নারীবাদের উৎপত্তি নারীকে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেবার জন্য হয়নি। নারীবাদ তত্ত্ব বা ফেমিনিস্ট থিওরির মূল কথা হচ্ছে লিঙ্গ সমতা নির্ধারণ ও স্থাপন। সাম্য আনতে গিয়েও তত্ত্বের নামে শুধু ‘নারী’ ট্যাগ লাগানো এবং এই তত্ত্বের মূল কথাকে অতিক্রম করে এর নাম অর্থাৎ ‘নারীবাদ’ শব্দটি ধারণার সাথে পরস্পরবিরোধিতার শিকার হচ্ছে আজকের সমাজে। নারীবাদী বলতেই উপরি সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া, এমনটাই মনে করেন অনেকে। কিন্তু মূল নারীবাদ সাম্য চেয়েছে, অতিরিক্ত লাভ কিংবা লোকসানও নয়। মূল নারীবাদের ফোকাসে রেখেছে ‘লিঙ্গ বৈষম্য’কে এবং তারপর একে সমূলে উৎপাটন করতে। কাউকে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে যাতে বলতে না হয়, “নারীও তো মানুষ”, বরং চোখ বন্ধ করে আত্মবিশ্বাসের সাথে যেন সবাই ভাবতে পারে, “নারী-পুরুষ উভয়েই মানুষ”।
‘ফেমিনিজম’ শব্দটি কখন এলো?
প্রথমদিকে নারীবাদী আন্দোলনকারীরা নিজেদের আদৌ ‘নারীবাদী’ ভাবতেন না। তারা নিজেদেরকে ভোটাধিকারপ্রার্থী বলেই অভিহিত করতে স্বচ্ছন্দবোধ করতেন। ফেমিনিজম শব্দটি প্রথম পরিচিতি পায় ফ্রান্সে, অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। তখনও পর্যন্ত কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই শব্দটি অজানাই ছিল। এমনকি যাকে বলা হয় ফেমিনিজমের প্রথম ঢেউ, সে সময়েও ‘ফেমিনিজম’ শব্দটি আসেনি। ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘Feminisme’ থেকে উৎপত্তি হয়েছে ইংরেজি ‘Feminism’-এর। এটি প্রথম প্রবর্তিত হয় সমাজতন্ত্রবিদ চার্লস ফুরিয়ারের মাধ্যমে। ইংরেজি ভাষায় সর্বপ্রথম এর ব্যবহার এই আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে, ১৯৯০ সালে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীবাদী আন্দোলনের তিনটি পর্যায় ছিল। ধাপে ধাপে তা পূর্ণতা পেয়েছে এবং পূর্বের ভুল থেকে শিক্ষাগ্রহণও করেছে। এই তিন পর্যায়ে ‘নারীবাদ’-এর ধারণা অভিজাত শ্রেণি থেকে ক্রমেই হয়ে উঠেছে আপামর জনতারও। এই লেখায় আমরা নারীবাদের এই তিনটি পর্যায়ের উপর আলোকপাতের চেষ্টা করবো।
প্রথম ধাপ
উনবিংশ শতক জুড়ে এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে এই আন্দোলনের প্রথম পর্যায়টি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সময় নারীরা কোন কোন ব্যাপার থেকে দূরে ছিল, সেটা একটু দেখে নেয়া যাক।
- উইল কিংবা কোনো আইনি কাগজে স্বাক্ষর দেয়া
- বিচারক কিংবা জুরিবোর্ডের সদস্য হওয়া
- নির্বাচনে ভোট দেয়া
- স্বামীর সাথে যৌন সম্পর্কে অসম্মতি জানানো
- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া
- সন্তানের আইনি কাস্টডি পাওয়া
- বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া
- কোনোপ্রকার সম্পত্তির অধিকার রাখা
এই ছিল তখনকার পশ্চিমা নারীদের জীবনযাপনের ধরন। নারী নিজে কোনো সম্পত্তির অধিকার রাখতে পারতো না, কারণ সে নিজেই কারো সম্পত্তি ছিল। হতে পারে সেটা তার স্বামী, বাবা কিংবা ভাই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যেখানে নারীকে নিজের সম্পত্তি এবং অধিকারের একটা বাধ্যগত জায়গা হিসেবে চালিয়ে যাচ্ছিলো, তখনই একটা ঢেউয়ের শুরু হয় এই বৈষম্যগুলোর বিরুদ্ধে। সেটিকেই আজ আমরা জানি নারীবাদের প্রথম ধাপ হিসেবে। এটি একটি নির্দিষ্ট সময়জুড়ে চলেছিলো। আনুষ্ঠানিকভাবে নারী আন্দোলনের বীজ বলা যায় এই সময়টুকুকে। যদিও সচেতনতার শুরু আগে থেকেই হয়েছিল, কিন্তু এরও যে একটি ভবিষ্যত হতে পারে, তার প্রথম স্বীকৃতি এই ধাপটিই।
এই পর্যায়ের দাবিগুলো ছিল
- ভোটাধিকার
- রাজনৈতিক সমতা
- আইনি অধিকার
আনুষ্ঠানিকভাবে এর শুরুটা হয়েছিলো ১৮৪৮ সালে ‘সেনেকা কনভেনশন ফলস’-এ। সেখানে ৩০০ নারী-পুরুষ একসাথে সমবেত হয়েছিলো নারী অধিকারের পক্ষে। এ সময় বর্ণবাদী আন্দোলনের সাথেও নারীবাদের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। আমেরিকার নারীরা তাদের ‘লর্ড’-এর পাশে গম্ভীর ও সুসজ্জিত ‘লেডি’ চেহারা থেকে বেরিয়ে এসে রাজনৈতিক সচেতনতা গ্রহণ করতে শুরু করলে তখনকার নারী-পুরুষের আসল বৈষম্য যেন সকলের চোখে পড়ে। ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকে আমেরিকা তখনও বেরিয়ে আসেনি, তাদের মজ্জাগত জীবনে তখনো রয়ে গিয়েছিলো তথাকথিত কিছু লৈঙ্গিক সংজ্ঞা।
এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন ভল্টারিন ডি ক্লেইর ও মার্গারেট সাঙ্গার। তারা অর্থনৈতিক সাম্য ও সন্তানদানে জন্মদানে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করেছিলেন। তারা জানতেন যে দারিদ্র্য ও অবাধে জন্মদান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং এজন্যই তাদের লক্ষ্য ছিল এতে নারীর সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে এই আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে ভূমিকা রাখেন লুসি স্টোন, এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন, সুজান বি অ্যান্থনি, অলিম্পিয়া ব্রাউন, হেলেন পিটস প্রমুখ। একটি বেশ পরিসরের নারীদের পেয়েছিলো এই আন্দোলন এবং সবাই এতে সচেতনভাবে নিজের জায়গা থেকে অংশ নিয়েছিলেন। ব্রিটেনে ১৯১৮ সালে ‘দ্য পিপলস রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য অ্যাক্ট’ পাশ হয় এবং ত্রিশোর্ধ্ব নারী, যাদের নিজস্ব বাড়ি আছে তারা ভোট দেবার জন্য উপযুক্ত বলে স্বীকৃতি পান। ১৯২৮ সালে এই শর্ত সরে গিয়ে ১৮ বছরের উর্ধ্বে সকল নারীর জন্যই ভোটাধিকার দেয়া হয়। নারীবাদী আন্দোলনের প্রথম ধাপের সমাপ্তি ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ঊনবিংশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯২০ সালের এই সংশোধনীটিতে মুখ্য হয়ে ছিলো ‘নারীর ভোটাধিকার’ অংশটুকু।
দ্বিতীয় ধাপ
এই অংশটি প্রথম ধাপেরই ধারাবাহিকতা বহন করছিলো। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সময়কে ধরা হয় নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ। নারীর ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবন যে পুরোপুরি আন্তঃনির্ভরশীল, এই বোধটি জেগে ওঠে এ ধাপে। ক্যারল হ্যানিশের একটি প্রবন্ধের শিরোনাম ‘The Personal is Political’ তখন যেন নারীবাদেরই সমার্থক একটি শ্লোগান হয়ে উঠেছিলো। এই শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর হয় সম-অধিকারের আন্দোলনটি। প্রথম ধাপ যেমন মৌলিক বিষয়গুলোর উপর আলোকপাত করেছিলো, এ সময় ব্যাপারটি আরেকটু অগ্রসর হয়ে প্রবেশ করে আপাতদৃষ্টিতে কিছু গৌণ বিষয়েও। যেমন- শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের প্রতি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ, সাংস্কৃতিক বৈষম্য, ক্ষমতার লৈঙ্গিক প্রতিচ্ছবি ইত্যাদি বিষয়ে জোর দেয়া হয় আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে এসে। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু সক্রিয় কার্যক্রম হয় যার ফলস্বরূপ ১৯৬৮ সালে আসে ‘Women’s Liberation Front’। এ সময় তথাকথিত নারীসুলভ দ্রব্যাদি ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে বা পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়ে চাপিয়ে দেয়া সংজ্ঞা ‘নারী’র প্রতি।
১৯৬৩ সালে আমেরিকান নারীবাদী লেখক বেটি ফ্রিড্যান রচিত বই ‘The Feminine Mystique’ নারীবাদী আন্দোলনকে এক অন্যরকম গতি প্রদান করে। এতে তিনি নারীর শুধুমাত্র ‘গৃহিণী’ ভূমিকাটি যে একজন নারীকে কতটা অপূর্ণ করে রাখে, তা নিয়ে হাইপোথিসিসমূলক ধারণা দিয়েছেন। নারীর অন্যান্য ভূমিকা তার পূর্ণতার জন্য কতটুকু গুরুত্ব বহন করে এবং কীভাবে এটি অর্জন করতে হবে, কীভাবে মিথ্যে বিশ্বাসের ছায়া থেকে নারীকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে- এসবই বলেছেন এই বইয়ে। এতে তিনি নারীর আবহমান ভূমিকা ছেড়ে এসে আত্মতৃপ্তি খুঁজবার আহ্বান জানিয়েছেন। ঠিক সে সময়ে বইটি অনেক বেশি তাৎপর্য রেখেছিলো নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে। এই বইটি তখনকার সকল মানুষকে একটা ধাক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিলো এবং বহু নিন্দা-সমালোচনার পরও অনেক নারীই লেখককে চিঠি পাঠাতো এই বলে যে, তাদের জীবনে বইটি ইতিবাচক সাড়া ফেলতে পেরেছে। বইটি রাতারাতি বেস্টসেলারও হয়।
দ্বিতীয় ধাপের ত্রুটি-বিচ্যুতি
নারীদের কর্মক্ষেত্রে পাঠানোর সাথে সাথেই কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি তাদের ‘গৃহিণী’ ভূমিকাটিও। পুরুষ যখন বাইরে কাজ করে, সে ঘরের চিন্তা খুব কমই করে। কিন্তু নারীদের মাথার উপর চাপ থেকে যায় ঘর সামলানোর। আর দ্বিতীয় ধাপ এক্ষেত্রে এসে জন্ম দেয় ‘সুপার মম’ ধারণার। সন্তানও মনে করে মা বাইরে-ঘরে সমান তালে কাজ করবে এবং একটুও হাঁপাবে না। ‘মা’ মানেই তার কাছে হয়ে ওঠে সব্যসাচী কোনো চরিত্র। নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ নারীকে কর্মক্ষেত্রে যাবার স্বাধীনতা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেই সাথে জুড়ে দিয়েছে এই ‘সুপার মম’ ট্যাগটিও! এছাড়াও এই ধাপের পরিকল্পনার সাথে সবসময় আন্দোলন সমান তালে তাল মেলাতে পারেনি এবং তাই হয়তো এর স্থায়িত্বও খুব বেশি ছিল না।
তৃতীয় ধাপ
স্বাভাবিকভাবেই দ্বিতীয় ধাপের শেষে এসে এই সময়ের শুরু হয়। এই ধাপে এসে নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকেছেন অড্রে লোর্ড, চেরি মোরাগা, গ্লোরিয়া আঞ্জালডুয়া, চেলা স্যান্ডোভাল, বেল হুকস, ম্যাক্সিন হং কিংস্টোন এবং নাম না জানা আরো অনেক কৃষ্ণাঙ্গ নারীবাদী। দ্বিতীয় ধাপের ভুলগুলো শুধরাতেই যাত্রা শুরু করে তৃতীয় ধাপের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা। দ্বিতীয় ধাপের সুবিধা ভোগকারী নারীবাদের সীমাবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে আসাই ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য। নিম্নবিত্ত ও অন্যান্য সংস্কৃতির নারীদেরকেও এই ধাপে এসে সংযুক্ত করা হয় আন্দোলনের সাথে এবং বাস্তব জীবনের কষ্টিপাথরে ‘নারীবাদ’কে যাচাই করে নেয়া শুরু হয়। ১৯৯১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে মনোনীত হওয়া এক ব্যক্তি ক্লারেন্স টমাসকে শ্লীলতাহানির জন্য অভিযুক্ত করে আনিতা হল নামে এক নারী। কিন্তু বহু তর্ক-বিতর্কের পর সিনেট ভোট অভিযুক্তেরই পক্ষে যায়। এই কেসটির সাড়া হিসেবে ‘Becoming the Third Wave’ শিরোনামে রেবেকা ওয়াকার একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন, যাতে তিনি বলেছিলেন, “আমি নারীবাদ পরবর্তী কেউ নই, আমিই তৃতীয় ঢেউ”। একে নারীবাদের তৃতীয় ধাপের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও বলা যেতে পারে।
এভাবেই পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীবাদ আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করে।