হঠাৎ করে আমাদের অনেকেরই খুশিতে আকাশে উড়ে যেতে ইচ্ছা করে। কেউ কেউ আবার অনেক দুঃখ-শোকের পর মনে মনে ইচ্ছা করেন, যদি উড়ে যেতে পারতেন অন্য কোথাও! খুব সাধারণ এই চিন্তাগুলোও যে আসলে অসাধারণ আর কল্পনার অতীত ছিলো একসময় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু মানুষের মনেপ্রাণে এই যে আকাশে উড়ে বেড়ানোর দুর্বার বাসনা, সেটা বোধকরি সেই আদিম মানুষের ধারাবাহিকতায় আজও মানুষের মনে টিকে আছে।
প্রযুক্তির কল্যাণে আজ মানুষ কিন্তু ঠিকই আকাশে পাড়ি জমাতে পারে, অর্থাৎ উড়োজাহাজে চড়ে মানুষ এখন আকাশপথে পাখির মতই উড়ে যেতে পারছে। লেখার বিষয় আসলে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের তৈরী করা এই উড়োজাহাজ নিয়ে নয়, বরং তাদের উড়োজাহাজ তৈরীর আগে মানুষের এই দুর্নিবার ইচ্ছা সফল করার দুর্নিবার চেষ্টাগুলো নিয়ে। উড়োজাহাজের আবিষ্কারক রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের একজন উইলবার রাইট বলেছিলেন,
“আকাশে ওড়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে আমাদের বহুপূর্বপুরুষদের কাছ থেকে যারা প্রাগৈতিহাসিক যুগে পৃথিবীর এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং আশ্চর্য বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছেন সকল বাধা উপেক্ষা করে অসীম আকাশে ঊর্ধ্ব সীমায় সর্বোচ্চ গতিতে মুক্তভাবে বিচরণ করা পাখিদের।”
তো চলুন জেনে আসা যাক পূর্বসূরীদের ওড়ার চেষ্টা নিয়ে।
ডেইডালাস এবং ইকারাস
সর্বপ্রথম ওড়ার চেষ্টা করার কথা বলতেই প্রথমে আসে ডেইডালাস এবং ইকারাস-এর নাম। এই ঘটনার অবতারণা পাওয়া যায় মূলত গ্রীক পুরাণে। কিন্তু এর পৌরাণিক গুরুত্বের পাশাপাশি ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়।
ইকারাস ছিলেন ডেইডালাসের ছেলে। সেই সময়ে গ্রীসের রাজা মাইনোস এবং ডেইডালাসের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে এই সম্পর্ক একসময় খারাপ হয়ে যায়। ডেইডালাস রাজা মাইনোসকে ‘ল্যাবিরিন্থ’ নামে এক গোলকধাঁধা তৈরী করে দেন যেখানে রাজা পৌরাণিক দৈত্য মিনোটারকে বন্দী করে রাখেন। কুখ্যাত এই ধাঁধার মধ্যে রাজা তার শত্রুদেরও বন্দী করতেন যেন মিনোটারের হাতে তাদের মৃত্যু হয়।
কিন্তু ডেইডালাস কোনো এক সময় থিসিয়াসকে বাঁচাতে তাকে এই ধাঁধা থেকে বের হওয়ার পথ বলে দেন। এতে মাইনোস ক্ষিপ্ত হয়ে ডেইডালাস আর তার ছেলে ইকারাসকে ডেইডালাসের তৈরী করা ল্যাবিরিন্থে বন্দী করেন।
ডেইডালাস ছিলেন একজন চতুর ব্যক্তি এবং তিনি ভাবতে বসলেন যে কীভাবে সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া যায়। তিনি বুঝতে পারলেন, তার এই গোলকধাঁধা পার হওয়া যেহেতু খুব কষ্টসাধ্য সেহেতু তাকে অন্য উপায় বের করতে হবে। এদিকে এই ধাঁধা ছিলো সমুদ্রের পাশে এবং সেখানেও রাজার তীক্ষ্ণ প্রহরা। সুতরাং সমুদ্রপথেও পালানো সম্ভব না। একমাত্র পালানো সম্ভব যদি তারা উড়তে পারেন।
যেই ভাবা সেই কাজ। ডেইডালাস শুরু করে দিলেন তার কাজ। ওসিয়ার নামক গাছের ডালগুলোকে তিনি একটির সাথে আরেকটিকে জুড়ে দিলেন মোমের সাহায্যে, তৈরী করলেন বিশালাকায় পাখা যা দিয়ে তারা পাড়ি দিতে পারবেন ভূমধ্যসাগর। তিনি এরপর ইকারাসকে শিখিয়ে দিলেন কীভাবে উড়তে হয়। একদিন তারা সত্যিই মোমের পাখা লাগিয়ে উড়লেন আকাশে। এটাই ছিলো সর্বপ্রথম মানুষের আকাশে ওড়ার কাহিনী।
কিন্তু শেষপর্যন্ত ডেইডালাস সাগর পার হতে পারলেও ইকারাস পারলেন না। প্রথমবার আকাশে ওড়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে তিনি ভুলেই গেলেন যে তাদের পাখাটি মোমের তৈরী। ডেইডালাসের সাবধানতা ভুলে গিয়ে তাই তিনি অনেক উপরে উঠে গিয়েছিলেন। ফলাফল সূর্যের তাপে মোমের বিগলন, আইকারাসের পতন এবং সমুদ্রে ডুবে তার মৃত্যুবরণ। তার নামানুসারেই সাগরের ঐ অংশের নাম রাখা হয়েছিলো ইকারিয়ান সাগর।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি
পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে এবার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক। ভিঞ্চির নাম শুনলে যে কেউই তাকে সেই যুগের মহৎ পুরুষ বলে একবাক্যে মেনে নেবে, কারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি দিকেই তিনি রেখেছেন তার ছোঁয়া।
আকশে ওড়ার ক্ষেত্রে মানুষের একমাত্র অনুপ্রেরণা ছিলো পাখিরা। ডানা ঝাপটিয়ে পাখির উড্ডয়ন কৌশলকে কাজে লাগিয়ে মানুষও চেয়েছিলো উড়তে। কিন্তু মানুষের বাহু ডানা ঝাপটানোর জন্য যথেষ্ট শক্তি ধারণ করে না। কাজেই ডানাকে যান্ত্রিকভাবে চালানোর জন্য অর্নিথপ্টার নামক যন্ত্রের নকশা করা হয়।
মূলত ১৪৮০ সাল থেকে ১৫৯১ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ভিঞ্চি বেশ কয়েকটি অর্নিথপ্টার যন্ত্রের নকশা তৈরী করেছিলেন। পাখির উড্ডয়ন কৌশল নিয়ে তিনি বেশ বৈজ্ঞানিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেছিলেন। তার নোটবুকে পাখিদের উড্ডয়নের স্কেচ পাওয়া যায় অসংখ্য। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন পাখির ওড়ার সময় কোন অবস্থানে তার ডানার অবস্থা কেমন থেকে, কীভাবে সেটা আবার পাল্টে যায়। যদিও যতদূর জানা যায় যে, তাঁর নকশাকৃত কোনো যন্ত্রই বাস্তবে তৈরী করেন নি। তাঁর নকশাগুলো মৌলিক হলেও এরোডাইনামিক বৈশিষ্ট্যে যথেষ্ট অপূর্ণতা ছিলো।
যদিও তিনি সফলভাবে কোনো যন্ত্র তৈরী করতে পারেন নি। কিন্তু তার এই চিন্তাধারাই পরবর্তীতে অন্যান্যদের উৎসাহ জুগিয়েছে আকাশের ওড়ার রসদ হিসেবে। মানুষের উড়তে শেখার শুরুটা ছিলো মূলত উড্ডয়নের উপর ভিঞ্চির বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষণ থেকেই।
জিওভান্নি বাতিস্তা দান্তি এবং পাওলো গাইদত্তি
লিওনার্দোই রেঁনেসা যুগের প্রথম ব্যক্তি ছিলেন না যিনি উড্ডয়ন কৌশল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তার সমসাময়িক জিওভান্নি বাতিস্তা দান্তি নামক একজন ইতালীয় গণিতবিদও ছিলেন, যিনি ভুলক্রমে পাখির উড্ডয়নের শারীরবিদ্যার ব্যাখ্যা করেন এবং পাখি ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলার গতি পর্যবেক্ষণ করেন।
তিনি ভিঞ্চির মত কোনো যন্ত্রের নকশা যদিও করেন নি, করেছিলেন পাখার নকশা। অর্থাৎ ডেইডালাসের মত পাখা লাগিয়ে ওড়ার চেষ্টা করেন তিনি। এজন্য তিনি পাখির পালক সংগ্রহ করেন এবং সেগুলো আঠার সাহায্যে লাগিয়ে তৈরী করেন পাখা। সেটা লাগিয়ে ফেলেন তার বাহুতে। উদ্দেশ্য একটাই, পাখির মত উড়বেন। পরীক্ষামূলকভাবে তিনি ট্রাসিমেনো হ্রদের উপরে উড়লেন ঠিকই, কিন্তু সেটা গিয়ে সমাপ্ত হলো সেইন্ট মেরী গির্জার ছাদে আছড়ে পড়ে। তার জীবনেরও সমাপ্তি হলো।
রেঁনেসার আরেকজন ব্যক্তি হলেন পাওলো গাইদত্তি, যিনি ভিঞ্চি এবং জিওভান্নির একশ বছর আগেই জন্মেছিলেন। পাওলো পাখির-ডানা তত্ত্বের সাহায্যে উড়তে চেষ্টা করেছিলেন। ডানা তৈরী করেছিলেন তিমির হাড়ের উপর আঠা দিয়ে পালক লাগিয়ে এবং ডানার বক্রতা তৈরী করেছিলেন স্প্রিংয়ের সহায়তায়। এই ডানার সাহায্যে তিনি উড়তে চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রায় চারশ গজের মত উড়তে পেরেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম, উড়তে উড়তে একসময় আছড়ে পড়েন আর নিজের উরু ভেঙে ফেলেন।
মারকুইস ডি বাকভিল
উড়বার ক্ষেত্রে যদিও মারকুইসের তেমন খ্যাতির কথা জানা যায় না, তারপরও জানা যায় ১৭৪২ সালের কোনো এক সকালে উঠে তিনি ঘোষণা করেন, তিনি আকাশে উড়বেন। শুধু তা-ই নয়, উড়ে পাড়ি দেবেন সীন নদী। যদিও তার পরিকল্পনা ছিলো নদীর তীরে অবস্থিত নিজের অট্টালিকা থেকে ওড়া শুরু করবেন এবং ‘জর্ডিন দেস টুইলারিস’ নামক প্রাসাদের বাগানে গিয়ে অবতরণ করবেন যার দূরত্ব ছিলো প্রায় ছয়শ ফুটের মত।
তাঁর ওড়ার দৃশ্য দেখার জন্য বেশ বড়সড় এক ভিড় জমে গিয়েছিলো। যথাসময়ে মারকুইস প্রস্তুত হলেন ওড়ার জন্য। নিজের হাত ও পায়ে লাগালেন ডানা। এরপর দালানের উপর হতে লাফ দিলেন বাগানের উদ্দেশ্যে ওড়ার জন্য। প্রথমদিকে যদিও তাঁর নিজের শক্তির উপর নিয়ন্ত্রণ ছিলো, কিন্তু অচিরেই সেই ক্ষমতা লোপ পেলো। মারকুইস শক্তি হারিয়ে আছড়ে পড়লেন এক যুদ্ধজাহাজের ডেকের উপর আর ভেঙ্গে ফেললেন নিজের পা।
পিয়েরে দেসফ্রগেস
পিয়েরে দেসফ্রগেস ছিলেন একজন ফরাসী পাদ্রী। পাখির ওড়ার পর্যবেক্ষণ করে পিয়েরে ১৭৭০ সালে তৈরী করেছিলেন একজোড়া ডানা। কিন্তু পূর্বে অনেকের ডানায় ভর করে ওড়ার চেষ্টা করে মৃত্যুবরণ ও আহত হওয়ার ঘটনা জেনে তিনি নিজে ওড়ার পরীক্ষাটি করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তিনি এই পরীক্ষাটি করতে চাইলেন তাঁর প্রতিবেশি এক কৃষককে দিয়ে।
তিনি কৃষকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাখির পালক দিয়ে আবৃত করেন এবং দুই বাহুতে লাগিয়ে দেন তাঁর তৈরী করা ডানা দুটি। এরপর তাকে নিয়ে যান গির্জার ঘন্টাঘরে এবং তাকে বুঝিয়ে বলেন কিভাবে কি করতে হবে। সব শুনে কৃষক কোনো ভাবেই রাজি হলো না। জেনেশুনে কেউতো আর মৃত্যুর দিকে হেঁটে যেতে পারে না।
পিয়েরে কিন্তু হাল ছেড়ে দিলেন না। পরবর্তীতে প্রায় দুই বছর কঠোর পরিশ্রমের পর তিনি তাঁর উড্ডয়ন যন্ত্রের বাস্তবায়ন করেন। যন্ত্রটি ছিলো ১.৮ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি গন্ডোলা যা শামিয়ানার আচ্ছাদনে আবৃত ছিলো। এর সাথে লাগিয়ে দিলেন ডানা।
যন্ত্রটি এবার পরীক্ষা করার পালা। পিয়েরে চারজন কৃষকের সাহায্যে এটিকে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন গির্জার নিকটে এক উঁচু টাওয়ারে। নিজেই এবার উঠে বলসেন এই যন্ত্রে এবং কৃষকেরা সবার সামনে তাঁর যন্ত্রটিকে ঠেলে দিলেন ওড়ার জন্য। কিন্তু এখানেও বিধি সহায়ক হলো না। পিয়েরে তাঁর যন্ত্রসহ সোজা গিয়ে পড়লেন মাটিতে। যদিও হাত ভেঙ্গে যাওয়া ছাড়া তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি তাঁর।
স্যার জর্জ ক্যালি
জর্জ ক্যালি ছিলেন ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার প্রদেশের বাসিন্দা এবং পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনিই মূলত প্রথম ব্যক্তি যিনি আধুনিক উড়োজাহাজের মডেলের ধারণায় অগ্রগতি লাভ করেছিলেন। তিনি এই বিমান সম্পর্কিত তিনটি গবেষণাপত্রও প্রকাশ করেন। তিনি তার এই গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন যে উড্ডয়নের ক্ষেত্রে বিমানের পাখার উপরিতলের নিম্নচাপের অঞ্চলকে কাজে লাগানো হবে এবং সমতল পাখা অপেক্ষা বক্র পাখার সাহায্যে এই উড্ডয়ন আরো সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হবে।
তার এই পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা অনুযায়ী পরবর্তীতে তিনি একটি গ্লাইডারের মডেল তৈরী করেন। কিন্তু এই নকশায় একটু ত্রুটি থেকে গিয়েছিলো। তিনি এই নকশায় গ্লাইডার পরিচালনার জন্য ফ্ল্যাপার ব্যবহার করেছিলেন। ফলে জিনিসটি মোটামুটি অসম্ভব একটা নকশায় পরিণত হয়েছিলো। পরে অবশ্য আশি বছর বয়সে তিনি একটি পূর্ণ গ্লাইডার তৈরী করেছিলেন এবং এতে তার অনিচ্ছুক কোচম্যানকে চড়তে বাধ্য করেছিলেন। কোচম্যানটি এই গ্লাইডারে চড়ে ছোট একটা উপত্যকা ভ্রমণ করে।
এরপর আস্তে আস্তে বেশ কয়েকজন মানুষের হাত ধরে গ্লাইডার আর কপ্টারের উন্নতি হতে হতে আজকের উড়োজাহাজ আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
আজকের আকাশে ওড়ার কথা আমাদের চিন্তায় আসলে আমরা খুব সহজেই শান্ত হয়ে যাই। কারণ এখন আকাশে ওড়া আমাদের জন্য আসলে কোনো ব্যাপারই না। এখন উড়োজাহাজ আমাদের আকাশ পথে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে দূর-দূরান্তে। কিন্তু আজকের এই প্রাপ্তির পেছনে আছে কতিপয় বেপরোয়া মানুষ, যারা সাহস করে উড়তে চেষ্টা করেছেন, উড়তে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন কিংবা আহত হয়েছেন।