ধরুন, হুট করে কেউ আপনাকে একটি হীরার নাম বলতে বলল। সময় মাত্র তিন সেকেণ্ড। এমতাবস্থায় কোন নামটি আপনার মাথায় প্রথম আসবে? শতকরা ৯০ ভাগ সম্ভাবনা, আপনি যে হীরাটির নাম মুখে আনবেন তা হলো কোহিনূর। কারণ গোটা বিশ্বব্যাপীই কোহিনূর সবচেয়ে আলোচিত হীরা। আর ভারতীয় উপমহাদেশে তো এর জনপ্রিয়তা আরো বেশি। এই হীরার জন্মস্থানই যে পৃথিবীর এই প্রান্তে!
সর্বাধিক জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত যেমন, বিশ্বের সবচেয়ে বিতর্কিত হীরাগুলো একটিও কিন্তু এই কোহিনূরই। কয়েকশো বছরের একটি লম্বা ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই হীরার নামের সাথে। কখনো এটি শোভা পেয়েছে মুঘল দরবারে, কখনো ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছে ইরানী যোদ্ধাদের হাতে, কখনো আবার সমৃদ্ধ করেছে আফগান শাসক কিংবা পাঞ্জাবি মহারাজাদের। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীনকালে সুন্দরী কুমারীরা যেমন বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ ও শাসকদের হাতে হাতে ঘুরে বেড়াত, ঠিক এমনই একটি পথচলা ছিল কোহিনূরেরও।
তবে এই মুহূর্তে কিছুটা স্থবিরই রয়েছে কোহিনূরের অবস্থা। সেই উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় ১৭০ বছর যাবত এটি রয়েছে ব্রিটিশদের মালিকানায়, এবং এর বর্তমান অবস্থান টাওয়ার অফ লন্ডনে, ক্রাউন জুয়েলসের অংশবিশেষ হিসেবে। কিন্তু ব্রিটিশদের মালিকানা নিয়ে যথেষ্ট আপত্তি রয়েছে অনেক ভারতীয়ের। কেননা তাদের বিশ্বাস, ব্রিটিশরা এই ভারতবর্ষ থেকে চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ১০৫.৬ ক্যারেটের, আলোর পর্বত নামধারী এই অমূল্য রত্নটিকে।
কালের অববাহিকায় কোহিনূর হীরা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বহু কিংবদন্তী, উপকথা ও গল্পগাথার। মানুষের মননে ঢুকে গেছে বিভিন্ন ভ্রান্ত ও অন্ধবিশ্বাস। সেগুলো দূর করার উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে উইলিয়াম ডালরিম্পল ও অনীতা আনন্দ রচিত “কোহিনূর: দ্য স্টোরি অভ দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ইনফেমাস ডায়মন্ড” নামক বইটি।
বইটি থেকে আমরা জানতে পারি, ১৮৪৯ সালে কোহিনূর যখন তৎকালীন ভারতের গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির হাতে আসে, তখন তিনি প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করেন রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে সেটি পাঠানোর। কিন্তু কেবল হীরাটি পাঠালেই হবে কেন! সেটি যে ঠিক কতটা মূল্যবান, তা-ও তো রানীর সামনে তুলে ধরতে হবে। তাই লর্ড ডালহৌসি ঠিক করলেন, রত্নটির সাথে এর একটি আনুষ্ঠানিক ইতিহাসও প্রেরণ করবেন তিনি।
সেই লক্ষ্য অনুযায়ী তিনি নিয়োগ দেন দিল্লির একজন জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যাজিস্ট্রেট, থিও মেটক্যাফকে। মেটক্যাফের কাজ ছিল কোহিনূরের ইতিহাসের উপর গবেষণা করা, এবং সেই গবেষণার উপর ভিত্তি করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা। কিন্তু তিনি খুব একটা সুবিধে করতে পারেননি। ইতিমধ্যেই বাজারে কোহিনূর সম্পর্কে যেসব অতিকথন প্রচলিত ছিল, সেগুলোরই পুনরুল্লেখ করেন তিনি তার প্রতিবেদনে। অথচ তার সেই প্রতিবেদনটিকেই রেফারেন্স হিসেবে ধরে এরপর থেকে হাজার হাজার নতুন আর্টিকেল ও বই প্রকাশিত হয়েছে, নির্মিত হয়েছে বহু তথ্যচিত্রও। এভাবেই কোনো একসময়ে কোহিনূর বিষয়ক যেসব তথ্য ছিল নিছকই মনগড়া, শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশে সৃষ্ট, সেগুলোই পরবর্তীতে বিবেচিত হতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠিত সত্য হিসেবে।
ডালরিম্পল ও আনন্দের লক্ষ্য ছিল, অতিরঞ্জনগুলোকে ছেঁকে সেখান থেকে বাস্তব সত্যগুলোকে বের করে নিয়ে আসা। এবং সেই কাজটি তারা বেশ সফলভাবেই করতে পেরেছেন বলে রায় দিয়েছেন অনেক সমালোচক। বর্তমানে কোহিনূরের প্রকৃত ইতিহাস জানতে অনেকেই নির্ভর করছেন এই বইটির উপরই।
চলুন পাঠক, আলোচ্য বইটির আলোকে ভাঙা যাক কোহিনূর হীরা সম্পর্কে প্রচলিত এতদিনের মিথগুলো।
কোহিনূরই ভারতের একমাত্র সর্বশ্রেষ্ঠ হীরা নয়
ইতিহাস ঘেঁটে কোহিনূরের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্তত আরো দুটি হীরকখণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়। একটি হলো দরিয়া-ই-নূর (আলোর সাগর), এবং অপরটি “গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড” হিসেবে পরিচিত অরলভ হীরা। ১৭৩৯ সালে ইরানী শাসক নাদির শাহের লুটের অংশ হিসেবে তিনটি হীরাই ভারতবর্ষ ত্যাগ করেছিল। কেবল উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কোহিনূর পুনরায় পাঞ্জাবে ফিরেছিল, তখন থেকেই এটি সর্বশ্রেষ্ট হীরার তকমা পেতে শুরু করে, এবং এটি নিয়ে উচ্ছ্বাস শুরু হয়।
কোহিনূর নিখুঁত কোনো হীরকখণ্ড ছিল না
অনেকেই মনে করে থাকেন, প্রকৃত কোহিনূর হয়তো একদম নিখুঁত ছিল। কিন্তু আদতে তা সত্য নয়। এর উপর অনেকগুলো হলুদ রঙের দাগ ছিল। কয়েকটি দাগ তো এত বড় ছিল যে, সেগুলোর কারণে হীরাটি ঠিকভাবে আলো প্রতিফলনের ক্ষমতাই হারিয়েছিল। এ কারণেই রানী ভিক্টোরিয়ার স্বামী, যুবরাজ আলবার্ট এত বেশি আগ্রহী ছিলেন হীরাটিকে নতুন করে কাটানোর জন্য।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কোহিনূর বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরা তো নয়ই, এমনকি বৃহত্তম হীরার ধারেকাছেও নেই এটি। এর অবস্থান মাত্র ৯০তম। এ কারণেই টাওয়ার অফ লন্ডনে এর আকৃতি দেখে অনেক দর্শনার্থীই বেজায় অবাক হন। কেননা ঠিক পাশেই রাখা দুটি কালিনান হীরার সাথে তুলনা করলে কোহিনূরকে সত্যিই অনেক ক্ষুদ্রাকৃতির বলে মনে হয়।
কোহিনূরের জন্ম সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব
অনেকেরই দাবি, কোহিনূর হীরাটি নাকি ত্রয়োদশ শতকে ভারতের কোল্লুর খনি থেকে এসেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কবে, কোথায় এটি উত্তোলিত হয়েছে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া একদমই সম্ভব নয়। এবং এই অনিশ্চয়তাই তো একে এত বেশি রহস্যময় করে তুলেছে।
অনেকেই আবার বিশ্বাস করেন, কোহিনূর নাকি কৃষ্ণকে নিয়ে রচিত ভগবদ পুরাণের সেই সিমন্তক মণি। এবং মজার ব্যাপার, থিও মেটক্যাফের প্রতিবেদনেও রয়েছে এর উল্লেখ। সেখানে তিনি লিখেছেন, কিংবদন্তী অনুযায়ী কৃষ্ণের জীবদ্দশায়ই নাকি উত্তোলিত হয়েছিল কোহিনূর হীরা।
কিন্তু ডালরিম্পল ও আনন্দের বইটিতে জোর দিয়ে দাবি করা হয়েছে, কোহিনূর কোনো খনি থেকে উত্তোলন করা হয়নি, বরং এটি তোলা হয়েছে সম্ভবত দক্ষিণ ভারতের কোনো শুষ্ক নদীপৃষ্ঠ থেকে।
কোহিনূর কখনোই মুঘলদের সবচেয়ে মূল্যবান ধন ছিল না
এ কথা অবশ্যই সত্য যে হীরা এক মহামূল্যবান রত্ন। বিশেষত হিন্দু ও শিখদের কাছে এটি যেন অমূল্য। কিন্তু মুঘল ও ইরানীদের বিষয় আলাদা। তারা হীরার থেকেও বেশি পছন্দ করত বৃহৎ, আকাটা, উজ্জ্বল রঙের পাথর। আর সেজন্যই কোহিনূর হীরাকে মুঘলদের সবচেয়ে মূল্যবান ধন বলে যে দাবি করা হয়, তা যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয় না।
বস্তুত, মুঘলদের রাজকোষে ছিল বহু ধরনের মূল্যবান ধন-সম্পদ। কোহিনূর সেগুলোরই একটি। কিন্তু মুঘলরা সবচেয়ে বেশি অধিগ্রহণ করেছিল যে বস্তুটি, তা হীরা নয়। বরং তাদের বেশি ঝোঁক ছিল বাদাখশানের লোহিতক ও বার্মার পদ্মরাগমণির উপর।
কোহিনূরের (কিংবা হীরার) প্রতি মুঘলদের ঔদাসীন্য প্রমাণিত হয় আরেকটি ঘটনা থেকেও। কথিত আছে, নির্বাসিত থাকাকালীন মুঘল সম্রাট পারস্যের শাহ তাহমাসপকে উপহারস্বরূপ “বাবরের হীরে” বলে যে হীরাটি দিয়েছিলেন, সেটি নাকি ছিল আসলে কোহিনূরই।
বাবুরের হীরে পরে আবার দক্ষিণে ফিরে এসেছিল বটে, কিন্তু ঠিক কবে বা কীভাবে ফের মুঘল রাজদরবারে এর প্রত্যাবর্তন ঘটে, তা আজও অবিদিত।
পাগড়ি বিনিময়ের মাধ্যমে কোহিনূরের দখল নেননি নাদির শাহ
কথিত আছে, মোহাম্মদ শাহ রঙ্গিলা নাকি তার পাগড়ির ভিতর কোহিনূর লুকিয়ে রাখতেন। এ কথা জেনে যান নাদির শাহ, এবং তিনি এক সুচতুর কৌশল বের করেন। তিনি মোহাম্মদ শাহকে একটি প্রাচীন রীতির কথা মনে করিয়ে দেন: দুই বাদশাহ পরস্পর দেখা হলে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাগড়ি বিনিময় করবেন।
মোহাম্মদ শাহের বুঝতে বাকি ছিল না, নাদির শাহ আসলে হীরাটি ছিনিয়ে নিতে চাইছেন। অথচ তৎকালীন পরিস্থিতিতে পাগড়ি বিনিময়ে অস্বীকৃতির মাধ্যমে নাদির শাহের বন্ধুত্বের আহ্বান ফিরিয়ে দেয়াও তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তিনি বাধ্য হন পাগড়ি বিনিময় করতে। এভাবে পাগড়ির মালিক বনে যান নাদির শাহ। এরপর তিনি রাতের পাগড়ি পরিহিত অবস্থায় তার একান্ত কক্ষে প্রবেশ করেন। পাগড়ি খুলতেই হীরাটি দেখে তিনি বলে ওঠেন, কোহিনূর! এবং এভাবেই হীরাটির নাম হয়ে যায় কোহিনূর।
কিন্তু বাস্তবে মোহাম্মদ শাহের পক্ষে হীরাটি তার পাগড়িতে লুকিয়ে রাখা সম্ভব ছিল না। পারস্যের ইতিহাসবিদ মারভির চাক্ষুষ সাক্ষ্যমতে, ওই মুহূর্তে কোহিনূর হীরাটি সর্বকালের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ ও মূল্যবান আসবাব, শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসনের মাঝে বসে দ্যুতি ছড়াচ্ছিল।
কোহিনূর ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ নয়
ফরাসি রত্নবণিক ও পর্যটক জন-ব্যাপ্টিস্ট ট্যাভারনিয়ার মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছ থেকে অনুমতি পেয়েছিলেন তার ব্যক্তিগত রত্নালঙ্কারের সংগ্রহশালা পরিদর্শনের। তার ভাষ্যমতে, সম্রাটের ভাস্কর হোর্তেনসিও বোর্গিও খুব বড় আকারের একটি হীরাকে ভুলবশত কেটে ফেলেছিলেন। এর ফলে হীরাটির আকৃতি নষ্ট হয়ে যায়।
ট্যাভারনিয়ার ওই হীরাটিকে চিহ্নিত করেছিলেন “গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড” হিসেবে, যেটি শাহজাহান উপহার পেয়েছিলেন হীরক-বণিক মীর জুমলার কাছ থেকে।
একটা সময় পর্যন্ত অনেকেই বিশ্বাস করত, ‘গ্রেট মুঘল ডায়মন্ড’ই হয়তো কোহিনূর। কিন্তু বর্তমান সময়ের অনেক পণ্ডিত ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, সেটি ছিল আসলে অরলভ হীরা, যা বর্তমানে মস্কোর ক্রেমলিন জাদুঘরের শোভাবর্ধন করছে।
ইতিহাসের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/