২০১৬ সালের জুলাইতে, আমেরিকার সেন্ট্রাল ফ্লোরিডায় এক অ্যালিগেটরের আক্রমণে প্রাণ হারায় দুই বছর বয়সী শিশু লেইন গ্রেভস। অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেয় ফ্লোরিডার কর্তাব্যক্তিরা, পাঁচটি অ্যালিগেটর মেরে ফেলার পাশাপাশি, সংখ্যাটাকে বৃদ্ধি করার নানান পরিকল্পনাও করা হয়।
এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগের কথা। ওহায়ো স্টেটের সিনসিনাটি চিড়িয়াখানায় খাঁচার কাছে চলে গিয়ে গরিলার হাতে আহত হয় তিন বছর বয়সী এক শিশু। অ্যালিগেটরগুলোর মতো একই ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়েছিল সেই গরিলাটিকেও।
ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ একটাই- মানবপ্রাণের মূল্য অন্য যে কোনো প্রাণীর চেয়ে বেশি। অথচ, যদি আমরা মাত্র মাত্র এক শতক আগের দৃশ্যপটে তাকাই, সেখানে দেখা যাবে নির্মম নিষ্ঠুরতার এক উল্টোচিত্র!
ইতিহাস ও বৈচিত্র্যে আফ্রিকা মহাদেশ বরাবরই অনন্য। কিন্তু, বহুমাত্রিক পরিবর্তনের পথচলায় সোনালি অতীতের পাশাপাশি আফ্রিকার আছে অন্ধকারের অসংখ্য গল্প। এর বৃহত্তম অংশ জুড়ে আছে আছে দাসপ্রথা এবং মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিকতার স্মৃতিচিহ্ন।
ইউরোপ ও আমেরিকায় আফ্রিকান ক্রীতদাসদের সাথে হওয়া সকল পাশবিকতাকেই যেন হার মানিয়েছিল অ্যালিগেটর ধরার টোপ হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের ব্যবহার করার প্রথা।
ডিসকভারি চ্যানেলে সোয়াম্প ব্রাদার্স নামের একটি টিভি শো প্রচার পেয়েছিল। ২০১১ সালের সেই শোতে দেখা যেত, কীভাবে দুজন শিকারি আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে অ্যালিগেটর শিকার করেন। কাজটি এতটাই চ্যালেঞ্জিং যে, এতে জীবনের ঝুঁকিও আছে। তাই, দক্ষতার সাথে সাথে অ্যালিগেটরের মতো হিংস্র ক্ষিপ্র প্রাণী শিকারে প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত সতর্কতা। সামান্য সুযোগ পেলেই নিষ্ঠুর আক্রমণে মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলার সামর্থ্য রাখে অ্যালিগেটর।
কিন্তু, নিষ্ঠুরতায় যে কোনো প্রাণী মানুষের কাছে হার মানতে বাধ্য।
ইংরেজিতে ‘বেইট’। বাংলায় ছিপ বা টোপ তো আমরা সবাই চিনি। মাছ ধরার টোপ হিসেবে কেঁচো, আটা ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। আবার বাঘ ধরার টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হয় শুকর কিংবা ছাগল। মাত্র এক শতক আগেও, আমেরিকার বুকে অ্যালিগেটর ধরার টোপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো মানব শিশু।
অ্যালিগেটর বেইট বা গেটর বেইট নামে পরিচিত এই টোপে আফ্রিকান শিশুদেরকে ব্যবহার করে জল থেকে অ্যালিগেটরকে ডাঙায় আসতে প্রলুব্ধ করা হতো। লুইজিয়ানা, ফ্লোরিডাসহ আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলেই মূলত প্রচলিত ছিল এই প্রথা।
চামড়ার জুতা, জ্যাকেট, বেল্ট ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হবার সুবাদে সেই সময়ে, অ্যালিগেটরের চামড়ার চাহিদা ছিল তুঙ্গে। ১৮০০ থেকে ১৯০০ সময়টাতে, অ্যালিগেটরের চামড়ার ব্যবসা খুবই লাভজনক ছিল। স্বাভাবিকতই শিকারীদের নজর ছিল অ্যালিগেটর ধরার দিকে।
কিন্তু কাদাজল থেকে অ্যালিগেটরকে ডাঙায় তুলে আনার সময় ধস্তাধস্তিতে প্রায়ই ঘটত নানা দুর্ঘটনা। হাত, পা, চোখসহ অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়তে হতো তাদের। প্রাণহানির সম্মুখীনও হতো অনেকেই। এসব সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে তারা খুঁজে বের করল অদ্ভুত এক সমাধান।
টোপ হিসেবে মুরগি, খরগোশ কিংবা ছাগল ব্যবহার করার সুযোগ ছিল না। মূল্য অনেক বেশি। তাই, বাধ্য (!) হয়ে তারা টোপ হিসেবে বেছে নেয় দীর্ঘ নয়মাস ধরে গর্ভে ধারণ করা মানবশিশু। কারণ, এরা তো ক্রীতদাসের সন্তান। আর ক্রীতদাসের জীবনের চেয়ে, এক কাপ কফির মূল্যও ছিল অনেক বেশি।
১৮৬৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৩তম সংশোধনে অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে কাগজে-কলমে আমেরিকায় দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটলেও, বাস্তবের চিত্রটা ছিল একদমই আলাদা।
বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই বিষয়টিকে আড়াল করার চেষ্টা করা হলেও, একাধিক সূত্রে ইতিহাসের পাতা থেকে এসব তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করা গেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একটি সূত্র হলো, মিশিগানের ফেরিস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অবস্থিত জিম ক্রো মিউজিয়াম। সেখানে সংরক্ষিত বিভিন্ন হাউজ আর্টিফ্যাক্টস (পোস্টকার্ড, নিকন্যাক, প্রোডাক্ট প্যাকেজিং ইত্যাদি) দেখলে বোঝা যায়, বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমেরিকান পপ কালচারে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বর্বরতা কতটা গভীরভাবে মিশে গিয়েছিল।
পরবর্তী সময়ে জিম ক্রো মিউজিয়ামে পাওয়া প্রমাণাদির সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ছবি পাওয়া যায়। ফ্লোরিডার বাসিন্দা এক ব্যক্তির বাড়িতে পাওয়া যায় বাঁধাই করা পুরনো ছবিটি। যেখানে দেখা যায়, নগ্ন দেহের নয়টি ছোট্ট কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান শিশু। ছবিটির নিচে ক্যাপশনে লেখা ‘অ্যালিগেটর বেইট’।
সে সময়, আফ্রিকান-আমেরিকান শিশুদেরকে বৈষম্যমূলক গালি হিসেবে ‘পিকানিনিস’ ডাকা হতো। মিউজিয়ামে সংরক্ষিত নানান ছবিতে পিকানিনিসদেরকে অ্যালিগেটর বেইট হিসেবে দেখা যায়।
১৯২৩ সালে প্রকাশিত টাইম ম্যাগজিনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়,
“কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদেরকে অ্যালিগেটর ধরার টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় অগভীর পানিতে তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে, নিকটবর্তী নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে একজন দক্ষ বন্দুকধারী। শিকারের লোভে কোনো অ্যালিগেটর ডাঙায় উঠে আসতে নিলেই, তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।”
প্রতিবেদনটি করা হয়েছিল আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের চিপলি শহরে।
এছাড়াও, ১৯০৮ সালের ৩রা জুন, ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, নিউ ইয়র্ক জুওলোজিক্যাল গার্ডেন কর্তৃপক্ষ পিকানিনিস ব্যবহার করে উইন্টার কোয়ার্টার থেকে অ্যালিগেটর ধরেছিল। শীত শেষে দর্শনার্থীদের সামনে হাজির করতেই অ্যালিগেটরদেরকে উইন্টার ট্যাংক থেকে সামার ট্যাংকে নিয়ে আসা হয়। যেখানে অ্যালিগেটর বেইট হিসেবে দুজন আফ্রিকান ক্রীতদাস শিশুকে রাখা হয়েছিল, তা ছিল ২৫টিরও বেশি অ্যালিগেটর ও কুমিরের আবাসস্থল।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়,
“উপস্থিত দর্শনার্থীদের ভিড়ের সামনে রেপটাইল হাউজে ট্যাংকে প্রবেশ করিয়ে ‘কাজে লাগানো হয়’ দু’জন কৃষ্ণাঙ্গ শিশুকে। ভয়ে চিৎকার করতে থাকা বাচ্চা দুটোকে দেখেই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে সরীসৃপের দল। এভাবেই সরাসরি ছোট্ট আফ্রিকান শিশুদেরকে ব্যবহার করে বোকা বানিয়ে অ্যালিগেটরদেরকে নিয়ে আসা হয় তাদের গ্রীষ্মকালীন আবাসে।”
সাধারণত দিনের বেলায় যখন ক্রীতদাসেরা ব্যস্ত থাকত হাড়ভাঙা খাটুনিতে, তখনই তাদের ঘর থেকে সন্তান চুরি করে নিয়ে যাওয়া হতো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ঘটনার শিকার হতো এক বছরের কম বা সামান্য বেশি বয়সী শিশুরা।
তাদেরকে ধরে এনে নিয়ে যাওয়া হতো জলাভূমিতে। রাতের বেলা তাদের গলা ও পেটের সাথে দঁড়ি পেঁচিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে ফেলে রাখা হতো।
অবুঝ শিশুদের ভয়ার্ত চিৎকারেই যেন আকৃষ্ট হতো মাংসাশী হিংস্র অ্যালিগেটরের দল। ছুটে আসত ডাঙায়। অনেকসময় কোনো কোনো শিশুকে কামড়ে মুখে পুরেও ফেলত অ্যালিগেটর, দেখা যেত শুধুই দড়ি।
২০০৬ সালে শ্যারন ড্রেপার রচিত বই ‘কপার সান’-এ বর্ণিত তথ্যানুসারে, গত শতাব্দীর শুরুর দিকে ফ্লোরিডার কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদেরকে হারলেমে অ্যালিগেটর বেইট হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো।
বর্তমান সময়ে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার মানুষগুলোর আওয়াজ হয়তো অনেকেরই মনে বিরক্তির উদ্রেক করে। কিন্তু, যাদের আদিপুরুষেরা শত শত বছর ধরে সমপ্রজাতির হাতে নির্মমতার শিকার হয়ে এসেছে, প্রকৃতির বিচার হিসেবেই বাড়তি সম্মান ও সুযোগ তাদের প্রাপ্য।
সেকালে ভোট দেয়ার চেষ্টা করায় প্রকাশ্য দিবালোকে জনসম্মুখে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার মতো ঘটনার নজির আছে। আধুনিকতা ও উন্নতির শিখরে থাকা সত্ত্বেও আমেরিকান সমাজে নির্মূল হয়নি বর্ণবৈষম্য। শুধুমাত্র পরিস্থিতির চাপে অপরাধীকে গ্রেফতার করতে হবে বলে, নিরপরাধ কৃষ্ণাঙ্গকে মৃত্যুদণ্ডের আসামী হিসেবে ধরে নিয়ে যাবার মতো ঘটনাও ঘটেছে নিকট অতীতে।
তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি সুন্দর আগামীর, সুন্দর ভবিষ্যতের, সুন্দর এক পৃথিবীর। যে পৃথিবী হবে জাতিগত বিদ্বেষ ও জাতিগত আধিপত্যের নোংরা থাবামুক্ত। যেখানে প্রতিটি শিশুর হাসিই হবে অমূল্য ঐশ্বর্য সমতুল্য।