লোকের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে এমন লোককথা আর প্রবাদের সম্ভার আছে প্রতিটি সাহিত্যেই। বৃহত্তর বাংলায় ঘুরে ফিরে বেড়ায় খনার বচন। এই খনার বচনে পাওয়া যায় কৃষি আর গৃহস্থালীর নানা কাজের অভিজ্ঞ উপদেশ। এলাকা থেকে দেশের সীমানাভেদে সেই মুখের কথা কিংবা শ্লোকটি বদলে গেলেও মূলভাব আর রেশ রয়ে যায় মানুষের মাঝে। খনার বচন ছাড়াও বৃহত্তর বাংলায় ঠাকুমার ঝুলি কিংবা গোপাল ভাড়ের মজার গল্পগুলোও বেশ প্রচলিত।
মধ্য এশিয়ায় এদের মতোই এক চরিত্র হলেন মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা। এই চরিত্রটির খ্যাতি ভারতবর্ষেও কম নয়। হোজ্জার নামের সাথেই শত সহস্র কিংবদন্তী মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। কখনো গোপাল ভাড়ের গল্পটাও নাসিরুদ্দিনের নামে দিব্যি চালান হয়ে যায় আবার কোথাও নাসিরুদ্দিনের গল্প মিশে যায় গোপাল ভাড়ের সাথে। এরজন্য কাউকে মোটেও দোষারোপ করা যায় না। লোককথার চরিত্রই এমন, চারদিক থেকে সে নিজেকে সমৃদ্ধ করে। সন্ধ্যার গল্পের আসরে কিংবা চায়ের কাপে বন্ধুদের সাথে রসিকতায় যে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প কিংবা চুটকী বেঁচে আছে, সেই নাসিরুদ্দিন নামে কেউ কি ছিলেন এই পৃথিবীতে?
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের তালাশ
মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা নামে ইতিহাসে যে ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায় তার জন্ম হয়েছিল তুরস্কের খোর্তো গ্রামে। সময়টা ত্রয়োদশ শতাব্দী। তার কিংবদন্তী আর গল্পগুলো তুরস্কের বাইরে মূলত মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। এর বাইরে ইউরোপের গ্রীস, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া আর জার্মানিতেও প্রচলিত আছে। চীনেও তার কিংবদন্তীর বেশ চল আছে। উইঘুর মুসলমানদের দাবি নাসিরুদ্দীনের জন্ম আর কর্মস্থল ছিল চীনদেশেই। মধ্য এশিয়ার মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা পরিচিত নাসিরুদ্দিন এফেন্দি নামে। এই এফেন্দি সম্মানসূচক পদবী, এই নামেই সমাজের জ্ঞানী ব্যক্তিদের অভিহিত করার রেওয়াজ ছিল মধ্য এশিয়ায়।
তার জীবন রহস্য উদঘাটন করা বেশ কষ্টসাধ্য, তার জীবনের প্রতিটা ঘটনার সাথে কোনো না কোনো রসিকতা একদম আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সৈয়দ মুজতবা আলীও রসিকতা করে মোল্লা নাসিরুদ্দিনকে নিয়ে বলেছিলেন,
“তার সম্পর্কে প্রচলিত দু’আনা পরিমাণ কিংবদন্তি বিশ্বাস করলে আমাদের কালিদাস সম্পর্কে প্রচলিত সব ক’টাই বিশ্বাস করতে হয়।”
নাসিরুদ্দিনের জীবন আর কাজ
মোল্লা নাসিরুদ্দীন হোজ্জার সম্পর্কে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় তিনি খুব জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন, ধর্ম বিষয়ে উঁচু পণ্ডিত হওয়ার কারণে মানুষ তার কাছে পরামর্শের জন্য আসতো বলে জানা যায়। জীবদ্দশায় মানুষকে তিনি শুধু পরামর্শ দিয়ে ক্ষান্ত হতেন না, একদম হাতে কলমে কাউকে কাউকে শিক্ষা দিয়ে দিতেন। বাস্তব জীবনে অর্থ উপার্জনের জন্য তার পেশা কী ছিল সে ব্যাপারে গবেষকরা সন্দিহান। নাসিরুদ্দিন হোজ্জা বাস্তবে একজন সূফী সাধক ছিলেন বলেও ধারণা করেন অনেকেই। তার গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অনেক বাণী সূফীবাদ থেকে অনুপ্রাণিত বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। পাওয়া যায় সমাজে প্রচলিত সত্যের প্রতি কটাক্ষ। এ কটাক্ষ সাধারণ দৃষ্টিতে হাস্যরসাত্মক মনে হলেও এর নিগুঢ় অর্থের সন্ধানে ব্যস্ত অনেকেই।
কথিত আছে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের মজলিশে এক লোক তার বয়স জানতে চাইলেন। মোল্লা উত্তর দিলেন তার বয়স চল্লিশ। মজলিশে উপস্থিত কয়েকজন জানালেন, দশ বছর আগেও মোল্লা তার বয়স চল্লিশ বলেছিলেন। তাহলে এখনো তার বয়স চল্লিশ থাকে কী করে? মজলিশের গুঞ্জন শুনে মোল্লা উত্তর দিলেন, তিনি এককথার মানুষ, কয়েকদিন পর পর মতের পরিবর্তন তিনি করেন না।
হাস্যরসাত্মক আলাপেই মোল্লা নাসিরুদ্দীন বলে দিলেন, সত্য সময়ের সাথে বদলে যায়, একই কথা আজকে সত্য হলে কাল হয়তো মিথ্যা হয়ে যেতে পারে। তাই সময়ের সাথে আমাদের বদলে যেতে হয়, এটাই আমাদের ভবিতব্য।
হোজ্জার গল্পে প্রায়শই একটি পরিবার দেখা যায়, তার পুত্র কন্যার সন্ধান খুব একটা পাওয়া না গেলেও তার স্ত্রীর সন্ধান পাওয়া যায় প্রায়শই। যেখানে তার স্ত্রীকে বোকা বানিয়ে কিংবা কথার ফাঁদে আটকে ফেলে বেশ মজা নেন হোজ্জা।
একবার হোজ্জা বাজার থেকে এক সের মাংস নিয়ে এলেন, তার স্ত্রীকে বললেন কাবাব বানিয়ে দিতে। স্ত্রী কাবাব বানিয়ে হোজ্জা ফিরে আসার আগেই খেয়ে নিলেন সব কয়টা! হোজ্জা ফিরে আসলে দোষ দিলেন বিড়ালের। হোজ্জাও কম যান না, বিড়ালকে ধরে নিয়ে দাঁড়িপাল্লায় দিলেন, মেপে দেখা গেলো বিড়ালের ওজনও এক সের। হোজ্জা তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন এই যদি বিড়াল হয় তবে মাংস কোথায়? আর এটাই মাংস হয় তবে বিড়াল কোথায়?
হোজ্জার গল্পকে মোটা দাগে তিনভাগে ভাগ করে থাকেন অনেকেই। প্রথম ধরনটি হলো, তিনি এখানে চালাকি করে অন্যকে বোকা বানাচ্ছেন, আরেক ধরনের গল্পে সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে অদ্ভুত জবাব দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরস্ত্র করে দিয়েছেন। আর তৃতীয় ধরনের গল্পে তিনি বোকা সেজে বসে আছেন, যেন গল্প থেকে উঠে আসা মোল্লা নাসিরুদ্দিন পাঠককে জব্দ করে মজা নিচ্ছেন। হোজ্জার গল্পগুলোকে অনেকে মোটাদাগে তাই ‘স্যাটায়ার’ হিসেবেও বলে থাকেন। ইশপের গল্পের মতোই দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়িয়েছে, কখনো নিজেদের মতো করে পরিবর্তন হয়েছে গল্পগুলো, অনেক ক্ষেত্রে বদলে গেছে মূলভাবও। তবে এই গল্পের মধ্যেই বেঁচে আছেন মোল্লা নাসিরুদ্দীন হোজ্জা।
তুরস্কে মোল্লা নাসিরুদ্দিন সম্মানে হয়ে থাকে ‘আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দীন হোজ্জা উৎসব’। জুলাইয়ের পাঁচ থেকে দশ তারিখের মাঝে তুরস্কের আকশেহিরে এই উৎসব হয়ে থাকে। এই আকশেহির শহরেই নাসিরুদ্দিন হোজ্জার সমাধি অবস্থিত। সারাবিশ্ব থেকে হোজ্জা অনুরাগীরা সেখানে পাড়ি জমান, হোজ্জাকে স্মরণ করেন। সেই উৎসবে একজন প্রতীকী নাসিরুদ্দিন আকশেহিরে ঘুরে বেড়ান। হোজ্জার কাজকর্মের আলোচনা, ছবি আঁকার মাধ্যমে তাকে স্মরণ করা হয়। দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে কার্টুনিস্ট আর গল্প লেখকরা পাড়ি জমান হোজ্জার শহরে।
একবার হোজ্জার জন্মদিন পালনের সময় দীর্ঘদিন পরে তুরস্কের বুকে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে, তো সৈয়দ মুজতবা আলী এই নিয়ে তার চতুরঙ্গ বইয়ে মন্তব্য করেছিলেন,
“তা হলে বোঝা গেল মা ধরণীর পাকা দুশো বছর লেগেছে হোজ্জার রসিকতার মর্ম গ্রহণ করতে; তাই বোধহয় হয় হাসতে হাসতে তার নাড়িভুঁড়ি এখন ভূগর্ভ থেকে ছিড়ে বেড়িয়েছে!”
জীবিত থাকাকালে মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জা কতটুকু জনপ্রিয় ছিলেন সেই দলিল দস্তাবেজ নেই। তার ব্যক্তিগত জীবন আর কর্মের ব্যাপারে খুবই কম তথ্য গ্রন্থিত হয়েছে। তার গল্প আর কিংবদন্তির কাছে সব ঢাকা পড়ে গেছে। এমনকি তার গল্পগুলো সংকলন আর পরিমার্জন করে পাঠ্য আকারে বিভিন্ন দেশের পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ছাড়াও মধ্য এশিয়া আর ইউরোপের বিস্তীর্ণ এলাকায় নাসিরুদ্দিন ভীষণ জনপ্রিয়। নাসিরুদ্দিনের কিংবদন্তি সারা বিশ্বের মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ইউনেস্কো ১৯৯৬-৯৭ সালকে আন্তর্জাতিক নাসিরুদ্দিন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার নাম আর তার কিংবদন্তী পৌঁছে যেতে শুরু করে তখন থেকেই।
আকাশে বাতাসে মোল্লা নাসিরুদ্দিন হোজ্জার নামে যত অদ্ভুত গল্প ঘুরে বেড়ায় তার সংকলন নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছে। ইদরিস শাহ ‘The Pleasantries of the Incredible Mulla Nasrudin’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন ১৯৬৮ সালে। এই বই অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, পৌঁছে গেছে মানুষের হাতে হাতে। বাংলায় সত্যজিৎ রায়ও ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প’ নামে হোজ্জার গল্পের একটি সংকলন বের করেছিলেন। নাসিরুদ্দিন থেকে অনুপ্রাণিত অনেক নাটক, সিনেমা আর চলচ্চিত্র আছে। তিনি পুরো পৃথিবীর জন্য অনন্য এক সম্পদ।