সুইস রসায়নবিদ আলবার্ট হফম্যান সান্দোস ল্যাবরেটরি (বর্তমান নোভার্টিস)-তে প্রফেসর স্টলের সাথে মেডিসিনাল প্ল্যান্ট স্কুইল এবং আরগট নামের ছত্রাক নিয়ে নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন, যেন এসব থেকে প্রাপ্ত যৌগ বিশুদ্ধ ও সংশ্লেষণ করে ফার্মাসিউটিক্যালের জন্য কাজে লাগানো যায়। হফম্যানের মূল লক্ষ্য ছিল শ্বাসনালী এবং সংবহনতন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করতে পারে এমন কোনো ওষুধ বা রাসায়নিক প্রস্তুত করা।
১৯৩৮ সালের ১৬ নভেম্বরের বিকেলবেলা। হফম্যান ছত্রাক থেকে একটি যৌগ সংশ্লেষণ করতে সক্ষম হন। কিন্তু তিনি যে উদ্দীপক তৈরির চেষ্টা করছিলেন, যৌগটিতে তেমন কোনো উপাদান দেখতে পেলেন না। ফলে প্রজেক্টটি কয়েক বছরের জন্য বন্ধ রাখলেন।
এর পাঁচ বছর পরের ঘটনা। ১৯৪৩ সাল; তিনি আবারও অজ্ঞাত যৌগটি সংশ্লেষণের চিন্তা করলেন। পুনরায় সংশ্লেষণের পর দুর্ঘটনাক্রমে যৌগের ২৫০ মাইক্রোগ্রাম তিনি গিলে ফেলেন। এর মোটামুটি এক ঘন্টা পরের কথা। তিনি অদ্ভুত এক জগতে হারিয়ে যেতে থাকলেন। সেখানে আজব সব আকৃতির বস্তু, তীব্র আলোর ঝলকানি এবং বিভিন্ন আলোক বর্ণালীর উপস্থিতি বিদ্যমান। তিনি তার ল্যাবরেটরি সহকারীকে অনুরোধ করলেন তাকে বাসায় নিয়ে যেতে। তখনকার দিনে সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে সাইকেলের খুব প্রচলন ছিল। তারা সাইকেলে করে বাসার দিকে যাত্রা শুরু করেন বলে এই ঘটনাটি ‘বাইসাইকেল ট্রিপ’ নামে পরিচিত।
হফম্যান যে পদার্থটি দুর্ঘটনাক্রমে গিলে ফেলেছিলেন, সেটা ছিল বহুল আলোচিত ‘এলএসডি’ ড্রাগ! এলএসডির পূর্ণরূপ ‘লাইসারজিক এসিড ডাইইথাইল্যামাইড’। এটি একধরনের হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ যা একটি সাইকোঅ্যাকটিভ এজেন্ট, অর্থাৎ এটি খেলে মানুষ এক অবাস্তব জগতে হারিয়ে যেতে থাকে। হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগের কয়েকটি প্রকারের মধ্যে এলএসডি ‘সাইকাডেলিক ড্রাগ’ নামক প্রকারের মধ্যে পড়ে।
এলএসডি-কে এলএসডি না বলে অনেক সময় ‘এসিড’ নামেও ডাকা হয়। এছাড়াও এর আরো কয়েকটি নাম হলো স্ট্যাম্পস, লুসি, মাইক্রোডটস, পার্পল হার্টস, সানশাইন, হ্যাভেনলি ব্লু প্রভৃতি।
কিন্তু এটা কিভাবে একজন মানুষকে হ্যালুসিনেটেড করে ফেলে? এই ব্যাপারটি বুঝতে হলে মানব মস্তিষ্ক নিয়ে কিছুটা ধারণা থাকা জরুরি। আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের প্রাণরস বা হরমোন নিঃসরণ করে। এরা বিভিন্ন রাসায়নিক বার্তা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিয়ে যেতে পারে বলে এদের ‘নিউরোট্রান্সমিটার’ নামেও ডাকা হয়। উদাহরণ হিসেবে ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের নাম বলা যেতে পারে। এই রাসায়নিক বার্তা সংগ্রহের জন্য কোষগুলোতে রিসেপ্টর থাকে, যেমন- ডোপামিন রিসেপ্টর, সেরোটোনিন রিসেপ্টর।
সেরোটোনিন হরমোন আমাদের দেহের জন্য বিভিন্ন কাজ করে থাকে। যেমন- আবেগ নিয়ন্ত্রণ, মেজাজ স্থিতিশীল রাখা, গতিবিধি, ঘুম, খাওয়া, পরিপাক ইত্যাদি ঠিক রাখতে সাহায্য করে। এলএসডি যখন শরীরে প্রবেশ করে তখন এটি আসলে সেরোটোনিনকে নকল করে। ফলে আমাদের মস্তিষ্ক এলএসডিকে সেরোটোনিন হিসেবে ভেবে নিয়ে কোষের সেরোটোনিন রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হতে সাহায্য করে। আরো নির্দিষ্টভাবে বললে ‘সেরোটোনিন 2A’ রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়। এলএসডি মলিকিউল রিসেপ্টরের সাথে এমন প্রবল আকর্ষণে যুক্ত হয় যে সহজে আলাদা হতে চায় না, যার ফলে এলএসডির প্রভাব দীর্ঘসময় চলতে থাকে।
এলএসডি এর সাথে আরো একটি কাজ করে থাকে। মস্তিষ্কের ‘ডিফল্ট মুড নেটওয়ার্ক’ (ডিএমএন)-কে সে দুর্বল করে দেয়। অ্যানাটমির ভাষায় এটি ‘মিডিয়াল ফ্রন্টোপ্যারাইটাল নেটওয়ার্ক’ নামে পরিচিত। ডিএমএন বেশ কিছু কাজ, যেমন- দিবাস্বপ্ন, কারো সম্পর্কে ভাবা, অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে রোমন্থন করা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করে থাকে। এলএসডি এই ব্যাপারগুলোকে দমিয়ে ফেলে এবং পুরো মস্তিষ্কের মধ্যে যোগাযোগ ও সংযুক্তিকরণে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। এলএসডি গ্রহণের ফলে চিন্তাভাবনার যে একটি অপরিবর্তনীয় ছাঁচ আছে সেটাকে অতিক্রম করে ফেলে।
ডোজ পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় একজন ব্যক্তি হিংস্র বা আতংকিত হয়ে যেতে পারেন। তিনি কাউকে আক্রমণ করতে পারেন অথবা নিজেকেই আঘাত করে বসতে পারেন। এলএসডি গ্রহণকারীর ডোজ গ্রহণের পরবর্তী সময়ে এলএসডির কারণে ‘ওড়া’র অনুভূতি জাগতে পারে, যার কারণে অনেকেই জানালা বা বারান্দা থেকে লাফ দেয়। কিছু ব্যক্তি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা, ব্যক্তিত্বহানী, ক্রমাগত ভয়, ডিপ্রেশন, মুড সুইং, বিভ্রম ইত্যাদিতে আক্রান্ত হতে পারেন। ক্রমাগত এলএসডি ব্যবহার স্থায়ী মনোব্যধিতে রূপ নিতে পারে।
এলএসডি গ্রহণের কয়েকটি লক্ষণ হলো শুষ্ক মুখ, পিউপিল বড় হয়ে যাওয়া, হার্ট রেট বেড়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, ভয়ানক মুড সুইং, ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশন, গায়েবী আওয়াজ কিংবা গন্ধ পাওয়া, ‘ভেসে থাকা’ অনুভূত হওয়া ইত্যাদি। ১২-১৮ ঘন্টা পর্যন্ত এর প্রতিক্রিয়া থাকতে পারে।
অদ্ভুত সব হ্যালুসিনেশনের মুখোমুখি হবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১০% মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময় এলএসডি গ্রহণ করেছেন বলে ২০১৭ এর একটি সমীক্ষা বলছে। এমনকি বাংলা সাহিত্যেও এর কথা লেখা আছে। এলএসডির এই হ্যালুসিনেশনের বিষয়ে নিয়ে লিখেছেন সত্যজিৎ রায় তার ‘ফেলুদা’ সিরিজের ‘যত কান্ড কাঠমুন্ডুতে’ গল্পে।
সাহিত্য এবং মানব অভিজ্ঞতা থেকে আসা যাক সামরিক বাহিনীতে এলএসডির প্রয়োগ নিয়ে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র তত্ত্বাবধানে ১৯৫০ এর দিকে শুরু হয় ‘এমকে আল্ট্রা’ প্রজেক্ট। একে কখনও কখনও ‘মাইন্ড কন্ট্রোল প্রোগ্রাম’ নামেও ডাকা হতো। এই প্রজেক্টের অধীনে সিআইএ স্বেচ্ছাসেবক এবং বন্দীদের উপর এলএসডি এবং অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে। সিআইএ মনে করেছিল, এলএসডি তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘মানসিক অস্ত্র’ হতে পারে। তবে ১৯৬৪ সালে এসে এই প্রজেক্টের পরিধি সীমিত করে আনা হয়।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি, মেডিকেল ফ্যাসিলিটি, এমনকি মিউজিক্যাল পারফরম্যান্স ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেও এলএসডি নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা চালানো হয়। ১৯৬০ এর শুরুর দিকে সান ফ্রান্সিসকোর একটি মিউজিক্যাল পারফরম্যান্সে অংশগ্রহণকারীদের উপর এলএসডি প্রয়োগ করা হয়, যা ‘এসিড টেস্টস’ নামে পরিচিত।
একই সময়ে হার্ভাডের সাইকোলজির প্রফেসর টিমোথি ল্যারি এবং রিচার্ড আলপার্ট এলএসডি ও অন্যান্য সাইকাডেলিক ড্রাগ নিয়ে একটি পরীক্ষা চালান শিক্ষার্থীদের ওপর। তারা মূলত ছাত্র-ছাত্রীদের চেতনার উপর হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগের প্রভাব দেখতে চাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে তাদেরকে হার্ভাড থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ল্যারি পরবর্তীতে এলএসডিকেন্দ্রিক একটি ‘সাইকাডেলিক রিলিজিয়ন’ খুলে বসেন, যার নাম দেন ‘লীগ ফর স্পিরিচুয়াল ডিসকভারি’। এছাড়াও ১৯৫০ সালের দিকে থেরাপিস্টরা নিউরোসিস, অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার, অ্যালকোহলিজম ইত্যাদি সমস্যার সমাধান এলএসডি দিয়ে করার চেষ্টা করেছিলেন।
মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহারের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০ সালে এলএসডি-কে ‘দ্য আনকন্ট্রোল্ড সাবস্টেন্সেস অ্যাক্ট’ এর অধীনে আনা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের কনভেনশনে একে নিষিদ্ধের কথা বলা হয়, যার জন্য বেশিরভাগ দেশেই এলএসডি এখন এক নিষিদ্ধ রাসায়নিক।