সিনেট দশজন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে যা ডিসেমভিরি নামে পরিচিত।
তাদের উপর এই আইন রচনার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য রোমের সর্বময় ক্ষমতা এক বছরের জন্য তাদের হাতে অর্পণ করা হয়। ৪৫১ সালে প্যাট্রিশিয়ান ক্লডিয়াসের নেতৃত্বে ডিসেমভিরি কাজ শুরু করে এবং এক বছরের মধ্যে দশটি আইন বিষয়ক ট্যাবলেট প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়। সমস্যা দেখা দেয় ৪৫০ সালে যখন ডিসেমভিরি অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদেরকে অনির্দিষ্টকালের জন্য রোমের হর্তাকর্তা ঘোষণা করে। তারা অবশিষ্ট দুটি ট্যাবলেট লেখার পাশাপাশি প্লেবেইয়ানেদের হত্যা ও তাদের সম্পদ আত্মসাৎ করা শুরু করে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৯ অব্দ: দ্বিতীয় সেসেশান
ডিসেমভিরি সিনেটকে রোমান নাগরিকদের সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার আদেশ জারি করতে বললে সিনেট তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন তারা নিজেরাই আদেশ জারি করলে প্লেবেইয়ান সিকিয়াস দেন্তেতাস এর বিরোধিতা করেন, যার কারণে তাকে হত্যা করা হয়। অপ্রয়োজনীয় এই রক্তপাতে প্লেবেইয়ানদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়। এছাড়াও ক্লডিয়াস রোমান বাহিনীর প্লেবেইয়ান অফিসার ভার্জিনিয়াসের কন্যা ভার্জিনিয়ার প্রতি নিজের কামনা চরিতার্থে তাকে কাঠগড়ায় তুললে প্রাক্তন ট্রিবিউন ইকিলিয়াস তাতে বাধা দেন। ইত্যবসরে ভার্জিনিয়াস রোমে ফিরে আসেন এবং কন্যা ভার্জিনিয়ার সম্মান রক্ষার্থে নিজ হাতে তাকে হত্যা করেন।
ক্লডিয়াস এবার ইকিলিয়াস ও ভার্জিনিয়াসকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্যাট্রিশিয়ান সিনেটর হোরাশিয়াশ ও ভ্যালেরিয়াস তাতে বাদ সাধেন এবং প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য ডিসেমভিরিকে ভর্ৎসনা করেন। পরিস্থিতি দেখে ইকিলিয়াস ও ভার্জিনিয়াস তাদের বাহিনী নিয়ে রোমের মধ্য দিয়ে মার্চ করে প্রথম সেসেশানের মতো স্যাক্রেড মাউন্টে গিয়ে ওঠেন।
গৃহবিবাদে জর্জরিত রোম আরও দুর্বল হয়ে পড়বে এই আশঙ্কায় হোরাশিয়াশ ও ভ্যালেরিয়াস তাদের সাথে সমঝোতা মধ্যস্ততা করেন, যার ফলে ডিসেমভিরি বিলুপ্ত হয় এবং প্লেবেইয়ান কাউন্সিলের ক্ষমতার বৈধতা রোমান সিনেট কর্তৃক স্বীকৃত হয়।সিনেটের নির্দেশে রোমের প্রধান পুরোহিত (পন্টিফেক্স ম্যাক্সিমাস) ইকিলিয়াস ও ভার্জিনিয়াসকে ট্রিবিউন হিসেবে নিয়োগ দেন। তারা প্লেবেইয়ান কাউন্সিল আহবান করেন এবং সেখানে হোরাশিয়াশ ও ভ্যালেরিয়াসকে কন্সাল নির্বাচিত করা হয়। এর মাধ্যমে রোমে আবার তার রিপাবলিক চরিত্রে ফিরে যায়।
দ্বিতীয় সেসেশান – ফলাফল
১) ভ্যালেরীয়-হোরাশিয়ান আইন
– ট্রিবিউনদের রাষ্ট্রীয় কর্মচারী হিসেবে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয় এবং তাদের হয়রানি করার প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ান উভয়ের জন্যই রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
– রোমান নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য সকল আইন রোমের মন্দিরগুলোতে প্রদর্শন করার বিধি জারি করা হয় যাতে সাধারণ জনগণ তাদের করণীয় সম্পর্কে জানতে পারে।
– যেকোনো অভিযোগের বিপরীতে রোমান নাগরিকের আপিল করার অধিকার আইনসঙ্গত করা হয়। পূর্বে কিছু ক্ষেত্রে আপিলের সুযোগ থাকলেও সর্বজনের জন্য এই আপিলের আনুষ্ঠানিক কাঠামো এই আইনের মাধ্যমেই বিবৃত হয়।
২) ১২ ট্যাবলেট
এই বারো ট্যাবলেট রোমের প্রথম লিখিত আইনের সংকলন। প্রথম দশটি ট্যাবলেট আগে থেকে চলে আসা আইনের গ্রন্থিত রূপ মাত্র। এগুলো ডিসেমভিরি কর্তৃক লিপিবদ্ধ হলেও অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন এগার ও বারো নাম্বার ট্যাবলেট তাদের পতনের পর প্রণীত হয়। বারো নাম্বার ট্যাবলেট প্লেবেইয়ানদের ক্ষমতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। আর এগারো নাম্বার ট্যাবলেট অত্যন্ত বিতর্কিত একটি আইনের অবতারণা করে যার মধ্য দিয়ে প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ানদের অন্তর্বিবাহ নিষিদ্ধ করা হয়। ইতিহাসবিদদের মতে, প্লেবেইয়ানদের ক্রমশ ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার কারণে শঙ্কিত প্যাট্রিশিয়ানরা এই আইন প্রণয়ন করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল। তবে মাত্র চার বছরের মাথায় এই বিতর্কিত আইন বিলোপ করা হয়।
তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সেসেশান
প্লেবেইয়ান ও প্যাট্রিশিয়ানদের এর মতবিরোধ চলেছিল আরও অনেক বছর ধরে। এর পথ ধরেই ৪৪৫, ৩৪২ ও ২৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আরও ছোট আকারে তিনটি সেসেশানের উল্লেখ পাওয়া যায়। সর্বশেষ পঞ্চম সেসেশানের মাধ্যমে রোমান সমাজে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। কুইন্টাস হর্টেনসিয়াসের প্রণীত আইন (হর্টেনশিয়ান ল) প্লেবেইয়ান কাউন্সিলকে একটি আইন প্রণয়নকারী কমিটি হিসেবে চিহ্নিত করে যার মাধ্যমে প্লেবেইয়ানরা রোমের জন্য আইন প্রণয়ন করতে এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পদে তাদের লোক নিযুক্ত করতে পারত। এর ফলে প্লেবেইয়ান অভিজাতগোষ্ঠী প্যাট্রিশিয়ানদের সমান রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করতে সমর্থ হয়। মূলত এর মধ্য দিয়েই প্রায় দুই শতাব্দী ধরে চলা প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ান বিরোধের সমাপ্তি হয়।
এক নজরে প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ান বিরোধের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা
৪৯৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: প্রথম সেসেশান
৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: রোমের প্রথম লিখিত আইন, যা বারোটি ট্যাবলেটের আকারে প্রণীত হয়
৪৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: প্যাট্রিশিয়ান ও প্লেবেইয়ানদের অন্তর্বিবাহের আইনগত স্বীকৃতি
৩৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: প্লেবেইয়ানরা কন্সাল হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হয়
৩৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: আইন করে দুই কন্সালের একজন প্লেবেইয়ানদের মধ্যে থেকে আসা বাধ্যতামূলক করা হয়
৩৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: আইন করে দুই সেন্সরের একজন প্লেবেইয়ানদের মধ্যে থেকে আসা বাধ্যতামূলক করা হয়
৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: রোমান পুরোহিতদের অর্ধেক পদ প্লেবেইয়ানদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়
২৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দ: প্লেবেইয়ানদের করা আইন সকল রোমান নাগরিকের জন্য প্রযোজ্য হবে বলে ঘোষণা করা হয়