অ্যাডলফ হিটলার এবং তার অধীনস্থ নাৎসি বাহিনীর অপকর্মের কথা সম্পর্কে সকলেই কমবেশি অবহিত। গণহত্যা, অত্যাচার, স্বৈরাচার, অন্যায়ের কালো অধ্যায়ের সওগাত বয়ে আনা নির্দয় এই দলে ছিল ড. ম্যাঙ্গেলা নামক এক ব্যক্তি, যার হাত ধরে রচিত হয়েছিল নির্মমতার আরেক ভয়াবহ চিত্রকল্প। বন্দীশিবিরে ধরে আনা যুদ্ধবন্দী সাধারণ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যার পাশাপাশি নিজের মর্জিমাফিক অমানবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাদের মৃত্যু ডেকে আনতেন তিনি। এ কারণে তাকে মৃত্যুদূত তথা Angel of Death নামে ভূষিত করা হয়। মানুষের উপর যন্ত্রণাদায়ক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি জমজদের প্রতি অত্যাধিক আগ্রহের দরুন অনেক জমজ শিশুদেরও হত্যা করেন তিনি। তার গবেষণাগারের দেয়ালে লাগানো থাকতো সারি সারি মানবচোখ! অসউইতজের বন্দীশিবিরে অসহায় মানুষের মৃত্যুযন্ত্রণার কারিগর এই কুখ্যাত ড. ম্যাঙ্গেলা এবং তার অমানবিক কার্যকলাপকে ঘিরেই আজকের লেখা।
ডক্টর ম্যাঙ্গেলার পুরো নাম ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা। ড. ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা ছিলেন সুতজটাফের (Schutzstaffel, তৎকালীন প্রতিরক্ষা বাহিনী) একজন কর্মকর্তা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অসউইতজ (Auschwitz) বন্দীশিবিরের একজন ডাক্তার। ইহুদি ও জিপসিদের বন্দীশিবিরে ধরে আনা হতো। এই শিবিরে ধরে আনা লোকদের মূলত দু’ভাগে ভাগ করা হতো। একদল যাদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হবে এবং অন্যদলকে কঠিন পরিশ্রম করানোর পাশাপাশি নানান পরীক্ষানিরীক্ষার কাজে ব্যবহার করা হবে। এই বাছাইয়ের কাজটি ড. ম্যাঙ্গেলার উপস্থিতিতেই ঘটতো। এমনকি প্রতিদিন তার জন্য নির্ধারিত বাছাইকারীর দায়িত্ব পালনের সময়সীমা পার হয়ে যাবার পরও তিনি বাছাইয়ের স্থানে উপস্থিত থাকতেন যাতে কোনো জমজ শিশুই তার কব্জা থেকে বাদ না পড়ে।
জমজ হওয়ার পাশাপাশি যে কোনো চোখে লাগার মতো বৈশিষ্ট্য যেমন- বেঁটে, দৈত্যাকার মানুষ, হাত বা পা বেঁকে যাওয়া কিংবা হেটারোক্রোমিয়া (দুই চোখের মণি ভিন্ন ভিন্ন রঙের) নিয়েও আগ্রহী ছিলেন ড. ম্যাঙ্গেলা। একবার এক নারীকে জমজদের শুক্রাণু ব্যবহার করে গর্ভবতী করান তিনি এবং তার সন্তানও নিজেই জন্মদান করান। কিন্তু সন্তানটি জমজ না হওয়ায় মায়ের সামনেই জরায়ু থেকে বের করা শিশুটিকে ছিঁড়ে দু’ভাগ করে ফেলেন তিনি। বন্দীশিবির থেকে বেঁচে ফেরাদের ভাষ্যমতে, অনেক জমজ শিশুকে মানুষের ভিড় থেকে আলাদা করে নিতে সক্ষম হয়েছিলো তারা। আবার কেউ কেউ নিজেদের শিশুদের আড়াল করতে সক্ষম হন। বলা বাহুল্য, তাদের স্থান তাদের মায়ের সাথে গ্যাসচেম্বারে হয়েছিল।
পৈশাচিক কর্মকান্ডের হোতা ড. ম্যাঙ্গেলার নির্যাতনের ভয়াল জগতে প্রবেশ করার আগে তার অতীত সম্পর্কে কিছুটা জেনে নেয়া যাক।
ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলার জন্ম ১৯১১ সালের ১৬ মার্চ জার্মানির বাভারিয়ার গুঞ্জবার্গে। কার্ল ও ওয়েলবুর্গা ম্যাঙ্গেলার তিন সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ইয়োসেফের অন্য দুই ভাই কার্ল জুনিয়র এবং এলোইস। কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী কার্ল ম্যাঙ্গেলা এন্ড সন্স কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তার পিতা। ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা ১৯৩০ সালের এপ্রিল মাসে স্কুলের পাঠ চুকিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্টের গোয়েথে বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখে যথাক্রমে মেডিসিন এবং দর্শন নিয়ে পড়তে আসেন।
১৯৩৫ সালে ইউনিভার্সিটি অফ মিউনিখ থেকেই নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি অর্জন করেন এবং ১৯৩৭ সালে ফ্রাঙ্কফুর্টের ইন্সটিটিউট ফর হেরেডিটারি বায়োলজি এন্ড রেসিয়াল হাইজিন এর বিজ্ঞানী ড. ওটমার ফ্রেইহার ভন ভার্সচুয়ারের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন। একই বছর তিনি নাৎসি দলে যোগ দেন। ড. ওটমার বংশগতির উপর গবেষণা করতেন এবং জমজদের বিষয়ে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। ড. ওটমারের সহকারী হিসেবে ম্যাঙ্গেলার খাঁজযুক্ত চিবুক, ঠোঁট ইত্যাদি বিষয়ের জন্য দায়ী বংশগত কারণগুলোর প্রতি আগ্রহ ছিল এবং এর ওপর কাজের জন্য তাকে ১৯৩৮ সালে মেডিসিনে পিএইচডি ডিগ্রী দেয়া হয়। যদিও পরবর্তীতে তার দুটো পিএইচডি ডিগ্রীই বিশ্ববিদ্যালয় দুটি থেকে বাতিল করা হয়। একই বছর ম্যাঙ্গেলা এসএস বা সুতজটাফেতে যোগ দেন।
১৯৩৯ সালের ২৮ জুলাই ম্যাঙ্গেলা আইরিন স্কনবেইনকে বিয়ে করেন। পাঁচ বছর পর তাদের পুত্রসন্তান রলফের জন্ম হয়। ১৯৪০ সালের জুন মাসে ম্যাঙ্গেলাকে সেনাবাহিনীতে পাঠানো হয় এবং এরপর তাকে ওয়াফেন-এসএসে (সশস্ত্র প্রতিরক্ষাবাহিনী) চিকিৎসা সেবার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। ১৯৪০-৪৩ সালের মধ্যে ম্যাঙ্গেলা নানান স্থানে দ্বায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে আহতাবস্থায় জার্মানিতে ফিরে আসেন। সেখানে তিনি কাইজার উইলহেম ইন্সটিটিউটে ড. ওটম্যানের নির্দেশনায় নৃবিজ্ঞান, মানুষের বংশগতি এবং নিয়ন্ত্রিত সুপ্রজননবিদ্যার উপর কাজ করা শুরু করেন। সে বছরের এপ্রিল মাসেই পদোন্নতি পেয়ে এসএস ক্যাপ্টেন হন যার ফলস্বরূপ মে মাসের ৩০ তারিখ বদলী হয়ে অসউইতজে চলে আসেন। এই অসউইতজই সেই স্থান যেখানে তার অমানবিক পৈশাচিকতার স্বাক্ষর রাখেন তিনি।
১৯৪৩ সালের মে মাসে একজন সুশিক্ষিত, অভিজ্ঞ চিকিৎসা গবেষক হিসেবে অসউইতজে আগমন ঘটে ড. ম্যাঙ্গেলার। সে সময়কার কিছু শীর্ষ চিকিৎসক এবং গবেষণাকারীর সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তার। সুনাম অর্জনের ভাবনায় মগ্ন ম্যাঙ্গেলা তখন বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম চোরাবালিতে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন বংশগতির গূঢ় সত্য!
নাৎসিবাদের জাতিগত তত্ত্বের মতবাদ ছিল যে, জার্মানরা শ্রেষ্ঠ জাতি তথা আর্যদের অন্তর্ভুক্ত। এডলফ হিটলারের মতে, এই আর্য জাতির বিশুদ্ধতা থাকতে হবে অটুট, একমাত্র তবেই একদিন তারা সারা বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে। হিটলারের মতে, একজন আদর্শ আর্যের বৈশিষ্ট্য হল- সোনালি চুল, নীল চোখ এবং লম্বা উচ্চতা বিশিষ্ট হওয়া। যদি প্রতিটি আর্য নারী একজোড়া করে সোনালি চুল আর নীল চোখের সন্তান জন্ম দিতো তাহলে তা এই নাৎসিতত্ত্বের জন্য কতটাই না ফলপ্রসূ হতো! তাদের ভবিষ্যতও হতো সুরক্ষিত। ড. ওটমারের অধীনে কাজ করা ড. ম্যাঙ্গেলা ভাবলেন, জমজের মধ্যেই এ রহস্যের সমাধান লুক্কায়িত। তাই জমজদের নিয়ে গবেষণা করার জন্য অসউইতজই তার কাছে আদর্শ স্থান মনে হয়েছিল কেননা সেখানে অধিক সংখ্যক জমজের উপস্থিতি তার গবেষণার জন্য নমুনা হিসেবে ব্যবহারে অত্যন্ত সুবিধাজনক ছিল।
বন্দীশিবিরে আনা মানুষগুলোকে দু’ভাগে ভাগ করা হতো- দুর্বল ও সবল। দুর্বলদের গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলা হতো আর সবলদের দিয়ে করানো হতো অমানুষিক পরিশ্রম। এই বাছাইকালীন সময়ে উপস্থিত থাকতো ম্যাঙ্গেলা ও তার দল, যাতে কোনো জমজ কিংবা বিশেষ দৈহিক বৈশিষ্ট্যধারী মানুষ বাদ না পড়ে। যখন হতভাগা মানুষের দল রেলগাড়ি থেকে নেমে দুই সারিতে ভাগ হতে থাকতো তখনই শকুনি চোখে বিশেষ বৈশিষ্ট্যধারী মানুষ খুঁজে বেড়াতো ম্যাঙ্গেলা ও তার এসএস অফিসারের দল। যদি তারা জমজদের দেখা পেতো সঙ্গে সঙ্গে জার্মান ভাষায় চিৎকার করে উঠতো “Zwillinge” (জমজ) বলে। শিশুগুলোর পিতামাতাকে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হতো, পরিবার থেকে চিরতরে আলাদা হয়ে যেত চিহ্নিত করা জমজশিশুরা।
ভেরা ক্রিগেল ও তার জমজ বোন ওলগাকে যখন চেকস্লোভাকিয়ায় তাদের গ্রাম থেকে অসউইতজে নিয়ে আসা হয়, তখন তারা মাত্র পাঁচ বছরের শিশু। ট্রেনের গবাদিপশু বহনকারী বগিতে করে তাদের অসউইতজে নিয়ে আসা হয়। বগিগুলোতে এতই ঠাসাঠাসি করে মানুষ ঢোকানো হতো যে পথে মারা যাওয়া লোকগুলোও মানুষের চাপে দাঁড়িয়েই থাকতো! ভেরাকে তার মা ও বোনসহ সরাসরি এসএস ক্যাপ্টেন ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলার কাছে নেয়া হয়। তার মায়ের গঠন বৈশিষ্ট্য এবং নীল চোখ একদম আর্যদের মতো নিখুঁত বলে রায় দেন ড. ম্যাঙ্গেলা এবং ভেরা আর তার বোনের চোখ ছিল বাদামী।
কাজেই, আগ্রহী হয়ে গবেষণার জন্য তাদের বাছাই করে নেন ড. ম্যাঙ্গেলা। জোনা ল্যাকস নাম্নী আরেকজন মহিলার কথা জানা যায়, যাকে কৈশোরে লডজ ঘেট্টো থেকে অসউইতজ ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। তাকে প্রথমে জমজ শিশুদের একজন হিসেবে সনাক্ত করা যায়নি এবং তাই তাকে গ্যাস চেম্বারের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার বোন যখন ম্যাঙ্গেলাকে জানায় যে, তারা জমজ। তখন তাকে গ্যাস চেম্বার থেকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ম্যাঙ্গেলা তাদেরকে গবেষণাগারে নিয়ে আসেন। এছাড়াও মট্টি এলোন, মেরাকেম মদনারের মতো অনেকেই অসউইতজের বন্দীশিবিরে ড. ম্যাঙ্গেলার অত্যাচারের চাক্ষুষ প্রমাণ ছিলেন।
‘ভিক্টিমস এন্ড সারভাইভরস অফ নাজি হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টস’ এর লেখক ও অক্সফোর্ড ব্রুকস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল ওয়েন্ডলিং এর মতে, ম্যাঙ্গেলার পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে শত শত শিশু ব্যবহৃত হয়েছিল। তার ভাষ্যমতে, “আমি বন্দীশালায় কর্মরত একজন চিকিৎসক ও ব্যাকটেরিয়াবিদের নথি খুঁজে পাই। যার তথ্যানুসারে সেখানে ৭৩২ জোড়া জমজশিশু ছিল।” সেই চিকিৎসককে ম্যান্ডেলার অধীনে কাজ করার জন্য জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়েছিল। “আমার মনে হয় সম্ভবত সে জমজ সন্তান জন্মাবার প্রবণতার ওপর বংশগতির প্রভাব নিয়ে আগ্রহী ছিল।” তিনি বিশ্বাস করেন, অসউইতজের অনেক জমজ শিশুই প্রাণে বেঁচেছিল, যদিও সম্ভবত রোমা জমজ শিশুদের প্রায় কেউই হয়তো বাঁচতে পারেনি।
বেঁচে যাওয়া কিছু শিশু এখন বয়োবৃদ্ধ এবং তারা পরীক্ষাগুলোর ব্যাপারে খুব বেশি কিছু মনে করতে পারেন না আর বাকীদের স্মৃতি হাতড়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা-ও শতভাগ নির্ভুল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও নানা ভুক্তভোগীর জবানবন্দীতে ম্যাঙ্গেলার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভয়াবহ রূপ তুলে ধরা হলো এখানে:
জোনা ল্যাকসের মতে, ম্যাঙ্গেলা মানুষের শরীর থেকে কোনো প্রকার এনেসথেশিয়া ছাড়াই অঙ্গ-প্রতঙ্গ বের করে নিতেন। যদি তার পরীক্ষা চলাকালীন জমজ শিশু জোড়ার একজনের মৃত্যু হতো তাহলে অন্যজনকেও হত্যা করা হতো! ভেরা আলেক্সান্ডারের ভাষ্যানুযায়ী, গুইডো ও নিনা নাম্নী প্রায় বছর চারেকের দুই জমজ শিশুকে ম্যাঙ্গেলা নিয়ে আসেন এবং খুবই নির্মমভাবে তাদের অঙ্গহানি করেন। তাদেরকে একসাথে সেলাই করে জোড়া দেয়া হয়, সিয়ামিজ জমজদের মতো! ম্যাঙ্গেলা তাদের শিরাগুলোও একসাথে জুড়ে দেন, তাদের ক্ষতস্থানে পুঁজ হয়ে পেকে উঠতে থাকে এবং দিনরাত তাদের ক্রন্দনে চারপাশ ভারী হয়ে ওঠে। তাদের মা স্টেলা আর সইতে না পেরে কোনোভাবে কিছু মরফিন যোগাড় করে তাদের চিরতরে এ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেন।
আরেক ভুক্তভোগী ভেরা ক্রিগেল জানান, ম্যাঙ্গেলা মানুষের হৃদপিণ্ডে ইনজেকশন দিয়ে তাদের মেরে ফেলতেন এবং তারপর মৃতদেহের ব্যবচ্ছেদ করতেন। তিনি ম্যাঙ্গেলার গবেষণাগারে নিক্ষেপিত হবার ঘটনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমি পুরোপুরি মানবচোখ দ্বারা সজ্জিত একটি দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নীল, বাদামী, সবুজ চোখের একটি দেয়াল। দেখে মনে হচ্ছিল, প্রজাপতির সংগ্রহশালার মতো সাজানো এ চোখের সারি আমার দিকে তাকিয়ে আছে এবং আমি মাটিতে পড়ে যাই।” তার উপর করা প্রথম পরীক্ষাটি ছিল এমন: তাকে ও তার বোনকে ছোট্ট কাঠের খাঁচায় রেখে তাদের পিঠে ব্যাথাময় ইনজেকশন দেওয়া হতো। তিনি জানেন না এটা কেন দেওয়া হতো, তবে ধারণা করেন সম্ভবত তাদের চোখের রং পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে এমনটি করা হতো। অন্য আরেকটি পরীক্ষাকালে, তারা সহ প্রায় শতাধিক জমজ শিশুদের মুখ ও জননাঙ্গের রোগ ‘নোমা’ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। কিছু শিশুর জ্বর হয় আর কেউ কেউ মারা যায়।
বিভিন্ন সময়ে ম্যাঙ্গেলা নানা উপলক্ষ্যে নিজেই সিন্টি এবং রোমা জমজ শিশুদের মেরে ফেলতেন। এই মৃতদেহগুলো ব্যবচ্ছেদ করে তাদের কোষকলার নমুনা এবং দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাইজার উইলহেম ইন্সটিটিউটে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ এবং বার্লিন-ডাহলেম এ নৃবিজ্ঞান বিষয়ক নিরীক্ষণের জন্য পাঠানো হতো। বলা বাহুল্য, বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র ছাপা হলে এই ‘গবেষণা বস্তু বা নমুনা’র জন্য লিখিতভাবে ম্যাঙ্গেলাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা হতো। ম্যাঙ্গেলা একবার আটজনের পুরো পরিবারকে হত্যা করে তাদের বিভিন্ন রঙের চোখগুলো ডাহলেম ইন্সটিটিউটে পাঠান।
জমজদের পাশাপাশি বেঁটে, দৈত্যাকার মানুষ ও রোমাদের নিয়েও ম্যাঙ্গেলা গবেষণা করতেন। এবার তাহলে অসউইতজের কালো জগতে পা রাখা ৯ বছর বয়সী মটি আলোনের স্মৃতি থেকে শোনা যাক। ৯ বছরের ছোট্ট শিশুকে জোরপূর্বক একজন বেঁটে লোক ও এক রোমা মহিলাকে বাধ্য করে করানো দৈহিক মিলন দেখতে হয়েছিল। মটি ও তার ভাইয়ের হাতে বিশেষ সংখ্যা ট্যাটু করে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছিল। এমনই আরেক হতভাগ্য হলেন মেনাকেম বদনার ও তার তিন বছরের ভাই- উল্কি করা সংখ্যাই হয়ে গিয়েছিল যাদের নিজ পরিচয়।
১৯৪৫ সালে যখন তিনি ক্যাম্প ছেড়ে যান তার বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছিল না তিনি কে! নিজের নামটিও ভুলে বসেছিলেন তিনি। ইসরায়েলি পরিবার বিশেষজ্ঞ আয়ানা কিমরন এবং সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া একটি ফেসবুক পেজের কল্যাণে তিনি জানতে পেরেছেন, তার আসল নাম ইলিয়াস গটেসম্যান এবং তিনি ও তার ভাই জেনো তদানীন্তন হাঙ্গেরির অংশ (বর্তমানে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত) মুনকাকসের পূর্বের এক ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কিমরন খোঁজ করে জানতে পারেন যে, ইলিয়াসের বাবা ক্যাম্পেই মারা যান এবং তার মা রোজা ফ্লসেনবার্গের বন্দীশিবির থেকে ডেথমার্চের মাধ্যমে হাঙ্গেরি পৌঁছান। পরবর্তীতে ১৯৪৬ সালে সেমিটিক বিরোধী দাঙ্গার সময় তাকে নিজ বাসভবনে হত্যা করা হয়। ৭৪ বছর বয়সী ইলিয়াস আজও নিজের হারানো ভাইকে খুঁজে বেড়ান, যাকে শেষবারের মতো তিনি দেখেছিলেন ১৯৪৫ সালে মুক্ত করে দেয়া সেই বন্দীশিবিরে।
এছাড়াও ম্যাঙ্গেলার আরো নানান ভয়ানক পরীক্ষার কিছু নমুনা এরকম:
উচ্চতাভিত্তিক পরীক্ষা
অতিরিক্ত উচ্চতায় মানুষের সহিষ্ণুতা এবং অস্তিত্বের সীমারেখা নিয়ে গবেষণা করার সময় মানুষকে নিম্নচাপযুক্ত প্রকোষ্ঠে রাখা হতো এবং উচ্চতানুসারে বায়ুচাপের পরিবর্তন অনুসরণ করে সেখানে চাপের পরিবর্তন করা হতো। অনেকেই এ সকল পরীক্ষায় মারা যেত, কাউকে কাউকে ভীষণ আঘাত, যন্ত্রণা, নির্যাতন ও নিপীড়ন সহ্য করত হতো।
আগ্নেয় বিস্ফোরক পরীক্ষা
ফসফরাসে পুড়ে যাওয়া ত্বকের ওপর নানান ঔষধি দ্রব্যের প্রভাব যাচাই করার জন্য বিস্ফোরক বোমা থেকে ফসফরাস নিয়ে তা দিয়ে পুড়ে যাওয়া অংশে দেয়া হতো। এতে মারাত্মক বেদনা, কষ্ট, ভোগান্তি ও সাংঘাতিক শারীরিক ক্ষত হয়ে যেত।
ঠান্ডায় জমিয়ে ফেলা
ঠান্ডায় মারাত্মকভাবে জমে যাওয়া বা শীতল হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে চিকিৎসা দেবার সবচেয়ে কার্যকরী উপায় খোঁজার জন্য এই পরীক্ষা করা হতো। এতে ভুক্তভোগীদের ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বরফ পানিতে জোরপূর্বক চুবিয়ে রাখা হতো। অত্যন্ত কম সময়ে প্রচন্ড কাঁপুনি-জ্বর চলে আসতো এবং অনেক মানুষ এই পরীক্ষার সময় মারাও যেত। যারা এর ভেতর দিয়ে যাবার পরও বেঁচে যেত, তাদের শরীর পুনরায় গরম করার জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করা হতো। অন্য আরেকটি পরীক্ষায় ক্যাম্পের বাইরের আবহাওয়ায় শূন্য ডিগ্রির নিম্নবর্তী তাপমাত্রায় সারারাত বন্দীদের উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। শরীর জমে যেতে শুরু করলে তাদের চিৎকারে আন্দোলিত হয়ে উঠতো ক্যাম্পের চারিদিক।
সামুদ্রিক জলের পরীক্ষা
সমুদ্রের পানিকে পানযোগ্য করে তোলার নানা পন্থা খতিয়ে দেখতে এই বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। হতভাগ্য মানুষদের কোনো খাবার দেয়া হতো না, শুধু দেয়া হতো রাসায়নিকভাবে প্রক্রিয়াজাত সামুদ্রিক পানি। এসব পরীক্ষা প্রচুর ব্যথা, ভোগান্তি এবং মারাত্মক শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন করতো বন্দীদের।
ম্যালেরিয়ার পরীক্ষা
ম্যালেরিয়া রোগ প্রতিরোধ এবং তার চিকিৎসাকল্পে মানুষকে সরাসরি ম্যালেরিয়া জীবাণুবাহী মশা কিংবা মশার মিউকাস গ্রন্থি থেকে বের করে নেয়া নির্যাস ইনজেকশনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে জীবাণু প্রবেশ করানো হতো। একবার ম্যালেরিয়া হয়ে গেলে ভুক্তভোগীদের নানান ঔষধ দিয়ে সেগুলোর আপেক্ষিক কার্যকারিতা যাচাই করা হতো। প্রায় সহস্রাধিক মানুষকে এসব পরীক্ষায় ব্যবহার করা হয়। অনেক মৃত্যু ঘটে এবং অনেকের মারাত্মক যন্ত্রণা ও স্থায়ী পঙ্গুত্ব দেখা দেয়।
মাস্টার্ড গ্যাস পরীক্ষা
মাস্টার্ড গ্যাস দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতের সবচেয়ে কার্যকরী চিকিৎসার খোঁজে এই পরীক্ষা চালানো হতো। মানুষজনকে জখম করে তাদের ক্ষতস্থানে মাস্টার্ড গ্যাস দেয়া হতো। কিছু ভুক্তভোগী এর ফলে মারা যেত এবং বাকীদের প্রচুর ব্যথা ও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো।
সালফোনামাইড পরীক্ষা
সালফোনামাইডের কার্যকারিতা নিরূপণের জন্য মানুষকে আঘাত করে তাদের ক্ষতস্থানগুলোতে স্ট্রেপ্টোকক্কাস, গ্যাস গ্যাংগ্রিন ও ধনুষ্টঙ্কারের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সংক্রমণ করানো হতো। ক্ষতস্থানের দুই পাশেই রক্তবাহী নালিকাগুলোকে বেঁধে ফেলে রক্ত চলাচল প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করা হতো যাতে তা যুদ্ধে পাওয়া আঘাতের ক্ষতের মতো হয়। কাঠের ছোট টুকরো ও কাঁচের গুঁড়া ক্ষতস্থানে দেওয়া হতো সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। সংক্রমণস্থলগুলোতে সালফোনামাইড ও অন্যান্য ঔষধ দিয়ে তাদের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা হতো। অনেকেই এতে মারা যায় এবং মারাত্মক যন্ত্রণা ও ভোগান্তির সম্মুখীন হয়।
তিলকিত জ্বর পরীক্ষা
তিলকিত জ্বরসহ অন্যান্য প্রতিষেধকের কার্যকারিতা নির্ণয়ের জন্য অসংখ্য মানুষকে এই রোগের ভাইরাস দিয়ে সংক্রমিত করে ফেলা হয়েছিল- যাতে ভাইরাসটিকে মানবদেহের মাধ্যমে জীবিতাবস্থায় পাওয়া যায়। এই পরীক্ষাটি যাদের ওপর করা হয় তাদের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি মারা যান।
বিষক্রিয়ার পরীক্ষা
মানবদেহের ওপর বিভিন্ন বিষের প্রভাব নির্ণয়ের জন্য খাবারের মাধ্যমে মানুষকে গোপনে বিষ দেয়া হতো। মানুষগুলো হয় বিষক্রিয়ায় মারা যেত নতুবা তাদের ময়নাতদন্ত করার জন্য তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হতো। ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে জীবনের নির্মম পরিহাসের শিকার মানুষগুলোকে বিষাক্ত বুলেট দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল। অত্যাচারজনিত মৃত্যুরও সেখানে কমতি ছিল না।
১৯৪৫ সালের শুরুর দিকে ম্যাঙ্গেলা পূর্বদিক থেকে অগ্রসরমান সোভিয়েত সেনার ভয়ে অসউইতজ থেকে পালিয়ে যান। ভেরা ক্রিগেলের ভাষ্যমতে, “১৯৪৫ সালের ২৬ জানুয়ারি ক্যাম্পের রক্ষীরা বেশ ভয়ার্ত ছিল। তারা ব্যারাকগুলোতে পেট্রোল ছিটিয়ে দিচ্ছিল এবং সকল প্রমাণ ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।” ভেরা তার মা ও বোনসহ একটি পারিবারিক ছবি নিয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে সেদিন ধরা পড়ে যান এবং তাদের মারধর করে ব্যারাকে ফেলে রাখা হয়। পরদিন সকালে তথা ২৭শে জানুয়ারি সোভিয়েত সেনারা সেখানে পৌঁছায় এবং সেদিনই অসউইতজ বন্দীশিবির মুক্ত হয়। বেঁচে যাওয়া ৭,৬০০ বন্দীর নধ্যে কয়েকশত শিশু ছিল যাদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত হয়েছিল এই কারণেই যে, তারা প্রত্যেকেই ম্যাঙ্গেলা কিংবা অন্য ডাক্তারদের বিকৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে গিনিপিগের মতো ব্যবহৃত হয়েছিল। ।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, ম্যাঙ্গেলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেফাজতে বন্দী ছিলেন। কিন্তু এ সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাকে চিনতে ব্যর্থ হন, তারা এটাও জানতে পারেননি যে, ম্যাঙ্গেলা এসএস এর সদস্য এবং একজন চিহ্নিত অপরাধী। ভুলবশত তাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং তারপর সে বাভারিয়ার এক খামারে কাজ করে নিম্নস্তরের জীবনযাপন করতে থাকে এই ঘৃণ্য ব্যক্তি। এরপর ১৯৪৯ সালে তিনি পালিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা চলে যান এবং বাকী জীবন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যান। তাকে ধরার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ইসরায়েলি এজেন্ট এবং নাৎসি সন্ধানী দলগুলোর সকল প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রাজিলে সাঁতার কাটার সময়ে স্ট্রোকের কারণে তার মৃত্যু হয়। তাকে ছদ্মনামে সমাহিত করা হয়। ১৯৮৫ সালে ‘উলফগ্যাং গারহার্ড’ নামক এক ব্যক্তির কবর খুঁড়ে যে দেহাবশেষ পাওয়া যায় তার ডিএনএ রিপোর্ট (১৯৯২) প্রমাণ করে যে, এই দেহাবশেষ কুখ্যাত ড. ম্যাঙ্গেলার।
মানবতাবিরোধী কাজ ও অমানুষিক নির্যাতনের জন্য ড. ইয়োসেফ ম্যাঙ্গেলা এক কুখ্যাত নাম। নাৎসিদের নির্মম কাজের ভয়াবহতার রূপকারদের একজন এই ম্যাঙ্গেলা মানবজাতির ইতিহাসে কালিমাযুক্ত এক অংশ।
ফিচার ছবিসূত্র- all-that-is-interesting.com