স্কুলজীবনে নতুন বছরে নতুন বই পাওয়ার সাথে সাথেই আমাদের প্রথম কাজ হতো সেটা উল্টেপাল্টে দেখা, এর গন্ধ শোঁকা। নতুন বইয়ের গন্ধের মাঝে মানুষকে আকৃষ্ট করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। তবে নতুন সেই বই নিয়ে খুব বেশি আবেগ দেখানোর আগেই মা-বাবা তাড়া দিতেন বইটি বাঁধিয়ে ফেলার জন্য, নাহলে অল্পদিনের মাঝেই ছিড়ে যাবে বইটি। সেজন্য পুরনো বছরের ক্যালেন্ডার, মোটা কাগজ প্রভৃতি দিয়ে ভালো করে বাঁধাই করা হতো বইটি।
গল্প-উপন্যাস-পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি নানা ধরনের বইয়ে নানা ধরনের বাঁধাই আমরা দেখেছি। কিন্তু কোনো বন্ধু এসে যদি আপনাকে বলে বসে, “জানিস, মানুষের চামড়া দিয়েও না এককালে বই বাঁধাই করা হতো!”, তাহলে কী করবেন? বিশ্বাস করবেন কি এত সহজে? নাকি “ধুর! এইসব আজাইড়া প্যাচাল পারিস না তো।” বলে তাকে থামিয়ে দেবেন?
আপনি বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, ইতিহাস বলে, এককালে আপনার-আমার স্বগোত্রীয় সদস্যদের শরীরের চামড়া দিয়েও বাঁধাই করা হয়েছে কিছু বই। এর মাঝে বেশ কিছু বইয়ের ব্যাপারে তোলা দাবী অবশ্য শেষপর্যন্ত ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও এ বছরের মে মাসে করা সর্বশেষ গবেষণা অনুযায়ী বিশ্বে মানবচর্ম দিয়ে বাঁধানো বইয়ের বর্তমান সংখ্যা দেড় ডজন অর্থাৎ আঠারোটি!
মানুষের চামড়া দিয়ে বই বাঁধানোর এ চর্চাটির পুস্তকীয় নাম বেশ খটমটে। অ্যান্থ্রোপোডার্মিক বিবলিওপেজি (Anthropodermic Bibliopegy) বলে ডাকা হয় এ প্রক্রিয়াটিকে। এর মাঝে ইংরেজি ‘Bookbinding’ শব্দটিরই অপ্রচলিত একটি প্রতিশব্দ হলো ‘Bibliopegy’। এটি এসেছে দুটি গ্রীক শব্দ ‘বিবলিয়ন (বই)’ ও ‘পেজিয়া (বাঁধাই করা)’ থেকে। অন্যদিকে ‘Anthropodermic’ এসেছে অন্য দুটি গ্রীক শব্দ ‘অ্যান্থ্রোপোস (মানুষ)’ ও ‘ডার্মা (চামড়া)’ থেকে। সামগ্রীকভাবে আমরা তাহলে পেয়ে যাচ্ছি ‘মানবচর্মে বাঁধানো বই’ অর্থটিই।
আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরি থেকে ৪৭টি বইয়ের ব্যাপারে সেখানকার কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে, সেগুলো মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো। এর মাঝে এখন পর্যন্ত ৩২টি বই পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মাঝে ১৮টি ছিলো আসলেই মানুষের চামড়া দিয়ে বাঁধানো। বাকিগুলো বাঁধানো হয়েছিলো ছাগল, ভেড়া কিংবা হরিণের মতো প্রাণীদের চামড়া দিয়ে। বই বাঁধাইয়ে কোন উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তা যাচাইয়ে Peptide Mass Fingerprinting (PMF) এবং Matrix-Assisted Laser Desorption/Ionization (MALDI) পরীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
ব্যবচ্ছেদ করা লাশ দিয়ে অ্যানাটমির বই, মৃত উইলকারীর চামড়া দিয়ে কোনো উইল বাঁধানো, খুনের দায়ে অভিযুক্ত কোনো অপরাধীর চামড়া দিয়ে বই বাঁধানো, এমনকি যৌনতা সম্পর্কিত নানা বইও মানবচর্ম দিয়ে বাঁধাই করার নজির ইতিহাসে আছে। এবার তাহলে চলুন এমন কিছু বইয়ের সাথেই পরিচিত হয়ে নেয়া যাক।
দ্য জন স্টকটন হাফ কালেকশন
পিটসবার্গের ডাক্তার জন স্টকটন এক অদ্ভুত কাজ করেছিলেন। তিনি তার মৃত রোগীদের চামড়া দিয়ে তার কাছে থাকা বিভিন্ন বই বাঁধাই করেছিলেন। সেই বইগুলোর অধিকাংশই এখন আছে ফিলাডেলফিয়ার মাটার মিউজিয়ামে। উনিশ শতকের শেষের দিকে এমনই এক বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়, যাতে লেখা ছিলো ‘মিসেস এল’ নাম্নী একজন নারীর নাম। মাটার মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে আরো অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে, সেই নারীর নাম ছিল লিঞ্চ। ১৮৬৯ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সেই মারা যান তিনি।
ডক্টর জন স্টকটন লিঞ্চের মৃত্যুর পর তার উরু থেকে খানিকটা চামড়া কেটে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেটি দিয়ে বই বাঁধাইয়ের সিদ্ধান্ত নেন।
Des Destinees de l’Ame (Destinies of the Soul)
ফরাসি এ বইটির সন্ধান পাওয়া যাবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হাফটন লাইব্রেরিতে। ধারণা করা হয়, এটি একজন মহিলা মানসিক রোগীর চামড়া দিয়ে বাঁধানো। বইটির লেখক আর্সেন হুসেয় ১৮৮০ সালের দিকে বইটি তার এক ডাক্তার বন্ধুর কাছে দিয়েছিলেন। সেই বন্ধুই পরে এমন বিচিত্র কাজটি করে বসেন। এ বইয়ে আত্মার স্বরুপ এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন লেখক।
ব্রিস্টল রেকর্ড অফিসের বই
এবার চলে যাওয়া যাক ১৮২১ সালের যুক্তরাজ্যে। জন হরউড নামে আঠারো বছর বয়সী এক তরুণ পাগলের মতো ভালোবাসতো বালসাম নামে এক তরুণীকে। কিন্তু বালসাম পাত্তা দেয়নি জনকে। এজন্য বালসামকে প্রাণনাশের হুমকিও দিয়েছিলো জন। অবশেষ একদিন যখন মেয়েটি কুয়া থেকে পানি আনতে যাচ্ছিলো, তখন তার দিকে সজোরে পাথর ছুড়ে মারে জন। পাথরটি গিয়ে সরাসরি মেয়েটির মাথায় আঘাত করে। চিৎকার করে ওঠে বালসাম। তার আর্তনাদ শুনে বন্ধু-বান্ধবেরা ছুটে আসে। দ্রুতই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। কিন্তু আর বাঁচানো যায় নি মেয়েটিকে। মাথার আঘাত থেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে জন। যথারীতি বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং সেটি কার্যকরও করা হয়। ব্রিস্টল রয়্যাল ইনফার্মারিতে তার মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদ করেন রিচার্ড স্মিথ নামে এক চিকিৎসক। তারপর তার মাথায় এলো এক অদ্ভুত খেয়াল। সেই খেয়ালের বশবর্তী হয়েই তিনি পরবর্তীতে এই কেসের কাগজগুলো জনের চামড়ার কিছু অংশ শুকিয়ে সেটি দিয়ে বাঁধাই করে রাখেন। বাঁধাইকৃত বইটির উপরে রয়েছে মানুষের খুলি ও হাড়ের আড়াআড়ি ছবি, লেখা আছে ‘Cutis Vera Johannis Horwood’, যার অর্থ ‘জন হরউডের আসল চামড়া’! এ বইটি এখন আছে ব্রিস্টলের রেকর্ড অফিসে।
উইলিয়াম বার্কের চামড়া দিয়ে বানানো পকেটবুক
প্রায় দু’শ বছর আগে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের অ্যানাটমিক্যাল ডিসেকশন সম্পর্কে হাতে-কলমে জ্ঞান দিতে দরকারি মৃতদেহের অভাব দেখা দেয় ব্রিটেনে। এ অভাব পূরণের উপায় হিসেবেই কালক্রমে জন্ম নেয় ইতিহাসের ভয়াবহ দুই সিরিয়াল কিলার উইলিয়াম বার্ক ও উইলিয়াম হেয়ার। একসাথে তারা মোট ষোলোজনকে হত্যা করেছিলো।
হত্যার পর মৃতদেহগুলো বিক্রি করে অর্থ কামাতো তারা। একসময় দুজনই ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। পুলিশকে সহযোগিতা করায় বেঁচে যায় হেয়ার। নির্দিষ্ট সময়ের সাজা খেটে মুক্তি পায় সে। তবে মুক্তি মেলে নি বার্কের।
১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জানুয়ারি সকাল সোয়া আটটায় প্রায় ২০,০০০-২৫,০০০ মানুষের সামনে বার্কের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। পরদিন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সকলের সামনেই তার দেহটি কাটা হয়। তাকে কাটার সময় প্রফেসর অ্যালেক্সান্ডার মনরো তার কুইলটিকে বার্কের রক্তে চুবিয়ে লেখেন, “This is written with the blood of William Burke, who was hanged at Edinburgh. This blood was taken from his head”। বার্কের কঙ্কাল এখন এডিনবার্গ মেডিক্যাল স্কুলের অ্যানাটমি মিউজিয়ামে প্রদর্শনের জন্য রাখা আছে। তার ডেথ মাস্ক এবং শরীরের চামড়া শুকিয়ে বানানো বইটি সার্জনস হল মিউজিয়ামে রাখা আছে।
জেমস অ্যালেনের কাহিনী
ম্যাসাচুসেটস স্টেট প্রিজনের ওয়ার্ডেনের কাছে মৃত্যুর আগে নিজের যাবতীয় অপরাধকর্ম স্বীকার করে গিয়েছিলো জেমস অ্যালেন। তার কথা ছিলো, তার জানানো এ কাহিনীগুলো লিপিবদ্ধ করে যেন বই আকারে বের করা হয় এবং সেই বইয়ের দুটো কপি যেন তার চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা হয়!
অ্যালেন বইটি প্রকাশ করতে বলেছিলো তার মৃত্যুর পর। বিশেষ সেই দু’কপি বইয়ের এক কপি তার ডাক্তারকে আর আরেক কপি তাকে যে লোকটি একবার ডাকাতির সময় প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলো তাকে দিতে বলেছিলো।
এভাবে মরণোত্তর নিজেদের চামড়া দান করেছিলো আরো দুজন অপরাধী। এর মাঝে জর্জ কাডমোর তার স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগ করেছিলো এবং উইলিয়াম কর্ডার মারিয়া মার্টেন নাম্নী এক নারীকে হত্যা করেছিলো।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ওয়েলকাম লাইব্রেরিতে কুমারীত্ব বিষয়ক একটি বই আছে। উনিশ শতকে এটি বাঁধাই করা হয়েছিলো মানুষের চামড়া দিয়ে, সুনির্দিষ্ট করে বললে একজন নারীর চামড়া। ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত ফরাসি জ্যোতির্বিদ ক্যামিল ফ্ল্যামারিওনের বই Les terres du ciel (The Worlds of the Sky)-এর এক কপি তার এক নারী ভক্তের চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা হয়েছিলো!