১৯৭৬ সালের জুন মাসের এক আলোকোজ্জ্বল শনিবারের ঘটনা; তারুণ্যোদ্দীপ্ত সুরেশ গ্রোভার তখন ইংল্যান্ডের সাউথহলে অবস্থিত ডোমিনিয়ন সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন, সামান্য দূরে এক পুলিশ কর্মকর্তা নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছেন, অথচ সেখানেই কোনো এক মানুষের শরীরের রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। এমন সময় গ্রোভার এগিয়ে গিয়ে ঐ পুলিশ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
এখানে কি কেউ মারা গেছে?
প্রত্যুত্তরে ঐ পুলিশ কর্মকর্তা বললেন,
হ্যাঁ, এগুলো ভারতীয়দের রক্ত।
এ সময় ঐ পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রোভারের কাছে খুব নিষ্ঠুর ও হিতাহিত জ্ঞান হীন মনে হলো। এতে তার মনে তীব্র ধাক্কা লাগলো- কোনো পুলিশ কর্মকর্তার মুখের ভাষা এমন হতে পারে? ভারতীয়দের রক্ত বলে এর কোনো মূল্য নেই? তাহলে কি ভারতীয় মানুষদের রক্তের মূল্য ব্রিটেনের মানুষের রক্তের মূল্য থেকে কম?
গ্রোভার যখন নিজেকে নিজে এসব প্রশ্ন করছিলেন, তখন সেই রক্তের প্রবাহ এসে গ্রোভারকেও স্পর্শ করেছে। আর এই প্রবাহিত রক্ত ছিল গুরুদীপ সিং সাগার নামের এক ভারতীয় যুবকের লাশের।
১৮ বছর বয়সী এই যুবক পশ্চিম লন্ডনের একটি জেলা শহরে বর্ণবাদীদের ভয়াল আক্রমণের মুখে নিহত হন। ব্রিটেনের এই শহরেই দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অভিবাসী বসবাস করতো- বিশেষত ভারতের উত্তর পাঞ্জাব থেকে আসা অভিবাসীরা। গ্রোভারের বর্তমান বয়স ৬২ বছর। তিনি সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,
পরবর্তী দিন আমরা সকলে পুলিশ স্টেশনে গেলাম এবং স্টেশন ঘেরাও করে প্রতিবাদী বক্তব্য দিতে থাকলাম। এরপর সাউথহল অচল করে দিলাম। দুপুরের মধ্যে প্রায় ৫ হাজার মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিলো। নারী-পুরুষ, এশিয়ান, আফ্রো-ক্যারিবিয়ান নির্বিশেষে সকলে মিলে একটি শক্তিশালী ও অভেদ্য প্রতিবাদ গড়ে তুললাম। অনেকেই আমাদের সাথে সহমর্মিতা জ্ঞাপন করতে ও নিরাপত্তা বিধান করতে এগিয়ে আসলো। সাউথহলের তৎকালীন ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ গণপ্রতিরোধ। সেদিনই ‘সাউথহল ইয়ুথ মুভমেন্ট’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সাউথহল ইয়ুথ মুভমেন্টের অধিকাংশ সদস্য ছিল এশিয়ান অঞ্চল থেকে আগত অভিবাসী। যে মাসে গুরুদীপ সিং নিষ্ঠুর বর্ণবাদীদের হামলায় নিহত হলেন, সেই মাসে থেকে সকল অভিবাসী আরও বেশি অধিকার সচেতন হয়ে উঠলেন। সবাই বর্ণবাদী সন্ত্রাস ও পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুললেন। খুব দ্রুত এই আন্দোলনের দাবানল ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়লো। বিশেষত ব্র্যাডফোর্ড, ম্যানচেস্টার এবং শেফিল্ডের মতো শহরগুলোতে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা দিল। তাদের সকলকে নিয়ে গঠিত হলো ‘এশিয়ান ইয়ুথ মুভমেন্ট (এওয়াইএমস) নামের একটি সংগঠন।
কিন্তু তিন বছর পর দেখা গেল, সাউথহলের বর্ণবাদী পরিস্থিতি আসলে খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৭০ সালের ২৩ এপ্রিল ‘দ্য ফার-রাইট ন্যাশনাল’ গ্রুপের উদ্যোগে একটি সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু পুলিশ উক্ত সভার অনুমতি বাতিল করে দেয় এবং কোনো ধরনের গণজামায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করে- এতে সংশ্লিষ্ট জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে এবং তারা একটি বৃহৎ ফ্যাসিবাদ বিরোধী মিছিলের পরিকল্পনা করে। কিন্তু পুলিশ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংস হয়ে ওঠে এবং মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়।
মিছিল থেকে শতাধিক প্রতিবাদকারীকে গ্রেফতার করা হয়। অনেকে পুলিশি হামলায় মারাত্মকভাবে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এবং হামলায় নিউজিল্যান্ড থেকে আগত শিক্ষক ব্লেইর পিচ মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ঐদিন মৃত্যুবরণ করেন।
২০১০ সালে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঐ প্রতিবেদনে ব্লেইর পিচের হত্যাকাণ্ডকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা’ বলে উল্লেখ করা হয়। অথচ তার মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার কিংবা কোনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। গত ২৪শে এপ্রিল ছিল পিচ হত্যাকাণ্ডের ৪০ বছরপূর্তি দিবস। দিবসটি উপলক্ষে তার ভক্তরা একটি ক্যাম্পেইন চালায়।
সাউথহলে অনুষ্ঠিত উক্ত ক্যাম্পেইনে ব্লেইর পিচ, গুরুদীপ সিং সাগার হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি এবং এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে ব্রিটেনের ইতিহাস ও বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
গ্রোভার বলেন,
১৯৭৩ সাল থেকে এই দুজন আমাদের সকল অনুপ্রেরণার মধ্যমণি। তখন থেকে আমরা আর আমাদের অতীত ইতিহাস নিয়ে ভাবতে চাইনি। তখন থেকে আমরা বলতাম, আমরা এখানে জন্মগ্রহণ করেছি, এখানে বেড়ে উঠেছি এবং কখনো আর মাতৃভূমিতে ফিরে যাব না, সুতরাং এখানে বসবাসের পূর্ণ অধিকার আমার রয়েছে।
তিনি আরও বলেন,
তবে এ সময় আমাদের তীব্রভাবে জাতীয়তাবাদীদের বর্ণবাদী আচরণের মোকাবেলা করতে হয়। আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের স্বগোত্রীয়দের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে বর্ণবাদী হামলার মোকাবিলা করতে হবে। এর ফলে আমরা একটি যুব আন্দোলনের প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে সক্ষম হই; যদিও সেই প্লাটফর্ম বেশিদিন টেকেনি, কিন্তু এটি ছিল আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা।
ব্রিটেনে দক্ষিণ এশীয়দের বসবাসের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়; এ সময় ব্রিটেনে তীব্র শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল; সেই সঙ্কট মেটাতে দক্ষিণ এশিয়া থেকে প্রচুর শ্রমিক সরবরাহ করেছিল ব্রিটেন সরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও শিল্প কারখানা ও স্বাস্থ্যখাতে পুনরায় প্রচুর দক্ষিণ এশিয়ান শ্রমিক নিয়েছিল ব্রিটেন সরকার। ফলে ১৯৭১ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে ব্রিটেনে দক্ষিণ এশিয়ানদের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৪,৭৮,০০০ থেকে ৯,৯৩,০০০ এ উন্নীত হয়।
‘ব্রিটেইন’স এশিয়ান ইয়ুথ মুভমেন্ট’ বইয়ের লেখক ও শেফিল্ড হলাম ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আনন্দী রামমূর্তি বলেন,
প্রথম ধাপে শুধুমাত্র পুরুষ সদস্যরা ব্রিটেনে আগমন করে। কিন্তু ১৯৭০ সালে নতুন অভিবাসী আইন পাস হলে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অনেকে স্বপরিবারে ব্রিটেনে আসতে থাকে ও স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। এতে পুরো দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়ে যায়। দ্রুত সময়ের মধ্যে তীব্র বর্ণবাদ মাথাচার দিয়ে ওঠে। কর্মক্ষেত্র, বাসস্থান ও স্কুলসমূহে বর্ণবৈষম্য প্রকাশ্য রূপ লাভ করে।
এশিয়ান ইয়ুথ মুভমেন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করা তারেক মেহমুদ। ১৯৬০ সালে তার বাবা সপরিবারে ব্রিটেনে চলে আসেন। তারেক মেহমুদ তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন,
আমরা একটি বিব্রতকর পরিবেশে বেড়ে উঠি। আমরা স্থানীয় কোনো স্কুলে পড়তে যেতে পারতাম না। বাসস্থান থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় মাইল দূরের স্কুলে আমাদের পড়তে যেতে হতো। কেননা এক স্কুলে অধিক সংখ্যক অশ্বেতাঙ্গ শিশু কর্তৃপক্ষ ভর্তি নিতে চাইতো না। তাছাড়া আমরা ছিলাম বর্ণবাদী সহিংসতার লক্ষ্যবস্তু।
আন্দোলনের অন্যতম সদস্য গ্রোভার যুবক বয়সে পূর্ব আফ্রিকা থেকে এসে ব্রিটেনের নর্থওয়েস্টে বসবাস শুরু করেন। কিছুদিন পরেই তিনি বর্ণবাদী সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে পরিস্থিতি বেশি খারাপের দিকে যেতে থাকে। গ্রোভার সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
আমরা আমাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে থাকি। এ সময় বর্ণবাদী সহিংসতার আমাদের বেশ কয়েকজন নিহতও হয়। বর্ণবাদীরা বলতে থাকে- কালো ও বাদামীদের নিজ দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এ সময় ব্রিটেনের একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ করে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে দেয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়, অভিবাসীদের কারণেই ব্রিটেনে কর্মসংস্থান ও বাসস্থানের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এছাড়া এরা তাদের দেশ থেকে ব্রিটেনে রোগ বহন করে নিয়ে আসছে।
এমন পরিস্থিতিতে এশিয়ান ইয়ুথ মুভমেন্টের সদস্যরা আরও সতর্ক ও সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা অধিকার আদায়ের পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতি সংরক্ষণে তৎপর হয়ে ওঠে। অভিবাসীদের অধিকাংশ সদস্য ছিল শিখ, হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের অনুসারী। কিন্তু নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে।
কিন্তু পিচ হত্যাকাণ্ডের ৩ বছরের মাথায় ১৯৮১ সালে আবার এক ভয়ানক বর্ণবাদী হামলার শিকার হয় অভিবাসীরা। এ সময় ব্রিটেনের প্রায় ৩০টি শহরে বর্ণবাদী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সাউথহল আবারো খবরের শিরোনামে পরিণত হয়। একটি বর্ণবাদী গানের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। বরাবরের মতো এই সংঘাতেও পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করে।
এরপর অভিবাসীরা ডানপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কেননা, বর্ণবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ডানপন্থীদের সুস্পষ্ট অবস্থান ছিল। ফলে অভিবাসীরা রাজনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে আরও সচেতন হয়ে ওঠে। ১৯৮১ সালের জুলাই মাসে একটি বড় বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। পুলিশ সেখানেও হামলা চালায়; জবাবে বিক্ষোভকারীরাও পাল্টা পেট্রোল বোমা ছোড়ে। এ সময় মেহমুদসহ আরও অনেক সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। মেহমুদ বলেন,
আমরা ভাবতেও পারিনি পুলিশ আমাদের নিজস্ব সীমানার মধ্যে এসে আমাদের ওপর হামলা চালাবে। যখন পুলিশ আমাদের নিজস্ব এলাকার মধ্যে এসে হামলা চালায়, তখন আমরাও পাল্টা পেট্রোল বোমা ছুড়ি। ফলে ফ্যাসিবাদের ক্রীড়ানকরা ফিরে যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু সন্তাসবাদের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে আমাদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
তবে আদালত রায় দেয় যে, নিজেদের ও নিজ সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে রক্ষা করার জন্য মেহমুদরা যে ভূমিকা পালন করেছিল- তা তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে। ফলে পেট্রোল বোমা ছোড়ার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মেহমুদ ও তার ১১ সহযোগীকে মুক্তি দেয় ব্রিটেনের আদালত। এভাবে ইংল্যান্ডে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াই একটি আনুষ্ঠানিক ও আইনি অধিকার লাভ করে।
কিন্তু সরকারের অর্থায়ন ও ষড়যন্ত্রে ধীরে ধীরে এই অধিকারকামী সংগঠনগুলো দুর্বল হয়ে যায়। ব্রিটেনে এখনও মাঝেমধ্যে বর্ণবাদী সহিংসতার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এশিয়ান অভিবাসীরা বর্ণবাদ বিরোধী লড়াইয়ের যে পথ দেখিয়ে গেছেন, সে পথ ধরেই এখন পর্যন্ত ব্রিটেনে বর্ণবাদ বিরোধী লড়াই অব্যহত আছে।