দ্বিতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধের পর ফ্ল্যামিনিনাসের ঘোষণা মোতাবেক গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীন কার্যক্রমের অনুমোদন প্রদান করা হয়। কিন্তু গ্রিসের কাছে এই ঘোষণার মানে ছিল পূর্ণ স্বাধীনতা এবং নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করার অধিকার, অন্যদিকে রোমান সিনেটের কাছে এর মানে ছিল রোমের স্বার্থ বিনষ্ট হয় এমন কাজ পরিহার করা। এই পরিপ্রেক্ষিতে আকিয়ান লীগ ও স্পার্টার বিবাদ নিরসনে রোমান সিনেটের দেয়া রায় নিয়ে আকিয়ান লীগের ভেতর অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ক্রমে ক্রমে এখানে এবং অন্যান্য নগর রাষ্ট্রে দু’টি পক্ষের জন্ম হয়, রোম সমর্থক এবং রোমবিরোধী। বিরোধীরা রোমের ক্ষমতা প্রতিস্থাপনের তাগিদের মেসিডোনিয়ার সাহায্য কামনা করে।
এদিকে তৃতীয় অ্যান্টিওকাসের বিরুদ্ধে সিরিয়াতে রোমের অভিযানে ফিলিপ গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য দিয়েছিলেন। তার আশা ছিল এর পুরস্কার হিসেবে রোম তাকে দ্বিতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধের পর হারানো অঞ্চলগুলো ফেরত দেবে। কিন্তু রোমান সিনেট শক্তিশালী মেসিডোনিয়াকে রোমের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখতে চায়নি। তাই তারা ফিলিপের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। সুতরাং ফিলিপ রোমের আওতা থেকে বের হয়ে আসার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। এজন্য প্রথমেই তিনি সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেন। এছাড়া গ্রিসের রোমবিরোধী অন্যান্য শক্তির সাথে তিনি জোট গঠনের প্রচেষ্টা শুরু করেন।
১৭৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিলিপের মৃত্যু হলে সিংহাসনে বসলেন তার পুত্র পার্সেউস। তিনি ফিলিপের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ হাজার সৈন্যের বাহিনী পেয়েছিলেন, আর কোষাগারে ছিল ৬,০০০ ট্যালেন্ট, যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৭,২০০,০০০ মার্কিন ডলার। পার্সেউস উদ্যমের সাথে পিতার অসমাপ্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলেন। রোমবিরোধী অনেকের সাথে মৈত্রী স্থাপিত হল। এছাড়াও উত্তরদিকে তার সাম্রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করার আগ্রহ রোমান সিনেটের কাছে অশনিসংকেত মনে হল। গ্রিস থেকে রোমান মিত্ররা তাকে নিয়মিতভাবে সব খবরাখবর জানাচ্ছিল। ১৭২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান সিনেটের প্রেরিত প্রতিনিধিরা পার্সেউসের কাছে সিনেটের দাবি পেশ করলেন। মেসিডোনিয়ার স্বাধীনতা রোমের কাছে বিসর্জন দিতে বলা হল।অনুমিতভাবেই পার্সেউস রাজি হলেন না। সূচনা হল তৃতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধের।
গ্রিসে রোমান সেনাদল
মার্চ, ১৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
রোমান কন্সাল ক্রাসুস অ্যাড্রিয়াটিক অতিক্রম করে অ্যাপোলনিয়াতে পৌঁছলেন। তার সাথে ৩৫,০০০ পদাতিক ও ২,০০০ অশ্বারোহী। রোম ও পার্গামনের যৌথ নৌবহর গ্রিসের পূর্ব উপকূল জুড়ে টহল জারি করল, আর ক্রাসুস স্থলপথে সেনাবাহিনী নিয়ে এপিরাস হয়ে থেসালির দিকে এগিয়ে গেলেন। পার্সেউস সেখানেই ঘাঁটি করেছিলেন। তার সাথে যোগ দিয়েছিল তার মিত্ররা। সব মিলিয়ে তার বাহিনীতে ৪,০০০ অশ্বারোহী সহ প্রায় ৪৩,০০০ যোদ্ধা ছিল, যার মধ্যে ৫,০০০ আবার ছিল এলিট মেসিডোনিয়ান রাজকীয় এলিট ফোর্স। ক্রাসুস যখন থেসালিতে এলেন, তখন ২,০০০ অশ্বারোহী ও ৫,৫০০ পদাতিক নিয়ে রোমান মিত্ররা তার বাহিনীতে যোগ দিল।
ক্যালনিসাস (১৭১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
রোমান বাহিনী থেসালির ক্যালনিসাস পাহাড়ের কাছে শিবির স্থাপন করল। তাদের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ের ইচ্ছায় পার্সেউস খুব কাছে তার ক্যাম্প সরিয়ে আনলেন। তার দলের অশ্বারোহী ও হাল্কা অস্ত্রে সজ্জিত যোদ্ধাদের সাথে রোমানদের ছোট একটি দলের সংঘর্ষে মেসিডোনিয়ানরা বিজয়ী হলে তিনি পূর্ণ আক্রমণের প্রস্তুতি নেন।
পার্সেউস তার ফ্যালানক্স মোতায়েন করে অশ্বারোহী ও হালকা অস্ত্রের পদাতিকদের পাঠালেন। এদিকে ক্রাসুস তার মূল শক্তি, ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পদাতিকদের শিবিরের ভেতরে রেখে শুধু অশ্বারোহী আর হাল্কা অস্ত্রধারী পদাতিক যোদ্ধাদের নিয়ে পার্সেউসের মোকাবেলা করলেন। মেসিডোনিয়ান অশ্বারোহীদের প্রবল চাপে ক্রাসুসের ডানবাহু ভেঙে পড়ল। সেনাদলের মধ্যভাগও পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো। রোমান বাহিনী পিছু হটে শিবিরে চলে যায়। প্রায় ২০০ অশ্বারোহী ও ২,০০০ পদাতিক রোমান সেনা হতাহত হয়। কিন্তু, ফ্যালানক্সের গঠন শিবির আক্রমণের উপযুক্ত না হওয়ায় পার্সেউস আর অগ্রসর হলেন না।
ক্রাসুস এরপর পার্সেউসের সাথে সরাসরি লড়াইতে না গিয়ে থেসালি আর বোটিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল অধিকার করায় ব্যস্ত থাকলেন। এর মধ্যে নুমিডিয়া থেকে তার কাছে এক হাজার সুদক্ষ অশ্বারোহী, এক হাজার পদাতিক ও ২২টি হাতি এসে পৌঁছে। কিন্তু তিনি এর সঠিক ব্যবহার করতে ব্যর্থ হন এবং ১৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ কোনো সাফল্য ছাড়াই কেটে যায়। রোমান বাহিনী মেসিডোনিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় থেসালির ভেতরেই রয়ে গেল, চেষ্টা করেও তারা মেসিডোনিয়াতে ঢুকতে পারছিল না।
১৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান কম্যান্ডার ফিলিপাস মেসিডোনিয়াতে প্রবেশ করলেও সেনাবাহিনীর রসদ ও সরঞ্জামের অভাবে আবার পিছিয়ে আসতে বাধ্য হন। অবস্থার পরিবর্তন হলো ১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, নতুন রোমান কম্যান্ডার লুসিয়াস অ্যামিলিয়াস পলাস দায়িত্ব নিলে।
পিডনার যুদ্ধ (১৬৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দ)
১৬৮-৬৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শীতে পার্সেউস মাউন্ট অলিম্পাসের কাছাকাছে মেসিডোনিয়ার প্রবেশপথের উপর দুর্গ নির্মাণ করে পাহারা দিচ্ছিলেন। পলাস রোমানদের নিয়ে ঘুরপথে তাকে কাটিয়ে চলে গেলে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রুত মেসিডোনিয়াতে ফিরে আসেন। এখানে পিডনার কাছে দুই সেনাদল মুখোমুখি হয়।
পার্সেউস ফ্যালানক্সের দুই পাশে তার অশ্বারোহী ও হালকা অস্ত্রধারী পদাতিকদের রেখে এগিয়ে গেলেন। সারিবদ্ধ ফ্যালানক্সের প্রবল চাপে রোমান বাহিনীর পিছু হটে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তাদের সম্মুখসারি প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। কিন্তু পলাস লক্ষ করেন যে, ফ্যালানক্স যত অগ্রসর হচ্ছে, তাদের মধ্যে ততই ফাঁক-ফোকরের সৃষ্টি হচ্ছে। তার নির্দেশে রোমান সেনারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সেই ফাঁক দিয়ে মেসিডোনিয়ান বাহিনীর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ল।
একেকজনের লড়াইতে রোমান সেনাদের তরবারি আর ঢাল মোকাবেলা করার সামর্থ্য ফ্যালানক্সের যোদ্ধাদের ছিল না। পলাস তার হাতিবাহিনীর সাহায্যে পার্সেউসের অশ্বারোহী দল ছত্রভঙ্গ করে দিলেন। মেসিডোনিয়ান সেনাদল ধ্বংস হয়ে গেল। ২০ থেকে ২৫ হাজার সেনা নিহত হল, প্রায় ১১ হাজার সেনাকে রোমানরা বন্দি করল।
পার্সেউস পালিয়ে যান এবং পরে আত্মসমর্পণ করেন। রোম পুরো মেসিডোনিয়াকে চারটি স্বাধীন রাজ্যে ভাগ করে দেয়, যাদের মধ্যে বাণিজ্যিক ও সামাজিক যোগাযোগ নিষিদ্ধ ছিল। পার্সেউস ও তার পরিবারকে বন্দি করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানেই কয়েক বছর পর নীরবে-নিভৃতে মেসিডোনিয়ার সর্বশেষ সম্রাটের মৃত্যু ঘটে। এভাবেই পতন ঘটল এককালের পরাক্রমশালী মেসিডোনিয়ান সাম্রাজ্যের।
গ্রিসের উপর রোমের প্রভুত্ব স্থাপন
তৃতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধের পরেই এটা পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, রোম গ্রিসকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার সুযোগ কখনোই দেবে না। গ্রিসের বিভিন্ন রাষ্ট্রে রোমবিরোধীদের উপর হত্যা ও নির্যাতন নেমে আসে। আকিয়ান লিগের শহরগুলো থেকে প্রায় এক হাজার খ্যাতনামা গ্রিককে রোমে জিম্মি হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়, যার মধ্যে বিখ্যাত ঐতিহাসিক পলিবিয়াস অন্যতম। রোমের মিত্র হিসেবে পরিচিত রোডিয়ান ও পার্গামনও বাদ যায়নি। পিডনার যুদ্ধের আগে রোডস রোম ও মেসিডোনিয়ার মধ্যে শান্তির চেষ্টা করেছিল, তার সিনেট শাস্তি হিসেবে এশিয়া মাইনরে তাদের সকল অঞ্চল কেড়ে নেয়।
এছাড়া ডেলোস দ্বিপে রোম সমুদ্রবন্দর স্থাপন করে যা রোডসের একচেটিয়া নৌবাণিজ্যের সমূহ ক্ষতি করে। পার্গামনও তাদের বিজিত বেশকিছু এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সবথেকে খারাপ ভাগ্য বরণ করে এপিরাস। এর ৭০টি শহর পুড়িয়ে দেয়া হয়, প্রায় দেড় লাখ অধিবাসীকে বিক্রি করে দেয়া হয় দাস হিসেবে। গ্রিসের অন্যান্য অনেক নগর রাষ্ট্র মেসিডোনিয়ার মতো ভাগ করে ফেলে তাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।
এসময় রোমের দাপট কতটা ছিল, তা চতুর্থ অ্যান্টিওকাসের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। তৃতীয় মেসিডোনিয়ান যুদ্ধ চলাকালে সিরিয়ার তৎকালীন সম্রাট চতুর্থ অ্যান্টিওকাস ইজিপ্ট আক্রমণ করেন। পিডনার যুদ্ধের পর রোমান সিনেটের প্রতিনিধি পপিলাস তার সাথে দেখা করতে আসেন। অ্যান্টিওকাস তখন আলেক্সান্ড্রিয়ার বাইরে, শহর দখল করার ছক কষছেন। পপিলাস অত্যন্ত সাদামাঠাভাবে তাকে জানান যে, হয় তাকে ইজিপ্ট ছেড়ে চলে যেতে হবে, নতুবা রোমের সাথে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। সম্রাট তার সিদ্ধান্ত জানাতে সময় নিচ্ছিলেন। তখন পপিলাস সম্রাটের চারিদিকে বালুতে বৃত্ত আঁকলেন এবং তাকে এই বৃত্ত ছেড়ে বের হবার আগেই সিদ্ধান্ত জানাতে হবে বলে দাবি জানান। অ্যান্টিওকাস ইজিপ্ট ছেড়ে ফিরে এসেছিলেন।
পিডনার লড়াইয়ের প্রায় বিশ বছর পর রোমের বিরুদ্ধে গ্রিসে আবার অসন্তোষ মাথাচাড়া দেয়, যা সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। এর শুরু হয় মেসিডোনিয়ান আন্ড্রিস্কাসের হাত ধরে, যিনি নিজেকে পার্সেউসের সন্তান বলে দাবি করতেন। এজন্য অনেকসময় এই অসন্তোষকে চতুর্থ মেসিডোনিয়ান যুদ্ধে নামেও অভিহিত করা হয়, যা আনুমানিক ১৪৯-১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত চলেছিল। ১৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমান জেনারেল মেটালাস আন্ড্রিস্কাসকে দু’টি লড়াইতে পরাজিত করার পর মেসিডোনিয়াকে রোম আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয় এবং এর এর শাসনের জন্য রোমান ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করে।
একই সময় স্পার্টার সাথে আকিয়ান লিগের এক বিবাদের জের ধরে মেটালাস আকিয়ান সেনাবাহিনীকে স্কারফিয়ার যুদ্ধে পরাজিত করলে গ্রিক বিদ্রোহীদের অবশিষ্টাংশ করিন্থে আশ্রয় নেয়। ১৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিনেটের নির্দেশে নতুন রোমান কম্যান্ডার মামিয়াস গ্রিসের শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান করিন্থ ধুলোয় মিশিয়ে দেন। এর সমস্ত মূল্যবান জিনিস রোমানরা লুট করে নিয়ে যায় এবং এর সকল স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। এর অধিবাসীদের কপালে জোটে দাসত্বের বাঁধন। গ্রিসের নতুন নাম হয় আকিয়া, রোমের একটি প্রদেশ।