মানব প্রজননশাস্ত্র ও জীবতত্ত্ব বেশ বিস্ময়কর এবং চমৎকার একটি বিষয়। এই যে আমাদের দেহ কত পরিপূর্ণ এবং সুগঠিত! দেহের অভ্যন্তরটাও যেন অত্যন্ত যত্ন সহকারে সাজানো! প্রতিটি অঙ্গ, অঙ্গতন্ত্র যে যার মতো সুপরিকল্পিতভাবে নিজেদের কাজ করে চলেছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে সুন্দরভাবে সাজানো এই মানবদেহেই কিছু ব্যাধি বা শারীরিক বিশৃঙ্খলা বাঁধে। ডাক্তারি ভাষায় যাকে ডিজঅর্ডার বলে। তাছাড়া বংশগতি বা জেনেটিক্স নির্ধারণ করে দেয় আমরা কতটুকু বেড়ে উঠবো বা লম্বা হবো।
কিছু ডিজঅর্ডারের কারণে যেমন জাইগান্টিজম এবং মারফান সিন্ড্রোমের কারণে অনেকে স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্তভাবে বেড়ে উঠেন। যেমন পিটার মেহিউ (স্টার ওয়ারস সিনেমার চিউবাকা) এবং আন্দ্রে দ্য জায়ান্ট- এর উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দুজনই সাত ফুটেরও বেশি লম্বা ছিলেন। আবার জেনেটিক্সের কিছু ডিজঅর্ডারের কারণেই অনেকে আবার ক্ষুদ্রাকায় থেকে যান; যা ডোয়ার্ফিজম নামে পরিচিত।
তবে অ্যাডাম রেইনারের বিষয়টি ছিলো আরো অদ্ভুত। সাধারণত দেখা যায়, যার যে আকার সারাজীবন তা-ই থেকে যায়। কিন্তু অ্যাডাম রেইনার তার সারা জীবনে একই সাথে পরিচিত হয়েছিলেন ক্ষুদ্রকায় এবং দৈত্যাকার মানব হিসেবে। কারণ জীবনের প্রথমভাগে অ্যাডাম ছিলেন বেশ বামনাকৃতির। যৌবনের পরের ভাগে এই অ্যাডামই বাড়তে বাড়তে হয়ে গিয়েছিলেন দৈত্যাকৃতির। আসুন আজ একাধারে এই বামন এবং দৈত্যাকৃতির ব্যক্তির ব্যাপারে জানা যাক।
১৮৯৯ সালে অ্যাডাম রেইনার অস্ট্রিয়ার গ্র্যাজে জন্মগ্রহণ করেন। অ্যাডামের পিতা-মাতা দুজনেই দৈহিকভাবে স্বাভাবিক উচ্চতার ছিলেন। কিন্তু অ্যাডাম কখনোই তা ছিলেন না। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্ট্রিয়ান সেনাবাহিনীতে সৈন্য অধিভুক্তির সময় অ্যাডামেরও ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিলো।
ডাক্তারদের মতে, অ্যাডামের সৈন্য হবার মতো দৈহিক সামর্থ্য ছিলো না, কারণ সে ছিলো আকারে খাটো এবং শারীরিকভাবে দুর্বল। কারণ তখন বয়স ১৮ হওয়া সত্ত্বেও তার উচ্চতা ছিলো মাত্র ৪ ফুট ০.২৫ ইঞ্চি বা ১২২.৫৫ সেন্টিমিটার। অ্যাডাম আকারে খাটো হলেও তার হাত এবং পায়ের পাতা তুলনামূলকভাবে বড়সড় ছিল। দুই বছর পর অ্যাডাম আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে গেলে পুনরায় অনুপযুক্ত হিসেবে গণ্য হন। কারণ এই দু’বছরে তার উচ্চতা বেড়েছিল মাত্র দুই ইঞ্চি। যা সেনাবাহিনীর সর্বনিম্ন উচ্চতার মাপকাঠি (৪ ফুট ১০ ইঞ্চি) থেকে কম। যদিও সেসময় তিনি বেশ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন, তবুও তাকে ডাক্তারিভাবে বামন হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো।
১৯২০ সালে অ্যাডাম রেইনার ২১ বছর বয়সে পদার্পণ করেন। তখনও তিনি স্বাভাবিকের তুলনায় ছিলেন খাটো। তবে সে সময়েই কিছু একটা হয়েছিলো তার দেহে। ২১ বছরের সেই সময়টাতে, যখন অধিকাংশ মানুষেরই দৈহিকভাবে বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়, ঠিক সে সময়টিতেই রেইনার দ্রুত শারীরিকভাবে বাড়তে থাকেন। তার এই বৃদ্ধি এতটাই মাত্রাতিরিক্ত ছিল যে, মাত্র এক যুগের মধ্যে তার উচ্চতা ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি থেকে ৭ ফুট ১ ইঞ্চি হয়।
তৎকালীন ডাক্তাররাও বেশ হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন রেইনারের এমন অদ্ভুত শারীরিক বৃদ্ধিতে। তারা ঠাহর করতে পারছিলেন না রেইনারের দেহের এমন অদ্ভুত আচরণের ব্যাখা। অবশেষে তারা যে যুক্তিটি নিয়ে এসেছিলেন তা হলো- রেইনারের পিটুইটারি গ্রন্থির কোনো টিউমার হয়তো অ্যাক্রোমেগালির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এটি হলো এমন একটি মেডিকেল কন্ডিশন যা গ্রোথ হরমোন উৎপন্নের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এই ডিজঅর্ডারের লক্ষণ হলো হাত এবং পায়ের পাতা দেহের অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় বড় হয়ে যাওয়া। এতে মাঝে মাঝে কপালের আকৃতি বেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে। এবং রেইনারের মাঝে এই তিনটি লক্ষণই বিদ্যমান ছিলো। এগুলোর পাশাপাশি শরীরে আরো যেসব লক্ষণ সাধারণত দেখা যায় তা হলো মায়োপিয়া, হাড়ের গিঁটে ব্যথা এবং মাইগ্রেন।
অ্যাডাম রেইনারের শারীরিক এই বৃদ্ধির মাঝপথেই তিনি বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হওয়া শুরু করেন। তার স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়া শুরু করে। ১৯২৬ সালের দিকে দেখা যায় তার মেরুদণ্ড বেঁকে যাচ্ছে। তার ক্ষুধা কমে যাওয়া শুরু হয়। খাবারের প্রতি অরুচি দেখা দেয়। পরবর্তী এক যুগের মধ্যেই রেইনার তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি হারান। তবে সেই পরিস্থিতির সাথে রেইনার দ্রুতই নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন এবং তিনি যেকোনো বইও পড়তে পারতেন তখন। তবে সমস্যা তার পিছু ছাড়েনি।
এদিকে অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে থাকে। হাড়ের গিঁটে ব্যথা, মাথা ব্যথা তো ছিলোই, সেই সাথে তিনি কিছুদিনের মধ্যেই তার বাম কানের শ্রবণশক্তিও হারান। মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়ার কারণে স্বাভাবিক চলাফেরা করা তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এমনকি কিছুদিন পর তিনি উঠে দাঁড়ানোর মতো শক্তিও হারিয়ে ফেলেন, যার ফলে পরবর্তী সময় তাকে বিছানায় থাকতে হয়েছিলো। তিনি কিছুই খেতে পারতেন না, ফলে দেহকে প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দিতে পারতেন না। তবুও এর মাঝে দৈহিকভাবে বৃদ্ধি বেড়েই চলেছিলো। শেষের দিকে এই বৃদ্ধির মাত্রাটা কমে গেলেও তা কখনো থেমে থাকেনি। ফলে রেইনারের শরীরের আরো দ্রুত অবনতি হতে থাকে।
১৯৩০ সালের আগস্ট এবং ১৯৩১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সময়টুকুতে ডাক্তার এ. মান্ডল এবং এফ. উইনঢলজ রেইনারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সর্বপ্রথম তারা রেইনারের উচ্চতা মাপেন, যা ছিলো ৭ ফুট ১ ইঞ্চি। কিন্তু রেইনারের মেরুদণ্ডের বেঁকে যাওয়ার সমস্যার কারণে তার দাঁড়ানো উচ্চতা হয় ৬ ফুট ৯ ইঞ্চি।
রেইনারের অস্বাভাবিক এই শারীরিকবৃদ্ধির কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিলো। তার পিটুইটারি গ্রন্থিতে আসলেই একটি টিউমার হয়েছিলো। এরপর রেইনারের অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৩০ সালের ২ ডিসেম্বর প্রফেসর ও. হিরশ্চ রেইনারের অস্ত্রোপচার করেন। পরের বছরের মে মাসে আবার রেইনারের উচ্চতা মাপা হয়। দেখা যায়, রেইনারের উচ্চতা আগের মতোই রয়েছে, তবে তার মেরুদণ্ডের সমস্যাটি আরো বেড়ে গিয়েছে। এ থেকে ডাক্তারগণ বুঝলেন তাদের অস্ত্রোপচার সফল হয়নি। তবে যে সুফলটা পাওয়া গিয়েছিলো তা হলো রেইনারের শারীরিকভাবে বৃদ্ধির মাত্রা কিছুটা কমানো গিয়েছিলো।
অ্যাডাম রেইনারকে তার বাকি জীবন বিছানাগত হয়েই কাটাতে হয়েছে। তাকে একটি বিশেষ হাসপাতালে রাখা হয়েছিলো যেখানে তিনি তার বাকি দিনগুলো কাটিয়েছিলেন এবং ডাক্তারগণ যেখানে তার সমস্যাটি আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন। তবে পরবর্তীতে অ্যাডামের দেহে কখনোই কোনো শারীরিক উন্নতি দেখা যায়নি এবং তার দেহের বৃদ্ধিও কমেনি কখনো। জটিল সব শারীরিক সমস্যায় ভুগে ১৯৫০ সালের ৪ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৫১ বছর। মৃত্যুর সময় তার উচ্চতা হয়েছিলো ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি বা ২৩৪ সেন্টিমিটার থেকে ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি বা ২৩৯ সেন্টিমিটারের মাঝে (ধারণাকৃত)। তাকে তখন বলা হতো অস্ট্রিয়ার সবচেয়ে লম্বা ব্যক্তি এবং পৃথিবীর দীর্ঘ ব্যক্তিদের মাঝে অন্যতম একজন।
অ্যাডামের জন্য তার এই শারীরিক বৃদ্ধিটা হয়তো কাল হয়েই দাঁড়িয়েছিলো তবে তার এই ঘটনাটি বিশ্বের ইতিহাসে এক চমকপ্রদ এবং বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি তার জীবনে ডাক্তারিভাবে একাধারে বামন এবং দৈত্যাকৃতির উপাধি পেয়েছেন। যিনি জন্মেছিলেন ক্ষুদ্র হয়ে কিন্তু মারা গিয়েছেন বিশালাকার হয়ে।
ফিচার ইমেজ: haikudeck.com